লড়াই–ই কি ফিলিস্তিনিদের ‘আইডেন্টিটি কার্ড’

গাজা এখন ধ্বংসস্তূপ। ইসরায়েলি আগ্রাসনের শিকার হয়েছে পশ্চিম তীরও। অস্তিত্বের তাগিদে এখন লড়াই করছে ফিলিন্তিনিরা। কিন্তু লড়াই–ই কি ফিলিস্তিনিদের ‘আইডেন্টিটি কার্ড’?

ইসরায়েলি নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে ফিলিস্তিনি বিক্ষোভকারীদের সংঘর্ষ চলছে। সংঘর্ষ চলাকালে ফিলিস্তিনের পতাকা হাতে একজন নারী। গাজা উপত্যকা, ফিলিস্তিনছবি: রয়টার্স

‘ফিলিস্তিনিরা মরে না, তারা সব সময় ফিরে আসে, তাদের মারা খুব কঠিন’—বলেছিলেন বাসেম ইউসুফ। এই মিসরীয় কমেডিয়ান ও টিভি ব্যক্তিত্বকে হামাসের হামলার বিষয়ে নিজের টক শোতে প্রশ্ন করেন ব্রিটিশ উপস্থাপক পিয়ার্স মরগান।

টকটিভিতে প্রচারিত ‘পিয়ার্স মরগান আনসেনসর্ড’ নামের এই টক শোতে অনেকটা নির্বিকারভাবেই নিজের কথাগুলো বলেছেন বাসেম ইউসুফ। তিনি জানান, তাঁর ফিলিস্তিনি স্ত্রীর পরিবারের সদস্যরা গাজাতেই থাকেন। তাঁদের সঙ্গে কোনো যোগাযোগ করা সম্ভব হচ্ছে না। তবে এসব ঘটতেই থাকে, বারবার তাদের ওপর বোমা হামলা হয়। তারা মরে না। মরগানের সঙ্গে দীর্ঘ আলাপে ইউসুফ প্রশ্ন ছুড়ে দেন, ৭ অক্টোবরের হামলার আগেও ফিলিস্তিনিরা মরেছে। পশ্চিম তীরে হামাসের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই, সেখানে কেন ফিলিস্তিনি শিশুরা মরছে?

একপর্যায়ে বাসেম ইউসুফ বলে ওঠেন, কীভাবে পশ্চিমারা বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে আদিবাসীদের বর্বর হিসেবে চিহ্নিত করে তাদের হত্যা করেছে। তারপর যখন তারা বিপন্ন জাতিতে পরিণত হয়েছে, তখন তাদের প্রতি পশ্চিমাদের মায়া জন্মেছে। হয়তো ‘বর্বর’ ফিলস্তিনিদেরও হত্যা করা উচিত, যাতে তাদের অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যায়। তারপর যে কিছুসংখ্যক ফিলিস্তিনি বেঁচে থাকবে, তাদের প্রতি পশ্চিমের মায়া জন্মাবে। ইসরায়েলি প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্ট গাজাবাসীদের বলেন, ‘মানব জানোয়ার’, যারা নালায় বাস করে। বাসেম বলেন, একদিন ইহুদিদেরও ‘ইঁদুর’ বলে গ্যাসচেম্বারে ঢুকিয়ে দলে দলে হত্যা করেছিল নাৎসি বাহিনী। তাহলে ‘ইহুদি’ শব্দটা কি এখন ‘মুসলিম’ দিয়ে প্রতিস্থাপিত হলো?

হামাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধকে স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও গণতন্ত্র রক্ষার এক আদর্শিক যুদ্ধে রূপ দিয়েছে ইসরায়েল। আর এই যুদ্ধে সর্বাত্মকরণে তাদের পাশে আছে যুক্তরাষ্ট্র। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এই যুদ্ধে হাজার হাজার কোটি মার্কিন ডলার সহায়তাকে মার্কিনিদের জন্য ‘স্মার্ট বিনিয়োগ’ বলে মনে করছেন। আর পানি, খাবার, রসদবিহীন গাজায় প্রতিদিন হাজার হাজার বোমা ছোড়া হচ্ছে। তবে কথা হলো, অবরুদ্ধ অঞ্চলে জমি, শিক্ষা, চাকরিবিহীন ফিলিস্তিনিরা তো কেবল বেঁচে থাকার চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু এখন কি তারা বেঁচে আছেন? কারাগারেও তো তারা আর নিরাপদ নন।    

ব্রিটিশ টেলিভিশন চ্যানেল টকটিভিতে প্রচারিত ‘পিয়ার্স মরগান আনসেনসর্ড’–এ অতিথি হয়ে এসেছিলেন মিশরীয় কমেডিয়ান ও টিভি ব্যক্তিত্ব বাসেম ইউসুফ
ছবি: সংগৃহীত

