লেখক–সাহিত্যিকদের রঙ্গরসে টইটম্বুর যে বই
প্রথমা প্রকাশন থেকে সম্প্রতি বের হয়েছে ‘লেখক–সঙ্গ: স্মৃতি আনন্দ’। বইটিতে আমাদের প্রণম্য লেখকদের নিয়ে স্মৃতিচারণা করেছেন আনিসুল হক। সেই বই নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ।
ঐতিহাসিক ঘটনাকে উপজীব্য করে যিনি অতুলনীয় সাহিত্য সৃষ্টি করে চলেছেন, ‘গদ্যকার্টুন’ নামে যিনি বাংলা সাহিত্যে নতুন এক ধারার প্রবর্তন করেছেন, তিনি আর কেউ নন, কথাসাহিত্যিক আনিসুল হক। প্রতিবছরই এই লেখকের দু–একটি বই বইমেলা উপলক্ষে তো বের হয়ই। তা ছাড়া বইমেলার বাইরেও তিনি বই প্রকাশ করেন। আনিসুল হক রচিত ‘রক্তে আঁকা ভোর’, ‘যারা ভোর এনেছিল’, ‘বিক্ষোভের দিনগুলোতে প্রেম’, ‘আলো-আধাঁরের যাত্রী’, ‘জেনারেল ও নারীরা’, ‘অপারেশন মুক্তাগাছা’ ইত্যাদি বই সাম্প্রতিক বছরগুলোতে পাঠকেরা বেশ ভালোভাবে গ্রহণ করেছেন। ইতিহাসকে কেন্দ্র করে তাঁর লেখা বইগুলো শুধু তথ্যবহুল ও সুখপাঠ্যই নয়, চমকপ্রদও বটে। তবে ২০২৩ সালের একুশে বইমেলায় প্রকাশিত ‘লেখক-সঙ্গ স্মৃতি আনন্দ’ বইটি একটু ব্যতিক্রম।
‘লেখক–সঙ্গ: স্মৃতি আনন্দ’
আনিসুল হক
প্রকাশক: প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা, প্রকাশকাল: ফেব্রুয়ারি ২০২৩, প্রচ্ছদ: সব্যসাচী হাজরা, ২৬৪ পৃষ্ঠা, দাম: ৫৮০ টাকা।
নন্দিত কবি–সাহিত্যিকদের নিয়ে এমন বই এখানে খুব একটা লেখা হয় না। তাই প্রসঙ্গক্রমে বইটি নিয়ে কিছু আলোকপাত করব। নামকরণই বলে দিচ্ছে, এটি একটি স্মৃতিচারণামূলক বই। এতে ২৫ জন বাংলাদেশি লেখক এবং ২ জন ভারতীয় লেখকের সঙ্গে আনিসুল হকের বিশেষ বিশেষ স্মৃতি আর ব্যক্তিগত ঘটনা প্রাধান্য পেয়েছে। সাধারণত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর-কাজী নজরুল ইসলাম, রবীন্দ্রনাথ-জগদীশ চন্দ্র বসুসহ অনেক কবি সাহিত্যিকের পারস্পরিক সম্পর্কের কথা আমরা জানি। তাঁদের নিয়ে অনেক গল্পকাহিনি বাজারে চালু আছে। বিশেষ করে রবীন্দ্র-নজরুল, তবে লেখকদের নিয়ে আলাদা করে এমন বই লেখা খুব একটা চোখে পড়ে না। আনিসুল হক কবি–সাহিত্যিকসহ সমাজের বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে সব সময় নিবিড় যোগাযোগ রক্ষা করে চলেন। তাঁর একটি ভালো গুণ হলো পরিচিতজনদের বিপদে-আপদে ছুটে যান, পাশে থাকেন। চলুন কবি-সাহিত্যিকদের নিয়ে এ বইয়ের পর্যায়ক্রমিক আলোচনা একটু দেখে নিই।
