মানুষ কি ‘পাঠক’ থেকে ‘শ্রোতা’ হয়ে উঠবে

কয়েক দশক ধরে যে হারে বইপড়ুয়া মানুষের সংখ্যা কমতে শুরু করেছে, তাতে এমন আশঙ্কা কি হতেই পারে যে একসময় হয়তো আমাদের সমাজে ‘পাঠক’ নামের প্রাণীটি দুষ্প্রাপ্য হয়ে উঠবে? এর পেছনে ই-বুক, কিন্ডল, পিডিএফ, পডকাস্টের যেমন ভূমিকা আছে, তেমনি আছে অডিও বুকের ভূমিকা।

‘অডিও বুক’ শব্দটি হাল সময়ে বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। ক্রমেই এর ব্যবহারকারীর সংখ্যা বাড়ছে। ফলে অনেকেই কপালে চিন্তার ভাঁজ ফেলে বলছেন, ভবিষ্যতে ‘পাঠক’ বলে কিছু থাকবে না। সবাই–ই ‘শ্রোতা’ হয়ে যাবে।

সাম্প্রতিক সময়ে অডিও বুক জনপ্রিয় হলেও এর ইতিহাস কিন্তু বেশ পুরোনো। অডিও বুক প্রথম বের হয়েছিল ১৯৩২ সালে। তখন দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের জন্য বই রেকর্ডিং করতে শুরু করেছিল দ্য আমেরিকান ফাউন্ডেশন নামের একটি সংস্থা।

সে সময় অবশ্য এর নাম ছিল ‘টকিং বুক’। পরে ১৯৭০–এর দশকে অডিও ক্যাসেট আবিষ্কৃত হলে টকিং বুকের নাম হয় অডিওবুক।

এরপর একটু একটু করে অডিও বুকের জনপ্রিয়তা বাড়তে বাড়তে গেল শতকের নব্বইয়ের দশকের পর এই শ্রবণনির্ভর বইয়ের জনপ্রিয়তার গতি আরও দ্রুততর হয়েছে। সবচেয়ে বেশি বিস্ফোরণ ঘটেছে ২০১০ সালের পর।

২০১০ সালের পর থেকে প্রতিবছরই অডিও বুকের গ্রাহক বেড়েছে। ২০১৫ সালের তুলনায় ২০১৬ সালে অডিও বুকের বিক্রি ১৮ দশমিক ২ শতাংশ বেড়ে ২ দশমিক ১ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছিল। ওই বছর অডিও বুক প্রকাশিত হয়েছিল ৫১ হাজার।

সর্বশেষ গত বছর যুক্তরাষ্ট্রে ৬৫৯ মিলিয়ন অডিও বুক ডাউনলোড হয়েছে, যা আগের বছরের তুলায় ১৫ দশমিক ৬ শতাংশ বেশি।

২০২১ সালে অডিও বুক থেকে রাজস্ব আয় বেড়েছে ১০ দশমিক ৮ শতাংশ, ২০২০ সালে যা ছিল ১০ দশমিক ৪ শতাংশ।

অন্যদিকে গত বছর ই-বুকের বিক্রি কমেছে ৩ দশমিক ৭ শতাংশ।

পাবলিশার্স অ্যাসোসিয়েশনের বরাত দিয়ে এ বছরের শুরুতে নিউইয়র্ক টাইমস বলেছে, ২০২০ সালে যুক্তরাষ্ট্রে অডিও বুক থেকে রাজস্ব আয় বেড়েছে ১২ শতাংশ।

করোনা মহামারি শুরুর আগে থেকেই অডিও বুকের বেচাবিক্রির ঊর্ধ্বগতি ছিল। করোনার সময় তা আরও ফুলেফেঁপে উঠেছে। ধারণা করা হচ্ছে, ২০২৭ সাল নাগাদ অডিও বুকের বাজার ১৯ বিলিয়ন ডলারের ইন্ডাস্ট্রিতে পরিণত হবে। গত বছরের নভেম্বরে স্পটিফাই ঘোষণা করেছে, তারা ফাইন্ডঅ্যাওয়ে কিনে নেবে। ফাইন্ডঅ্যাওয়ে হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম বৃহৎ অডিও বুক পরিবেশক।

এ থেকেই বোঝা যাচ্ছে, সামনের দিনগুলোয় অডিও বুক কতটা সম্ভাবনাময় হয়ে উঠবে।

আজ থেকে ২০ বছর আগে অডিও বুক শোনার জন্য অ্যামাজন প্রথমবারের মতো বহনযোগ্য অডিও প্লেয়ার বাজারে ছেড়েছিল। দাম ছিল ২০০ ডলার। শোনা যেত মাত্র দুই ঘণ্টার রেকর্ড। আর এখন মানুষ তাদের স্মার্টফোনেই শত শত ঘণ্টার রেকর্ড শুনতে পারে। পাবলিশার্স অ্যাসোসিয়েশন বলছে, বছরে ৬৭ মিলিয়ন মার্কিন অডিও বুক শুনে থাকে।

অডিও বুক শোনার নানা মাধ্যম রয়েছে। টাকা দিয়ে শোনার প্ল্যাটফর্ম যেমন আছে, তেমনি মোবাইল অ্যাপও রয়েছে। যেমন আইপ্যাড, কিন্ডল ইত্যাদি। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের স্থানীয় অনেক লাইব্রেরিতেও বিনা মূল্যে অডিও বুক শোনার ব্যবস্থা রয়েছে।

এখনো কোথাও কোথাও অডিও বুকের সিডি ভার্সনও বিক্রি হয়।

বর্তমানে অডিও বুক সবচেয়ে বেশি তৈরি হচ্ছে আত্মজীবনী ও স্মৃতিকথামূলক বইয়ের, আত্ম–উন্নয়নমূলক বইয়ের, ক্রাইম থ্রিলার ও সায়েন্স ফিকশন বইয়ের। বৈশ্বিক পরিসংখ্যান বলছে, এসব বইয়ের অডিও বুকের শ্রোতাই বেশি। আর তাঁদের বেশির ভাগেরই বয়স ২০ থেকে ৩৫ বছরের মধ্যে।

সব মিলিয়ে অডিও বুকের যে রমরমা, তাতে বোঝা যাচ্ছে, অদূর ভবিষ্যতে মাধ্যমটি আরও বেশি জনপ্রিয় হয়ে উঠবে। তখন অনেকেই আর বই পড়বে না, অডিওতে বইয়ের লেখা শুনবে। বাস্তবতা যখন এমন, সে সময় আবারও আসতে পারে এই প্রশ্ন যে সামনের পৃথিবীতে ‘পাঠক’ বলে কি কিছু থাকবে, নাকি সবাই হবে শ্রোতা? মানুষ কি ‘পাঠক’ থেকে ‘শ্রোতা’ হয়ে উঠবে?


সূত্র: নিউইয়র্ক টাইমস, রাইটার্স ডাইজেস্ট, পাবলিশার্স উইকলি ও পিবিএস ডট ওআরজি