লোভের ফাঁদে কেন পা দেয় মানুষ

মাল্টিলেভেল মার্কেটিং বা এমএলএম, ই–কমার্সের পর এবার দেখা গেল এমটিএফইর মতো অ্যাপভিত্তিক প্রতারণা। এর আগেও মানুষ বিচিত্র উপায়ে প্রতারিত হয়েছেন। তবু তাঁরা কেন বারবার পা দেন লোভের ফাঁদে?

বিনা শ্রমে অধিক মুনাফার প্রলোভন এড়ানো যেকোনো মানুষের পক্ষেই কঠিনছবি: সংগৃহীত

মাল্টিলেভেল মার্কেটিং বা এমএলএম, ই–কমার্সের পর এবার দেখা গেল এমটিএফইর মতো অ্যাপভিত্তিক প্রতারণা। মোড়ক নতুন, প্রতারণার কৌশল ঘুরেফিরে সেই এক। ডেসটিনি, ইউনিপেটুইউ, যুবক, ইভ্যালি, ই–অরেঞ্জ, ধামাকা, এমটিএফই—নানা ধরনের স্ক্যাম বা প্রতারণার তালিকাটা কেবলই দীর্ঘ হচ্ছে। একই ফাঁদে তবু কেন বারবার পা দিচ্ছেন মানুষ?

ধোঁকা, জালিয়াতি, প্রতারণা, জোচ্চুরি—যে নামেই ডাকুন, এর শিকার আপনি হচ্ছেন শত শত বছর ধরেই। প্রতারক আমার–আপনার মতোই একজন মানুষ; এবং সে আপনার–আমার আশপাশেই বিচরণ করে। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন স্ক্যাম খুঁটিয়ে দেখলে আপনি দেখবেন, প্রতারক প্রত্যেকবারই চেনা পথে হেঁটেছে। আস্থা, প্রলোভন ও অংশীদারত্বের একটি চক্র তৈরি করা হয়েছে, যা এড়ানো প্রায় অসম্ভব। আর এই ফাঁদ পাতার জন্য বেছে নেওয়া হয় বিশেষ সময় ও পরিস্থিতি; অনেক সময় পরিস্থিতি তৈরিও করা হয়। কীভাবে ঘটে সেটা?  

আস্থার মাধ্যমে

অস্ট্রেলীয় সাইবার নিরাপত্তাবিশেষজ্ঞ মনিকা টি হুইটি গবেষণা করেছেন স্ক্যামার বা প্রতারকদের আস্থাভাজন হয়ে ওঠার কৌশল নিয়ে। ‘দ্য ব্রিটিশ জার্নাল অব ক্রিমিনোলজি’তে প্রকাশিত এক নিবন্ধে তিনি ব্যাখ্যা করেন, প্রতারকেরা কীভাবে ধাপে ধাপে আস্থা অর্জন করে। আর তা করতে খুব সতর্কভাবে সাজায় পরিকল্পনা।

হুইটি বলছেন, মানুষ মানুষকে বিশ্বাস করবে এটাই স্বাভাবিক। এটাই স্বীকৃত সামাজিক প্রথা। একজন মানুষ আরেকজন মানুষকে কেন মিথ্যা বলবে, এই সরল মানবিক অবস্থানকে কাজে লাগিয়েই মূলত প্রতারক জাল বিস্তার করা শুরু করে।

কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা

আস্থা অর্জনের পরের ধাপটি হলো কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা। প্রতারক নিজেকে কোনো গুরুত্বপূর্ণ পদধারী বা স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠানের কর্তাব্যক্তি হিসেবে পরিচয় দেন, যেমন কোনো ব্যাংক, অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান, নিরাপত্তা সংস্থা বা তদন্তকারী সংস্থা। এতে করে ভিকটিম বা আক্রান্ত ব্যক্তি তাঁকে ভয় পান বা  মান্য করেন। যার ফলে কোনো রকম যাচাই–বাছাই ছাড়াই মেনে নেন প্রতারকের কথা।

