সময়কে পরখ করার চোখ

‘লস্ট অ্যান্ড ফাউন্ড’, শিল্পী: চন্দ্রশেখর দে

চন্দ্রশেখর দে ব্যঞ্জনাপ্রধান ছবি আঁকেন। বস্তুবিশ্ব তাঁর ভুবনে এমন এক রূপময়তা পায়, যা অনুকারক জাতের নয়। তবু তিনি বাস্তবের দিকে পিঠ ফিরিয়ে রাখেন না। বাস্তবের যে পুনর্নির্মাণ তাঁর কাজকে ব্যঞ্জনা দেয়, তা-ও দ্বন্দ্বহীন নয়; বরং কলকাতাকেন্দ্রিক শিল্প আন্দোলনের অন্যতম পুরোহিত নন্দলাল বসুকৃত ছবির যে তিন প্রকারের চরিত্র—অনুকারক, ব্যঞ্জক ও ছান্দসিক—তার মধ্যেই চন্দ্রশেখর সৃষ্টিশীলতার সুরাহা করে আসছেন।

প্রায় এক যুগ আগে গ্যালারি-২১-এর প্রদর্শনীতে শিল্পীর রূপসাধনা বিমূর্ততা পর্যন্ত বিস্তার পেয়েছিল, কিন্তু তিনি প্রচলিত বিমূর্তের দ্বারস্থ হননি। সাদা-কালোতে এমন রূপ চাক্ষুষ করে তুলেছিলেন, যা একাধারে অন্দরমহল ও আকাশমহলের অনুভূতি দেয়। ছবি যে বস্তুকে ভাবব্যাঞ্জক পরিণতির দিকে নিয়ে যাওয়ার বাহন—এ বিষয়ে শিল্পীর কোনো দ্বিধা ছিল না। গ্যালারি কায়ার মাঝারি পরিসরে অসংখ্য ড্রয়িং ও আলো-ছায়াপ্রধান চিত্রে চন্দ্রশেখরের ভাষার পরম্পরা জানা যায়।

রেখার ঋজুতা চন্দ্রশেখরের ছবির মূল বলে ধরে নেওয়া যায়। এই প্রদর্শনীতে রেখাচিত্রের বৈচিত্র্য অনেক।

অনুকৃতি থেকে যদিও প্রতিটি কাজের শুরু, অধিকাংশ ক্যানভাসে তা রং ও রেখার ছন্দে চন্দ্রশেখরের নিজস্ব আকারায়ণের সূত্রে ছবি হয়ে উঠেছে। নারী-অবয়ব ও প্রকৃতি যেমন সাদা রঙের পটভূমিতে ছান্দসিক মাত্রা পেয়েছে, তার বিপরীতে কাগজে-কলমে আঁকা ছোট আকারের ছবিতে শিল্পী তাঁর নৈশ চরিত্রের চিত্রকল্পগুলোতে যেন এক ঐশীভাবের জন্ম দিয়েছেন। ছবিগুলোতে গৎবাঁধা অঙ্কনের চিহ্ন নেই। শিল্পী এমন এক মায়াবী জগতের ইশারা হাজির করেছেন, যাতে রেখা, বিন্দু ও অপরাপর কলমজাত কারিকুরিতে তৈরি আবহ অঙ্কন থেকে দূরের বলে ঠাহর হয়। সাধারণত আলোয় উদ্ভাসিত চিত্রকল্পে আমরা দিব্যতা খুঁজি, তাঁর ক্ষেত্রে তা যেন অন্ধকারাচ্ছন্ন জগতের মধ্যে থিতু। 

এসব ছবি ভূ দৃশ্যের মতো। এখানে ব্যক্তির পরিসর প্রায়শ প্রাকৃতিক বা নাগরিক পরিসরে একাকার। পরাবাস্তব ছবির মতোই এতে বাস্তবের চিহ্ন আধো উপস্থিত, আধো অনুপস্থিত। অথচ কোনো কোনো ছবিতে পরিপ্রেক্ষিতের সূত্রে দিগন্ত পর্যন্ত দেখা যায়। এচিং বা অ্যাকোয়াটেন্ট ব্যবহার করে তলের যে সৌন্দর্য তৈরি করা যায়, কলমের সূক্ষ্ম ব্যবহারে শিল্পী তা অর্জন করেছেন। 

শিল্পী কিছু প্রতিকৃতিও এঁকেছেন। নিজের প্রতিকৃতি আঁকতে গিয়ে যেন রাতের আকাশে চোখ রেখে নাক–চোখ-কপালে আলোর ঝলক ধরার প্রয়াস পেয়েছেন। আবার ‘মেমোরেবল ফেস’ শিরোনামের কাজে যেন তুলে ধরেছেন মানুষের আদিম সভ্যতার অচেনা অবয়ব। এসব ছবি গভীর অভিনিবেশের ফল।

রেখার ঋজুতা চন্দ্রশেখরের ছবির মূল বলে ধরে নেওয়া যায়। এই প্রদর্শনীতে রেখাচিত্রের বৈচিত্র্য অনেক। তারপরও প্রসাধন বা অবসর মুহূর্তে এক নারীমূর্তির বারবার উপস্থিতি পুনরাবৃত্তিমূলক। তবে রেখার শক্তি এখানেও দৃশ্যমান। 

যে অন্তঃপ্রেরণায় চন্দ্রশেখর দে শিল্প রচনা করেন, তাতে এক গভীর সময়চেতনা বর্তমান। তিনি কী চোখে সময়কে পরখ করেন, তার মোক্ষম উদাহরণ ‘লস্ট অ্যান্ড ফাউন্ড’ কাজটিতে। এতে ক্যানভাস বাঁধাই করা হয়েছে প্রাচীন দালানের খিলানের অনুকরণে, যা কাঠ দিয়ে পোঁতা। মধ্যবর্তী ক্ষেত্রে ভাসমান চেয়ার, জ্যামিতিক ও অজ্যামিতিক আকার যেন সময়ের অবশিষ্টাংশ। পুনর্নির্মাণের হয়তো এখানেই শুরু।

প্রদর্শনীটি চলবে ১৭ মে পর্যন্ত।

মোস্তফা জামান