যেভাবে মফস্​সলে বিনোদন-মরিয়া মানবস্রোত

ঈদের ছুটিতে নগর ছেড়ে নাড়ির টানে গ্রাম বা মফস্​সলের ‘বাড়ি’তে ফিরেছিলেন মানুষ। কিন্তু এখন কেমন আছে আমাদের গ্রাম ও মফস্​সলগুলো? এক সাহিত্যিকের কলমে সেই বৃত্তান্ত

অলংকরণ: এস এম রাকিবুর রহমান

মানুষ জন্মায়, মরে আর কাজ করে। কাজ করতে করতে সে পরিশ্রান্ত হয়, তার শ্রান্তিমোচন দরকার হয়। সরকারি চাকরিতে শ্রান্তিবিনোদন ছুটি নামে একটা সবেতন ছুটি আছে। অর্থাৎ সরকার আপনার বিনোদন-চাহিদার ব্যাপারে সজাগ এবং এ বিষয়ে অর্থসহায়তাও করছে। উৎসব-পার্বণে মানুষ ছুটি পান, অনেকে উৎসব ভাতাও পান। সেই ভাতার উল্লেখযোগ্য অংশ চলে যায় বিনোদন খাতে। যাঁরা শ্রান্তি বিনোদন ছুটি পান না এবং উৎসব ভাতাও পান না, তাঁরাও পিছিয়ে নেই বিনোদনকর্ম থেকে। বিনোদন জীবনের অংশ। বিনোদন করার ধরন থেকে মানুষকে চেনা যায়।

লম্বা ছুটির দিনগুলোয় মানুষ বিনোদনকেন্দ্রগুলোয় হামলে পড়ে। কিন্তু আমাদের বিনোদনের জন্য পর্যাপ্ত সুযোগ নেই, অবকাঠামোও নেই। ফলে ছুটিছাটা এলে ঢাকার জ্যাম স্থানান্তরিত হয় কক্সবাজারে কিংবা রাঙামাটিতে। লাখ লাখ লোক একটু নিরিবিলিতে সাগর কিংবা পাহাড় দেখার আশায় পরস্পরের সঙ্গে ঠেসাঠেসি কিংবা ঘেঁষাঘেঁষি করে। মানুষ ঢাকা ছাড়ে মুক্ত নিরিবিলি পরিবেশে একটু নিশ্বাস নেওয়ার জন্য। কিন্তু কোথায় আছে সেই জায়গা? 

লম্বা ছুটি পেয়ে ঢাকার বিনোদনপ্রয়াসী মানুষ মফস্‌সলেই আছড়ে পড়ে। এ যেন জ্বলন্ত উনুন থেকে উত্তপ্ত কড়াই! সবুজ ধানখেত, স্বচ্ছ জলাভূমি, খেলার মাঠ আর ঘুরে বেড়ানোর জায়গাগুলো কেবল স্মৃতিতেই থাকে।

বর্ধিষ্ণু পরিবার আর রেমিট্যান্সের জোরে গ্রামগুলো বস্তির চেয়েও ঘন হয়ে গেছে। চাষযোগ্য জমিতে দালানকোঠা হয়ে গেছে। গ্রামে তো কোনো নগর-পরিকল্পনা নেই, তাই কোনো ঝামেলাও নেই। রাজউক এসে বলে না, অত পারসেন্ট ছাড়ুন! ১০ বছর ধরে এমনই এক বীভৎস গ্রামায়ণ হচ্ছে।

কিন্তু তার চেয়েও ভয়াবহ মফস্​সল শহরগুলোর অবস্থা। এগুলো নামে শহর, আসলে গ্রামেরই এক্সটেনশন বা বর্ধিতকরণ। শুরুতে মফস্​সল মানে ছিল একটা বাজার, একটা থানা, একটা কোর্টকাছারি, একটা সদর রোড, একটা হাসপাতাল, দু-তিনটি স্কুল-কলেজ আর কয়েকটি ব্যাংক। এর বাইরে বাকি সবই গ্রাম। এখন সেই গ্রামগুলো গ্রামায়ণের অংশ হিসেবে হামলে পড়েছে ছোট্ট শহরগুলোর ওপর। গত পাঁচ বছরে এসব শহরের আশপাশে যত পতিত জায়গা বা জলাভূমি ছিল, সব ভরাট হয়ে গেছে। উঠেছে দালানকোঠা। গ্রামে থাকা অবস্থাপন্ন মানুষেরা মফস্​সলমুখী হয়েছে ব্যাপকভাবে। এর কারণ স্ট্যাটাস-সিম্বল, বাচ্চার স্কুল, চিকিৎসাব্যবস্থা—যা-ই হোক। এই বিপুল চাপ নেওয়ার জন্য ছোট্ট মফস্​সলগুলো কোনোভাবেই তৈরি ছিল না।

