আবছায়া

অফিস থেকে বেরিয়ে যাচ্ছিলাম দ্রুত; তখনই রিসেপশনিস্টের ডাক, স্যার, একটা পার্সেল আছে!

পার্সেলটা বেশ একটা বাহারি খামের—সোনালি রং দিয়ে খামটার চারপাশে খুদে খুদে ছবি আঁকা। এ জিনিস কে পাঠাল?

তবে প্রশ্নটা থাকে ও পর্যন্তই। খামটা খুলে দেখার আগেই সুমনের ফোন, ‘বস, কই আপনে?’

খাম পকেটে চালান।

ফার্মগেটের এদিকটায় একটা ভাঙাচোরা বার আছে। দিনের বেলায়ও অন্ধকার আর মশা থাকে। সুমন, কী জানি কেন, জায়গাটা পছন্দ করে খুব। অন্ধকারে বসে থাকে ঘাপটি মেরে। কিছুক্ষণ পরপর হাসে। আমাকে দেখতেই গ্লাস এগিয়ে দেয়, ‘খান!’

আমি খাই, তবে ভয়ে ভয়ে। সুমন বলে, কী বসস…জিনিসটা হেবি না?

সুমনের মন কোনো কারণে ফুরফুরা! তাল দেওয়ার জন্য বলি, হ্যাঁ হেবি!

আপনে শালা বুড়া হয়া যাইতেছেন!

বয়স হলে মানুষ বুড়াই তো হয়!

কত? ৪০ পার করছেন না? এই বয়সে এই শহরেই মানুষজন কী কইরা বেড়াইতেছে জানেন?

চোখে চশমা উঠতেছে সবার, আর কী?

বস, আপনেরে একটা কথা কই, মনে মনে বুড়া হইয়া যাইয়েন না! সব ব্যবস্থা আমি কইরা দিব! আপনের যা দরকার, তা হইল একটা সঙ্গিনী. . . হিহিহি!

বদলায় কী করতে হবে, আরেকটা লোন?

সুমন হাসে। গ্লাস ভরে দেয়। মদটা আর পেটে যায় না। হাত চলে যায় খামে। কী আসছে এটায়?

দুই.

সাড়ে দশটা বেজে যায় বাসায় পৌঁছাতে পৌঁছাতে। মিলি দরজা খুলে দেয় বটে; কিন্তু তাকায় না একবারও। মদ খেয়ে ফিরলে এমনটাই করে। মদ যে খেয়েছি, এটাও আগে থেকে বুঝে যায় কীভাবে কীভাবে। অথচ আমি মাতাল হই না, স্পষ্টই তাকাতে পারি মানুষের দিকে, কথা বলতে পারি, ৮১১ থেকে ৪০২ বাদ দিতে পারি আরামসে...এসব সে গ্রাহ্যই করে না।

খাবার টেবিলেই থাকে সব সময়, আজও ছিল; আমি খাই।

ছেলেটা ঘুমিয়ে গেছে। জেগে থাকলেও এখন কাছে আসত না। শুধু মিলি না, মিতুলও বোঝে আজ আমার কাছে আসা যাবে না। ছেলেটা মায়ের কপি হয়ে যাচ্ছে!

বারান্দাটা ভালো। ভালো মানে, জায়গা আছে কিছুটা। বসে সিগারেট খেতে খেতে জীবন নিয়ে ভাবার বাতুলতা করা যায়। তবে আমার অত অভ্যাস নেই। কষে কয়েকটা টান মেরে থম মেরে বসে থাকতেই আমার সুখ। আব্বা বলেছিল এখানে দাঁড়িয়ে, ‘তোর ভাবার জন্য ভালো জায়গা হয়েছে এইটা, না?’

আব্বা ভেবেছে আমাকে এখনো ভাবতে হয়।

বয়স যখন কম, তখন ভাবতে দেখেছিলেন তো! মানে এই বই পড়ছি, এই ভাবছি। ছাদে ভাবছি, ঘরে ভাবছি, বারান্দায় ভাবছি। সবাই ভেবেছিল, বিরাট কবিটবি হয়ে যাব। সবার কী দোষ, আমিও তো তা–ই ভেবেছিলাম। পরে দেখলাম, ওই সব ফক্কা! কবিতা ভাবার চাইতে ফালতু জিনিস কিছু নেই।

কিন্তু আব্বা ছিলেন কবিতার লোক। নজরুল পড়ে পড়ে ঠোঁটের ওপর উল্টে ফেলেছিলেন। জীবনানন্দ দাশও, ‘বাঁশপাতা—মরা ঘাস—আকাশের তারা; /বরফের মতো চাঁদ ঢালিছে ফোয়ারা’।

খুব জোরে জোরে আব্বা পড়তেন। বলতাম, এই কবিতা তো এত জোরের না!

