বাঙালির ইফতারে যেভাবে এল ছোলা-মুড়ি-পেঁয়াজু

ছোলা-মুড়ি-পেঁয়াজু ছাড়া বাঙালির ইফতার এখন জমেই না। কিন্তু বাঙালির ইফতারে কীভাবে যুক্ত হলো এই পদগুলো? সাহিত্য ও ইতিহাস ঘেঁটে তার সুলুকসন্ধান

মুড়ির সঙ্গে ছোলা-মুড়ি-পিঁয়াজু, জিলাপি ইত্যাদি মাখিয়ে খাওয়ার ধরনটি এসেছে পুরান ঢাকা থেকে
ছবি: প্রথম আলো

একসময়ে রোজার দিনে পানিতে চাল ভিজিয়ে রাখা হতো। গ্রামবাংলার সাধারণ মুসলমানেরা সেই ভেজানো চাল মুখে দিয়ে রোজা খুলতেন। ভাতের ওপর নির্ভর করা বঙ্গ জনগোষ্ঠী বিভিন্ন উৎসব-পার্বণের প্রধান খাদ্য উপাদান হিসেবে বরাবরই ধান-চালকে ব্যবহার করে আসছে। চাল, ভাত, খই-চিড়ার জায়গায় মাখানো ছোলামুড়ি কীভাবে বাঙালি মুসলমানের ইফতারির মূল উপকরণ হয়ে উঠল, সে ইতিহাস বেশ কৌতূহলোদ্দীপক বটে।

সপ্তম-অষ্টম শতক থেকেই বাণিজ্য ও ধর্মপ্রচারের কাজে এ অঞ্চলে আরব দেশ থেকে লোকেরা আসতে শুরু করেন। আর ত্রয়োদশ শতকের শুরুতে বঙ্গে মুসলমান শাসনের সূত্র ধরে সনাতনসহ বিভিন্ন ধর্মের মানুষ ধর্মান্তরিত হতে থাকেন। এভাবেই সাধারণ সনাতনীদের জীবনাচারের অনেক রীতিনীতি বাংলার মুসলমানদের মধ্যে প্রবেশ করেছে। আবার দিল্লিতে পাঠান ও মোগল শাসনের সূত্র ধরে অভিজাত ভারতীয় পোশাক-পরিচ্ছদ ও খাদ্যতালিকায় যুক্ত হয়েছে মুসলমানি ধারা। মধ্যযুগে শ্রীচৈতন্যের উত্থানের পর নদীয়াকে কেন্দ্র করে পূর্বে আসাম থেকে পশ্চিমে বিহার পর্যন্ত হিন্দু-মুসলিম সংস্কৃতির সমন্বয় প্রবল হয়।

আনুমানিক ষোলো শতকে লেখা মুকুন্দরামের কাব্যে আছে, মুসলমানেরা ‘পাঁচ বেরি’ নামাজ পড়েন এবং ‘প্রাণ গেলে’ও রোজা ছাড়েন না। আর কাজী নজরুল ইসলামের কাব্যগ্রন্থ নতুন চাঁদ (১৯৪৫)-এর অনেক কবিতায় রোজা আর ইফতারের প্রসঙ্গ আছে। যেমন ‘এই উপবাসী আত্মা—এই যে উপবাসী জনগণ,/ চিরকাল রোজা রাখিবে না—আসে শুভ “এফ্​তার” ক্ষণ!’ (‘কেন জাগাইলি তোরা’), ‘রোজা এফ্তার করিব সকলে, সেই দিন ঈদ হবে’ (‘কৃষকের ঈদ’)।

নমুনাগুলো থেকে এটা পরিষ্কার, কবি ‘রোজা’ আর ‘ইফতার’কে ব্যবহার করেছেন বিদ্রোহের তাৎপর্যে। উপনিবেশিত জনগণের অবস্থা বোঝাতে এবং পরিবর্তিত নতুন সময়ের প্রত্যাশায় তিনি এখানে রোজা-ইফতারের প্রসঙ্গ টেনেছেন।

আসলে বাংলা সাহিত্যে রোজা, ইফতার—এসব প্রসঙ্গ খুঁজে পাওয়াই দায়। চর্যাপদ থেকে প্রাচীন বাংলার সমাজজীবন খুঁজে বের করা যায়, কিন্তু বাংলাদেশের সাহিত্য থেকে ইফতারির খাদ্য-উপাদানের বিবর্তন বোঝা যায় না। এর জন্য আশ্রয় নিতে হয় ইতিহাসের।

