পাপোষ

দোষটা শরিফার নয়। তার আর কীই-বা এমন দোষ? সে তো সেই কোন সকালে উঠে জুতা জোড়া বুরুশ করে কালি করে রেখেছিল, তবু যে সেই দুর্ঘটনাই ঘটবে, তা কে জানত? এখন কথাটা শুনে মনটা খুঁতখুঁত করে উঠল ওর। বলল, ‘একটু সাবধানে গেলেই পারতে কিন্তু।’

: তা–ই তো গিয়েছি। কাল রাতের বৃষ্টিতে গলির মুখে এত কাদা আর নোংরা হয়েছে যে কী বলব। পা হড়কে গেল।

: পড়ে যাওনি তো?

: বাকি ছিল না, আর একটু হলেই। সেই তখনই জুতা জোড়া কাদায় লেপটে গেল।

কামাল কাপড় ছাড়তে ছাড়তে বলল। শরিফা ততক্ষণে নাশতা নিয়ে এসেছে। একটু ভালো করে, একটু যত্ন করে সাজিয়েছে রেকাবিটা পড়তি দুপুরবেলায়। এখন সামনে এগিয়ে দিয়ে বলল, ‘খাও। সায়েব খুব রাগ করলেন, না?’

: করবেনই তো। ওর বসবার ঘরটা যদি দেখতে, ইশ্​! চোখ জুড়িয়ে আসে। ঘুমিয়ে পড়তে ইচ্ছে হয়, এত সুন্দর করে সাজানো।

: আর কী বললেন?

শরিফা শঙ্কিত দৃষ্টি মেলে কামালের ওপর।

: আর কী বলবেন, এক দিনই তো।

তা হলেও কামাল মনে মনে একটু ভয় পায়। হয়তো সামান্যের জন্যই এ চাকরিটাও চলে যাবে। শরিফাও বুঝি ভয় পায়। নইলে গ্লাসে পানি ঢালতে ঢালতে বলবে কেন, ‘তা হোক বাপু, তুমি একটু সাবধান হয়ে যেয়ো কাল থেকে।’ তারপর একটু থেমে, অনেকক্ষণ থেমে ও আবার বলল, ‘সামনে একটু চেষ্টাচরিত্র কোরো বাসার জন্য। এ এলাকাটা যা–ই বলো, একেবারেই বিশ্রী কিন্তু।’

নতুন রাস্তা হচ্ছে শহরে। কংক্রিট করা, ওয়ার নেটিং করা রাস্তা। তারই এক কন্ট্রাক্টরের আপিসে কাজ পেয়েছে কামাল। দিনের রিপোর্টগুলো মিলিয়ে সায়েবের কাছে পেশ করাটাই ওর কাজ।

আজকেই জয়েন করেছে ও। সায়েব ডেকেছেন কিছুক্ষণ পরই। পর্দা সরিয়ে ভেতরে ঢুকে পাপোষের ওপর দাঁড়াল সে। সায়েব—হামিদ সায়েব মুখ তুলে তাকালেন, কিন্তু কোনো কথা বললেন না। অনেকক্ষণ তাকিয়ে রইলেন ওর পায়ের দিকে। আর সাথে সাথে কামাল দৃষ্টি নামিয়ে আনল নিচে।

একটু সংকুচিত হয়ে ঝকঝকে পরিষ্কার আর পুরু পাপোষটা থেকে পা সরিয়ে নিল। কাদা লেগেছে পাপোষে অনেকখানি। পায়ের মাপ রয়ে গেছে। হামিদ সায়েব কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। তারপর বললেন, ‘তুমি কামাল, না?’

: হ্যাঁ, স্যার।

: এর আগে কোনো দিন কোনো অ্যারিস্টোক্র্যাট ফার্মে চাকরি করোনি বুঝি। থাকো কোথায়?