আব্বা হাসতেন, ‘ওই সব তোরা বুঝিস। যারা লেখিস।’

পরে আর লিখিনি। একটা চাকরি হলো ব্যাংকে। চাকরি করলে চাকরিটুকুই করতে হয়—এই বিশ্বাস হলো তারও দুই বছর পর। এরই মধ্যে বিয়ে। বিয়েটা ভাগ্যিস হলো, নাহলে জানতেই পারতাম না, প্রেম একটা দুই চাক্কার সাইকেল!

তিন.

বারান্দার আলো ঘোলা। খামটা তাতে আরও ঘোলা হয়ে চোখের সামনে। আজব সুন্দর রং। খুলতেই ভেতরে সাদা পাতা। তাতে খুব ছোট ছোট করে লেখা আরও আজব কথা, ‘আমার একটা ছায়া ছিল, অবশ্য সবারই থাকে। কিন্তু জানেন, ছায়াটা হারিয়ে গেছে। কবে হারিয়েছে বুঝতে পারিনি। কত দিন ধরে যে খুঁজছি, কিছুতেই পাচ্ছি না। দয়া করে আপনি কি আমার ছায়াটাকে খুঁজে দেবেন?’

চার.

আজ অফিসের মিটিং, বোরিংয়ের চূড়ান্ত। মিশন-ভিশন বোঝাতে বোঝাতে ফেনা তুলে দিচ্ছেন একেকজন। আমার মাথার মধ্যে কালকের ওই লাইনগুলো। কার ছায়া নেই, কাকেই–বা সাহায্য করতে হবে? পুরাই হুদাই একটা ব্যাপার।

রসিকতাই যে করেছে কেউ—এ কথা বুঝতে অসুবিধা হয় না। সত্যি সত্যি কারও সাহায্যের দরকার হলে হলফ করে নিজের নাম-ঠিকানা উল্লেখ করত। পাশে রাখত ফোন নম্বর। অবশ্য তার চেয়ে বড় কথা—ছায়া কি আর হারিয়ে যেতে পারে কারও? আলো যেমন সত্য, ছায়াও তো সত্য!

সত্য না?

বন্ধুবান্ধবের মধ্যে এ রকম রসিকতা করার সুযোগ আছে নিশ্চয়ই। হিমেল কি এমন কাজ করতে পারে? কিন্তু হিমেলের এমন বুদ্ধি-শুদ্ধি আবার কবে হলো? ওর ইচ্ছা ছিল কোটিপতি হওয়ার এবং এখন তো অন্তত লাখপতি হয়েছেই। সে খাম কিনে তাতে ছবি এঁকে, লিখে রসিকতা করবে—এতটা আশা করা যায় না। শেষবার যখন ওর সঙ্গে দেখা হয়েছিল, সে–ও তো বছর তিনেক আগে, গুলশানে। একটা গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছিল। সঙ্গে থাই কোনো ভদ্রলোক। আমাকে দেখতেই তাড়াতাড়ি বলে উঠল, ‘বিজনেসের কাজে আছি বন্ধু, পরে কথা হবে!’

আমিও চাকরির কাজেই তো ছিলাম, হাঁপ ছেড়ে বলেছিলাম, ঠিক আছে ঠিক আছে!

পরে আর কথা হয়নি, অনেক দিন।

এদিকে নিলয় তো কানাডায়। কাজ করছে শপিংমলে। গাড়িও কিনে ফেলেছে। বাড়ি কিনতে পারছে না বলে জানিয়েছে। কী সব নতুন নিয়ম-কানুন নাকি করেছে কানাডা। তাতেই চাপে পড়েছে একটু। এসব শুনতে ভালো লাগে না। হোয়াটসঅ্যাপে ফোন দিয়েছিল, ধরিনি। ও নিশ্চয় এত কাব্য করা কিছু পাঠাবে না আমাকে। তাহলে বাকি থাকল যে, সে পাতা!

আমরা তাকে বলতাম, লতা-পাতা-ঘাস... ধরণির একলা সর্বনাশ!

পাঁচ.

