প্রিয়র গলিতে দুই গজ জমিন না পাওয়া সম্রাট

বাহাদুর শাহ জাফরের গজল

১৯৪৪ সালের ১১ জুলাই। রেঙ্গুনে সুভাষচন্দ্র বসুর আজাদ হিন্দ ফৌজের যোদ্ধারা কুচকাওয়াজে গাইলেন একটি গজল। সেই গজলটির দুটি লাইন হলো ‘কিতনা হ্যায় বদনসিব জাফর দাফন কে লিয়ে/ দো গজ জমিন ভি না মিলি কুয়ে যার মেঁ।’ উর্দু থেকে যার অনুবাদ দাঁড়ায়, ‘কতটা হতভাগ্য জাফর সমাধি নেবে বলে/ দুই গজ জমিনও পেল না প্রিয়র গলিতে’।

প্রিয়র গলিতে নিজের সমাধির জন্য দুই গজ জমিন না পাওয়ার এই আক্ষেপ ভারতের শেষ মোগল সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফরের। মূল উর্দু থেকে তাঁর গজলগুলো সম্প্রতি বাংলাভাষী পাঠকের সামনে নিয়ে এসেছেন জাভেদ হুসেন, বাহাদুর শাহ জাফরের গজল নামে বইটির মাধ্যমে।

ফারসি, উর্দু আর আওধি ভাষার কবি ও সুফিসাধক মির্জা আবু জাফর সিরাজউদ্দিন মুহাম্মদ ঘটনাক্রমে সম্রাট হয়েছিলেন। দিল্লির রেসিডেন্টকে আক্রমণ করায় মির্জা জাহাঙ্গীর বখতকে যেতে হয়েছিল নির্বাসনে, আর জাফরকে টেনে এনেছিল এক যুগসন্ধিক্ষণের ইতিহাসে। সম্রাট হওয়ার পর তাঁর নামের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল বাহাদুর শাহ। কিন্তু এমন এক সময়ে তিনি সম্রাট হলেন, যখন মহাপরাক্রমী মোগল সাম্রাজ্য আটকে পড়েছে দিল্লির দেয়ালঘেরা সীমানার মধ্যে। ইংরেজদের বেঁধে দেওয়া মাসোহারায় চলত সম্রাটের জীবনযাপন। উপনিবেশ প্রতিষ্ঠা করতে আসা ব্রিটিশদের বিপুল শক্তি সম্পর্কে ভালোভাবেই জানতেন বাহাদুর শাহ জাফর। তবু ৮২ বছর বয়সেও ভারতবর্ষকে মুক্ত করার আহ্বানে ইংরেজদের শৃঙ্খল ভাঙতে পিছপা হননি তিনি। ইতিহাসের সেই ক্রান্তিকালে এই বাহাদুর শাহ হয়ে উঠেছিলেন হিন্দু–মুসলমাননির্বিশেষে উপমহাদেশের প্রথম স্বাধীনতাসংগ্রামের প্রতীক।

বাহাদুর শাহ জাফরকে কেন্দ্র করে উর্দু কবিতা স্বর্ণযুগে পৌঁছেছিল। তাঁর সময়ের অন্যতম সেরা কবি জাফর দিল্লির রাজপ্রাসাদের দিওয়ানে খাসে আয়োজন করতেন কবিসভার। স্বাধীনতাসংগ্রাম স্তিমিত হওয়ার পর সেই দিওয়ানে খাসে ইংরেজরা মিলিটারি কমিশন বসিয়ে বিদ্রোহ, ষড়যন্ত্র ও হত্যার দায়ে দোষী সাব্যস্ত করে জাফরকে। তাঁকে বার্মার (এখন মিয়ানমার) রেঙ্গুনে নির্বাসনে পাঠানো হয়। নিঃসঙ্গ অবস্থায় এখানেই তাঁর মৃত্যু হয়। ইংরেজরা তাঁর কবরের চিহ্ন নিশ্চিহ্ন করে দিতে সব আয়োজনই করেছিল। রাজপ্রাসাদের সম্রাট থেকে জনতার সম্রাট হয়ে পুনর্জন্ম পাওয়া বাহাদুর শাহ জাফরের চিহ্ন মুছে ফেলার সেই প্রচেষ্টা একেবারেই সফল হয়নি। মুখে মুখে ফেরা তাঁর কবিতা যুগপৎ প্রেম ও বিদ্রোহের স্মারক হয়ে উঠেছে। 

বাহাদুর শাহ জাফর সুফি কবি। আর সব মরমি কবির মতো তাঁর কবিতায় নিজের সঙ্গে প্রেমাস্পদের কিংবা জীবসত্তার সঙ্গে পরমসত্তার মিলনের আকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত হয়েছে। কিন্তু তিনি যখন শেষ জীবনে জনতার সম্রাট হয়ে উঠছেন কবিতায় সেই মরমি জগৎ ভেঙে পড়ছে।

প্রথম স্বাধীনতাসংগ্রামের ঢেউ স্তিমিত হয়ে যাওয়ার পর দিল্লিজুড়ে নৃশংস গণহত্যা শুরু করে ইংরেজরা। অবর্ণনীয় সেই নিষ্ঠুরতা ধরা পড়েছে মির্জা গালিবের বয়ানে, দিল্লির ধুলো যেন তার বাসিন্দাদের রক্তের জন্য তৃষ্ণার্ত হয়ে ছিল। নিষ্ঠুর সেই অন্ধকার সময়কে নিয়ে বন্দী সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফর তাঁর গজলে লিখলেন: ‘ভাগ্যের হাওয়া নিমেষে পাল্টে গেল, আমার হৃদয় অশান্ত/ বেদনায় আর্ত আমার বুক, সেই নির্দয়তার কথা কী বলব আমি/ হিন্দুস্তানের বাসিন্দাদের সর্বনাশ হলো, কী সইল তারা কী করে বলি/ নতুন শাসকেরা যাকেই দেখে বলে একেও ফাঁসিতে চড়াও।’

অনুবাদক জাভেদ হুসেন উর্দু, ফারসি, আরবি ও হিন্দুস্তানি ভাষার সাহিত্যের সঙ্গে বাংলাভাষী পাঠকের সেতুবন্ধ গড়ে দেওয়ার পরিশ্রমসাধ্য কাজটি নিরলসভাবেই করে আসছেন। উৎস ভাষা থেকে মনসুর হাল্লাজ, মির তকি মির, মির্জা গালিব, কবীর দাশ, মুহাম্মদ ইকবাল, ফয়েজ আহমেদ ফয়েজ অনুবাদ করেছেন।

আলোচ্য বইটিতে জাভেদ হুসেন একটি নাতিদীর্ঘ ভূমিকা দিয়েছেন। বাহাদুর শাহ জাফরের সময় ও ব্যক্তি জাফর সম্পর্কে স্পষ্ট একটি ধারণা পাওয়া যাবে ভূমিকাটিতে। মূল গজলে প্রবেশের ক্ষেত্রে পাঠকের সঙ্গে এটি সেতুবন্ধ স্থাপনেও সহায়তা করবে।

বাহাদুর শাহ জাফরের গজল

উর্দু থেকে অনুবাদ: জাভেদ হুসেন

প্রকাশক: প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা

প্রকাশকাল: ফেব্রুয়ারি ২০২২

প্রচ্ছদ: আরাফাত করিম

১৬০ পৃষ্ঠা, দাম: ২৮০ টাকা।

বইটি পাওয়া যাচ্ছে : prothoma.com এবং মানসম্মত বইয়ের দোকানে।