কামাল ঠিক করতে পারল না, উনি কী বলতে চান। তাই কোনো উত্তর করতে পারল না। আমতা আমতা করল খানিক। হামিদ সায়েব একটু হাসলেন।

: কামরায় ঢুকবার আগে জুতা জোড়া পরিষ্কার করে আসা উচিত ছিল তোমার।

: তাড়াতাড়িতে খেয়াল করতে পারিনি, স্যার। কামালের ভেতরটা ঘেমে–ভিজে গেছে এতক্ষণে।

: জানো, কোনো বিলিতি ফার্ম হলে তোমাকে এক্ষুনি ডিসচার্জ করা হতো।

হয়তো তা–ই, ভাবল কামাল। হামিদ সায়েব পার্কার ফিফটি ওয়ান বন্ধ করলেন। রেখে দিলেন পেনস্ট্যান্ডে। তারপর বাঁ হাতের অনামিকায় কী জানি কি কাচ কি হিরে-বসানো আংটিটা ঘোরাতে ঘোরাতে বললেন,

: নতুন এসেছ বলে আমি আজ আর কিছু বলছিনে। তবে এর পর থেকে এ রকমভাবে শুধু আমার কামরায় কেন, আপিসেই ঢুকবে না। বি পার্টিকুলার।

ঘাড় কাত করল কামাল।

মেদে থলথল করছে হামিদ সায়েবের শরীর। রিভলভিং চেয়ারের হাতলে যেন দুপাশের মাংস উপচে পড়েছে। আর গলার কাছে একতাল মাংস ভাঁজ হয়ে রয়েছে। হয়তো গরমের জন্যই উনি মাছের মতো একটু হাঁ করলেন হঠাৎ। তারপর ঘোঁৎ করে ঢোঁক গিলে বললেন, ‘ঠিক এই কারণেই এ দেশের লোকেরা শাইন করতে পারে না। তুমি নতুন বলেই বলছি। আমি চাই, তোমরা উন্নতি করো। আই ফিল ফর ইউ। ধরো, আমার কথাই। প্রবাবলি তুমি জানো না, নিজের ভাগ্য আমি নিজেই গড়েছি, সেলফ মেডম্যান। শুধু চেষ্টা আর অধ্যবসায় ছিল আমার মোটো।’

কামাল অপরাধীর মতো দাঁড়িয়ে থাকে। বাধিতজনের মতো স্মিত মুখে শোনে তাঁর কথা।

: এই যে কাদা পায়ে তুমি ঢুকেছ, এটা একটা বিজনেস ফার্মের পক্ষে কতখানি ক্ষতিকর, তা জানো? সব সময় টিপটপ, স্মার্ট থাকবে। যাও।

হয়তো বেশি কথা বলে হাঁপিয়ে পড়েছেন উনি। তাই কথার মাঝখানে হঠাৎ থেমে গেলেন। কামাল ফিরে যাচ্ছিল, পেছন থেকে ডাকলেন।

: এই ফাইলটি নিয়ে পরিতোষের কাছ থেকে বুঝে নিয়ো।

: আচ্ছা, স্যার।

বাইরে এসে একটা পুরোনো খবরের কাগজ দিয়ে জুতা জোড়া মুছল ও। কাদা উঠিয়ে ফেলল। তারপর কামরায় গিয়ে বসল। আশ্চর্য! লোকটার কথা শুনে বুঝবার উপায় নেই, রাগ করেছেন কি না কিংবা নেহাত সহানুভূতি দেখিয়েই কথাগুলো বললেন?

রাত্তিরে শুতে গিয়ে কামাল বলল, ‘আমাদের সায়েবের তো আজকাল এত চাল দেখছ, দুদিন আগেও রাস্তার রাস্তায় ঘুরে বেড়াতেন। বিয়ে করে কিছু টাকা পেয়েছিলেন। তাই দিয়ে ব্যবসায় শুরু করে এত।’

তারপর একটু থেমে পাশ ফিরতে ফিরতে বলল, ‘অবিশ্যি শ্বশুরের টাকা পেলে ও রকম সবাই করতে পারে, কী বলো। কোথায় একটু কাদা লেগেছে, তাই নিয়ে কী বক্তৃতা, বাপরে বাপ!’