প্রথমে আসা যাক রোকনুজ্জামান খান দাদাভাইকে নিয়ে স্মৃতিগদ্যের দিকে। এ অধ্যায়ে আনিসুল হক তরুণ বয়সের স্মৃতিচারণা করেছেন। সদ্য স্নাতক শেষ করে কীভাবে ‘ইত্তেফাক’ পত্রিকায় তাঁর কবিতা প্রকাশিত হলো, সেই গল্পটাও তুলে ধরা হয়েছে। এরশাদবিরোধী আন্দোলন ও দ্বিজাতিতত্ত্ব নিয়ে প্রাণবন্ত আলোচনা লেখাকে সমৃদ্ধ করেছে। তবে এখানে দাদাভাইয়ের সঙ্গে স্মৃতিচারণামূলক গল্পে দাদাভাইয়ের প্রাধান্য ক্ষীণ বলেই মনে হয়েছে। উপরন্তু বুয়েটজীবনের স্মৃতি নিয়েই এখানে বড্ড আলোচনা করা হয়েছে। বিষয়বস্তুর প্রাসঙ্গিকতা যাই হোক না কেন, আত্মপ্রচারক হয়ে লেখক নিজের বই ‘ফাঁদ’–এর প্রসঙ্গ ঠিকই তুলে এনেছেন। তবে দাদাভাইয়ের কয়েকটি কথার গভীরতাই গল্পটিকে সুউচ্চ সীমায় নিয়ে গেছে। যেমন ‘পপুলার লিটারেচার জিনিসটা ভালো নয়। তুমি লিখবে লিটারারি ফিকশন। পপুলার ফিকশন না।’ এই উক্তি থেকে তরুণ লেখকেরা অনেক কিছু ধারণা নিতে পারেন।
‘প্রেমাংশুর রক্ত চাই’ আর ‘হুলিয়া’র কবি নির্মলেন্দু গুণের সঙ্গে স্মৃতিচারণামূলক গল্প তিনটি জম্পেশ হয়েছে। ‘নির্মলেন্দু গুণের রসিকতাগুলো’তে খুব একটা রসিকতা পাঠকেরা খুঁজে পাননি। তবে এখানেও জনাব হকের বুয়েটজীবনের স্মৃতি ছাড়াও নির্মলেন্দু গুণের বেশ কয়েকটি কবিতা নিয়ে অল্পবিস্তর আলোচনা করা হয়েছে। এদিকে নির্মলেন্দু গুণের ৭৭তম জন্মদিন উপলক্ষে আনিসুল হকের পদ্যটি অসাধারণ হয়েছে। এই কবিতার একটি লাইনের (এক শ বছর পরেও সচল নির্মলেন্দু গুণ) বিষয়বস্তু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতা ‘১৪০০ সাল’ (প্রকাশকাল ১৩০২ বঙ্গাব্দ) ও কাজী নজরুলের ‘১৪০০ সাল’ (প্রকাশকাল ১৩৩৪ বঙ্গাব্দ) কবিতা দুটোর সঙ্গে সাদৃশ্য খুঁজে পাওয়া যায়।
অপরদিকে নির্মলেন্দু গুণের মডেলিংয়ের বিষয়টি পাঠকদের কাছে খুব গুরুত্ব বহন করে না। তবে এই গল্পের মাধ্যমে গুণের অভিনয়–দক্ষতার কথা জেনে পাঠকেরা কিন্তু বেশ উচ্ছ্বসিতই হয়েছেন। তা ছাড়া আয়কর নিয়ে গুণের ব্যঙ্গাত্মক মন্তব্যটি বেশ লেগেছে, ‘ইনকাম ট্যাক্সটা দিয়ে দিব, বুঝছ? তাহলে আমাদের বড়লোকেরা যে ইনকাম ট্যাক্স দিতে চায় না, তাদের জন্য একটা দৃষ্টান্ত হবে।’ ‘নির্মলেন্দু গুণের আরও রসিকতা’ গল্পে বেশ কয়েকটি ভালো কৌতুকময় ঘটনা আছে, যা পাঠকদের সত্যি আনন্দিত করেছে। যেমন পুলিশে ধরা আর হোটেলে খেয়ে বিল না দেওয়া ইত্যাদি। নির্মলেন্দু গুণের রসবোধের প্রমাণ, হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে থেকেও সাংবাদিকদের নিয়ে তিনিই কেবল বলতে পারেন, ‘বাইরে ভিড় হয়ে গেছে নাকি? আমি তো এদের প্রত্যাশা পূরণ করতে পারব না। আমি তো মারা যাব না।’ তবে নির্মলেন্দু গুণকে নিয়ে দুটি স্মৃতিচারণা গল্পের শিরোনাম প্রায় একই রকম না হয়ে ভিন্ন হলে ভালো হতো। বোঝাই যাচ্ছে গল্পের শিরোনাম নিয়ে লেখক খুব বেশি তাড়াহুড়া করেছেন, বেশি চিন্তা করার সময় পাননি। আশা করি পরে যদি এ রকম লেখা আবারও লেখেন, তবে গল্পের শিরোনামের বিষয়ে আরও সচেতন হবেন।
অন্যদিকে কবি–কথাসাহিত্যিক সৈয়দ শামসুল হকের উপদেশ ‘পড়ো, পড়ো এবং পড়ো’ তরুণ লেখকদের জন্য এক অমীয় বাণী। আনিসুল হক সৈয়দ হককে নিয়ে যে লেখা লিখেছেন, তাতে সব্যসাচী এই লেখকের আরও একটি বক্তব্য আমাদের বিবেককে নাড়িয়ে দেয়, ‘এই দেশে সাহিত্য সমালোচনা করা হয় রাজনীতির মানদণ্ডে।’ সাহিত্যিকদের উদ্দেশে তাঁর আরও একটি কথা অসাধারণ অনুভূতিরই প্রকাশ, ‘…আমরা লেখক, আমাদের দায়িত্ব হলো ভালোবাসা দিয়ে লেখা। লেখার জন্য এই ভালোবাসাটুকু ধরে রেখো। আমাদের মধ্যে কতজনই তো তা ধরে রাখতে পারে না।’
সব্যসাচীর হাসপাতালে শয্যাশায়ীর অবস্থাও পাঠক হৃদয়কে নাড়িয়ে দিয়েছেন শায়েরি শুনিয়েছেন, ‘অশ্রুপাত করতে হয় না…’। আনিসুল হক অসাধারণ ও সুনিপুণভাবে সব্যসাচীর না ফেরার দেশে চলে যাওয়ার দৃশ্য পাঠকের দৃষ্টিপটে এঁকে তুলেছেন। কিন্তু অশ্রুপাত তো আর থামেনি। ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বরের বৃষ্টিপাতের সময় উদ্ভ্রান্ত আনোয়ারা সৈয়দ হকসহ সহস্র পাঠককে ভিজিয়ে দেবেন বলেই কি সব্যসাচী লেখক লিখেছেন ‘বৃষ্টি এসে ভেজায় কখন নাগেশ্বরীর মাঠ’।
এবার আসা যাক ‘শামসুর রাহমানের কাছে যাই’ গল্পে। এখানেও কবি শামসুর রাহমানের স্মৃতি যৎসামান্য বৈকি, বাকি সব নিজেদের বুয়েটের কথা আর কবির কয়েকটি কবিতা নিয়ে সামান্য আলোকপাত। তবে আনিসুল হকের ‘চোখের জ্যোতি নিয়ে যাচ্ছে কবি শামসুর রাহমানের’ লেখাটি পাঠকদের কলিজায় দাগ কাটল। সাংবাদিক জ ই মামুন আর অনু দুজনে কবিকে যে চক্ষুদান করতে ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন, এমন অজানা তথ্য পাঠকদের জানানোর জন্য আনিসুল হক ধন্যবাদ তো পাবেনই। তবে জ ই মামুনকে সাংবাদিক হিসেবে অনেকেই হয়তো চেনেন কিন্তু অনুর পরিচয় স্পষ্ট করা হলে পাঠকেরা তাঁকে চিনতে পারতেন। তা ছাড়া বর্তমানে