এক নারীর গল্প

অলংকরণ: আরাফাত করিম

প্রথম অংশ

কবর হলো পরের বুধবার। আমি আমার দুই ছেলে, সাবেক স্বামীসহ হাসপাতালে পৌঁছালাম। মর্গটা আলাদাভাবে চিহ্নিত ছিল না বলে খানিকটা হারিয়ে গিয়েছিলাম। তারপর দেখতে পেলাম মাঠের কোণ ঘেঁষে কংক্রিটের নিচু একটা দালান। সাদা কোট গায়ে একজন কর্মচারী ফোনে কথা বলছিল। সে ইশারায় আমাদের বলল করিডরে বসতে। টয়লেটের উল্টা পাশে দেয়াল ঘেঁষে সারিবাঁধা চেয়ারগুলোতে বসলাম আমরা।

দরজাটা কেউ খুলে রেখেছিল। আমি চাইছিলাম মাকে আরেকবার দেখতে, তার বুকের ওপরে আমার সঙ্গে আনা ক্যামেলিয়া ফুলের ডাঁটি দুটো রেখে দিতে। কফিনের ডালা বন্ধ করার আগে আরেকবার ওরা মাকে দেখতে দেবে কি না, আমরা বুঝতে পারছিলাম না। আন্ডারটেকারের যে অধস্তনকে কিছুক্ষণ আগে দোকানে দেখেছিলাম, সে বেরিয়ে এল সংলগ্ন একটা ঘর থেকে আর খুব বিনীতভাবে আমাদের বলল তাকে অনুসরণ করতে। আমার মা শুয়ে ছিল কফিনে, তার মাথা পেছনে হেলানো, ক্রুশটা ধরা ছিল জড়ো করা হাতের মুঠিতে। আগের দেখা সাদা পট্টি খুলে নিয়ে মাকে পরানো হয়েছে বর্ডারে কারুকাজ করা সেই রাতপোশাক, যা সে তার নিজের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার জন্য কিনেছিল। সাটিনের কাফনে তার বুক পর্যন্ত ঢাকা ছিল। কফিনটা ছিল কংক্রিটের দেয়ালওয়ালা বড় একটা ফাঁকা ঘরে। জানি না নরম আলোটা কোত্থেকে আসছিল।

সেই সহকারী এসে জানাল, দেখার সময় শেষ হয়েছে। আমাদের সে করিডরে ফিরিয়ে নিয়ে গেল। আমার মনে হলো, তারা যে তাদের কর্তব্যগুলো সন্তোষজনকভাবে পালন করেছে, শুধু সেটুকু বোঝাতেই আমাদের সে মাকে দেখাতে নিয়ে গিয়েছিল।

আমরা শহরের নতুন দিকটায় গাড়ি চালিয়ে গির্জা পর্যন্ত গেলাম, যা নির্মিত হয়েছে কলাভবনের পাশে। শবযান তখনো না পৌঁছানোয় আমরা গির্জার সামনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করলাম। রাস্তার উল্টা দিকে বাজারের সদর দরজায় আলকাতরা দিয়ে কেউ লিখে রেখেছে, ‘টাকা, ভোগ্যপণ্য এবং রাষ্ট্র হলো বর্ণবাদের তিন স্তম্ভ।’ এক ধর্মযাজক সামনে এসে দাঁড়ালেন। সহানুভূতিশীল স্বরে জানতে চাইলেন, ‘উনি কি আপনার মা ছিলেন?’ আমার ছেলেদের কাছে জানতে চাইলেন, তারা কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে যাচ্ছে, কী পড়ছে।

লাল মখমল বিছানো অদ্ভুত দেখতে ছোট একটা খাটিয়া বেদির নিরাভরণ সিমেন্টের ওপরে রাখা হয়েছে। সৎকারকারীরা পৌঁছালে আমার মায়ের কফিনটা ওই বিছানার ওপরে রাখা হলো। ধর্মযাজক টেপ রেকর্ডার চালু করলেন, যেখানে অর্গান বাজছিল। শুধু আমরাই ছিলাম সেখানে। এদিকের কেউই আমার মাকে চিনত না। যাজক প্রার্থনাসংগীত গাইলেন, বললেন ‘চিরন্তন জীবন’ আর ‘ধর্মবোনের পুনরুত্থান’-এর কথা। আমি চাইছিলাম অনুষ্ঠানটা চলতেই থাকুক, মায়ের জন্য আরও কিছু করা হোক; চাইছিলাম আমি আরও গান, আরও আনুষ্ঠানিকতা। অর্গানের বাজনা আবার বেজে উঠল, কফিনের দুই পাশের মোমবাতি দুটো নিভিয়ে দিলেন যাজক।

