গায়াথ আলমাধুন

ইন্টারন্যাশনাল রাইটিং প্রোগ্রামে অংশ নিতে যুক্তরাষ্ট্র এসেছি। ১০ সপ্তাহের এই আয়োজনে অংশ নিচ্ছেন পৃথিবীর ৩০টি দেশের ৩২ জন কবি, কথাসাহিত্যিক ও নাট্যকার। আমরা আইওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের আইওয়া হাউস হোটেলে থাকছি। প্রতিদিন নানা রকমের কর্মকাণ্ডে অংশ নিচ্ছি, দল বেঁধে বেড়াতে যাচ্ছি, একে অন্যকে নিজেদের লেখা পড়ে শোনাচ্ছি, আর বিচিত্র বিষয়ে গল্প করছি। 

বার্লিনপ্রবাসী ফিলিস্তিনি কবি গায়াথ আলমাধুনের গল্প শুনতে শুনতে মনে হচ্ছে, তাঁকে নিয়ে দীর্ঘ উপন্যাস লেখা যেতে পারে। তাঁর পিতামহের জন্ম ফিলিস্তিনের যে গ্রামে, ১৯৪৮ সালে সেখান থেকে সপরিবার উচ্ছেদ হয়ে গাজা সিটিতে বসতি স্থাপন (তখন তাঁর বাবার বয়স ছয় মাস); ১৯৬৭ সালে গাজা সিটি থেকে বিতাড়িত হয়ে প্রথমে মিসর, তারপর জর্ডান, তারপর সিরিয়ার দামেস্ক শহরে ফিলিস্তিনি শরণার্থীশিবিরে আশ্রয় গ্রহণ (সেখানে ১৯৭৯ সালে গায়াথের জন্ম); তারপর সেই প্রিয় দামেস্ক ছেড়ে ইউরোপ, বহু বছর ধরে সুইডেনের স্টকহোমে বসবাস, তারপর এখন বার্লিনে...কিন্তু মনের গভীরে, স্বপ্নে-দুঃস্বপ্নে সব সময় সেই ভূমি, যেখানে পিতামহের তৈরি বাড়িটা এখনো দিব্যি দাঁড়িয়ে আছে, কিন্তু অন্যদের দখলে...।

গায়াথ কবিতা লেখেন আরবিতে। সেগুলো অনূদিত হয়েছে ইংরেজিসহ আরও দশ-বারোটা ভাষায়। ইংরেজিতে অনূদিত তাঁর অ্যাড্রেনালিন কাব্যগ্রন্থের প্রথম কবিতা ‘ম্যাসাকার’ বাংলায় অনুবাদ করে তাঁকে পড়ে শোনালাম; কবিতাটার সব কথা ঠিকঠাক বুঝতে পেরেছি কি না তা তাঁকে দিয়ে যাচাই করিয়ে নিলাম। এখন সেই কবিতা ভাগ করে নিচ্ছি প্রথম আলোর পাঠকদের সঙ্গে।

ভূমিকা ও অনুবাদ: মশিউল আলম

ম্যাসাকার

গায়াথ আলমাধুন

ম্যাসাকার একটা মৃত রূপক, আমার বন্ধুদের খাচ্ছে, খেয়ে নিচ্ছে নুন ছাড়া। ওরা ছিল কবি, তারপর হয়েছে রিপোটার্স উইদাউট বর্ডার্স; ওরা ইতিমধ্যে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল, এখন আরও বেশি ক্লান্ত। ‘সূর্যোদয়ে পায়ের বহরে ওরা সাঁকো পার হয়’; তারপর মরে যায় জায়গায় যেখানে ফোন কভারেজ নেই। আমি নাইট ভিশন গগলস দিয়ে ওদের দেখি আর অন্ধকারে ওদের শরীরের উষ্ণতা অনুভব করি। ওই তো ওরা, অন্ধকারের দিকে ছুটতে ছুটতে পালাচ্ছে অন্ধকার থেকে, সঁপে দিচ্ছে নিজেদের এই মহামালিশের কাছে। ম্যাসাকার ওদের আসল মা, জেনোসাইড তো পেনশনভোগী বুদ্ধিজীবী জেনারেলদের লেখা ধ্রুপদি কবিতা ছাড়া কিছু নয়। জেনোসাইড উপযুক্ত শব্দ নয় আমার বন্ধুদের জন্য, কারণ তা সংগঠিত যৌথ কর্ম আর সংগঠিত যৌথ কর্ম ওদের স্মরণ করিয়ে দেয় সেই বামেদের কথা, যারা ওদের ত্যাগ করেছে। ম্যাসাকার জেগে ওঠে খুব ভোরে, ঠান্ডা পানি আর রক্তে গোসল করিয়ে দেয় আমার বন্ধুদের, ধুয়ে দেয় ওদের অন্তর্বাসগুলো, রুটি বানিয়ে চা করে দেয়, তারপর একটুখানি শিকার শেখায়।

সর্বজনীন মানবাধিকার সনদের চেয়ে ম্যাসাকার আমার বন্ধুদের প্রতি বেশি সদয়। ওদের দরজাগুলো যখন বন্ধ ছিল, ম্যাসাকার তখন ওদের জন্য দরজা খুলে ধরেছিল আর নাম ধরে ডেকেছিল ওদের, যখন সংবাদ প্রতিবেদনগুলো ব্যস্ত ছিল শুধু সংখ্যার সন্ধানে। অতীত-নির্বিশেষে ওদের আশ্রয় দেয় কেবলই ম্যাসাকার, ওদের আর্থিক অবস্থায় ওর কিছু এসে যায় না; ওরা বুদ্ধিজীবী না কবি ম্যাসাকার তা দেখে না; সে সবকিছু দেখে নিরপেক্ষ চোখে। ম্যাসাকারের রূপও ওদের মতোই, নামগুলোও ওদের বিধবা বউদের মতোই; গ্রাম আর শহরতলির ভেতর দিয়ে যায়, আর হঠাৎ হঠাৎ ওদের মতোই আবির্ভূত হয় ব্রেকিং নিউজের মতো। ম্যাসাকার আমার বন্ধুদের মতো, কিন্তু প্রত্যন্ত গ্রাম আর শিশুদের স্কুলগুলোতে সে সব সময় হাজির হয় ওদের আগেই।

ম্যাসাকার একটা মৃত রূপক, যে টেলিভিশনের ভেতর থেকে বেরিয়ে এসে আমার বন্ধুদের খেয়ে নেয়, এক চিমটি লবণও লাগে না।