পাকিস্তান যুগে বর্ষবরণ

১৩৭৩ বঙ্গাব্দের (১৯৬৭ সাল) পয়লা বৈশাখে অনুষ্ঠিত প্রথম প্রভাতফেরি। ছবিটি সে সময় ছাপা হয় পাকিস্তান অবজারভার–এছবি: সংগ্রামের নোটবুক থেকে

বঙ্গীয় নববর্ষের স্বাতন্ত্র্য কোথায়? ছদ্মনামা লেখক এ বি এম ইংরেজি ১৯৬৭ সালে ‘পাকিস্তান অবজারভার’-এর পয়লা বৈশাখ ক্রোড়পত্রে লিখেছেন, ‘ঈদের উদ্‌যাপন হয় পুরো মুসলিম জাহানে,’ খ্রিষ্টান নিউ ইয়ার-এর প্রথা তো এ দেশে ব্রিটিশদের আমদানি; ‘বছরে শুধু একটা দিনই আমাদের গ্রামগুলো বিশেষ বঙ্গীয় রং আর উৎসবের চিহ্নে সেজে ওঠে।’ বাংলা নববর্ষ যেহেতু বিশেষভাবে দেশজ, অন্য কোনো উৎসবের সঙ্গে এর তুলনা হতে পারে না।

পাকিস্তান যুগের সংবাদপত্রে বঙ্গীয় নতুন সন উদ্‌যাপনের যে ভাষ্য ধরা পড়েছে, সেগুলোর ওপর ভর করে এই লেখায় আমার কাজ তিনটি। প্রথমত, এটা ব্যাখ্যা করা যে ঠিক কোন অর্থে বাংলা বর্ষপঞ্জির মহল বা তালুক হচ্ছে বাংলাদেশ। দ্বিতীয়ত, কীভাবে বর্ষপঞ্জির প্রথম দিন উদ্‌যাপনের প্রথা আধুনিক অর্থে ‘ঐতিহ্য’ হয়ে উঠল। এবং সর্বশেষে নববর্ষের সঙ্গে ইসলামের সম্পর্কের প্রশ্নটিকে কীভাবে ফায়সালা করা হয়েছিল। বাংলা সন একান্তভাবে দেশজ—এ বি এমের এই দাবি সামান্য সঠিক হলেও সুনির্দিষ্টভাবে কথাটির মানে পাকিস্তান যুগে ছিল এই যে, বাংলা সন নির্দিষ্টভাবে বাংলার ভূগোলের মধ্যে প্রবিষ্ট। বাংলা সনের যে হিজরি এবং মোগল নছব, সেটার জিকির সূত্রে পঞ্চাশের দশক থেকেই এই ভূগোল বা স্থানিকতার কথাটা উঠতে থাকে। মোগল যুগে দরবারি বর্ষপঞ্জি হিজরি হলেও ‘পাকিস্তান অবজারভার’ তাদের ১৯৫৫ সালের নববর্ষ প্রতিবেদন-এ জানাচ্ছে: কৃষিভিত্তিক পূর্ববঙ্গে—যেখানে প্রকৃতির অলঙ্ঘ্য নিয়মে ষড়ঋতু ৩৬৫ দিন ঘিরে আবর্তিত—চান্দ্রমাসের হিজরি সন বিশৃঙ্খলা ঘটাতে বাধ্য। অর্থাৎ, একদিকে বাংলার প্রকৃতির আবর্তন এবং সেই প্রকৃতির সঙ্গে জড়িয়ে থাকা শ্রমের নানা রকম ধরন, আর অন্যদিকে হিজরি সনের, মধ্যে একটি অসামঞ্জস্য আছে। মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরীর সিধা জবানে: চান্দ্রমাসের হিজরি সন মেনে তারিখ ঠিক করলে ‘তাহা প্রত্যেক বৎসর ফসল তোলার সময়ের সাথে মেলে না।’ (১৯৬৯)

১৩৭৩ বঙ্গাব্দের (১৯৬৭ সাল) পয়লা বৈশাখে রমনা বটমূলে ছায়ানটের বর্ষবরণ

১৫৮৪ সালের ১০ মার্চ, আমির ফতেহউল্লাহ সিরাজি আর টোডর মলের যৌথ প্রেরণায়, আকবর যখন তারিখ-ই-ইলাহির প্রবর্তন করেছিলেন—বাংলা সন যার নামভেদমাত্র—সেখানেও এই অসামঞ্জস্যের যুক্তিটাই ছিল প্রধান। আকবরের মশহুর প্রধানমন্ত্রী (ওয়াজির-এ আজম) আবুল ফজল নতুন সন প্রবর্তনের যুক্তি ব্যাখ্যা করে লিখেছেন: নতুন বর্ষপঞ্জি প্রবর্তনের উদ্দেশ্য হচ্ছে ‘যেন বিষয়-বন্দোবস্তের ঋতু এবং ঘটনার সময়কাল অনায়াসে নির্ণয় করা যায়।’ আবুল ফজল এখানে ভাবছেন দুনিয়াবি ব্যক্তিদের কথা, যাঁরা সংসারী প্রয়োজনে নানা রকম চুক্তি করবেন। হয়তো কেউ জমির বন্দোবস্ত বা কর্জ নেবেন—কিন্তু চুক্তি শুরুর দিন ঠিকমতো না জানলে কবে চুক্তির মেয়াদ শেষ, সেটা কীভাবে জানা যাবে? ভারতবর্ষে প্রচলিত যেসব বর্ষপঞ্জি (আওরাক-ই-কুলপত্র)—প্রধানত ‘তারিখ-ই–হিন্দ’ আর ‘হিজরি সন’—ফজল জানাচ্ছেন, সেগুলো দুনিয়াবি ব্যক্তির জন্য ভোগান্তির। একটি নতুন সন প্রয়োজন, যা দেশজ ঋতুর আবর্তনের সঙ্গে তাল মেলাতে পারবে। আকবরের হুকুমে আমির শিরাজি, গুরগানি ক্যাননকে ভিত্তি করে যে নতুন সনের বন্দোবস্ত করলেন, ফজলের ভাষ্যে, সেই তারিখ-ই-ইলাহির সন আর মাসগুলো ‘শামসি হাকিকি’, জ্যারেট যাকে তরজমা করেছেন ‘প্রাকৃতিক, সৌর’।