শরিফা কোনো কথা বলল না। কী বলবে সে? তার বাবা বিয়ের টাকা দিতে পারেননি, সে কথা কি কামাল নতুন করে মনে করিয়ে দিল! নিজেকে অপরাধী মনে হলো তার। মনে হলো সমস্ত কিছু দিয়েও যদি এর প্রায়শ্চিত্ত করা যেত, তাহলে সে তা-ই করত।

সকালে উঠেই শরিফা বলল, ‘আজ আর তুমি জুতা পরে যেয়ো না। একেবারেই ভিজে গেছে।’

: স্যান্ডেলে যে কাদা উঠবে।

: ও উঠবে না। আমি মুচির দোকান থেকে সারিয়ে এনে দিচ্ছি।

কয়েক আনা পয়সা ছিল ট্রাংকে। শরিফা তা–ই খুঁজেপেতে বের করে, মোড়ের মুচির কাছ থেকে স্ট্র্যাপ সারিয়ে আনল। কালি করল নিজ হাতে। তারপর শাড়ি দিয়ে মেজে জিল তুলল।

: দ্যাখো তো। কেমন হয়েছে, পছন্দ হচ্ছে না?

: সত্যিই তো! একেবারে নতুনের মতো মনে হচ্ছে।

কামাল দেয়ালের আয়নায় চুল আঁচড়াতে আঁচড়াতে ফিরে তাকিয়ে বলল, ‘নিজের পয়সা দিয়ে সারালে বুঝি?’

: তাতে কি, ও তো তোমারই।

: তাহলেও। চাইলে পারতে। তোমার হাতে দু-এক আনার বেশি তো থাকে না। যাকগে, ওসব রাখো। এখন খাবে চলো।

তারপর খাওয়া শেষ হলে পর, শরিফা নিজ হাতে জামা পরিয়ে দিল। আর একটা পান সেজে দিল। তারপর বলল, ‘বাসে যেয়ো। হেঁটো না কিন্তু।’

: বাসে যা ভিড়। হেঁটে যাওয়াই ভালো।

: তা হোক, একটু হেঁটে স্ট্যান্ড থেকে উঠবে। রোজগার করে দুটো পয়সা নিজের জন্য খরচ করবে না তো করবে কার জন্য।

: আগে মাইনে পেতে দাও, তারপর তো, নাকি?

বলে শিশুর মতো হাসল কামাল। ‘স্যান্ডেল জোড়া এত চকচক করছে যে প্রায় মুখ দেখতে পারবে তুমি।’ কামাল তৃপ্তিতে ভর করে পা ফেলল। আর পেছনে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল শরিফা কপাটের আড়ালে।

আস্তে সন্তর্পণে হাঁটতে হবে কামালকে। গলির ওপর এখানে-ওখানে কাদা। কালকের মতো আবার কাদায় পা লেপটে যেতে পারে একটু আনমনা হলেই। পায়ের পাতার ওপর ভর করে করে ও গলিটা পেরোল। না, এক ফোঁটা কাদাও আজ আর লাগেনি।

পকেটে মাত্র কয়েক আনা পয়সাই আছে। বাসে গেলে দুপুরে এক কাপ চা খাওয়া হয়তো হবে না। কামাল মনে মনে হিসাব করল। কিন্তু শরিফা বারবার করে বলে দিয়েছে। কামাল বাসে বসে বসে পায়ের দিকে তাকিয়ে ভাবল, হামিদ সায়েব আজকে নিশ্চয়ই খুশি হবেন। আর কিছু না হোক, হয়তো একটু প্রশংসার হাসি হাসবেন। একধরনের অদ্ভুত রবে কামালের বুক ভরে গেল।

আপিসে বসে অনেকক্ষণ অপেক্ষা করল কামাল, হয়তো এখনই তার ডাক পড়বে। কিন্তু পড়ল না। পড়ল সেই টিফিনের পর।