অনুষ্ঠান শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে শবযাত্রা রওনা দিল ইভতুর দিকে, নর্মান্ডিতে, যেখানে বাবার পাশে মায়ের কবর হবে। আমি গেলাম আমার ছেলেদের নিয়ে নিজেদের গাড়িতে। সারাটা রাস্তা বৃষ্টি হলো, বাইরে তীব্র দমকা বাতাস। ছেলেরা অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সম্পর্কে জানতে চাইছিল আমার কাছে; কারণ, এটাই তাদের প্রথম অভিজ্ঞতা। তাদের কী করতে হবে, তা তারা বুঝতে পারছিল না।

ইভতুতে কবরস্থানের সামনে পরিবারের সবাই এসে জড়ো হয়েছিল। দূরে দাঁড়িয়ে সেদিকে আমাদের এগিয়ে যাওয়া দেখতে থাকার বিব্রতকর অনুভূতি চাপা দেওয়ার জন্য এক কাজিন চিৎকার করে আমাকে বলল, ‘আবহাওয়ার অবস্থাটা দেখছ, যেন এখন নভেম্বর!’ বাবার কবরের দিকে একসঙ্গে হেঁটে গেলাম সবাই। বাবার কবরের পাশে সদ্য খোঁড়া কবরটা খোলা পড়ে ছিল, এক পাশে হলুদ মাটির স্তূপ। মায়ের কফিনটা আনা হলো সামনে। যখন কবরে নামানো হলো, তখন যে লোকটা দড়ি ধরে ছিল, সে আমাকে সামনে এগিয়ে দাঁড়াতে বলল, যেন কবরে ঢুকে যেতে থাকা কফিনটাকে দেখতে পাই। খানিক দূরে গোরখোদক অপেক্ষা করছিল তার কোদাল নিয়ে। তার গায়ের রঙে রক্তিমাভা ছিল, একটা নীল ওভারঅল ছিল পরনে, মাথায় বেরেট, পায়ে বুট। ইচ্ছা করছিল এগিয়ে গিয়ে তার হাতে ১০০টা ফ্রাঙ্ক দিই, টাকাটা দিয়ে হয়তো সে মদ খাবে। আমার মায়ের সর্বশেষ যত্নটুকু তো সে-ই করবে, সারা দুপুর ধরে তাকে মাটি দিয়ে ঢাকবে। কাজটা না হয় সে উপভোগই করুক, কোনো ক্ষতি নেই তাতে। আত্মীয়স্বজন সবাই জোরাজুরি করল যেন ফিরে আসার আগে কিছু খাই। আমার খালা একটা রেস্তোরাঁয় সবার মধ্যাহ্নভোজনের ব্যবস্থা করেছে সৎকারের পরে। আমি থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। মনে হলো, মায়ের জন্য এখনো অন্তত এইটুকু করতে পারি। খাবার দিতে দেরি হচ্ছিল, আমরা আমাদের কাজ আর বাচ্চাদের নিয়ে কথা বলছিলাম। মাঝেমধ্যে মায়ের কথাও উঠছিল। আমাকে তারা বলছিল, ‘এ রকমভাবে তোমার মা বেঁচে থাকলেও কী হতো?’ ওরা সবাই মনে করছিল, মা মরে যাওয়াতেই ভালো হয়েছে। কেন যে পরম নিশ্চয়তার সঙ্গে এমন বিবৃতি দেওয়া হয়, তা কখনোই আমার বোধগম্য হয় না। বিকেলে ফিরে এলাম। সত্যিই সবকিছু ফুরিয়ে গেল।

দ্বিতীয় অংশ

আমার মায়ের উগ্র মেজাজের কথা যখন ভাবি, স্নেহের বিস্ফোরণ অথবা বকাঝকার তুফান—তার ব্যক্তিত্বের অংশ হিসেবে বিষয়গুলোকে না দেখে তার নিজের গল্প এবং সামাজিক পটভূমির সঙ্গে মেলাতে চেষ্টা করি। এ রকমভাবে লিখলে হয়তো আমি সত্যের একটু বেশি কাছাকাছি যেতে পারি—এই নৈর্ব্যক্তিক দৃষ্টিভঙ্গি আমাকে ব্যক্তিগত স্মৃতিচারণার অন্ধকার এবং ভারী বোঝা বহন করার হাত থেকে মুক্তি দেয়। অথচ আমার মনের গভীরের এক সত্তা কিছুতেই তা মানতে চায় না, সে কোনো রকম ব্যাখ্যা চায় না, শুধু অনুভূতি, মমতা আর অশ্রুতে মাকে স্মরণ করতে চায়।