ফলে বাংলা সনের প্রধান তাৎপর্য: এটি বাংলার প্রকৃতির যে নিজস্ব, অন্তর্নিহিত ছন্দ তাকে প্রকাশ করতে পারে। এখানে গোয়েতের ‘জার্নি টু ইতালি’র নিবিড় পাঠের মাধ্যমে মিখাইল বাখতিন যেভাবে ‘প্রাকৃতিক কাল’ আর ‘মানুষের কাল’—দুটির সম্পর্ক ধরতে চেষ্টা করেছেন, সেটা প্রাসঙ্গিক। কাল নিজেকে প্রকাশ করে, বাখতিন লিখছেন, সবার ওপর, প্রকৃতির মধ্যে। সূর্য আর নক্ষত্রমণ্ডলীর আবর্তন, সাতসকালে মোরগের ডাক, প্রতিটি ঋতুর যেসব সংবেদনজ-চাক্ষুষ ইঙ্গিত—এসবের মধ্যে ধরা পড়ে সময়। প্রধানত প্রাক্‌-আধুনিক সমাজে এই প্রাকৃতিক কালের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িয়ে থাকে ইনসানি ওয়াক্ত, যার সবচেয়ে নিবিড় প্রকাশ ঘটে মানুষের শ্রম, অবসরের ছন্দে। শীতের গ্রামবাংলায় যেভাবে ঝুপ করে এবং খানিকটা অকালীনভাবে, সন্ধ্যা নেমে আসে, তার আগেই শেষ হয় মাঠে চাষির কাজ। কারখানার শ্রমিক যেভাবে কাজ করে ক্লক-টাইম মেনে, তার বিপরীতে লৌকিক চাষীয় শ্রম মেনে চলে প্রকৃতিঘনিষ্ঠ ছন্দ।

পূর্ববঙ্গের আপামর মানুষের শ্রমঘনিষ্ঠ জীবনের ছন্দ আর ঋতুবৈচিত্র্যের প্রাকৃতিক ছন্দের যে সমধর্মিতা, সেটাই উৎকীর্ণ থাকে বাংলা বর্ষপঞ্জির পাতায়। সংবাদ ১৯৬১ সালের নববর্ষীয় সম্পাদকীয়র ভাষায়: বঙ্গসনের ‘মাস-দিন-প্রহর গনিয়া’ পূর্ববঙ্গের কৃষক ‘বীজ বোনে, ফসল ফলায়, ফসল কাটে,’ জেলেরা ‘নদীতে-সমুদ্রে নৌকা ভাসায়’, আর এই জনপদের মাটির মানুষ ‘সংসার ধর্ম শুরু করে, সামাজিকতা করে’, নিজেদের ‘আয়ুষ্কালের নিরিখ’ ঠিক করে। আনওয়ার হোসেন-এর ১৯৬৭ সালে প্রকাশিত লেখাতে এরই প্রতিধ্বনি এবং খানিকটা আবুল ফজলের যুক্তিরও বিস্তার: এই বাংলায় ‘কৃষিজমি, জলাধার, ফেরি, হাট, বাজারের বন্দোবস্তের’ শুরু বৈশাখের প্রথম দিন থেকে। তবে প্রকৃতি আর শ্রমের যুগলবন্দীর সবচেয়ে নিবিড় চিত্র পাওয়া যাবে এ বি এমের লেখায়। বৈশাখের পয়লা দিনটির পেছনে আছে একটি দীর্ঘ অবকাশের পটভূমি, যা নববর্ষের উৎসবের জন্য গ্রামীণ মানুষদের প্রস্তুত করে তোলে। বৃষ্টির দেখা পাওয়ার পর কৃষক যেদিন বোশেখ মাসে প্রথম জমিতে লাঙল বসাবে, তার আগে তার হাতে থাকে লম্বা, অখণ্ড অবসর। চাষি-বউ সারা বছরের হাড়ভাঙা খাটুনি শেষে বৈশাখের আগে আগে একটু অবকাশ পাবে বাপের বাড়ি নাইওর যাওয়ার। সংক্রান্তি বা পয়লা বৈশাখের মচ্ছবের বেশ আগে থেকেই ছেলেমেয়েরা দল বেঁধে সলা করবে, কোন অজুহাতে বাবা-মার থেকে কিছু পয়সা পাওয়া যাবে, যার খরচ হবে ওই দিন। কেউ বছরভর ছাগশিশু পেলেপুষে বড় করছে, যে হাটে বিক্রি করে নতুন জুতা কিনবে। আরেক দল ফসল ওঠার পর খালি মাঠে উদ্বৃত্ত ফসল খুঁটে বেড়াচ্ছে, যা বিক্রি করে কেনা হবে মাটির সরা। কৃষাণী নিজের পোষা মুরগি বদলি করে কিনবে একজোড়া বালা। চাষি এত দিন ধরে জমিয়ে রাখা নারকেল বেচবে মেলার দিন, আর সেই পয়সায় কিনবে টুপি–লুঙ্গি। কিছু বিশেষ দরকারি, শৌখিন পণ্য শুধু সংক্রান্তি বা নববর্ষের মেলার মাঠেই পাওয়া যায়: লাঙলের বিশেষ হাতল, স্যাকরার বানানো সবচেয়ে সুকুমার নথ। পালকির কারিগর, মিষ্টির দোকানের ময়রা, তাঁতি তাঁদের সেরা জিনিস নিয়ে আসবেন। মৃৎশিল্পীর কাজ, মাটির খেলনা—এগুলোও মেলার সাধারণ অনুষঙ্গ। রাখাল ছেলে বটগাছের ছায়ায় বসে বাজাবে বাঁশি, মেলা থেকে যেই বাঁশি এনে দিয়েছে তার বাবা। বাড়ির মেয়েরা নানা পদের খাবার আর মিষ্টি বানাবে ঘরে, যা বিলানো হবে পাড়া-পড়শির বাড়িতে।

পয়লা বৈশাখের দুটো জীবন কল্পনা করতে পারি আমরা—একটি হলো সজীব প্রবহমান জীবন, যার একটি চিত্র আমরা ওপরে ঋতুর আবর্তন এবং শ্রমের ধরনের আলাপে ইতিমধ্যেই পেয়েছি; অন্যটি নববর্ষের ‘রচিত জীবন’।

এই বিবরণের মধ্যে পাচ্ছি বেঁচে থাকার একটা খুব সুনির্দিষ্ট চেহারা, একটা জীবনাধারা। শ্রম, শখ, সামাজিকতা আর প্রয়োজনের, আকাঙ্ক্ষার, সম্পর্কের যে সাংস্কৃতিক জগৎ এখানে দেখা যাচ্ছে, কেবল তার মধ্যেই পয়লা বৈশাখ তার স্বাভাবিক দ্যোতনা নিয়ে হাজির হতে পারে। বাংলা বর্ষপঞ্জি যেহেতু এই গ্রামীণ জীবনের অন্তর্নিহিত সুর ধরতে পারে, ফলে বাংলাদেশের জন্য বিশেষভাবে চাই বাংলা নববর্ষ।

২.