আজ তাড়াতাড়ি এগিয়ে গেল ও। পর্দা সরিয়ে দাঁড়াল পাপোষের ওপর। কালকের সে কাদাটুকু নেই, হয়তো ঝেড়ে ফেলে দেওয়া হয়েছে। আর আজ সে পাপোষের ওপর নিঃসংকোচে দাঁড়িয়ে রইল। হামিদ সায়েব পায়ের দিকে তাকালে আজ পা সরিয়ে নিতে হবে না লজ্জায়, কুণ্ঠায় পাপোষ থেকে।

কিন্তু কী আশ্চর্য! হামিদ সায়েব তাকালেন না ওর পায়ের দিকে। ও একটু দাঁড়িয়ে রইল আশায় ভর করে। তারপর ম্লান মুখে এগিয়ে এল সামনে। কয়েকটা ফাইল বুঝিয়ে দিলেন উনি। ফাইলগুলো নিয়ে মন্থর পায়ে বেরিয়ে এল।

ভীষণভাবে হতাশ হয়েছে ও। শুধু কালকেই ওঁর চোখ পড়ল, আর আজ একবার মুখ তুলেও তাকালেন না। মুহূর্তে মনে পড়ল শরিফার সকাল থেকে স্যান্ডেলের পেছনে খাটুনির কথা। আর তার উৎকণ্ঠা। সারা সকালের সমস্ত প্রস্তুতি আর প্রতীক্ষা একমুহূর্তে ব্যর্থ হয়ে গেল। চরম একটা ব্যর্থতা ও বুকের অনেক গভীরে অন্তরঙ্গভাবে অনুভব করল। পরমুহূর্তেই খানিকটা সান্ত্বনা পেল এই ভেবে যে হয়তো কাজের চাপে উনি খেয়াল করতে পারেননি।

কিন্তু যদি সে পর্দার বাইরে একটুখানি দাঁড়াত, তাহলে সে শুনতে পেত, হামিদ সায়েব ফোন তুলে বলছেন,

‘একটা ফানি ব্যাপার বলছি, ডার্লিং। এইমাত্র আমার লোয়ার র​্যাঙ্কের একজন কর্মচারী এসেছিল কামরায়।...লোকটা থাকে বোধ হয় গ্রামে। চারদিকে এত বৃষ্টি হচ্ছে, কিন্তু কী আশ্চর্য জানো, তার পা আর স্যান্ডেল দেখলে মনে করবে যে বোধ হয় কার্পেটের ওপর দিয়ে সে হেঁটে এসেছে। ইটস র​্যাদার অ্যামিউজিং। ইজ’ন্ট ইট, ডার্লিং?’

ফোনের ও তরফ থেকে কী জবাব এল, তা এক হামিদ সায়েবেরই জানবার কথা।

সংগ্রহ ও ভূমিকা

দৈনিক সংবাদ-এর ঈদসংখ্যার একটি পৃষ্ঠা

কাজী জাহিদুল হক

কবিতা, কথাকাব্য, কাব্যনাটক, গল্প, উপন্যাস, শিশুতোষ রচনা, চলচ্চিত্রের কাহিনি, গান, আত্মজৈবনিক রচনা, প্রবন্ধ ও নিবন্ধ মিলিয়ে সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হকের লেখালেখির পরিমাণ অগণিত। এর মধ্যে এখনো তাঁর বেশ কিছু লেখা অগ্রন্থিত রয়ে গেছে। তেমনই এক অগ্রন্থিত গল্প হলো ‘পাপোষ’। এটি প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৫৫ সালে, দৈনিক সংবাদ-এর ১৩৬২ বঙ্গাব্দের ঈদসংখ্যায়। তত দিনে তাঁর প্রথম গল্পগ্রন্থ তাস (১৯৫৪) বের হয়েছে। ঈদসংখ্যার ৪৩, ৪৪ ও ৫৪—তিন পৃষ্ঠাজুড়ে ছাপা হওয়া এ গল্পে সে সময়ের বাস্তবতায় শ্রেণিচরিত্রের স্বরূপ উন্মোচিত হয়েছে। এখানে ছাপার সময় গল্পটিতে বর্তমান বানানরীতি ব্যবহার করা হয়েছে।