মেয়ে হারানোর বেদনা ভুলতে ‘মৈমনসিংহ গীতিকা’ নিয়ে সংকলন প্রকাশ করলেন যিনি

‘মৈমনসিংহ গীতিকা’ প্রকাশের শতবর্ষে বাংলাদেশ থেকে বের হয়েছে প্রামাণ্য একটি সংকলন। ‘মৈমনসিংহ গীতিকা প্রকাশনার শতবর্ষ সংখ্যা’ নামে বৈচিত্র্যময়, সমৃদ্ধ ও সুগ্রন্থিত সংকলনটি সম্পাদনা করেছেন নিভৃত এক সাহিত্যপ্রেমী—স্বপন ধর। মফস্‌সল শহর ময়মনসিংহ থেকে বের হওয়া সংকলনটি প্রশংসিত হয়েছে দুই বাংলায়। স্বপন ধরের সঙ্গে এই বিশেষ সংখ্যার সূত্র ধরে কথা বলেছেন আব্দুল্লাহ আল মুক্তাদির

স্বপন ধর
ছবি: জাহিদুল করিম
প্রশ্ন:

আব্দুল্লাহ আল মুক্তাদির: ‘জলদ’ নামের পত্রিকার ‘মৈমনসিংহ গীতিকা প্রকাশের শতবর্ষ সংখ্যা: উত্তরকাণ্ড’ শিরোনামের প্রায় সাড়ে আট শ পৃষ্ঠার সংখ্যাটি আপনি সম্পাদনা করেছেন তথাকথিত কেন্দ্র থেকে দূরে, ময়মনসিংহ শহরে বসে। এমন একটি কাজ কেন করলেন?

স্বপন ধর: আমি ময়মনসিংহের মানুষ। সাহিত্য আমার নেশা আর পেশায় আমি শিক্ষক—মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ের ছেলেমেয়েদের বাংলা পড়াই। আজ থেকে ত্রিশ বছর আগে, সবাই যখন রাজধানীমুখি হতে শুরু করল, আমি ভাবলাম, সবাই রাজধানীতে চলে গেল মফস্‌সলে যেসব সাহিত্যকীর্তি ও কীর্তিমান ব্যক্তিরা আছেন, তাঁদের নিয়ে কে কাজ করবে! এই ভাবনা থেকেই আমি ‘জলদ’ বের করা শুরু করি। যেহেতু আমি ময়মনসিংহের মানুষ, তাই এই জেলার যেসব মনীষী দেশের সাহিত্য–সাংস্কৃতিক অঙ্গণে অবদান রেখেছেন, তাঁদের নিয়ে কাজ শুরু করি। প্রথমে আমরা বৃহত্তর ময়মনসিংহের মানুষ যতীন সরকারের ওপর সংখ্যা করেছি। শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের জন্মশতবর্ষ ২০১৪ সালে এই কীর্তিমানকে নিয়ে একটি ঢাউস সংখ্যা বের করেছিলাম। দুই বঙ্গে এটা আদৃত হয়েছিল। ব্রহ্মপুত্র নদ নিয়েও সংখ্যা করেছিলাম। এরই ধারাবাহিকতায় বের হয়েছে মৈমনসিংহ গীতিকা নিয়ে এই সংখ্যা।

‘মৈমনসিংহ গীতিকা’ বৃহত্তর ময়মনসিংহের সম্পদ হলেও এটা তো আমাদের দেশের সম্পদ, পূর্ব বাংলার সম্পদ। আমার মনে হয়েছে, শতবর্ষে ‘মৈমনসিংহ গীতিকা’র দিকে আমাদের আবার ফিরে তাকানো দরকার। গীতিকা সংগ্রহের এক শ বছর তো আর অবহেলা বা বেখেয়ালে চলে যেতে পারে না!

প্রশ্ন:

মুক্তাদির: কবে সংখ্যাটির পরিকল্পনা করেছিলেন? মফস্‌সল থেকে সম্পূর্ণ ব্যক্তি উদ্যোগে এমন একটি আয়োজন কীভাবে সম্ভব হলো?