ঐতিহ্য বা সিলসিলা কী বস্তু? স্বেতলানা বয়েম খানিকটা লাটুর থেকে ধার করে বলেছেন, একটা একান্তভাবে আধুনিক ব্যাপার, যার গোড়ায় থাকে অপস্রিয়মাণ অতীত সম্পর্কে উদ্বেগ। এই অর্থে ঐতিহ্যমাত্রই ভূতাপেক্ষ, এর মুখ পেছন দিকে ঘোরানো। প্রথা বা যুগবাহিত দেশাচার থেকে আলাদা করে এরিক হবসবম এর নাম দিয়েছেন ‘ইনভেন্টেড ট্র্যাডিশন’ বা ‘রচিত ঐতিহ্য’। জীবনের যে সজীব, বহমান ধারা, যার মধ্যে প্রথা বা কাস্টম বেঁচে থাকে, সেটা আসলে ঐতিহ্যের প্রাক্‌-জীবন। অর্থাৎ যখন কোনো প্রথার স্বাভাবিক জীবনীশক্তি অপস্রিয়মাণ, অথচ যাকে মনে হতে থাকে অমূল্য, কেবল তখনই উঠে দাঁড়ায় ঐতিহ্য এবং প্রথা বা দেশাচারের পিছু নিতে থাকে। যুগবাহিত প্রথা আর রচিত ঐতিহ্যের মধ্যে এই সম্পর্ক, হবসবম খেয়াল করেছেন, নির্জলাভাবে পাতানো নয়; পুরোনো প্রথার মধ্যে আধুনিক, গ্রন্থিত ঐতিহ্য কখনো কখনো ‘প্রবিষ্ট’ (ইনসার্টেড), আবার কখনো পুরোনো দেশাচার-এর ওপর রচিত ঐতিহ্য ‘কলম করে’ বসানো (গ্র্যাফটেড)।

এদিক থেকে দেখলে পয়লা বৈশাখের দুটো জীবন কল্পনা করতে পারি আমরা: একটি হলো সজীব, প্রবহমান জীবন, যার একটি চিত্র আমরা ওপরে ঋতুর আবর্তন এবং শ্রমের ধরনের আলাপে ইতিমধ্যেই পেয়েছি; অন্যটি নববর্ষের ‘রচিত জীবন’—তবে শিলাভূত বা অসিফায়েড নয়—সেটি সজীব, প্রবহমান কিন্তু আপাতমুমূর্ষু দেশাচারকে নতুনভাবে সৃজন এবং যাপন করতে চায়। দেশাচার-এর যে সজীব জীবন, সেটা যখন স্মৃতির বিষয় হয়ে পড়ে, যেমনটা ওপরে দেখেছি আমরা, সেটা আসলে একই সঙ্গে একটা উদ্বেগেরও আভাস। ফলে দৈনিকের পাতায় পঞ্চাশের দশকে যখন নববর্ষের ফেলে আসা স্মৃতির রোমন্থন হচ্ছে, সেটা স্বয়ং নববর্ষের রচিত জীবনেরও প্রথম স্পন্দন।

পয়লা বৈশাখের রচিত জীবনের প্রথম প্রকাশ যদি হয় স্মৃতিচারণা—যেটার উদ্বেগধর্মী উৎসের কারণেই কখনোই ল্যামেন্ট, রেকুইয়েম বা নস্টালজিয়া থেকে কখনোই দূরের ব্যাপার নয়—একে যাপন করার আরও প্রাতিষ্ঠানিক, যৌথ এবং কংক্রিট প্রকাশ পাকিস্তান যুগে ঘটে মূলত দুটি প্রধান ধাপে—স্থানীয় আর জাতীয়। পাকিস্তান যুগের প্রথম পর্বে নববর্ষের যাপন ‘স্থানীয় চেহারা’য় হাজির হয়। পঞ্চাশের দশকে বৈশাখ ঘিরে যে নতুন যাপন—বা রচিত ঐতিহ্য—তার প্রথম প্রকাশ ছিল ‘ফাংশন’। এই ফাংশন পঞ্চাশ-ষাটের দশকে বাঙালি জীবনে এক নতুন, নারী-পুরুষের যৌথ সামাজিকতার পরিসর। এখানে অনুশীলনলব্ধ কৃষ্টি আত্মপ্রকাশের একটি পথ খুঁজে পেয়েছিল। মনে রাখতে হবে, পয়লা বৈশাখকে ঐতিহ্য আকারে কীভাবে যাপন করা হবে—অর্থাৎ ঐতিহ্য আকারে ‘গ্রন্থিত’ করা হবে—সেটা নির্ভর করে সমাজে উৎসব, যাপন ইত্যাদির কোন কোন আদর্শ, কল্পনা হাজির আছে এবং কোন ধরনের কল্পনা সমাজে যে বিশিষ্ট ঐতিহাসিক প্রয়োজনগুলো রয়েছে, তার নিবারণ করতে পারে। পঞ্চাশ-ষাটের দশকে, বিশেষ সামাজিক পর্বে, পাড়ায়-মহল্লায় ‘ফাংশন’ বা ‘কালচারাল ফাংশন’ নামে গান, আবৃত্তি, নাচ, নাটক-এর যে চর্চা হতো, তার প্রমাণ রয়েছে এই পর্বের কলকাতার বাংলা ছবিতে (উদাহরণ, বসন্তবিলাপ, যেখানে নারী আর পুরুষ মেসবাসীরা বাণী-বন্দনায় আলাদা দুটো ফাংশন করে)। পূর্ব পাকিস্তানে নববর্ষ যাপনের প্রথম পর্যায়ের নাগরিক উদ্যোগগুলো ছিল এ ধরনের স্থানিক ফাংশন, যার বাংলা নাম ‘বিচিত্রা’। নববর্ষের শুরুর দিককার একটি আয়োজনের খবর পাচ্ছি ১৯৫১ সালে, লেখক-শিল্পী মজলিশের উদ্যোগে। ‘সংবাদে’ ছাপা রিপোর্টে একে বলা হয়েছে, বিচিত্রানুষ্ঠান—শামছুন্নাহার মাহমুদের বক্তৃতার পর সুফিয়া কামালের নিজের কবিতা পাঠ, অজিত গুহের আবৃত্তি, সবশেষে গীতিবিচিত্রা। ১৯৫৩ সালে ফজলুল হক হলের ছাত্রদের উদ্যোগে বেতারশিল্পীদের নিয়ে গীতিবিচিত্রার পাশাপাশি খবর পাচ্ছি ইস্ট এন্ড প্রসেস ওয়ার্কস ব্লক নির্মাতা অফিসে চা-পান আর গানবাজনার। ১৯৫৪ সালের মার্চে হওয়া নির্বাচনে জিতে যুক্তফ্রন্ট একে ফজলুল হকের নেতৃত্বে সরকার গঠন করে। হক সাহেবের বাণী ছাপা হয় নববর্ষের ভোরে: ‘নব ঊষার নূতন আলো আর নির্ম্মল বাতাস প্রাণ ভরিয়া গ্রহণ করুক আমার পূর্ব্ব পাকিস্তানী ভ্রাতৃবৃন্দ—শ্যামল পূর্ব্ব বাংলার প্রতিটি গৃহ হউক শান্তির নীড়।’ শামসুজ্জামান খান জানাচ্ছেন, নববর্ষে ছুটিও ঘোষণা হয়েছিল সেবার, যদিও যুক্তফ্রন্ট সরকারের পতন হওয়ার পর ছুটিও আর বহাল থাকেনি। বিচিত্রার পাশাপাশি সেবার হয় পাকিস্তান সাহিত্য সংসদের আয়োজনে লায়লা সামাদের পরিচালনায় ‘শকুন্তলা’ নৃত্যনাট্য।