পাতার সঙ্গে আমার প্রেম হতে পারত।

বন্ধু তো ছিলামই আমরা। কিন্তু আমাদের মধ্যে বন্ধুত্বের চেয়ে ছিল বেশি কিছু। ও রকম কৈশোরমাখা তরুণ বয়সে যা থাকে আরকি! কলেজ শেষ হলেও আমাদের গল্প ফুরাত না। হিমেল, নিলয় বাড়ি চলে যেত, আমরা থাকতাম নদীর পাড়ে। মফস্‌সলি আমাদের ভাগ্য এত ভালো ছিল যে একটা নদী আর চারটে ব্রিজ ছিল দুজনের জন্য। আমরা কখনো নদীর পাড়ে, কখনো ব্রিজের ওপর বসে গল্প করতাম। কী যে এত কথা বলতাম, কে জানে! কত সূর্য যে আমরা পুনর্ভবায় ডুবে যেতে দেখেছি তার ইয়ত্তা নেই।

তবে পুনর্ভবায় শুধু সূর্যই যে ডুবেছে, তা তো না। পাতাও ডুবেছিল। ডুবেছিল মিনহাজ ভাইয়ের হাত ধরে। তারপর তারা কোথায় উঠে ডাঙা পেল, কোথায় পেল বসতি—তা আর কেউ বলতে পারেনি। কেউ কেউ বলেছিল ওরা নাকি ইন্ডিয়ায় চলে গেছে পালিয়ে। ইন্ডিয়া বলতে তখন মাধুরী দীক্ষিত ছিল আমার কাছে; এরপর মাধুরীর কোনো ছবি আমি আর দেখিনি।

ইন্ডিয়া থেকে দেশে ফিরে পাতা আমাকে এমন একটা চিঠি লিখেছে, ভরপেট নেশা করে থাকলেও আমার তা বিশ্বাস হবে না। এমন চিঠি লিখে সাহায্য চাইতে পারে, তেমন কোনো বন্ধু যে আসলে আমার নেই, বুঝতে একটু সময়ই লেগে যায়!

ছয়.

বিকেলের দিকে মিলির ফোন আসে, ‘তোমার প্যান্টের পকেটে এইটা কী?’

কী?

চিঠি। এত বাহারি চিঠি কে তোমাকে দিয়েছে?

জানার চেষ্টা করছি।

ভড়ং করবা না আমার সাথে। প্রেম করতেছ তুমি?

চিঠিটা পড়ে দেখছ? একজন সাহায্য চাইতেছে আমার কাছে!

তোমার চিঠি আমি পড়তে যাব কেন?

সাত.

বারান্দার সন্ধ্যা মোচড় দিয়ে রাতের ভেতর নাক গুঁজেছে। শেষ সিগারেট চলছে। মিলি আর মিতুলের কথোপকথনের শব্দ ভেসে আসছে। মিতুল কিছু নিয়ে বায়না করছে, মিলি সেটাকে নানা মিষ্টি কথায় প্রতিহত করছে। আশ্চর্য লাগে ওদের ভাষা, অজানাও লাগে এবং একটু মিষ্টিও।

আট

অফিসের জন্য বেরিয়ে যাচ্ছিলাম। মিলি আমাকে একটা প্যাড বের করে দেয়। তাকিয়ে থাকি কিছুক্ষণ। মিলি বলে, ‘চিনতে পারছ না?’

না।

তোমার কাছে আসা চিঠিটার প্যাড কি এটারই না? মিলিয়ে দেখো।

মিলিয়ে দেখার দরকার ছিল না। মিলি বলতেই মনে হলো, আসলে দুটো প্যাড একই। মিলি তবু মিলিয়ে নিল। এসব করতে তার ভালো লাগে।

নিজেকেই নিজে চিঠি লিখতে কেমন লাগল তোমার?

এই প্যাড কি আমি কিনছিলাম?

নিজের হাতের লেখাও ভুলে গেছ?

কিন্তু এই প্যাড আমি কখন কিনলাম?

কী বুঝাইতে চাও তুমি? তুমি খুব একলা? এত একলা যে তোমার ছায়াটাও তোমারে ছাইড়া গেছেগা?

বেরিয়ে যাই। গলিপথে দেখি আমার একটা ছায়া, এখনো আমার সঙ্গেই আছে। আমার ছায়া থাকবে না কেন?

নয়.

বারান্দা। সিগারেট। রাত। মিতুল আসে।

বাবা তুমি সিগি খাচ্ছ?

হুম। যাও।

বাবা তুমি অ্যাংরি হয়ে আছ?

না। যাও।

বাবা, ওই প্যাডটা কিন্তু মামণি কিনছে। আমার জন্য পেনসিলও কিনছে। তুমি কি আমার ড্রয়িইং দেখবে?

মিতুল ড্রইংখাতা নিয়ে আসে। সেখানে সে আমাদের এঁকেছে। আমরা তিনজন দাঁড়ানো আছি রাস্তার ওপর। এক পাশে বিল্ডিং, অন্য পাশে সূর্য। আশ্চর্য, আমাদের কারও কোনো ছায়া নেই! আমরা তিনজন একলা একলা দাঁড়িয়ে আছি।