স্বপন: পরিকল্পনা শুরু করেছিলাম ২০১৮ সালে। প্রথমে আমি বাংলাদেশ ও কলকাতার এক হাজার জনের কাছে সংখ্যার জন্য লেখা চেয়ে চিঠি পাঠালাম। কিন্তু কেউ আমার আহ্বানে সেভাবে সাড়া দেননি। আসলে আমি তো তেমন পরিচিত কেউ নই, তার ওপর মফস্‌সলে থাকি। তাই অনেকেই সেভাবে গুরুত্ব দেননি। কোনো কোনো ক্ষেত্রে অবজ্ঞারও শিকার হয়েছি। কেউ কেউ আবার এমন লেখা দিয়েছেন, যা আমার কাছে মানসম্মত মনে হয়নি। তো সেসব লেখা আমি গ্রহণ করতে অপারগতা জানালে তাঁরা আমার ওপর রুষ্ট হয়েছেন, কখনো বা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টিরও চেষ্টা করেছেন। এ সময় বাংলাদেশের অল্প দু–চারজন লেখকই আমাকে সহযোগিতা করেছেন। কিন্তু এত কিছুর পরও আমি দমে যাইনি।

আমার মনে হয়েছে, শতবর্ষে ‘মৈমনসিংহ গীতিকা’র দিকে আমাদের আবার ফিরে তাকানো দরকার। গীতিকা সংগ্রহের এক শ বছর তো আর অবহেলা বা বেখেয়ালে চলে যেতে পারে না!
স্বপন ধর

সংখ্যা করার পরিকল্পনা নিয়ে ২০১৯ সালে কলকাতায় গেলাম। ওখানে গিয়েই জানতে পারলাম, ‘পূর্বব্বঙ্গ গীতিকা’ভুক্ত ‘সত্যপীরের পালা’র কিছু অংশ উড়িষ্যার জাদুঘরে আছে। গেলাম জাদুঘরে। ড. দীনেশচন্দ্র সেনের প্রপৌত্রী দেবকন্যা সেনের সাহায্যে সেটা উদ্ধার করলাম, যা  ফ্যাক্‌সিমেলি আকারে বর্তমান সংখ্যায় রয়েছে। এভাবে বিচিত্র জায়গায় ঘুরে ঘুরে, বিভিন্নজনের সহযোগিতায় ‘মৈমনসিংহ গীতিকা’র ওপর আকর লেখাগুলো এ সংখ্যায় আমি একত্র করার চেষ্টা করেছি।

চার বছর ধরে বিভিন্ন সুধীজনের বহু রকম লেখা সংগ্রহ করেছি। সবাই সমান সাড়া না দিলেও যা পেয়েছি, তার তুলনা নেই। বাংলাদেশের ঢাকা, রাজশাহী ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে কলকাতা, যাদবপুর, প্রেসিডেন্সি, কল্যাণী, রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়, শান্তিনিকেতন পর্যন্ত যোগাযোগ এবং আসা-যাওয়া বা লেখার জন্য ধরনা দিতে গিয়ে তিক্ত অভিজ্ঞতা যেমন হয়েছে, তেমনি মধুর অভিজ্ঞতাও কম নয়। যেমন কলকাতার বেহালার নিজের বাসায় বসে নিজস্ব সংগ্রহ থেকে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র ও ছবি দিয়ে দেবকন্যা দিদি আমাকে ঋণী করেছেন।

আবার এ সংখ্যায় পুরোনো এমন কিছু লেখা আছে, যেগুলো সংগ্রহ ও সংকলন করতে পারাটাই ছিল আমার জন্য আনন্দের ব্যাপার। যেমন চেক প্রজাতন্ত্রের খ্যাতিমান ভাষাবিদ ড. দুসান জবাভিতেলের লেখা ‘ময়মনসিংহের বাংলা লোকগীতিকা’।

আসলে সম্পাদক হিসেবে আমার পরিকল্পনা ছিল, সংখ্যাটা যেন এমনভাবে বিন্যস্ত হয়, যাতে শিল্প–সংস্কৃতির প্রেক্ষাপটে ‘মৈমনসিংহ গীতিকা’র একটি বিস্তৃত অবয়ব ধরা থাকে। যেনতেন প্রকারে কিছু লেখা একত্র করে একটা সংখ্যা করা আমার উদ্দেশ্য ছিল না।

‘জলদ’–এর ‘মৈমনসিংহ গীতিকা প্রকাশের শতবর্ষ সংখ্যাসহ’ সম্পাদক স্বপন ধর
ছবি: জাহিদুল করিম
প্রশ্ন:

মুক্তাদির: এখানে আপনি দুষ্পাপ্য অনেক কিছু হাজির করেছেন। যেমন বজলুর রশীদ আর আবদুল মোত্তালিবের আঁকা বিরল একটা মানচিত্র যুক্ত করেছেন একেবারে শুরুর দিকে। এই যে ভূগোল বা নৃতত্ত্বের জায়গা থেকে ‘মৈমনসিংহ গীতিকা’র গুরুত্ব অনুধাবন, এটা কেন করলেন?