সে ছিল একজন কর্মজীবী মা, অর্থাৎ তার প্রথম কর্তব্য ছিল গ্রাহকদের প্রতি, যারা আমাদের জীবিকার উৎস। দোকানে কাজ করার সময় মাকে বিরক্ত করার অনুমতি ছিল না (রান্নাঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে এমব্রয়ডারি করার জন্য এক টুকরা রেশমের কাপড় অথবা খেলতে যাওয়ার অনুমতির জন্য অপেক্ষা ইত্যাদি অনেক কথা মনে করতে পারি)। যদি খুব বেশি গোলমাল করতাম, সে দুম করে ঘরে ঢুকে ঠাস ঠাস করে আমার গালে চড় দিয়ে বিনা বাক্যে কাউন্টারে ফিরে যেত। ছোটবেলা থেকেই শিখেছিলাম গ্রাহকদের সঙ্গ কেমন ব্যবহার করতে হবে, ‘সুন্দর স্পষ্ট গলায় হ্যালো বলবা’, ‘তাদের সামনে কিছু খাওয়া বা ঝগড়া করা যাবে না’, ‘কারও সম্পর্কে খারাপ কিছু বলা যাবে না’। তাদের বিষয়ে সন্দিহান হতেও শেখানো হয়েছিল আমাকে, ‘ওদের কথা কখনো বিশ্বাস কোরো না’, ‘দোকানে আর কেউ না থাকলে ওদের ওপর নজর রেখো’। মায়ের দুই ধরনের অভিব্যক্তি ছিল, একটা গ্রাহকদের জন্য, আরেকটা আমাদের জন্য। দোকানের ঘণ্টা বাজলে সে ভেতরে গিয়ে তার চরিত্রে অভিনয় করত—হাসিতে মুখ উদ্ভাসিত, ধৈর্যের পরাকাষ্ঠা, গ্রাহকদের স্বাস্থ্য, ছেলে-মেয়ে অথবা বাগান সম্পর্কে নিয়মমাফিক খোঁজখবর করে যখন রান্নাঘরে ফিরে ধপ করে বসে পড়ত, তখন মুখের হাসিটাও মিলিয়ে যেত। অভিনয়ের ক্লান্তিতে কিছুক্ষণ নীরব থাকত। যে গ্রাহকদের জন্য সে এত পরিশ্রম করে, ‘আরও সস্তা দোকান পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই’ তারা আর আসবে না, এ ধারণা একই সঙ্গে তাকে উত্তেজিত ও বিষণ্ন করত।

তৃতীয় অংশ

ছিল অর্থনৈতিক সংকটের কালো বছরগুলো, ধর্মঘট, লিওন ব্লুম (শ্রমিকদের পক্ষে দাঁড়ানো প্রথম মানুষ), সমাজ-সংস্কার আর ক্যাফেতে গভীর রাতের পার্টি। আত্মীয়স্বজনের আসা-যাওয়া, তারা ঘরে ঘরে গদি পেতে ঘুমাত আর ফেরার সময় বোঁচকা বেঁধে বিভিন্ন রসদ নিয়ে যেত (মা তো দিলখোলা মানুষ ছিল আর তা ছাড়া পরিবারে একমাত্র মা-ই ছিল অর্থনৈতিকভাবে সফল)। শ্বশুরবাড়ির পরিবারের সঙ্গে তার ঝগড়াঝাঁটিও ছিল।

তারপর তাদের সংসারে নেমে এল শোক। তাদের শিশুকন্যাটি ছিল হাসিখুশি, চঞ্চল। একটা ছবিতে তাকে বয়সের তুলনায় লম্বা দেখাচ্ছে—চর্মসার পা আর গাঁট বের হয়ে যাওয়া হাঁটু। সে হাসছে, সূর্যের আলো থেকে চোখ আড়াল করতে একটা হাত কপালে তুলে। আরেকটা ছবি এক কাজিনের হস্তার্পণের অনুষ্ঠানে। যদিও মুখের ভাব গম্ভীর, হাতের আঙুল সামনে ছড়িয়ে খেলছে। ১৯৩৮ সালে ইস্টারের তিন দিন আগে সে মারা গেছে। মা–বাবা একটাই সন্তান চেয়েছিল, তাদের মনে হতো, একা থাকলেই বাচ্চাটা বেশি ভালো থাকবে।

সেই বিষাদের ওপরে ধীরে টানা হয়েছে আবরণ। অবসাদের অনমনীয় নীরবতা। ছিল প্রার্থনা আর বিশ্বাস যে তাদের ছোট্ট মেয়েটা বেহেশতে গিয়েছে। আর তারপর, ১৯৪০-এর শুরুর দিকে, নতুন জীবন। মা দ্বিতীয়বার সন্তানসম্ভবা হলো। সেপ্টেম্বরে আমি জন্মাব।