মরক্কোর পর্যটক ইবনে বতুতা বাংলা ভ্রমণকালে সিলেটের সুফি-দরবেশ হজরত শাহজালাল (রাহ.)-এর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। ইবনে বতুতার ভ্রমণকাহিনি আর রিহলাতে আছে, হজরত শাহজালাল (রাহ.) ইফতারে গরুর দুধ পান করতেন। সপ্তম শতকে ইসলাম ধর্ম আরব দেশ থেকে বিস্তৃত হতে থাকে অন্যান্য দেশে। ওই সময়ে হজরত মুহাম্মদ (সা.) ইফতারি হিসেবে খেজুর ও পানি খেতেন। তাঁর মৃত্যুর প্রায় ২৫০ বছর পর সংগৃহীত এ তথ্য পৃথিবীর ধর্মপ্রাণ মুসলমানেরা সুন্নত হিসেবে পালন করেন। বাংলাদেশের মুসলমানেরাও ইফতারে খেজুর রাখেন। তবে মুসলিম সাম্রাজ্য বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে আন্তদেশীয় সম্পর্কের কারণে ইফতারির উপাদানের মধ্যে অনেক সংযোজন-বিয়োজন ঘটেছে। এমনকি স্থানীয় অনেক খাবারও জনপ্রিয় হয়েছে। যেমন মালদ্বীপে মাছ সহজলভ্য হওয়ায় সেখানকার ইফতারিতে মাছের তৈরি বিভিন্ন পদ ব্যবহার হতে দেখা যায়।

মোগল সেনাপতি মির্জা নাথান বাহারিস্তান-ই-গায়রি গ্রন্থে লিখেছেন, সতেরো শতকের শুরুর দিকে তিনি বঙ্গ অঞ্চলে ছিলেন। তখন প্রথম রমজানের দিনে পরিবার-পরিজনের কথা ভেবে তাঁর মন খারাপ হয়ে যায়। দিল্লির পুরোনো দিনের কথা স্মরণ করে তিনি বিষণ্ন মনে বন্ধু মির্জা আলম বেগের তাঁবুতে গিয়ে হাজির হন। সেখানে গিয়ে অবাক হয়ে লক্ষ করেন, এখানকার ইফতার আয়োজন অনেকটা দিল্লির মতো। বিভিন্ন ঐতিহাসিক সূত্র থেকে জানা যায়, মোগল সেনাদের তাঁবুর জনপ্রিয় পদ ছিল ‘নান তাফখান’—বাদাম দেওয়া একরকম গমের রুটি। এ ছাড়া সুজি দিয়ে তৈরি রুটি শিরমাল, আকবরি নানখাতাই—এসবও ছিল।

১৬৩৯ সালে শাহ সুজা বাংলার সুবাদার হওয়ার পর কয়েক শ শিয়া পরিবার ঢাকায় আসে। তারা এখানে খোরাসানি পোলাও পরিচিত করায়। এ ছাড়া মোগলরা মাংস, মসলা, লেবুর রস ও গম দিয়ে তৈরি হালিমজাতীয় একরকম খাবার তৈরি করতেন। তবে কাবাব, হালিম, বিরিয়ানি—এগুলো মূলত পারস্যের খাবার। জিলাপিও পারস্যের খাবার, জনপ্রিয় হয়েছে মোগলদের দ্বারা।

আঠারো শতকের গোড়ার দিকে ঢাকার দেওয়ান মুর্শিদ কুলি খাঁ চকবাজারকে আধুনিক বাজারে পরিণত করেন। তখন এর নাম ছিল ‘বাদশাহি বাজার’। নাজির হোসেনের কিংবদন্তির ঢাকা বইয়ে উল্লেখ আছে, রোজার সময়ে মোগলাই খাবার ও রকমারি ইফতারি বিক্রি করা হতো এখানে। বাকরখানি, বোগদাদি রুটি, শবরাতি রুটি, কাকচা, কুলিচা এবং হরেক রকমের নানরুটি পাওয়া যেত তখন। এসব পদের অধিকাংশই এই ২০০ বছরে হারিয়ে গেছে। ছিল ১০-১৫ সের ওজনের মাংসের টুকরা থেকে তৈরি পাসান্দ কাবাব, এখন যা সুতি কাবাব নামে পরিচিত। বিশ শতকের গোড়ার দিকেও ঢাকার ইফতারির বাজার বলতে কেবল চকবাজারকে বোঝাত।