স্বপন: আমি একদম বুঁদ হয়ে কাজ করেছি বহুদিন। আবার কিছু বিরল লেখা, ছবি ও পাণ্ডুলিপির খোঁজে ছোটাছুটিও করতে হয়েছে অনেক। এসবের একটা পর্যায়ে আমার মাথায় এল বজলুর রশীদ আর আবদুল মোত্তালিবের কথা। এক শ বছর আগে তাঁরা দীনেশচন্দ্র সেনের চাহিদা পূরণ করে ভূমিচিত্রটি এঁকে দিয়েছিলেন। আমি তা উদ্ধার করে আধুনিক প্রযুক্তির সাহায্যে যথাসম্ভব স্পষ্ট করার চেষ্টা করেছি। এই মানচিত্র প্রমাণ করে, ‘মৈমনসিংহ গীতিকা’র প্রকৃত ভূখণ্ড কোনটি। আমার পক্ষে তাই পালাকার, পালা সংগ্রাহক, সম্পাদক—সবাইকে একত্র করা সম্ভব হয়েছে।

‘মৈমনসিংহ গীতিকা’
প্রশ্ন:

মুক্তাদির: সংখ্যাটি করতে গিয়ে পশ্চিমবঙ্গের লেখক–গবেষকদের সহযোগিতা পেয়েছেন জানা গেল। বাংলাদেশের ঐতিহ্য বা লোকসাহিত্য বিষয়ে তাঁদের আগ্রহ কেমন?

স্বপন: ‘গেঁয়ো যোগী ভিক্ষা পায় না’—কথাটা লেখা সংগ্রহ করতে গিয়ে বুঝেছি। আগেই বলেছি, প্রথম দিকে বাংলাদেশে অনেকেই উৎসাহ দেখাননি। কলকাতায় গিয়ে সুবিধা হয়েছে দীনেশচন্দ্র সেনের প্রপৌত্রী দেবকন্যা সেনকে পেয়ে। তাঁর সহযোগিতা ভোলার মতো নয়। অন্য আরও অনেকের মধ্যেই আমি আগ্রহ দেখেছি। ভিনদেশি বলে তাঁরা ভেবেছেন, আমি হয়তো কেউকেটা গোছের কেউ। অথবা রাবীন্দ্রিকভাবে বলতে গেলে, ‘উত্তম নিশ্চিন্তে চলে অধমের সাথে’—পরিস্থিতি এমনটাই বোধ হয় হয়েছে।

প্রশ্ন:

মুক্তাদির: সংখ্যার প্রচ্ছদে ভারতীয় শিল্পমহাবিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ শিল্পী সতীশ সিংহের আঁকা ছবি ব্যবহৃত হয়েছে। সঙ্গে দেওয়া আছে ছবির বিবরণ। বিশেষত ছবিটি যে সতীশ সিংহের, তা আপনি খুঁজে বের করেছেন। সংকলনের মূল লেখাগুলোর আগে এ ধরনের সংযুক্তি কেন জরুরি মনে করলেন?

স্বপন: প্রচ্ছদে সতীশ সিংহের ‘বেদেদের পলায়ন দৃশ্য’ নামের ছবিটা আমি বিশেষভাবে রাখতে চেয়েছি। এই ছবি সহজেই সেই সময়ের প্রতিনিধিত্ব করে। ছবিটা অনেক দিন ধরে দৃশ্যমান থাকলেও শিল্পীর খোঁজ তেমন কেউ জানতেন না। ছবির জমিনে শিল্পীর সূক্ষ্ম একটা অনুস্বাক্ষর ছাড়া তাঁর নাম-পরিচয় কোথাও ছিল না। অক্লান্ত অনুসন্ধানে শেষমেশ সতীশ সিংহের জীবন ও কর্ম সম্পর্কে বেশ অজানা কিছু তথ্য উঠে এসেছে। ‘মৈমনসিংহ গীতিকা’ প্রকাশের শতবর্ষে দীনেশচন্দ্র সেনের সঙ্গে তাঁকেও সম্মান জানাতে চেয়েছি প্রচ্ছদ নিয়ে এক পৃষ্ঠার ওই লেখার মাধ্যমে।

‘জলদ’–এর মৈমনসিংহ গীতিকা প্রকাশের শতবর্ষ সংখ্যা
প্রশ্ন:

মুক্তাদির: আমরা জেনেছি, ২০১৮ সালে কাজ শুরুর পর মাঝখানে করোনা মহামারি এবং আপনার ব্যক্তিগত জীবনেও একটা বড় বিপর্যয় ঘটে। আপনার মেয়ে মারা যায়। ঘটনাটি একটু বলবেন...!