আমার মনে হয়, এবার আমার পালা মাকে দুনিয়াতে আনার, তাই তাকে নিয়ে লিখছি।

এই বই লেখা শুরু করেছি দুই মাস হয়ে গেল। একটা সাদা কাগজে লিখেছিলাম, ‘সোমবার, এপ্রিলের ৭ তারিখে আমার মা মারা গেছে।’ এখন এই বাক্যটা আমি মেনে নিতে পারি। লেখাটা অন্য কেউ লিখলে যে অনুভূতি হতো, ঠিক সে রকমই লাগে আমার। তবে হাসপাতাল আর বৃদ্ধাশ্রমের আশপাশে আমি যেতে পারি না অথবা তার জীবনের শেষ দিনটা হঠাৎ মনে পড়ে গেলে সহ্য হয় না। প্রথমে ভেবেছিলাম হয়তো লেখাটা সহজেই লিখতে পারব। আসলে কোন শব্দের পর কোনটা বসবে, কোন ঘটনা কখন বলব—এসব নিয়ে ভাবতে ভাবতেই অনেকখানি সময় পার হয়, যখন আমি লিখি, তখন একটা নির্দিষ্ট ক্রম খুঁজে পাওয়াটাই আমার কাছে একমাত্র বিষয়। যেন শুধু এক অপরিবর্তনীয় বিন্যাসই আমার মা সম্পর্কে সারকথাটা প্রকাশ করবে (অথচ কী সেই সারকথা, আমি জানি না)।

অনুবাদ প্রসঙ্গে

১৯৮৬ সালে মৃত্যুর আগে আনি এরনোর মা দুই বছর বার্ধক্যজনিত ডিমেনশিয়ায় ভুগেছেন। মায়ের অসুস্থতার সময় তাঁকে নিয়ে একটা বই লিখতে শুরু করেছিলেন এরনো। তবে মা মারা যাওয়ার পর সেই পাণ্ডুলিপি ছিঁড়ে ফেলেছিলেন, যা বহু বছর পর নতুনভাবে প্রকাশিত হয়েছে আই রিমেইন ইন ডার্কনেস নামে।

আ ওমেনস স্টোরি নামের উপাখ্যানটি তিনি লিখতে শুরু করেন তাঁর মায়ের মৃত্যুর কয়েক সপ্তাহ পর, যখন তিনি কিছুতেই এই বিষাদ কাটিয়ে উঠতে পারছিলেন না। মায়ের সঙ্গে এরনোর সম্পর্কে একরৈখিক ছিল না কিছুতেই—দুজনের ব্যক্তিত্ব, বিশ্বাস, জীবনবোধ প্রায় বিপরীতধর্মী। বইয়ের এক জায়গায় তিনি লিখেছেন, তাঁদের দেখলে মনে হতেই পারে, তাঁরা সারা দিন ঝগড়া করেন, অথচ পৃথিবীর যেকোনো জায়গায় মা-মেয়ের সম্পর্ক এ রকমই।

এখানে আ ওমেনস স্টোরি থেকে তিনটি আলাদা অংশের অনুবাদ রয়েছে, যা পাঠককে বইটি সম্পর্কে কিছুটা ধারণা দেবে। প্রথম অংশে আছে এরনোর মায়ের দাফনের বর্ণনা। দ্বিতীয় অংশে তাঁর ছোটবেলার স্মৃতি এবং মাকে কীভাবে উপস্থাপন করলে সত্যের কাছাকাছি যাওয়া যাবে, এ নিয়ে ভাবনা আর শেষ অংশে তিনি নিজের জন্মের কথা লিখতে লিখতে এক জায়গায় লিখেছেন, ‘আমার মনে হয়, এবার আমার পালা মাকে দুনিয়াতে আনার, তাই তাকে নিয়ে লিখছি।’

নিজের জীবনের নানা কাহিনি বিভিন্ন বইয়ে লিখেছেন আনি এরনো। এসব লেখায় তাঁর মা, আত্মীয়-পরিজন তথা মানুষকে তিনি কেবল মমতা ও সহানুভূতির আলোয় দেখতে চাননি, দেখেছেন নৈর্ব্যক্তিকভাবে, ভালো-মন্দের মিশেলে। ১৯৮৬ সালে প্রকাশিত আ ওমেনস স্টোরিও এর ব্যতিক্রম নয়। এ উপাখ্যানের অনূদিত তিনটি অংশে সেই চিহ্নই পাওয়া যাবে।