আমি জন্মেছি এবং বড় হয়েছি বাংলাদেশের ব্যস্ত মফস্​সলগুলোর একটায়। তবু দেখতাম, দুপুরবেলা শহরটি কীভাবে ঘুমিয়ে পড়ত। রাস্তাঘাট ফাঁকা হয়ে যেত। ছুটির দিনগুলো ছিল সুনসান। পাড়ায় পাড়ায় খেলার মাঠ ছিল, বর্ষাকালে মাছ ধরার মতো জলাভূমি ছিল। পরিত্যক্ত রেলবগির আশপাশে বিপুল পরিমাণ খালি জায়গা ছিল। শহরের সদর রাস্তা পার হলে গ্রাম, অবারিত সবুজ। এখন সবই মানুষে ভরে গেছে। জলাভূমিতে দালানকোঠা, খেলার মাঠে শপিং মল, সবুজের বদলে পেট্রলপাম্প আর ধানখেতে জুতার কারখানা।  

লম্বা ছুটি পেয়ে ঢাকার বিনোদনপ্রয়াসী মানুষ এসব মফস্​সলেই আছড়ে পড়ে। এ যেন জ্বলন্ত উনুন থেকে উত্তপ্ত কড়াই! সবুজ ধানখেত, স্বচ্ছ জলাভূমি, খেলার মাঠ আর ঘুরে বেড়ানোর জায়গাগুলো কেবল স্মৃতিতেই থাকে। চোখের সামনে সব বালু দিয়ে ভরাট, আর তাতে শাঁই শাঁই করে ছুটে চলে ব্যাটারিচালিত রিকশা। ঠেসাঠেসি আর ঘেঁষাঘেঁষি করে ছুটে চলে মানবস্রোত। অচেনা শহর, অচেনা মানুষ। রাস্তায় বেরোলেই আপনাকে আপনার স্মৃতির ভেতর থেকে হিড়হিড় করে টেনে এই ডিসটোপিয়ার সামনে দাঁড় করিয়ে দেবে!

কিন্তু আপনি যতই নস্টালজিক আর বিমর্ষ থাকুন, আশপাশের অবধারিত বিনোদন-আগ্রাসনের হাত থেকে রেহাই নেই। ছুটি এসেছে, এনজয় করতে হবে। বাচ্চা ছেলেরা আপনার নাকের ডগায় পটকা ফোটাচ্ছে, ট্রাক ভাড়া করে লাউডস্পিকারে গান বাজিয়ে ‘লুঙ্গি ড্যান্স’ দিতে দিতে এলাকায় ঘুরে বেড়াচ্ছেন একদল তরুণ, নদীর পাড়ে যে ভাঙাচোরা নাগরদোলাটা আছে, সেখানেই চড়ে বসছে বাচ্চারা এবং তাদের অভিভাবকেরা। ‘এনজয়’ করতে হবে যেকোনো মূল্যে। এই ‘এনজয়’ করার মনোবৃত্তিই যেন তার ‘বিকৃত দায়িত্ব’। জিজেক যেমন বলেন। 

মুশকিল হলো, এই যে আমাদের ক্রমবর্ধমান বিনোদন-চাহিদা, তার সঙ্গে পাল্লা দিতে পারছে না বিনোদনকেন্দ্রগুলো। এখানে নানা কারণে একটা ডিমান্ড-সাপ্লাইয়ের অসংগতি রয়ে যাচ্ছে। অর্থনীতির এই নিয়ম যে কার্যকর হচ্ছে না, এর একটা প্রধান কারণ বোধ করি জায়গার অভাব। দ্বিতীয়ত, বিভিন্ন ধরনের বিনোদনে বিনিয়োগ করার ব্যাপারে ধর্মীয়-সামাজিক বিধিনিষেধ। ফলে বিনোদনের অন্য মাত্রাগুলো উদ্​যাপন করতে একদল মানুষ ছুটিছাটায় বিদেশ চলে যান। দেশে যাঁরা থাকেন, তাঁদের হাতে ফেসবুক-ইউটিউব ছাড়া বিনোদনের আর কোনো উপায় থাকে না।