স্মৃতিচারণামূলক গল্প–উপন্যাসের শেষে চরিত্র পরিচিতি দেওয়ার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। এতে চরিত্ররা বর্তমানে কে কোথায় আছেন বা তাঁদের অতীত অবস্থান ও ইতিহাস সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। কারণ, এই বই শত বছর পরও পাঠক পড়ে যেন বর্ণিত চরিত্রগুলোকে বুঝতে পারেন, চিনতে পারেন। পরবর্তী প্রজন্মের জন্য হলেও এমন চরিত্র পরিচিতি দেওয়াটা দরকার।
‘লেখক-সঙ্গ’ বইয়ের মাধ্যমে শামসুর রাহমানের ‘একটি মোনাজাতের খসড়া’ কবিতাটি নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরেছেন, যা সত্যিই প্রশংসার দাবি রাখে। হাজার বছরের লালিত অসাম্প্রদায়িক চেতনা নতুন প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দেওয়ার ক্ষেত্রে জনপ্রিয় গদ্যকার্টুনিস্ট সব সময়ই ব্যতিক্রম। ‘একটি মোনাজাতের খসড়া’ কবিতাটি বর্তমান বাস্তবতায় খুবই প্রাসঙ্গিক। অসাম্প্রদায়িক চেতনার বিস্তার এবং অন্ধকারের শক্তির বিরুদ্ধে এই কবিতা সুনিশ্চিতভাবেই নতুন প্রজন্মকে উজ্জীবিত করবে। তবে কলামিস্ট আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী যে ‘একটি মোনাজাতের খসড়া’ কবিতার জবাব লিখেছিলেন, সেটাও আনিসুল হক পাঠকদের স্মরণ করিয়ে দিলেন, যা অতুলনীয়। প্রসঙ্গক্রমে বঙ্কিমচন্দ্রের ‘দুর্গেশনন্দিনী’ ও ইসমাইল হোসেন সিরাজীর ‘রায়নন্দিনী’-এর কথা নিশ্চয়ই পাঠকদের মনে পড়েছে। তা ছাড়া মির্চা ইলিয়ডের ‘লা নুই বেঙ্গলি’ উপন্যাসের জবাবেই তো মৈত্রেয়ী দেবী লিখেছিলেন ‘ন হন্যতে’।
হাসান আজিজুল হকের সঙ্গে স্মৃতিচারণাটি বেশ সাবলীল হয়েছে। হাসান আজিজুল হকের অজানা অনেক বিষয় আনিসুল হকের মাধ্যমে পাঠকেরা জানতে পারলেন। হাসান আজিজুল হক সম্পর্কে আনিসুল হকের বিশ্লেষণ বেশ চমৎকার। তবে এই স্মৃতিচারণাটিতে লেখকের সঙ্গে ব্যক্তিগত স্মৃতির চেয়ে আজিজুল হকের লেখার পর্যালোচনা করা হয়েছে বেশি। প্রখ্যাত লেখকদের ব্যক্তিগত কাহিনি বেশি বেশি থাকলে পাঠকেরা ভীষণ উপকৃত হতেন। কেননা ব্যক্তিগত বিষয়গুলো তো আর গল্প–উপন্যাসে পাওয়া যায় না। সাহিত্যিকদের জীবনাচরণ জানার আগ্রহ শাশ্বত। ব্যক্তিগত স্মৃতিচারণা থেকে অনেক কিছু শেখার আছে, এর মাধ্যমে লেখকদের মনোজাগতিক অনেক বিষয় জানা যায়, কবি-সাহিত্যিকদের দর্শন অনুধাবন করা সহজ হয় আর জীবনবোধ সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। সুতরাং এমন পুস্তক যত বেশি প্রকাশিত হবে, পাঠকদের চিন্তার ক্ষেত্রগুলোও আরও বেশি প্রসারিত হবে।