অনেক মানুষ আত্মবিশ্বাসী হন যে অন্যের সঙ্গে যা ঘটেছে, তাঁদের সঙ্গে তা ঘটবে না। যেহেতু তাঁরা শিক্ষিত এবং তাঁদের কাছে বেশি তথ্য রয়েছে, তাই তাঁরা সতর্ক থাকবেন। আর এই আত্মবিশ্বাসের বলেই অনেক সময় ভুল পথে পা বাড়ান তাঁরা।

অনেক মানুষ আত্মবিশ্বাসী হন যে অন্যের সঙ্গে যা ঘটেছে, তাঁদের সঙ্গে তা ঘটবে না
ছবি: সংগৃহীত

প্রলোভনের ধাঁধায়

লোভ মানুষের এক আদিম প্রবৃত্তি। বিনা শ্রমে অধিক মুনাফার প্রলোভন এড়ানো যেকোনো মানুষের পক্ষেই কঠিন। ব্রিটিশ বহুজাতিক ব্যাংক বার্কলের আচরণগত অর্থনীতি প্রধান পিটার ব্রুকস ব্রিটিশ পত্রিকা ‘স্টাইলিস্ট’কে বলছেন, ‘আমরা সবাই–ই চাই এমন কিছু যেন আমরা পাই, যা অন্য কেউ পাচ্ছে না; এবং এই আকাঙ্ক্ষা অনেক সময়ই আমাদের ভুল সিদ্ধান্ত গ্রহণের দিকে ঠেলে দেয়, যেহেতু আমরা অন্যদের তুলনায় নিজেরা ভালো থাকতে চাই।’

এ প্রসঙ্গে পিটার ব্রুকস আরও বলেন, ‘মানুষ নিজের সম্পদ বাড়াতে চান। আর এই প্রবৃত্তির সুযোগ নেন বিশেষজ্ঞ প্রতারকেরা। অনেক সময় অধিক মুনাফার জন্য আমরা নিজেদের বিচারবুদ্ধিকে পাশে সরিয়ে রাখতেও পিছপা হই না।’

আবার প্রতারকদের প্রকল্পে বিনিয়োগ করাকে অনেক ভিকটিম বা আক্রান্ত ব্যক্তি দীর্ঘমেয়াদি জুয়া হিসেবে দেখেন। যতবারই তাঁরা অর্থ হারান, ততবারই তাঁদের মনে এ রকম আশা জাগে, পরেরবার যে মুনাফা হবে, তাতে সব টাকা উঠে আসবে। মূলত এই আশাই গোটা প্রতারণাকে বাঁচিয়ে রাখে।

ধোঁকা, জালিয়াতি, প্রতারণা, জোচ্চুরি—যে নামেই ডাকুন, এর শিকার আপনি হচ্ছেন শত শত বছর ধরেই। প্রতারক আমার–আপনার মতোই একজন মানুষ; এবং সে আপনার–আমার আশপাশেই বিচরণ করে। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন স্ক্যাম খুঁটিয়ে দেখলে আপনি দেখবেন, প্রতারক প্রত্যেকবারই চেনা পথেই হেঁটেছে। আস্থা, প্রলোভন ও অংশীদারত্বের একটি চক্র তৈরি করা হয়েছে, যা এড়ানো প্রায় অসম্ভব।

অংশীদারত্বের ধোঁকাবাজি

এমএলএম, ই–কমার্স বা অ্যাপভিত্তিক প্রতারণা—প্রতিটি ক্ষেত্রেই বিনিয়োগকারী একটি বড় প্রতিষ্ঠান বা সংগঠনে অংশীদার হয়েছেন বলে তাঁকে আশ্বস্ত করেন প্রতারক। প্রতারকেরা বলেন, এটি একটি বড় নেটওয়ার্ক, যেখানে ধাপে ধাপে আছে ওপরে ওঠার সুযোগ। ফলে ‘ওপরে ওঠার’ স্বপ্ন নিয়ে এগোতে থাকেন বিনিয়োগকারী। আর তার অংশীদারত্বের অনুভূতি তাঁকে উদ্বুদ্ধ করে আরও মানুষকে এই প্রকল্পে বিনিয়োগে উৎসাহিত করতে। এবং সে জন্যও তাঁকে পুরস্কৃতও করেন প্রতারক। এর মাধ্যমে সামাজিকভাবেও পুরো প্রতারণার একটি গ্রহণযোগ্যতা তৈরি হয়। অন্যদের অংশ নিতে দেখে অংশগ্রহণ করেন অনেকেই। এভাবেই এই স্ক্যাম বা প্রতারণা সাফল্যের শীর্ষে আরোহণ করে।

