সত্যজিৎ কি কাঞ্চনজঙ্ঘার প্রেমে পড়েছিলেন?

আজ সত্যজিৎ রায়ের জন্মদিন। ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’ এই কালজয়ী নির্মাতার প্রথম রঙিন সিনেমা। কিন্তু ছবির ক্যানভাসজুড়ে রঙের বাড়াবাড়ি নেই, বরং মেঘ আর কুয়াশার দোদুলদুলে জীবনের এক মোহময় প্রচ্ছায়া এঁকেছেন তিনি। কেন তিনি প্রকৃতিসংলগ্ন হয়ে এমন সিনেমা বানালেন?

সত্যজিৎ রায়ছবি: সংগৃহীত

‘প্রেমে না পড়ে বিয়ে করিস না’—মনীষার উদ্দেশে শংকরদা এ কথা বলেছিলেন। মনীষা কে? মনীষা সত্যজিৎ রায়ের ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’ চলচ্চিত্রের নায়িকা। তবে নায়িকা শব্দে আমার আপত্তি আছে। আমি মনীষাকে নায়িকা মনে করি না। ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’ সিনেমায় নায়িকা হলো সময়, রং, রূপ-অরূপ, মেঘ, কুয়াশা, প্রকৃতি।

‘অণিমার শাড়িটা ভালো করে দেখো। ও একটা ভুল বিয়েতে বন্দী। ওর শাড়ির ডোরাগুলো জেলখানার গরাদকে মনে করাবে। অন্য দিকে মনীষার জীবন এখনো মুক্ত আকাশ। সেখানে কোনো কালো মেঘের ছায়া পড়েনি। তাই সূর্যোদয়ের রং লেগেছে তোমার শাড়িতে।’

হঠাৎ মনীষার কথা বলছি, কারণ আজ সত্যজিৎ রায়ের জন্মদিন। ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’ আমার কাছে অনেকখানি আরামের, স্বস্তির সিনেমা। একটা অব্যক্ত পৃথিবীকে ব্যক্ত করার টুকরো কোলাজ। দশ কোম্পানির মালিক রায় বাহাদুর ইন্দ্রনাথ রায় চৌধুরীর পর্বতসম অহমিকার সামনে সাধারণ রক্ত–মাংসের লাবণ্য রায় চৌধুরীর জন্য আমার মন কেমন করে। মানুষের বানানো সভ্যতায় পুঁজি আর অর্থের নিগড়ে গড়ে তোলা পিতৃতান্ত্রিক আবহে এসব মানুষ ঘুরে বেড়ায়। শংকর হলো মনীষার বড় বোনের স্বামী। সে এক ভালোবাসাহীন বৈবাহিক সম্পর্কের মধ্যে হাঁসফাঁস করে। তবে আমরা কাউকে কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে পারি না। কারণ, ব্যক্তি নয়, এখানে প্রতিপক্ষ হলো, পিতৃতান্ত্রিক কাঠামো। এই জটিল শব্দবন্ধের অতলে আমার ভালো লাগে চলমান মানুষের যাত্রা দেখতে। পুরো সিনেমাতেই মানুষগুলো পথ হাঁটে। এক বিকেলের গল্প, না না গল্প নয়, বরং অগল্পই বলে যায় তারা।

সত্যজিৎ রায়ের অন্য সব সিনেমায় গল্প বলার যে ঢং, তা থেকে অনেকখানি সরে এসে এখানে তিনি এঁকেছেন অন্য চিত্রকল্প। এ প্রসঙ্গে আমি খুঁজে পাই বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ক্যানভাস। প্রতিটি পাতায় নতুন মুখ, নতুন ঘটনার বাতাবরণ। খুব অল্প সময়ের জন্য ভিন্ন ভিন্ন অনুষঙ্গ এসে হাজির হয়; অথচ তারা মনের মধ্যে হাজারো ছাপ ফেলে যায়। ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’য় সত্যজিৎ একটি পরিবারের মধ্যে থাকা আপাত বিচ্ছিন্ন কতগুলো মানুষের টুকরো টুকরো স্মৃতির ক্যানভাস রচনা করে গেছেন।

‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’ ছবির দৃশ্য
ছবি: সংগৃহীত

এটি সত্যজিতের প্রথম রঙিন সিনেমা, তবে রঙের বাড়াবাড়ি নেই, বরং মেঘ আর কুয়াশার দোদুলদুলে জীবনের এক মোহময় প্রচ্ছায়া এঁকেছেন। মনীষার গায়ে লেপ্টে থাকা একরঙা কমলা রঙের শাড়িটা যেন একটুকরো ভোর। একজায়গায় পড়েছিলাম, মনীষা চরিত্রে অভিনয় করা অলকানন্দা তাঁর শাড়ির রং নিয়ে মন খারাপ করে সোজা সত্যজিৎ রায়কে গিয়ে বলেছিলেন, ‘দিদি কী ভালো একটা ডুরে শাড়ি পরেছে! আর আমার বেলা একরঙা, তাও তেমন উজ্জ্বলও নয়।’ উত্তরে সত্যজিৎ রায় বলেছিলেন, ‘অণিমার শাড়িটা ভালো করে দেখো। ও একটা ভুল বিয়েতে বন্দী। ওর শাড়ির ডোরাগুলো জেলখানার গরাদকে মনে করাবে। অন্য দিকে মনীষার জীবন এখনো মুক্ত আকাশ। সেখানে কোনো কালো মেঘের ছায়া পড়েনি। তাই সূর্যোদয়ের রং লেগেছে তোমার শাড়িতে।’

রং নিয়ে এমন ভাবনায় আমার আন্তোনিওনির ‘রেড ডেজার্ট’–এর মনিকা ভিত্তির মুখ ভেসে আসে। ভিত্তির সোনালি চুল আর কালচে সবুজ রঙের মিশেল ভিত্তির অন্তর্জগতের মরুভূমিকে, খাঁ খাঁ শূন্যতাকে আরও বাড়িয়ে তোলে, যোগ করে নতুন মাত্রা। আন্তমানবিক সম্পর্কের টানাপোড়েনের গল্প বলতে গিয়ে তিনি রং বিছিয়ে দেন পরতে পরতে। যদিও কাঞ্চনজঙ্ঘার রং অনেকটা ফিকে। মনীষা, অণিমা, লাবণ্য, শংকর, অনিল, অশোক ও ইন্দ্রনাথ—এসব চরিত্রের সবাইকে সত্যজিৎ তাদের অন্তর্জগৎ আর বহির্জগতের মিশেলেই তুলে ধরেছেন। কথায় আছে, রং দিয়ে যায় চেনা। দার্জিলিংয়ের প্রকৃতিজুড়ে কত রঙের খেলা, অথচ ছবির ক্যানভাসে থাকা মানুষেরা ফিকে থেকে ক্রমেই ফ্যাকাশে পথ ধরে হাঁটে। তারা যেন প্রত্যেকেই প্রত্যেকের জীবনে বন্দী। নিজের কাছে, অপরের কাছে।

‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’ ছবির দৃশ্য
ছবি: সংগৃহীত

সিনেমার শেষ প্রান্তে লাবণ্যর কণ্ঠে রবীন্দ্রনাথ ভেসে আসেন, ‘এই পরবাসে রবে কে, হায় কে রবে এ সংশয়ে, শান্তিতে, শোকে?’ সামনে থেকে দেখা যাচ্ছে কুয়াশাচ্ছন্ন একটুকরো কাঞ্চনজঙ্ঘা। মেঘ ভেসে ভেসে এসে তাকে জড়িয়ে যাচ্ছে। সামনে গভীর খাঁদ। কী এক অতল শূন্যতা...এমন শূন্যতার সামনে দাঁড়িয়ে মনীষার কথা ভাবতে ভাবতে আমার মনে পড়ে চারুর কথা। ‘নষ্টনীড়’ গল্পের ‘চারু’ বিস্তৃতি পেয়েছে কাঞ্চনজঙ্ঘার স্বর্ণশিখরে। সঙ্গে চোখে লেগে থাকে সত্যজিৎ রায়ের সেই কাঞ্চনপ্রেম!