‘আমরা শ্রীলঙ্কানরা দুঃখ-কষ্ট নিয়ে ব্যঙ্গ করতে জানি’

১৭ অক্টোবর ঘোষিত হয়েছে বুকার পুরস্কার। শ্রীলঙ্কার কথাসাহিত্যিক শেহান করুণাতিলকা তাঁর উপন্যাস দ্য সেভেন মুনস অব মালি আলমেদার জন্য এ বছর পুরস্কারটি পেয়েছেন। তাঁর সাক্ষাৎকার নিয়ে আয়োজন।

দ্য সেভেন মুনস অব মালি আলমেদা হাতে শেহান করুণাতিলকা
ছবি: সংগৃহীত

শ্রীলঙ্কার কথাসাহিত্যিক শেহান করুণাতিলকার উপন্যাস দ্য সেভেন মুনস অব মালি আলমেদা বুকার পুরস্কারের সংক্ষিপ্ত তালিকায় নির্বাচিত হওয়ার পর তাঁর এই সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন জন সেলফ। উপন্যাসটি লেখার প্রেক্ষাপট বিশদভাবে উঠে এসেছে এখানে। ৮ অক্টোবর ব্রিটিশ সাময়িকী দ্য গার্ডিয়ান–এ প্রকাশিত সেই আলাপচারিতার নির্বাচিত অংশ অনুবাদ করেছেন নাফিস সাদিক

প্রশ্ন:

জন সেলফ: বুকার পুরস্কারের সংক্ষিপ্ত তালিকায় জায়গা করে নেওয়ার জন্য আপনাকে অভিনন্দন। দ্য সেভেন মুনস অব মালি আলমেদা কী কারণে বিচারকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে বলে আপনি মনে করেন?

শেহান করুণাতিলকা: এটা একটা কঠিন প্রশ্ন। বইটা আমি বেশ কয়েক বছর ধরে লিখছি। প্রতিবছর যখন নানা রকম পুরস্কার ঘোষিত হয়, তখন বিচারকদের বলতে শুনি, ‘আমরা বাস্তবধর্মী গল্প পছন্দ করি’ অথবা ‘আমরা গুরুগম্ভীর ধাঁচের বই পছন্দ করি।’ এসব কারণে কিছু অনুমান না করাটাই শ্রেয় মনে হয় আমার কাছে। বুকারের এ বছরের তালিকায় বেশ কিছু ব্যঙ্গাত্মক বা অন্য রকম বইও আছে দেখেছি। এবারের বিচারকদের সঙ্গে আমি তাই দেখা হওয়ার অপেক্ষায় আছি। সাক্ষাৎ পেলে আমি তাঁদের রুচিবোধের প্রশংসা করতে চাই।

প্রশ্ন:

জন: বুকারের সংক্ষিপ্ত তালিকায় থাকা অন্য প্রতিদ্বন্দ্বী লেখকদের কারও বই কি আপনি পড়েছেন?

শেহান: প্রতিদ্বন্দ্বী! আমি বরং বলব, আমরা কজন একসঙ্গে লটারি জিতেছি। দীর্ঘ তালিকায় থাকা বইগুলো ইতিমধ্যে অর্ডার দিয়েছি। তবে শ্রীলঙ্কায় এখন বই ডেলিভারি দেওয়া হচ্ছে না। কারণ, বর্তমান উদ্ভূত পরিস্থিতিতে বইকে আর নিত্যপ্রয়োজনীয় ভাবা যাচ্ছে না। যুক্তরাজ্যে গেলে সেখান থেকে বইগুলো সব সংগ্রহ করব।

প্রশ্ন:

জন: আপনার আগের উপন্যাস চায়নাম্যান প্রকাশের ১১ বছর পার হয়েছে। এই পুরোটা সময় ধরে আপনি কি দ্য সেভেন মুনস লিখছিলেন?

