শ্রদ্ধা
বাবার জন্য কয়েক ছত্র
আগামীকাল কবি হাবীবুল্লাহ সিরাজীর জন্মদিন। গতবছরের মে মাসে প্রয়াত হয়েছেন বাংলা একাডেমির সাবেক এই মহাপরিচালক। জন্মদিন উপলক্ষে বাবাকে নিয়ে নিজের অনুভবের কথা লিখেছেন তাঁর শিল্পী পুত্র।
আগামীকাল বাবার জন্মদিন। কবিতা লেখার খাতাগুলো তাঁর অপেক্ষায় থেকে থেকে ক্লান্ত বোধ হয়। তাকে থরে থরে সাজানো বইগুলো আজ নীরব, ঘুমন্ত। নিথর চশমা, কলম শুয়ে থাকে এককোণে। ঝুলবারান্দার গাছগুলো শীতের নরম রোদ গায়ে মেখে ঝিমোয়। দেয়ালে ঝোলানো ঘড়ির নির্লিপ্ত কাঁটা বুকে ভর দিয়ে দিন, মাস, বছর গড়ায়। ফ্রেমে বাঁধানো সাদাকালো ছবির কাচে ধুলা জমে কি? হলদে হয়ে যাওয়া কবিতার বইয়ের পাতার ক্ষীণ মর্মর ধ্বনি কানে আসে না আর।
বাবার লেখা কবিতা বরাবরই আমার কাছে দুর্বোধ্য, অধরা; বাবার মনের অতল গহিনের মতোই। সাহিত্য নিয়ে তাঁর সঙ্গে কদাচিৎ আলাপ হলেও কবিতা নিয়ে চর্চা হয়নি কখনোই। নিজের লেখা নিয়ে বাক্য ব্যয় করতে তিনি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতেন না হয়তো। কিংবা কবিতার অলিগলি তাঁর যতটা চেনা, আমার ততটা নয় বলেই হয়তো। সত্যি বলতে, বাবার সঙ্গে আমার কথা হতো অল্পই। পাশাপাশি বসে নীরবতার আশ্রয়ে।
হয়তো ভাষা খুঁজে পেতাম না আমরা বা মুখে বলার দরকার বোধ হতো না। শব্দ কি পারে মনের সব ভাব প্রকাশ করতে? নিজে কবিতার বড় সমঝদার না হলেও বাবার সংগ্রহে এন্তার কবিতার বই থাকার সুবাদে দেশ–বিদেশের বহু কবি আর কবিতার সঙ্গে আমার পরিচয় ঘটেছে। বাবার বন্ধুমহলে কবিদের আনাগোনাই ছিল বেশি। রফিক আজাদ, বেলাল চৌধুরী, রবিউল হুসেইন, আসাদ চৌধুরী, মুহম্মদ নূরুল হুদা, সমুদ্র গুপ্তসহ অনেক খ্যাতনামা কবির যাতায়াত ছিল বাড়িতে, রাত–বিরেতে, সময়–অসময়ে। ছিল পারিবারিক হৃদ্যতা। তাঁদের অনেকেই তাঁর সঙ্গী হয়েছেন অনন্তযাত্রায়, কেউ আগে, কেউ পরে।
বাবা লড়াই করে গেছেন জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত। লড়াই করেছেন নিজের সঙ্গে, সমাজের নিয়মতান্ত্রিকতার সঙ্গে, অর্থনৈতিক দৈন্যের সঙ্গে আর শেষে দুরারোগ্য ব্যাধির সঙ্গে। গৃহস্থের সংসারধর্ম তাঁকে আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধতে পারেনি। জীবন আর জীবিকার দ্বন্দ্বের জোয়াল বয়ে গেছেন। কবিতার জন্য ছুটে বেড়িয়েছেন দেশে–বিদেশে, দিনে–রাতে। জীবনের সিংহভাগ কাটিয়েছেন নিজের হিসেবে, নিজের লেখা কবিতার পঙ্ক্তিগুলোর মতোই। এত মানুষের ভিড়েও বাবা হয়তো নিঃসঙ্গই ছিলেন, নাহলে লিখবেন কেন, ‘আমার একজনই বন্ধু’? কবিরা বোধ হয় এমনই হয়, দ্বন্দ্ব আর দ্বৈততার দ্বৈরথে মত্ত।
বাবার বইয়ের প্রচ্ছদ বা অলংকরণের দায়িত্ব অনেক সময় আমার ঘাড়ে বর্তেছে। সত্যি বলতে, বেশির ভাগ সময়ই বেগ পেতে হয়েছে কঠিন পঙ্ক্তিগুলোর ভাবনির্যাস নিংড়ে বের করতে। বাবার অপ্রকাশিত বইয়ের পাণ্ডুলিপি এখনো পড়ে থাকে আমার পড়ার টেবিলে। প্রকাশকের তাগাদা সত্ত্বেও কাজ আর করা হয়ে ওঠেনি। পাণ্ডুলিপির পাতা ওল্টানোর সাহস সঞ্চয় করা হয়নি আর। একতাড়া কাগজের বোঝাটা বড্ড ভারী বোধ হয় আজ!