আমরা সবাই–ই চাই এমন কিছু যেন আমরা পাই, যা অন্য কেউ পাচ্ছে না
ছবি: সংগৃহীত

যেভাবে আপনি প্রতারকদের হাত থেকে বাঁচতে পারেন

মার্কিন বাণিজ্য সাময়িকী ‘ফোর্বস’ বলছে, কয়েকটি পদক্ষেপ নিয়ে আপনি প্রতারণার হাত থেকে বাঁচতে পারেন:

১. মনে রাখুন, প্রতারকেরা সব সময় আপনাকে খুঁজছে

আপনি যদি মনে করেন, যাঁরা প্রতারিত হন, আপনি তাঁদের মতো নন, তাহলে আপনি ভুল ভাবছেন। প্রতারকেরা যে কাউকে লক্ষ্য বানাতে পারেন এবং তাঁদের প্রভাবিত করতে পারেন।  

২. প্রতারকের মতো চিন্তা করুন

বেশির ভাগ মানুষই সৎ এবং তাঁরা অসৎ মানুষের মতো চিন্তা করেন না। মনে রাখুন যে জগতে অসৎ মানুষের অভাব নেই। কাজেই কেউ আপনার কাছে টাকা চাইলে আপনার মনে যেন সন্দেহ জাগে।

৩. মেনে নিন যে প্রতারকের কাছে আপনার ব্যক্তিগত তথ্য আছে

কেউ যদি আপনার ব্যক্তিগত তথ্য আপনার কাছে প্রকাশ করেন, তাহলে তাঁকে বিশ্বাস করবেন না। এ ধরনের তথ্য হাসপাতাল, ব্যাংক কিংবা সরকারি কোনো সংস্থা থেকে সহজেই জোগাড় করা সম্ভব। কাজেই নিজের যেকোনো ব্যক্তিগত তথ্য প্রকাশের আগে যথাযথভাবে বৈধতা যাচাই করুন।  

৪. নিজের অনুভূতির বিষয়ে সতর্ক থাকুন

প্রতারকেরা প্রথমে আপনাকে আবেগপ্রবণ করে তোলার চেষ্টা করবেন, যাতে আপনি সুষ্ঠুভাবে চিন্তা না করতে পারেন। তাই ভাবুন, আপনি যা করছেন, তা আবেগের বশবর্তী হয়ে করছেন কি না। তাড়াহুড়া করবেন না। ভালো করে ভাবুন। সব তথ্য যাচাই করুন। প্রতারকেরা সব সময় জরুরি পরিস্থিতির সৃষ্টি করেন এবং দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে বলেন। এটা প্রতারণার একটা বড় লক্ষণ। সময় নিয়ে আস্থাভাজন কারও সঙ্গে কথা বলে তারপর সিদ্ধান্ত নিন। মোদ্দা কথা, নিজের অনুভূতির বিষয়ে সতর্ক থাকুন।

৫. কর্তৃত্ব ফলানো হচ্ছে কি না খেয়াল করুন

প্রতারকেরা সব সময় কর্তৃত্ব ফলানোর চেষ্টা করবেন। তাঁরা চাইবেন আপনি তাঁদের কর্তৃত্ব মেনে নেন। যখন কেউ তথ্য, হুমকি, প্রযুক্তি, কর্তৃত্বপূর্ণ কণ্ঠ বা অন্য কোনো উপায়ে আপনাকে বশে আনার চেষ্টা করছেন, তখনই সতর্ক হয়ে যান।

সর্বশেষ কথা হলো, লোভের বশবর্তী হয়ে দ্রুত কোনো সিদ্ধান্ত না নেওয়াই সংগত।