এই স্থানীয় পাড়া-মহল্লাভিত্তিক উদ্‌যাপনের বিপরীতে ষাটের দশকে এসে আমরা দেখতে পাব নববর্ষে ‘রচিত ঐতিহ্য’ একটি জাতীয় ঘটনা হয়ে উঠছে। পঞ্চাশের দশকে এই জাতীয় চেহারাটি কালেভদ্রে, হঠাৎ আলোর ঝলকানিতে, হয়তো দেখা দিয়েছে—যেমনটি ঘটেছে যুক্তফ্রন্টের ঐতিহাসিক বিজয়ের পর—কিন্তু সেগুলো বৃহত্তর পরিসর থেকে দেখতে গেলে বিচ্ছিন্ন ঘটনাই। এই দশকে সংবাদপত্রে পয়লা বৈশাখ মানে ছিল এক কলামের ছোট উদ্‌যাপনের খবর বা একেবারেই নিখাদ নীরবতা; যদিও সচিত্র, ঢাউস বাণিজ্যিক বিজ্ঞাপনে ক্রেতাসাধারণকে জানানো হতো শুভেচ্ছা। ১৯৬১ সালে সম্ভবত প্রথমবারের মতো, পয়লা বৈশাখে সংবাদের প্রথম পাতায় গুরুত্ব দিয়ে ছাপা হয় ‘বাংলা নববর্ষের প্রথম দিন। চম্পক সুরভি ভরপুর পয়লা বৈশাখ’; সঙ্গে নববর্ষের বিশেষ ক্রোড়পত্র। এ সময় থেকেই নববর্ষ ঘিরে একটি জাতীয় কল্পনা পল্লবিত হতে থাকে, যা আগের পাড়া-মহল্লাভিত্তিক, ‘বিচিত্রাধর্মী’ উদ্‌যাপনের থেকে একেবারেই আলাদা। হবসবম ‘রচিত ঐতিহ্য’ কথাটি ইস্তেমাল করেছিলেন মূলত জাতীয় পরিচয় নির্মাণের সঙ্গে এর অতিক্রিয়ার দিকটিকে ধরবেন বলেই। রচিত সিলসিলাকে তিনি চিত্রিত করেছিলেন একগুচ্ছ প্রতীকী আচারপ্রথার সমষ্টি হিসেবে, যা পুনরাবৃত্তির মাধ্যমে কতগুলো মূল্যবোধ সঞ্চারিত করতে চায়, যার ফলে গড়ে উঠবে একটি যৌথ চেতনা এবং একটি যৌথ ধাত। নববর্ষের পাতানো ঐতিহ্যের এই জাতীয় চেহারাটির দিকে মনোযোগ দেওয়ার আগে একটু দম নেব এই সান্ধ্যমুহূর্তটিকে বোঝার জন্য, যখন একদিকে কালবাহিত প্রথা হারিয়ে যাচ্ছে, অন্যদিকে গজিয়ে উঠছে ভুঁইফোড় নানা উদ্‌যাপন।