পশ্চিমা আধিপত্যবাদের গোড়ার কথাই হলো, বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীকে বর্বর ও মনুষ৵ত্ব বিবর্জিতের তকমা লাগিয়ে দেওয়া। তাদের সমতা ও মর্যাদার আদর্শিক বুলি, পুঁজিবাদী ও সাম্রাজ্যবাদী লালসাকে ঢেকে রাখার একটি পর্দা ছাড়া আর কিছুই নয়। এ প্রসঙ্গে ফরাসি-আলজেরীয় মনোবিদ ও লেখক  ফ্রানজ ফানোকে স্মরণ করা যেতে পারে। ফানো বলেন, ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদীরা ‘নির্বাসন, গণহত্যা, জোরপূর্বক শ্রম ও দাসত্বকে’ ব্যবহার করে শতাব্দীর পর শতাব্দী ‘অনুন্নত বিশ্বে প্রকৃত যুদ্ধাপরাধীদের মতো আচরণ করেছে’। আর এই প্রেক্ষাপটে অবরুদ্ধ গাজায় ইসরায়েলি আগ্রাসনকে যুদ্ধাপরাধের সঙ্গে তুলনা করেছে জাতিসংঘসহ মানবাধিকার সংগঠনগুলো।

পশ্চিমাদের চোখে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া বাঁচিয়ে রাখার যুদ্ধে এবারের শত্রু হামাস। তালেবান ও আল– কায়েদার সঙ্গে তাদের তুলনা করা হচ্ছে। বাসেম ইউসুফের সঙ্গে পিয়ার্স মরগানের টক শোতে যখন আইএসের সঙ্গে হামাসের তুলনা করেন পিয়ার্স মরগান, তখন বাসেম ইউসুফও দিয়েছেন মোক্ষম জবাব। তাঁর উত্তর ছিল, যুগের পর যুগ অবরুদ্ধ হয়ে থাকা ফিলিস্তিনিরা, প্রতিদিন যাদের মানবাধিকার লঙ্ঘন করা হচ্ছে, তারা কি দখলদারের পক্ষ নেবে, নাকি যে সংগঠন দখলদার শক্তির বিরুদ্ধে প্রতিরোধের আশা দেখাচ্ছে, তাদের পক্ষ নেবে?

তাই পশ্চিমাদের চোখে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া বাঁচিয়ে রাখার যুদ্ধে এবারের শত্রু হামাস। তালেবান ও আল– কায়েদার সঙ্গে তাদের তুলনা করা হচ্ছে। বাসেম ইউসুফের সঙ্গে পিয়ার্স মরগানের টক শোতে যখন আইএসের সঙ্গে হামাসের তুলনা করেন পিয়ার্স মরগান, তখন বাসেম ইউসুফও দিয়েছেন মোক্ষম জবাব। তাঁর উত্তর ছিল, যুগের পর যুগ অবরুদ্ধ হয়ে থাকা ফিলিস্তিনিরা, প্রতিদিন যাদের মানবাধিকার লঙ্ঘন করা হচ্ছে, তারা কি দখলদারের পক্ষ নেবে, নাকি যে সংগঠন দখলদার শক্তির বিরুদ্ধে প্রতিরোধের আশা দেখাচ্ছে, তাদের পক্ষ নেবে?

আবার ফেরা যাক ফ্রানজ ফানোর কাছে। তিনি বলেছেন, ‘উপনিবেশবাদ হলো “নগ্ন সহিংসতা”র একটি যন্ত্র, যা তখনই বন্ধ হয়, যখন তা আরও বড় আকারের সহিংসতার মুখোমুখি হয়।’ নিজের এই বক্তব্যের জন্য পশ্চিমা তাত্ত্বিকদের মধ্যে ব্যাপকভাবে সমালোচিত ও নিন্দিত হয়েছিলেন ফানো। ফ্রান্সশাসিত আলজেরিয়ায় বেড়ে ওঠা ফানো পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়েই এমন অনুধাবনে পৌঁছেছিলেন। তিনি দেখেছিলেন, কীভাবে উপনিবেশিতের পরিচয় নির্মিত হয়েছে মনুষত্বের লেশমাত্র না রেখে—কখনো সে ‘নিগ্রো’, কখনো ‘বানরমুখো’, কখনো ‘রক্তচোষা’। যেমনভাবে পাকিস্তানি হানাদাররা আমাদের বলছে, ‘ভেতো বাঙালি, যাঁরা লড়তে জানে না।’