স্বপন: আমার মেয়ে শ্রীজা। ভালো নাম অর্কপ্রিয়া ধর। নবম শ্রেণিতে পড়ত। প্রুফ দেখাসহ নানা কাজে সে ছিল আমার সহযোগী, আমার সঙ্গে ছায়ার মতো লেগে থাকত। খুবই মেধাবী ছিল মেয়েটা। এই বয়সেই লোরকার কবিতা অনুবাদ করেছিল। তো করোনার পর একটানা অনেক দিন লেখা বাছাই, কম্পোজ, প্রুফ দেখায় এত মনোযোগী ছিলাম যে অন্য কোনোদিকে তেমন খেয়াল ছিল না। এ সময় অভিমানবশত আমার মেয়েটা আত্মহত্যা করে। ঘটনাটা এমন ঝড়ের বেগে ঘটেছিল এবং আমার জন্য এটা এতই অপ্রত্যাশিত ছিল যে ট্রমার মধ্যে পড়ে গিয়েছিলাম। প্রায় ছয়–সাত মাস বিছানা থেকে উঠতে পারিনি। তখন মনে হতো না, কখনো আবার কাজে ফিরতে পারব। ইচ্ছা বা আগ্রহ যা–ই বলি, আমি প্রায় সবকিছুই হারিয়ে ফেলেছিলাম।

পরে যতীন স্যারসহ আরও দু–একজন প্রিয় মানুষ আমাকে বললেন, ‘তুমি যদি কাজটা না করো, তাহলে আর কেউ করবে না, তোমার মেয়ের আত্মাও শান্তি পাবে না।’ মূলত মেয়েকে হারানোর বেদনা ভুলেতেই কাজটাতে আবার ঝাঁপিয়ে পড়ি। অবর্ণনীয় মানসিক কষ্টকে সঙ্গী করে কাজটা শেষ করেছি। আর সংখ্যাটা আমি উৎসর্গ করেছি শ্রীজা এবং তার অল্প দিনের তীব্র প্রতিভাময় জীবনের প্রতি।

টিউশনি থেকে অর্জিত টাকা এবং আমার স্ত্রীর সঞ্চিত অর্থ—দুই মিলিয়ে আমি কাজটা শেষ করেছি। আমি জানি, পত্রিকা প্রকাশের কাজে ব্যয় করা এই অর্থ কখনোই উঠে আসবে না। তবু এর মাধ্যমে যে পূর্ব বাংলার অবহেলিত মানুষের রচিত সাহিত্যের প্রতি সম্মান জানাতে পারলাম, এতেই আমার আনন্দ।

আমি বিশ্বাস করি, কাজটা শেষ করতে পারায় শ্রীজার আত্মা শান্তি পেয়েছে। কারণ, সে মনেপ্রাণে চেয়েছিল কাজটা যেন আমি শেষ করি।

প্রশ্ন:

মুক্তাদির: সংখ্যাটি বেরোনোর পর কেমন সাড়া পেলেন? সামনে আপনার পরিকল্পনা কী?

স্বপন: এ সংখ্যার প্রথম মুদ্রণ শেষের পথে—এটা আমার মতো একজন ছাপোষা মানুষের জন্য আত্মশ্লাঘার ব্যাপার। পাঠক চাইলেই সংখ্যাটা ঢাকায় প্রথমার বিক্রয় কেন্দ্র ও প্যাপিরাস নামের বইয়ের দোকান থেকে সংগ্রহ করতে পারবেন। তা ছাড়া অনলাইনেও অর্ডার করা যাবে।

সামনে আমার ইচ্ছা আছে, ‘মৈমনসিংহ গীতিকা’র যাবতীয় কিছু নিয়ে ‘জলদ’–এর আরও চারটা সংখ্যা প্রকাশ করার। এই সংখ্যায় যেমন দীনেশচন্দ্র সেনকে প্রধান করা হয়েছে, তেমনি পরের সংখ্যাগুলোয় একে একে আসবেন চন্দ্রকুমার দে, ‘সৌরভ’ পত্রিকার সম্পাদক কেদারনাথ মজুমদার, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আশুতোষ মুখোপাধ্যায়সহ অনেকে, ‘মৈমনসিংহ গীতিকা’র সঙ্গে যাঁরা ঘনিষ্টভাবে যুক্ত ছিলেন। এই পুরো কাজের মধ্য দিয়ে আমি বৃহত্তর ময়মনসিংহ তথা পূর্ব বাংলার সাহিত্যের এই অমূল্য ভান্ডারকে নতুনভাবে আলোয় আনতে চাই।