সিকান্‌দার আবুজাফর ১৯৫৫ সালের একটি লেখায় নববর্ষের উৎসবের শ্রীকে তুলনা করেছেন, ‘পিলেরোগীর মুখে ক্লিষ্ট হাসির সঙ্গে’—নিরাভরণ, পীড়াদায়ক। ‘বছরের প্রথম দিন হিসাবে পয়লা বৈশাখের পরিচয়টুকু ছাড়া তাকে আমরা আনুষ্ঠানিকভাবে বর্জন করেছি।’ অথচ তার নাকের ওপর দিয়েই আমরা একটি অন্য নববর্ষের সমাদর করে থাকি, যেটা তাঁর বিচারে, ‘পত্নী অপেক্ষা উপপত্নীকে বেশী মায়া করা।’ ডি এ রশিদ ‘মাটির পুতুল’ (১৯৬১) রচনায় এই অবহেলিত, বিলীয়মান সজীব ধারাটিকে তুলনা করেছেন নতুন গজিয়ে ওঠা শহুরে নববর্ষ যাপনের সঙ্গে। এই ‘রাজধানীর পরিবেশে আবদ্ধ থেকেও’ তিনি কল্পনায় দেখতে পান গাঁয়ের মেলার মাটির পুতুল, বাঁশের বাঁশি সাজানো দোকানগুলো। ‘বেলা শেষে গ্রামের ছেলেমেয়েরা’ যখন হাতে পুতুল নিয়ে বাঁশিতে ফুঁ দিতে দিতে ফিরত, মনে হতো, ‘পৃথিবীজোড়া যেন উৎসবের সমারোহ জেগেছে।’ ‘শহরের এই জৌলুশপূর্ণ নববর্ষ উৎসবের’ বিপরীতে গ্রামের আবাহন হয়তো জৌলুশহীন, আর গ্রামের মেলায় ওঠা অখ্যাত শিল্পীর বানানো মাটির পুতুল, বাঁশের বাঁশিকে হয়তো ‘এই আধুনিক সমাজ কোন মূল্যই দিবে না’, কিন্তু সেই গ্রামীণ উদ্‌যাপনে ছিল ‘শান্ত-স্নিগ্ধ প্রকৃতির মধুরতা’, আর তার অকিঞ্চিৎ শিল্পচর্চা ‘আমাদের রক্তের সাথে মিশে আছে যে সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য… বহন করছে তারই স্বাক্ষর।’ রশিদের জবানিতে যদিও অনাড়ম্বর গ্রামীণ নববর্ষ আর শহরের জৌলুশপূর্ণ উৎসব পরস্পর বিপরীত, কার্যত শহরের উৎসব দাঁড়িয়ে থাকে অপস্রিয়মাণ, অর্গানিক, খাঁটি, আবহমান বৈশাখের রশিদ-চিত্রিত অতীতের ইমেজের পাটাতনেই। শহর আর গ্রামের, খাঁটি আর মেকির এই বৈপরীত্য ধরা পড়ে ওবায়দুল হকের লেখাতেও। আমাদের রয়েছে দুটি বর্ষপঞ্জি: এর একটা মেনে চলে শিক্ষিত, ভদ্রলোক শ্রেণি, তাদের সরকারি অফিস, স্কুল-কলেজ, ব্যবসা-বাণিজ্য আরম্ভ হয় জানুয়ারি মাসে; দ্বিতীয় বর্ষপঞ্জিটি বাংলার আমজনতার, যাদের অর্থনীতি, হালখাতা, খাজনা আবর্তিত হয় বাংলা পঞ্জিকা অনুসারে—জানুয়ারি তাদের কাছে এক কিসিমের জানোয়ার, ডিসেম্বর হয়তো কুকুম্বার।

বদরুল হাসানের স্মৃতিধর্মী একটি লেখায় দুই রকম পয়লা বৈশাখের বৈপরীত্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক ধরা পড়ে। মোংলামিয়ের দোকানে নববর্ষের দিন হালখাতায় যাওয়ার স্মৃতি মনে করে তিনি লিখেছেন, বাবার সঙ্গে সেখানে যাওয়ার পর ধবধবে বিছানায় বসতে দেওয়া হয়েছিল, আর ফেরার সময় ‘পোঁটলা বেঁধে রসগোল্লা পানতুয়া’-ও সঙ্গে দেওয়া হয়েছিল। এই সূত্রেই তিনি খেয়াল করেন, পয়লা বৈশাখের যে নির্মল আনন্দ, যে উৎসবের ভাব, তার মূলসূত্রটি লুকিয়ে আছে একটি সামাজিক অন্তরঙ্গ পরিসরের মধ্যে। এটা হলো সেই সময়ের স্মৃতি যখন ‘একটা সহজ সৌহার্দ্যে খদ্দের আর ক্রেতা এক হয়ে যেত।’ মুড়ি-মুড়কির দোকানি রতনদাই শুধু নয়, ফেলে আসা যে গ্রাম্যজীবনের কথা বদরুল লিখছেন, সেখানে ‘রুটি, বিস্কুট, মিষ্টির, মুদির দোকান’—সবার সঙ্গে ছিল প্রীতির সম্পর্ক। আরও তাৎপর্যপূর্ণ ব্যাপার, ‘পাকিস্তান হবার পরও নববর্ষ উপলক্ষে পাড়ায় পাড়ায় যে অনুষ্ঠান হতো’, তার সঙ্গে তুলনা করলেও এখনকার আধুনিক ‘যান্ত্রিক অনুষ্ঠানে’ উচ্ছ্বাসের ছিটেফোঁটাও নেই। ’৪৯-৫০ সনের দিকেও শিল্পীদের এমন সমাবেশ দেখা যেত না, কিন্তু ‘ওয়ারী-স্বামীবাগের ছায়াচ্ছন্ন পরিবেশে নববর্ষ করতে গিয়ে’ আনন্দের হিল্লোল উঠত মনে। তাঁর মনে পড়ে, এক বছর র‍্যাঙ্কিং স্ট্রিটের দত্ত বাড়ির আঙিনার বটগাছের নিচে যখন নববর্ষের বিচিত্রা শুরু হয়েছে, এমন সময় ঝড়ের ঝাপটা; কিন্তু সেই ঝড়ের মধ্যেও চলতে লাগল অনুষ্ঠান, ঝড়ের ঝাপটার মধ্যেই সুরের ঝাপটা আঘাত করতে লাগল মনে: ‘গগনে গগনে যায় হাঁকি বজ্রবাহিনী বিদ্যুৎবাহী বৈশাখী।’

নদীতীরে পয়লা বৈশাখের উদ্‌যাপন। ১৯৬৭ সালে ছবিটি ছাপা হয়েছিল পাকিস্তান অবজারভার–এ