শেহান: না, এর মধ্যে আমার জীবনে অনেক কিছুই ঘটে গেল। বিয়ে হলো, সন্তান হলো। বাচ্চা দুটো এখন সারা দিন ছোটাছুটি করে বেড়ায়। এসব কারণে লেখালেখির গতিও কিছুটা কমে এসেছিল। আর বর্তমান নিয়ে আমি আসলে লিখতে চাইনি। বর্তমান বলতে বোঝাচ্ছি, ২০১০/২০১১ সালের কথা...শ্রীলঙ্কায় যখন গৃহযুদ্ধ সবে শেষ হয়েছিল। একজন আরেকজনকে দোষারোপ করায় তখন ব্যস্ত। আমি এ জন্য চাচ্ছিলাম, যারা গৃহযুদ্ধের ভয়াবহতার শিকার হয়েছে, তারাই নিজেদের কথা বলুক। এর কিছু পরে অনুভব করলাম, ১৯৮৯ সাল বা ওই সময়টাকে নিয়ে আমি লিখতে চাই। বেশ কয়েকবার ভুলভাবে শুরু করেছিলাম উপন্যাসটা। তবে একমাত্র জিনিস যেটা টিকে ছিল, সেটা হলো, এ উপন্যাসের মূল চরিত্র ‘মালি আলমেদা’। আর এভাবেই সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বইটা একটা আকার পেল।

প্রশ্ন:

জন: আপনি যে গল্প বলেছেন, সেটা ভয়াবহ আবার একই সঙ্গে হাস্যরসাত্মকও। এমন ভঙ্গিমা কেন বেছে নিলেন?

শেহান: আসলে পরিকল্পিতভাবে এমন করেছি কি না, বলতে পারছি না। আমরা শ্রীলঙ্কানরা অনেক ঝড়ঝাপটার ভেতর দিয়ে গেছি। যেকোনো দুঃখ–কষ্ট নিয়ে আমরা ব্যঙ্গ করতে জানি। এক বা দুই মাস আগেও যেমন ছিল, তার থেকে পরিস্থিতি এখন অনেক বেশি অস্থিতিশীল। চারদিকে অনিশ্চয়তা প্রকট। তবে এই অনিশ্চয়তা নিয়েও মানুষ কিন্তু হাসি-তামাশা করছে। কেবলই ভৌতিক—এমন কোনো গল্প আমি কোনো দিন লিখতে পারব বলে মনে হয় না। আমি বরং সময়টাকে অনুভব করার চেষ্টা করি। ১৯৮৯ সালের ওই ভয়াবহ সময়টাও অনেক রকম প্রহসনে ভরা। আমার লেখায় সেটাই আমি ধরার চেষ্টা করেছি।

প্রশ্ন:

জন: আপনার উপন্যাস লেখার ভঙ্গি অনেক বেশি শৃঙ্খলমুক্ত ও স্পন্দনশীল। নির্দিষ্ট কোনো রীতি কি আপনি অনুসরণ করেন?

শেহান: নব্বইয়ের দশক থেকে শ্রীলঙ্কার অনেক লেখক ইংরেজিতে লিখছেন। যেমন মাইকেল ওনদার্তশে, রমেশ গুনেসেকেরা। কিন্তু যাঁকে আমি গুরু হিসেবে মানি, তিনি হলেন কার্ল মুলার। ১৯৯৩ সালে দ্য জ্যাম ফ্রুট ট্রি লিখেছিলেন তিনি। শ্রীলঙ্কানদের মৌখিক কথনরীতি তিনিই প্রথমবার তাঁর লেখায় ব্যবহার করেছিলেন। চায়নাম্যান লেখার সময় আমি ওখান থেকে কিছু জিনিস ধার করেছিলাম, বিশেষ করে একজন মাতালের মুখ থেকে লম্বা একটা গল্প বলার আইডিয়াটা। কাজেই অপ্রচলিত বা শৃঙ্খলমুক্ত এই শ্রীলঙ্কান লিখনশৈলীর উৎপত্তি আসলে সেখান থেকেই।

প্রশ্ন:

জন: দ্য সেভেন মুনস লিখতে গিয়ে ঔপন্যাসিক হিসেবে আপনি নতুন কী শিখলেন?

শেহান: উপন্যাস লেখার প্রক্রিয়াটা এখন আরেকটু ভালোভাবে জানি। ২০০ পৃষ্ঠার খসড়া লেখা বেশ শ্রমসাধ্য। আগে নিজের লেখা নিজে পড়ে হতাশ হয়ে যেতাম। প্রথম খসড়া নিয়ে এখন আর আমার খুব বেশি প্রত্যাশা নেই। তৃতীয় উপন্যাসটা লিখছি এখন। জানি, প্রথম খসড়াটা খুব বাজে হবে। এর সঙ্গে এটাও জানি, যে উপন্যাস আমি লিখতে চাচ্ছি, সেটা লেখা সম্ভব।

সহজে হবে না, হয়তো অনেক বেশি কঠিন হবে। তবু একদিন হবেই।