ফানোর মতে, উপনিবেশিতের জন্য একমাত্র নিদান ‘পাল্টা সহিংসতা’। তিনি লেখেন, ‘যখন আপনাকে এবং আপনার সাথিদের কুকুরের মতো মেরে ফেলা হচ্ছে, তখন যেকোনোভাবে মানুষ হিসেবে নিজের অবস্থান প্রমাণ করা ছাড়া আপনার হাতে আর কোনো পথ খোলা থাকে না।’

শারম আল শেখে ইসরায়েল-ফিলিস্তিন বৈঠকের প্রতিবাদে বিক্ষোভ চলার সময় গাজা সীমান্তে টায়ারে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়
ছবি: রয়টার্স

ফানোর এ বক্তব্যের সত্য রূপ দিয়েছিলেন দক্ষিণ আফ্রিকার কিংবদন্তি নেতা নেলসন ম্যান্ডেলা। ম্যান্ডেলা ছিলেন মহাত্মা গান্ধীর অহিংস আন্দোলনের সমর্থক। তবে যখন শার্পভিলে দক্ষিণ আফ্রিকার কালো মানুষদের আক্ষরিক অর্থে কচুকাটা করা হলো, তখন ম্যান্ডেলা আন্দোলনের অহিংস রূপ থেকে পিছু হটতে বাধ্য হন। সশস্ত্র সংঘর্ষে আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেসের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন মান্ডেলা।  এ বিষয়ে এই নেতার মত হলো, ‘রাষ্ট্রীয় সহিংসতা কেবল একটি জিনিসই করতে পারে। আর তা হলো, পাল্টা সহিংসতার জন্ম দেওয়া।’    

এমন অবস্থায় দীর্ঘদিনের আগ্রাসনে ধুঁকে ধুঁকে মরতে থাকা ফিলিস্তিনিদের হাতে আর কী উপায় বাকি থাকে?

প্রশ্নটির উত্তর খোঁজা যেতে পারে ফিলিস্তিনের জাতীয় কবি মাহমুদ দারবিশের ‘আইডি কার্ড’ কবিতার মধ্যে:

‘লিখুন!
আমি একজন আরব
এবং আমার পরিচয়পত্র নং পঞ্চাশ হাজার,
আমার আট সন্তান
এবং নবমজনের জন্ম হবে এক গ্রীষ্মের পর
আপনারা কি রাগ করবেন?

লিখুন!
আমি একজন আরব
অন্য শ্রমিকদের সঙ্গে খনিতে কাজ করি
আমার আট সন্তান
তাদের জন্য রুটি
কাপড় আর বই আনি
ওই পাথর থেকে,
আপনাদের দুয়ারে ভিখ মাঙি না
কিংবা আপনাদের ঘরের বাইরে
লুটিয়ে পড়ি না
আপনারা কি রাগ করবেন?

লিখুন!
আমি একজন আরব
আমার নাম আছে, পদবি নেই,
আমি ধৈর্যশীল হয়ে থাকি এমন এক দেশে
যেখানে মানুষ ক্রুদ্ধ,
আমার শিকড় প্রোথিত হয়েছে
সময়ের জন্মেরও আগে
যুগের সূচনার আগে
পাইন ও জলপাই গাছের আগে
এবং ঘাস গজানোর আগে
আমার বাবা কৃষকের সন্তান
কোনো সুবিধাভোগী শ্রেণির নয়,
এবং আমার দাদাও ছিলেন কৃষক
ভালো খায়নি, ভাল ঘরে জন্মায়নি!
পড়তে শেখার আগে
আমাকে শেখানো হয় সূর্যের গৌরব
আর আমার ঘর যেন প্রহরীর ঘাঁটি
গাছের ডালপালা আর ছড়ি দিয়ে বানানো
আপনারা কি আমার অবস্থান নিয়ে সন্তুষ্ট?
আমার নাম আছে, পদবি নেই

মাহমুদ দারবিশ
ছবি: সংগৃহীত

লিখুন!
আমি একজন আরব
আপনি আমার পূর্বসূরিদের বাগান চুরি করেছেন
এবং যে জমিতে আমি চাষ করেছি
আমার সন্তানদের নিয়ে,
আপনারা আমাদের জন্য কিচ্ছু রাখেননি
এই পাথরগুলো ছাড়া
রাষ্ট্র কি এগুলোও নিয়ে নেবে
যেমনটা বলা হয়েছিল?
কাজেই!
প্রথম পাতায় সবার ওপরে লিখুন:
আমি মানুষকে ঘৃণা করি না
আমি দখলও করি না
কিন্তু আমি যদি ক্ষুধার্ত হয়ে পড়ি
দখলদারের গোশতই আমার খাবার হবে
সাবধান...
সাবধান…
আমার ক্ষুধা থেকে
এবং আমার ক্রোধ থেকে!’