কিন্তু এই যে স্মৃতির জগৎ, তার সম্পর্কের উষ্ণতা, তার অর্গানিক চরিত্র—এসব নিয়েই যে এই জগৎ অপস্রিয়মাণ সেই বোধও তখন থেকেই চেতনার স্তরে পরিষ্কার। লুপ্তপ্রায় জীবনধারা যেখানে মনের অচেতন স্তরে একটি ভ্যানিশিং পাস্ট সম্পর্কে বেদনা তৈরি করে, তার বাইরে এটা হচ্ছে সচেতন মনের আবিষ্কার। এ বি এম তাই খেয়াল করছেন, নতুন বছরে গ্রামে গ্রামে যে বহুরূপীর দেখা মিলত, যার পিছু নিয়ে শত শত ছেলেমেয়ে গ্রাম থেকে গ্রাম চরাত, তার সঙ্গে গাইত, নাচত—সেই বহুরূপী আজ কোথাও নেই; যেমন নেই চড়ক, যাকে বাদ দিলে বৈশাখী মেলার সঙ্গে আর দশটা মেলার কোনো প্রভেদই থাকে না। কেন হারিয়ে যাচ্ছে সেদিনের হালখাতা, বহুরূপী, চড়ক? কারণ, এসব মচ্ছব-আয়োজন থেকে আরও অনেক বেশি উত্তেজক এখন কাছের টাউন বা গঞ্জে চলা ম্যাটিনি শো; লাল ডুরে শাড়ি সরিয়ে এখন চলছে সস্তা নাইলনের শাড়ি। গ্রামের কুমারীর বিয়ের দিনটাও এখন আর পাঁজি দেখে, গ্রহ-নক্ষত্র বিচার করে ধার্য করা হচ্ছে না, এই দিনটাকে এখন হতে হবে অবশ্যই রোববার বা অন্য কোনো ছুটির দিন, যেটা খ্রিষ্টীয় বর্ষপঞ্জি মেনে আসে। বাংলা বর্ষপঞ্জির সঙ্গে মানুষের যে বৈষয়িক সূত্র, সেটা ছিন্ন হতে চলেছে। অথচ জাতীয় জীবনে বঙ্গাব্দের যে মূল্যায়ন দরকার, ‘এ সত্য বিস্মৃত হলে চলবে না।’ অর্থাৎ যে জীবনযাত্রা, যে উৎপাদন-সম্পর্কের মধ্যে বাংলা সনের সজীব, ঋতুভিত্তিক ছন্দের চলন ছিল স্বাভাবিক এবং জরুরি, সেই জীবনযাত্রার নদীটাই শুকিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু এই বর্ষপঞ্জির জরুরত রয়ে গেছে জাতীয় আত্মসত্তার প্রকল্পের জন্য, জাতির শরীরে নতুন উত্তাপ সঞ্চার করার জন্য। ইবনে রউফ তাই তাঁর লেখায় প্রস্তাব করেন, খ্রিষ্টীয় সালের পাশাপাশি—যে সাল এখন আন্তর্জাতিক এবং অপরিত্যাজ্য—বাংলা সন–তারিখেরও ব্যবহার থাকুক। যেহেতু খ্রিষ্টীয়র মতো বাংলা সনও সৌরবৎসর, প্রয়োজনীয় সংস্কার করে তাকে যদি খ্রিষ্টাব্দের সঙ্গে মিলিয়ে নেওয়া যায়, তাহলে ‘বঙ্গাব্দের মাস ও তারিখ নির্ণয় মোটেই দুরূহ ও কষ্টসাধ্য হবে না।’ ১৯৬৭ সালের এক রিপোর্ট থেকে জানা যাচ্ছে যে ঠিক আগের বছরই বাংলা একাডেমি একটি সংশোধিত বর্ষপঞ্জি প্রস্তুত করেছে—ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর নেতৃত্বে একাডেমির বানানো বিশেষজ্ঞ কমিটির পরামর্শ অনুযায়ী। কিন্তু এই নতুন বর্ষপঞ্জিকে সরকারি স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি। ফলে কিছু বেসরকারি সংস্থা এই সংস্কার হওয়া বর্ষপঞ্জি গ্রহণ করলেও বাকিরা পুরোনো তারিখই মেনে চলছে।

৩.

১৯৬১ সালে পয়লা বৈশাখ যাপনের যে জাতীয়করণ শুরু হয়, তার প্রসার ঘটে পরের বছরগুলোতে। তেষট্টি সালে আবার নববর্ষে ঘোষণা করা হয় সরকারি ছুটি; বাংলা একাডেমি, ঢাকা বেতার কেন্দ্র বিশেষ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে; ছায়ানট উদ্বোধন করে তাদের গানের স্কুল। এ সময় থেকেই সাক্ষ্য পাওয়া যাবে—যেমন শহীদুল্লা কায়সার ১৯৬৪ সালে লেখেন, ‘আমাদের সংস্কৃতিসেবী এবং বুদ্ধিজীবীরা সংস্কৃতির দেশজ উপাদান সম্পর্কে ক্রমশ মনোযোগী হয়ে উঠছেন।’ প্রায় সব কটি সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানই ইদানীং বাংলা নববর্ষে বিশেষ অনুষ্ঠান করছেন, যার মাধ্যমে ‘বিপণির শুভ হাল খাতা থেকে বাংলা নববর্ষ শহুরে জীবনেও একটা উৎসবে রূপান্তরিত হতে চলেছে।’ পাড়া-মহল্লার স্থানীয় যাপন থেকে জাতীয় উৎসব হয়ে ওঠার রূপান্তর কায়সারের লেখার মধ্যে পুরোপুরি স্পষ্ট। বিনোদ দাশগুপ্তের লেখায়ও পাওয়া যাবে একই সায়: ‘১৩৭৪ বাংলা সনকে বরণের মধ্য দিয়ে পূর্ব্ব পাকিস্তানবাসীর এক ক্রমবর্দ্ধমান জাতিসত্তার চেতনার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে।’

১৯৬৭ সালে নববর্ষের আয়োজনে দুটো অনুষঙ্গের যোগ ঘটে: প্রভাতফেরি এবং রমনার বটমূলে বর্ষবরণ। সংবাদ জানাচ্ছে, নববর্ষের ভোরবেলা, পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের উদ্যোগে একটি ‘সুসজ্জিত প্রভাতফেরী কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার হইতে বাহির হইয়া ঢাকা শহরের প্রধান সড়কসমূহ প্রদক্ষিণ করিবে।’ এই অনুষঙ্গের কল্পনা যে সরাসরি ভাষা আন্দোলন থেকে অনুপ্রাণিত, সেটা বলা বাহুল্য। বাংলা নববর্ষের যে ‘রচিত ঐতিহ্য’ পাকিস্তান যুগে জীবন পেতে শুরু করে, সেটার ওপর ভাষা আন্দোলনের নানা অনুষঙ্গের প্রভাব মনে রাখা একান্ত জরুরি। এই বছরই ছায়ানট বর্ষবরণ উপলক্ষে সকালবেলা রমনা পার্কে রেস্তোরাঁ প্রাঙ্গণে সংগীতানুষ্ঠানের আয়োজন করে। নববর্ষ আর জাতীয় চেতনা কীভাবে মিলেমিশে এক হয়ে গেছে, সেটা ধরা পড়ে একই দিনে ‘পাকিস্তান অবজারভার’-এ ছাপা হওয়া এই বাক্যে: ‘আজ আমরা গৃহচূড়া থেকে ঘোষণা করব, আমরা পাকিস্তানি, আমরা বাঙালিও।’

