কবি ও ছোটগল্পকার প্রেমেন্দ্র মিত্র বন্ধু কাজী নজরুল ইসলামকে নিয়ে লিখেছিলেন, ‘সে মুখ খুললে কবিতা আপনি ঝরে পড়ে।’ সেই বিদ্রোহী কবি দীর্ঘ স্থবিরতার কাল শেষে কোনো এক ১২ ভাদ্রে পাড়ি দিলেন অনন্তলোকে। এই কবির সাহিত্য ও সংগীতের ভুবন এখন সবার সম্পদ। আমরা বরং ‘হারানো হিয়ার নিকুঞ্জ পথে’ একটু ঘুরে বেড়াই, নজরুলকে ছুঁয়ে থাকা মণি-মুক্তার মতো কিছু ঝরা ফুলই কুড়াই। কবির পুত্র, পুত্রবধূ ও নাতনির চোখে দেখা অন্য এক নজরুলের সঙ্গে কিছুটা সময় থাকি।
১৮৯৯ সালে জন্ম। পত্রপত্রিকায় কবিতা প্রকাশের শুরু ১৯২০ সাল থেকে। ২২ কি ২৩ বছরের সৃষ্টিশীল একটা জীবন থেমে গেল ১৯৪২ সালে। নজরুল সংবিৎহারা হলেন। এর ১০ বছর পর, ১৯৫২ সালে, নজরুলের কলকাতার মানিকতলায় রাজেন্দ্র লালা স্ট্রিটের বাড়িতে ছোট পুত্রবধূ হয়ে এলেন কল্যাণী কাজী, হলেন নজরুলের ছোট পুত্র প্রখ্যাত গিটারবাদক কাজী অনিরুদ্ধের স্ত্রী।
চারতলা বাড়ির নিচে ছিল খাটাল আর কুস্তির আখড়া। তিনতলায় দুটি আর চারতলায় একটি ঘর নিয়ে ছিল কবির সংসার। ওপরতলায় পানির ব্যবস্থা ছিল না। নজরুলের পরিচারক কুশা সাউ একতলা থেকে পানি তুলে চাহিদা মেটাতেন।
সম্প্রতি প্রয়াত কল্যাণী কাজী সে সময় নজরুলের দিনযাপনের কথা লিখেছেন এভাবে, ‘অপেক্ষাকৃত ছোট একটা ঘরে বাবা থাকতেন আপনমনে। কখনো কাগজ ছিঁড়ে বালিশের তলায় রাখতেন, কখনো জানালার গরাদ ধরে নীল আকাশের দিকে তাকিয়ে অব্যক্ত ভাষায় আপনমনে কী যেন বলতেন আর হাসতেন। লোকজন দেখতে এলে চুপটি করে বসে থাকতেন। তাঁর দিকে বেশিক্ষণ কেউ তাকিয়ে থাকলে বা চশমা পরা বা ছাতা হাতে কোনো লোক এলে চিৎকার করে উঠতেন।’ (নজরুল বিচিত্রা)
নজরুলের এমন দশা। স্ত্রী প্রমীলা দেবীও পক্ষাঘাতে অচল। শুয়ে শুয়েই সবজি কাটতেন। চৌকির সামনে স্টোভ আনিয়ে কষ্টেসৃষ্টে কখনো রান্নাও করতেন। খাইয়ে দিতেন নজরুলকে।
এসবের ওপরে ছিল তীব্র আর্থিক টানাপোড়েন। হুটহাট নানা অশান্তি চেপে বসত, বিশেষ করে বাড়ি নিয়ে। বাড়িওয়ালারা চাইতেন উচ্ছেদ করে দিতে।
একসময় নজরুলের ঠাঁই হয় কলকাতার পাইকপাড়ার টালা পার্কের বাড়িতে, ছোট পুত্র অনিরুদ্ধ ও পুত্রবধূ কল্যাণীর সঙ্গে। পুত্র সব্যসাচী থাকেন ক্রিস্টোফার রোডের বাড়িতে। টালা পার্কের বাড়িতে ১৯৬২ সালে প্রমীলা দেবীর মৃত্যু হলে সব্যসাচী বাবাকে তাঁর বাড়ি নিয়ে যেতে আসেন। নজরুল কিছুতেই ঘর থেকে বের হবেন না। অনিরুদ্ধ বললেন, ‘বাবা, গাড়ি করে বেড়াতে যাব, চলো।’ কল্যাণী কাজীর লেখায়, ‘তখন বাচ্চা ছেলের মতো বাবা আমার স্বামীর হাত ধরে বাইরে এলেন। তবে বেরোনোর আগে খালি চৌকিটার দিকে আঙুল তুলে বোঝাতে চাইলেন তাঁর চিরদিনের সঙ্গীর কথা। সেদিন কেউ আমরা চোখের জল ধরে রাখতে পারিনি।’