পাকিস্তান পর্বে বিভিন্ন পাড়া-মহল্লায় ইফতারির অস্থায়ী দোকান গড়ে উঠতে দেখা যায়। তখন ইফতারির অন্য সব উপকরণের সঙ্গে স্থানীয় নানা রকম পিঠাও যোগ হয়। এখন বয়সে যাঁরা প্রবীণ, তাঁরা পুরান ঢাকার ইফতারির জৌলুশের কথা ভুলতে পারেন না। তাঁরা বলেন, সামান্য বেতনের কর্মচারীরাও রোজার দিনে ইফতারে দেদার খরচ করতেন। আজকের দিনেও বাঙালি ইফতারে কার্পণ্য করে না।

আজকের ইফতারে আমাদের প্রধান খাদ্য ছোলামুড়ি। এই ছোলা মূলত আফগানদের খাবার; কাবুলিওয়ালাদের হাত ধরেই তা বাঙালি মুসলমানের ইফতারে জায়গা করে নিয়েছে। রমজানের আগে শবে বরাতে যে বুটের ডালের হালুয়া তৈরি করা হয়, তার আসল নাম হাবশি হালুয়া। এটিও আফগানদের খাবার। পাকিস্তান আমলে চকবাজারে বুট ও শসাকুচি দিয়ে তৈরি ঘুগনির চল ছিল। আর পেঁয়াজু, আলুর চপ—এসব ভাজাপোড়া-জাতীয় খাবার এসেছে উত্তর ভারত থেকে। ওই সব খাবারের ধারায় বাঙালি নিজের কৌশল খাটিয়ে বানিয়েছে বেগুনি। এ ছাড়া চালের তৈরি নানা পদ, যেমন খই, মুড়ি, চিড়া বাঙালির খাদ্যতালিকায় তো বহু যুগ ধরেই আছে। শুরুতেই বলা হয়েছে রোজার দিনে একসময়ে চাল ভিজিয়ে রাখা হতো পানিতে এবং সাধারণ মুসলমানেরা সেই চাল মুখে দিয়ে রোজা খুলতেন। তবে ছোলা-মুড়ি-পেঁয়াজু একসঙ্গে করে খাওয়ার বুদ্ধি হয়তো স্থানীয় এবং সাম্প্রতিক।

সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হক তাঁর ছেলেবেলার স্মৃতিচারণায় লিখেছেন, ‘ইফতার মানে একমুঠো চালভাজা পাঁচজনে ভাগ করে চিবিয়ে খাওয়া, সঙ্গে বিচিঅলা আঁটিয়া কলা জুটল তো সেই কলা একটি, আর কুয়োর লাল পানি।’ শস্যদানা হিসেবে চাল বা মুড়ি ইফতারে ব্যবহৃত হয়ে আসছে বহুকাল আগে থেকেই। আর মুড়ির সঙ্গে ছোলা-মুড়ি-পেঁয়াজু ইত্যাদি, এমনকি জিলাপি ভেঙে মাখিয়ে খাওয়ার ধরনটি চলছে ১৫০-২০০ বছর ধরে, যা পুরান ঢাকা থেকে সারা দেশে ছড়িয়েছে। ধারণা করা যায়, হতদরিদ্র মানুষ বিভিন্ন জায়গা থেকে পাওয়া নানা রকম ইফতারি একসঙ্গে ভেঙে মিশিয়ে কয়েকজন ভাগ করে খেতেন।

লক্ষ করা যায়, ইফতার আয়োজনে শাসকদের পছন্দ-অপছন্দ সাধারণ মানুষকে প্রভাবিত করেছে। একই সঙ্গে আরও লক্ষণীয়, প্রায় ২০০ বছর ইংরেজরা শাসন করলেও পাশ্চাত্য খাবার ইফতারির তালিকায় কখনো আসেনি। এর পেছনে ধর্মীয় কারণই মুখ্য। তবে খাদ্যাভ্যাস, ফসলের প্রাপ্যতা, সংগতি ইত্যাদিও নিয়ামক হিসেবে কাজ করেছে। প্রসঙ্গত বলা যায়, বাঙালির গম খাওয়ার ইতিহাস খুবই নতুন। ফলে খাদ্যাভ্যাস নিয়ত পরিবর্তনশীল।

শেষ করি এই বলে যে বিভিন্ন স্মৃতিকথায় অল্পবিস্তর রোজা-ইফতারের কথা এলেও বাংলা সাহিত্যে এ প্রসঙ্গ প্রায় অনুপস্থিত থেকেছে।