তবে নববর্ষের উদ্‌যাপন কীভাবে জাতীয় প্রকল্পের সঙ্গে মিশে ছিল তার সবচেয়ে নাটকীয় প্রকাশ ১৯৬৩ সালের নববর্ষ উপলক্ষে ‘সংবাদ’-এর সম্পাদকীয়। পরপর দুই দিন ঝড় হয়ে গেল, এই তথ্য দেওয়ার পর সেখানে লেখা হচ্ছে: ‘এই ঝড় কি ১৩৭০ সালে আমাদের জীবনের পূর্বাভাস?’ নতুন বছরের যে সাধারণ থিম: পুনর্জন্ম, সেটা এখানে অ্যাপক্যালিপটিক চেহারা নিয়েছে: ‘১৩৭০ সালে আমাদের জীবনের প্রতি অঙ্গে সংকট আরও ঘনীভূত হইবে।’ তাই এই নতুন বছরের শীর্ষে দাঁড়িয়ে ‘রিম ঝিম বরষা নহে…ভয়ংকরের সাধনাই আমাদের করিতে হইবে।’ এখানেই শেষ নয়, সংবাদ ঘোষণা করে একটি শহীদি দাওয়াত: জাতির জীবনে এমন মুহূর্ত আসে, যখন ‘ব্যক্তিজীবনের পূর্ণ আহুতির পথেই জাতিকে জীবনের অভিসারী’ হতে হয়। আর তাই ‘পূর্ব বাংলার সকল তরুণ-তরুণীকে ১৩৭০ সালে জীবনের সংগ্রামে প্রয়োজন হইলে মৃত্যুবরণে প্রস্তুত হইতে হবে।’

১৩৭০ সংখ্যায় যে আহ্বান, তার যে পরিষ্কার প্রত্যুত্তর এসেছে সেটা জানা যাচ্ছে ‘ইত্তেফাক’-এর ১৩৭৩ বঙ্গাব্দের পয়লা বৈশাখে ইবনে রউফের লেখায়। ‘এ অনন্য প্রতিরোধলগ্নে আজ আমি চোখ মেলেছি। পহেলা বৈশাখ ১৩৭৩ বঙ্গাব্দ, পূর্বাশার দিগন্তপটে সুতীক্ষ্ণ উজ্জ্বল আখরে প্রদীপ্ত এক নূতনের স্বাক্ষর।’ কী পেয়েছি বৈশাখের ‘এই প্রদীপ্ত উষায়?’—মনের এই প্রশ্নের উত্তর রউফ পেলেন: ‘তুমি জেগেছ।’ চোখ মেলে দেখলেন, ‘আশ্চর্য্য, আমি একা নাই—আমার চতুষ্পার্শে জেগেছে আরও অগণিত মানুষ।’

৪.

তারিখ-ই-এলাহির শুরু আকবরের অভিষেক থেকে ধরা হলেও আবুল ফজল ‘আকবরনামা’য় নোকতা দেন, এর মধ্যে হিজরি সনের প্রতি কোনো অসম্মান নেই। বর্ষপঞ্জি একটি দুনিয়াবি ব্যাপার। এই দুনিয়াবি স্বচ্ছন্দের যুক্তিতেই মালিক শাহের আমলে জালালি সনের প্রবর্তন করা হয়েছিল। কিন্তু যেহেতু বেশুমার লোক—মূল ফারসিতে ‘আনবুহি’, এইচ এস জ্যারেট-এর ভাষ্যে ‘মাল্টিটিউড’—যারা মূলত জাহেল এবং বিষয়বুদ্ধিহীন, তাদের বিশ্বাস, বর্ষপঞ্জির সিদ্ধতা (রাওয়া-ই তারিখ) আবশ্যিকভাবেই একটি দ্বীন-ই বিষয় (রা নাগুজির দিন পেনদারান্দ), তাদের সম্মানে নতুন সনের হিজরি নছব আকবর গোপন করলেন না।

আকবরের চিন্তাশীলতার দিকটি তাৎপর্যপূর্ণ। যদিও তিনি মনে করেন, বর্ষপঞ্জির বিচার একটি দুনিয়াবি বিষয়—দ্বীনের বিষয় নয়—তবু হিজরি সনের সঙ্গে নতুন সনের সম্পর্ক ছিন্ন করা হলো না। খানিকটা কালানৌচিত্য দোষ ঘটিয়ে ফজলের ‘আনবুহি’ কথাটা আধুনিক অর্থে আওয়াম বা জনসাধারণ হিসেবে পাঠ করা যায়। নববর্ষের নতুন যাপনের আদল যখন তৈরি হচ্ছে, সেই সময় শহীদুল্লা কায়সার একটি লেখায় জানাচ্ছেন, যদিও নববর্ষের শহুরে উৎসবে ‘মঙ্গলঘটের সাক্ষাৎ কদাচ পাওয়া যায়… তবু কট্টর মৌলভীরা এ সব উৎসবকে বরাবরই অনৈসলামি আখ্যা দিয়ে এসেছেন, ভবিষ্যতেও দেবেন।’ তবে এসব প্রতিবাদকে সংস্কৃতিকর্মীরা ‘কখনো আমলে নেননি, এখনো নেবেন না।’ শহুরে উৎসবের ব্যাপারে মৌলভির নারাজি কবুল করা হবে কি না, সেই প্রশ্ন থাকলেও, এটাও মনে রাখা দরকার, পাকিস্তান যুগে পয়লা বৈশাখে চাল আর গুড় দিয়ে বানানো মিষ্টান্নর বন্যা বয়ে যেত গ্রামের মসজিদে। অর্থাৎ পয়লা বৈশাখের শহুরে, রচিত ঐতিহ্যে যেমনটাই হোক, গ্রামীণ সমাজে নববর্ষ আর ইসলামের মধ্যে পরিষ্কার লেনদেনের সম্পর্কই ছিল।