অথচ আগে অনেকটাই ছিল। শহরগুলোয় একাধিক সিনেমা হল ছিল, শীতকালে মেলা হতো, সেখানে যাত্রাপালা দেখা যেত, হাউজি খেলা হতো, সার্কাস ছিল। এসবের মধ্যে বিনোদন খুঁজত গ্রামের বা মফস্​সলের মানুষ। কিন্তু এসব কর্মকাণ্ডকে ‘অশ্লীল’ অভিধা দিতে থাকেন বহু মানুষ, লাগাতার প্রচারণা চলে ওয়াজ মাহফিলগুলোয়। ফলে মানুষেরা স্বাভাবিকভাবেই এসবের আয়োজন কিংবা এগুলোতে অংশগ্রহণ করা থেকে বিরত থাকতে শুরু করে। আয়রনি হলো, ওয়াজ মাহফিলগুলোই এখন বহু মানুষের বিনোদনের ঠিকানা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

ভৈরব পৌরসভার বাইরে পানাউল্লার চর নামের এক গ্রামে একটা বধ্যভূমি আছে। মুক্তিযুদ্ধের সময় সেখানে পাকিস্তানি বাহিনী নির্বিচার গণহত্যা চালিয়েছিল এবং পরবর্তীকালে যেখানে গণকবর পাওয়া গেছে। এটিকে ঘিরে একটা ছোট স্মারক মিনার তৈরি করা হয়েছে সেখানে। পাড়ার শহীদ মিনার থেকে বড় কিছু নয়। শহর থেকে বেশ দূরে, হেজে-মজে যাওয়া পুরোনো ব্রহ্মপুত্রের পারে। মাটির রাস্তা দিয়ে যেতে হয়। আশপাশে কোনো ঘরবাড়ি নেই। বধ্যভূমি একটা শোক প্রকাশের জায়গা, বিশেষ বিশেষ দিনে মানুষের সেখানে গিয়ে স্মৃতি তর্পণ করার কথা। কিন্তু দেখা গেল, এই ঈদের ছুটিতে সেখানে হামলে পড়েছে হাজার হাজার মানুষ। জায়গামতো বসে গেছে দু-একটা ফুচকা-চটপটির দোকান। আছে আইসক্রিম, পারলার আর ছোটখাটো কফিশপ। একটু বসার জায়গা। একটা দোলনা, বাচ্চাদের জন্য। ব্যস! এভাবেই বধ্যভূমি হয়ে গেল বিনোদনকেন্দ্র! যারা আসছে, তারা বধ্যভূমি ভেবে আসছে না। এমনকি অনেকে বিষয়টা জানে, এমনও মনে হলো না। তাদের বেশির ভাগই ‘এনজয়’ করতে এসেছে। মোটরসাইকেলে, ব্যাটারিচালিত রিকশায়, এমনকি নৌকায়। কিছুই নেই সেই পোড়ো জমিতে, দু-একটা কফি ও আইসক্রিমের দোকান ছাড়া। হামলে পড়া জনস্রোতের জন্য এটুকুই যথেষ্ট!

একদিকে বিনোদনহীন অবকাঠামো, অন্যদিকে বিনোদন-মরিয়া মানবস্রোত। একদিকে অর্থসমাগম, অন্যদিকে অধরা-আনন্দ। নয়া বিত্তবান ও মধ্যবিত্তদের জন্য খুব আফসোসের বিষয় এটা। টাকা খসছে, কিন্তু আনন্দ মিলছে না। তবু সবাই যে যার মতো বিনোদন পেতে ও দেখাতে উদ্​গ্রীব। রিকশায় উঠেও সেলফি নিতে ভুলছে না। রেললাইনের ওপর বসে ফেসবুকে লাইভ করছে। অদ্ভুত রকমের প্রদর্শনবাদিতা আচ্ছন্ন করে ফেলেছে আমাদের। 

তাহলে বিনোদন আসলে কোথায়? উপভোগে, নাকি প্রদর্শনে? আমি নিজে আনন্দ পেতে চাই, নাকি অন্যকে দেখাতে চাই যে আমি আনন্দ পাচ্ছি? এই আনন্দ কি অপরের মুখ ম্লান করে দেওয়ার আনন্দ? অপরের ঘুম হারাম করে দেওয়ার আনন্দ? কাদের দেখানোর জন্য আমরা এমন মরিয়া হয়ে বিনোদনের ‘সোনার হরিণ’ খুঁজে বেড়াচ্ছি?