অপেক্ষাকৃত ছোট একটা ঘরে বাবা থাকতেন আপনমনে। কখনো কাগজ ছিঁড়ে বালিশের তলায় রাখতেন, কখনো জানালার গরাদ ধরে নীল আকাশের দিকে তাকিয়ে অব্যক্ত ভাষায় আপনমনে কী যেন বলতেন আর হাসতেন। লোকজন দেখতে এলে চুপটি করে বসে থাকতেন। তাঁর দিকে বেশিক্ষণ কেউ তাকিয়ে থাকলে বা চশমা পরা বা ছাতা হাতে কোনো লোক এলে চিৎকার করে উঠতেন।
আরেক পুত্রবধূ সব্যসাচীর স্ত্রী উমাকে মা বলে ডাকতেন নজরুল। উমা মুখার্জি নার্স হিসেবে নজরুলের বাড়িতে এসেছিলেন। নজরুলের জন্য নার্স চেয়ে খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়েছিল।
উমা কলকাতার লেডি ডাফরিন মেডিকেল হাসপাতাল থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে নার্স হয়েছিলেন। প্রথম দিন এসে নজরুলের মাথার কাছে বসলে প্রমীলা বলেন, ‘মা, তুমি কি পারবে কবির সেবা করতে? এই যে দেখো, উনি কাগজ ছিঁড়ছেন। উনি এখন শিশুর মতো।’ উমা যেন তৈরি হয়েই এসেছিলেন। বললেন, ‘আমি তো কলকাতার হাসপাতালে শিশু বিভাগেই ডিউটি করেছি। উনি যদি শিশুর মতো হন, নিশ্চয়ই পারব।’
নজরুল ছিলেন উমার একান্ত বাধ্য। উমা-সব্যসাচীর কন্যা খিলখিল কাজী ভারত বিচিত্রায় লিখেছেন, ‘মা যখন দাদুর চুল কেটে দিতেন, তখন দাদুর মাথাটা পেছন থেকে আমি ধরতাম। মা যখন দাদুর নখগুলো কেটে দিতে আসতেন, দাদু সুন্দর করে তাঁর হাত দুটি মায়ের সামনে মেলে ধরতেন। মা একটা ছোট নখ কাটার কাঁচি দিয়ে কুটকুট করে তাঁর নখ কেটে দিতেন।’
ক্রিস্টোফার রোডের বাড়িটা যে সব সময় বিষাদে ভরা ছিল, তা নয়। মাঝেমধ্যে সে বাড়ির দরজা-জানালা দিয়ে ফালি ফালি আনন্দের রোদও ঢুকে পড়ত। জ্যৈষ্ঠ মাস এলেই বাড়িটা খুশিতে ঝলমল করে উঠত। এ মাসেই যে এই কবির জন্ম হয়েছে। কলকাতার আর্ট কলেজের ছেলেমেয়েরা সুন্দর করে আলপনা এঁকে দিত সারা বাড়িতে।
তখন বাচ্চা ছেলের মতো বাবা আমার স্বামীর হাত ধরে বাইরে এলেন। তবে বেরোনোর আগে খালি চৌকিটার দিকে আঙুল তুলে বোঝাতে চাইলেন তাঁর চিরদিনের সঙ্গীর কথা। সেদিন কেউ আমরা চোখের জল ধরে রাখতে পারিনি।
নজরুলের ঘর রজনীগন্ধা, বেলি, জুঁই ফুলে সাজত। নজরুলের পাশে ছোট টেবিলে প্রমীলার ছবি ফুলের মালা দিয়ে সাজানো থাকত। উমা এসে প্রথমে নজরুলকে মিষ্টি খাইয়ে দিতেন। শিল্পীরা একজনের পর আরেকজন এসে গান শুনিয়ে যেতেন। খিলখিল কাজী লিখছেন, ‘মানব কাকু (মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়) গাইছেন, “বাগিচায় বুলবুলি তুই”, আর দাদুর সেকি আনন্দ!’
কেবল জন্মদিনেই নয়, অসুস্থ নজরুলকে দেখতে প্রায় প্রতিদিনই বাড়িতে অনুরাগীদের ভিড় হতো। কাজী সব্যসাচী লিখেছেন, ‘অটোগ্রাফ নেওয়ার জন্য হুড়োহুড়ি লেগে যেত। নজরুল কাঁপা কাঁপা হাতে কোনোরকমে নিজের নামটা সই করতেন। মাঝেমধ্যে দু–এক লাইন কবিতাও লিখতেন। একবার যেমন লিখে ফেললেন, ‘আমি যেমন ভালো ছিলাম,/ তেমন ভালো আছি,/ হৃদয়পদ্মে মধু পেল,/ মনের মৌমাছি।’