ইসলাম প্রশ্নটি সোজাসুজি মোকাবিলা করেছেন কায়সার ১৯৬৮ সালের একটি লেখায়। আগের বছরই ‘বিজাতীয় সংস্কৃতি’ নিয়ে যে ধুন্ধুমার বিতর্ক ঘটে গেছে, তার পেছনের যুক্তি, কায়সার জানাচ্ছেন, ‘পয়লা বৈশাখ হিন্দুয়ানি ব্যাপার’। বিতর্কের আরও কারণ, কিছু বুদ্ধিজীবী যাঁরা সংস্কৃতবহুল বাংলা লেখেন তাঁরা বাড়াবাড়ি করছেন রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে, আর এঁদের মারফত ‘পশ্চিমবঙ্গের তথা ভারতের সংস্কৃতির অনুপ্রবেশ ঘটছে পূর্ব পাকিস্তানে।’ বঙ্গীয় বুদ্ধিজীবীরা জবাবিতে বলছেন, ‘পাকিস্তানের বিভিন্ন জাতিসত্তা—যথা সিন্ধি, বেলুচ, পাঠান এবং বাঙালি তাদের নিজ নিজ ভাষা ও সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যের অধিকারী।’ ভাষার ধর্মীয় বিচার সম্পর্কে কায়সারের দাবি: ‘ভাষার কোনো ধর্মীয় বিচার সম্ভব নয়।’ কারণ, আরবি প্রাক্‌-ইসলামি আরবে ছিল ‘পৌত্তলিকদের ভাষা’। এসব পৌত্তলিক পরে ইসলাম গ্রহণ করলেও প্রাক্‌-ইসলামি আরবি ভাষার ‘রূপ বা ব্যুৎপত্তি কিছুই বদলায়নি।’ ফারসি ভাষার মামলাও অভিন্ন, আদিতে এটি ‘অগ্নি উপাসকদের ভাষা।’ পারসিকেরা মুসলমান হওয়ার পর এই ভাষা ত্যাগ করেননি। পারস্য লোককাহিনির জনশ্রুত নায়ক-নায়িকা—সোহরাব–রুস্তম, শিরি–ফরহাদ—এঁরা কেউ মুসলিম নন। এসব জাতীয় সাহিত্য নিয়ে পারস্যবাসীরা গৌরব অনুভব করে যদি, তবে পূর্ববঙ্গে বাংলাচর্চার ক্ষেত্রে ‘ধর্মের দোহাই পাড়া একান্তই হাস্যকর।’

মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী এই প্রশ্নটাকে আরও চোখাভাবে হাজির করেন। প্রতিটি জাতিরই যে নিজস্ব স্বতন্ত্র এবং বৈশিষ্ট্যময় জীবনধারা সেটাই তার সংস্কৃতি; আর ‘এই সংস্কৃতি লইয়া যদি সে বাঁচিতে না পারে তবে উহা সেই জাতির পক্ষে পরাধীনতা।’ পারসিক জাতি যদি নওরোজ করতে পারে, আমরা কেন করব না পয়লা বৈশাখ? যাঁরা বলেন, ‘বাঙলা বর্ষ হিন্দু সাল’ তাঁরা ভুলে যান ‘বাঙলা সন হিজরী সনেরই রূপান্তর।’ এই অর্থে ‘বাঙলা বর্ষ যেমন এই দেশের, তেমনি মুসলমানীও বটে।’ কিন্তু এই সন মুসলমানি যদি না–ও হতো, তবু ‘আমাদের আবাসভূমির কার্য্যক্রম পরিচালনার সময়পঞ্জী হিসাবে বাঙলা বর্ষ’-এর গুরুত্ব খাটো করার উপায় ছিল না। কাজী দীন মুহম্মদ আরও জোরের সঙ্গে এই যুক্তিটা হাজির করেন। মোগল আমলে সরকারি সন হিসেবে হিজরির প্রচলন অধিক হলেও মোগলেরা ‘নওরোজ করতেন হিজরি সনের পয়লা দিনে নয়’, বরং আকবর পারস্যে প্রচলিত সনের ধারা অনুসরণ করে যে এলাহি সনের প্রবর্তন করেন, তার প্রথম দিনটা ছিল নওরোজ। আর বৈশাখের সঙ্গে আমাদের জাতীয় জীবনের যোগ নিয়ে যাঁরা প্রশ্ন তোলেন, তাঁদের মনে রাখা দরকার, যে সনের সঙ্গে ‘হিজরী সন, মুসলমান বাদশাহ ও মুসলমান জ্ঞানী-গুণীদের সম্পর্ক বিদ্যমান’ তার প্রথম দিন আমাদের জাতীয় দিন অনায়াসে হতে পারে। আর পয়লা বৈশাখ যে আমাদের জাতীয় সম্পদ তার পক্ষে আরেক প্রস্থ যুক্ত দেন মুহম্মদ: ‘স্বাধীনতা লাভের পর ভারতীয় কর্তৃপক্ষ তথা পশ্চিমবঙ্গ বাংলা সনকে বাদ দিয়েছেন’ এবং তার জায়গায় শকাব্দকে জাতীয় সন হিসেবে গ্রহণ করেছেন। এর কারণ, কাজী দীন মুহম্মদের মতে, বাংলা সনের সঙ্গে হিজরি সন ও মুসলমানদের যোগাযোগ থাকায়, তাঁরা তা নিজেদের ঐতিহ্য বলে গ্রহণ করতে পারেননি। ‘এমতাবস্থায় বাংলা সন যে আমাদের জাতীয় সম্পদ, এ বিষয়ে সন্দেহের আর কোনো অবকাশ থাকিতে পারে না।’

৫.

পয়লা বৈশাখের যে রচিত ঐতিহ্য, তার কল্পনার মধ্যে বঙ্গীয় বর্ষপঞ্জি যে একটি জীবনধারারও ভাঁড়ার, এই সত্যটি খুব বেশি ধরা পড়ে না বলেই মনে হয়। ইউনেসকো যে ‘ইনট্যানজিবল কালচার হেরিটেজ’ সম্পর্কে লিখেছে, এসব হেরিটেজের গুরুত্ব কেবল সাংস্কৃতিক অভিব্যক্তি হিসেবে নয়, বরং যে জ্ঞান এবং কলানৈপুণ্য হেরিটেজের মধ্য দিয়ে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে বাহিত হয়, সেটাও এর গুরুত্বের একটি প্রধান দিক। পয়লা বৈশাখও সেভাবেই একটি প্রায় হারিয়ে যাওয়া জীবনধারার ইঙ্গিতবাহী। এখন প্রয়োজন রচিত ঐতিহ্যের আরও নতুন বুনন, যেখান থেকে এই বিলীয়মান জীবনধারারও কয়েক পশলা আভাস আমরা পেতে পারব।