হুমায়ূন আহমেদের যে গল্পগুলো হয়তো কেউ কোনো দিন জানতেও পারত না, আনিসুল হক কিন্তু সেগুলোই পাঠকদের সামনে তুলে ধরেছেন। হুমায়ূন আহমেদের সঙ্গে লেখকের ভুল–বোঝাবুঝির গল্প ছাড়াও বইমেলার স্মৃতি, দক্ষিণ হাওয়ার ফ্ল্যাটের গল্প, চিকিৎসাধীন অবস্থায় নিউইয়র্কে হাসপাতালের গল্প, কত কিছুই না চলে এসেছে হুমায়ূন আহমেদকে নিয়ে লেখা চারটি স্মৃতিগদ্যে। হুমায়ূনের অসুস্থতা থেকে শুরু করে মৃত্যুর খবরও যে নিপুণ শব্দশৈলীতে পাঠকদের মানসপটে মর্মান্তিকভাবে তুলে ধরেছেন, তা সত্যি অতুলনীয়।
বইটিতে আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যারের বুদ্ধিদীপ্ত ব্যঙ্গাত্মক সরল গরল উক্তিগুলোও আনিসুল হক পাঠকদের সামনে অসাধারণভাবে তুলে ধরেছেন। সায়ীদ স্যার যে পরজনমে নারী হয়ে শত পুরুষের বুকের ওপর দিয়ে হেঁটে বেড়াতে চেয়েছেন, সেটা তো অনেকেরই জানা ছিল না। সায়ীদ স্যারের প্রতিটি কথা আর বক্তৃতার মধ্যে দার্শনিক তত্ত্ব নিহিত থাকে। মানবজীবনের চলমানতা নিয়ে তিনি তো বলেই ফেললেন, ‘…কিন্তু মানুষ একটা আশ্চর্যের ব্যাপার। সে ধ্বংস চায় না, নিজেকে সে ধ্বংস করবে না। পুঁজিবাদ নিজেদের প্রয়োজনে প্রযুক্তি আনল, নিম্নমানের প্রযুক্তি, পরিবেশবধ্বংসী। এখন পুঁজিবাদই তো নিজেদের প্রয়োজনে গ্রিন টেকনোলজি আনছে।’
ব্যক্তির প্রস্ফুটিত সাফল্য আর ব্যক্তির সক্ষমতা প্রতি অন্তহীন ভালোবাসা নিয়ে স্যারের যে বিশ্লেষণ, সেটা সত্যি ব্যতিক্রম, ‘...আমার ভালোবাসাটা কিন্তু ব্যক্তির জন্য নয়। ব্যক্তির জন্য আমার খুব ভালোবাসা আছে, কিন্তু এ ধরনের ভালোবাসা তো মরে যায়। আমার ভালোবাসা ব্যক্তির সম্ভাবনার প্রতি। কারও মধ্যে কোনো একটা সম্ভাবনা দেখলে আমি আন্তরিকভাবে চাই সেটা বিকশিত হোক।’
হাসান আজিজুল হকের সঙ্গে স্মৃতিচারণাটি বেশ সাবলীল হয়েছে। হাসান আজিজুল হকের অজানা অনেক বিষয় আনিসুল হকের মাধ্যমে পাঠকেরা জানতে পারলেন। হাসান আজিজুল হক সম্পর্কে আনিসুল হকের বিশ্লেষণ বেশ চমৎকার। তবে এই স্মৃতিচারণাটিতে লেখকের সঙ্গে ব্যক্তিগত স্মৃতির চেয়ে আজিজুল হকের লেখার পর্যালোচনা করা হয়েছে বেশি। প্রখ্যাত লেখকদের ব্যক্তিগত কাহিনি বেশি বেশি থাকলে পাঠকেরা ভীষণ উপকৃত হতেন। কেননা ব্যক্তিগত বিষয়গুলো তো আর গল্প–উপন্যাসে পাওয়া যায় না। সাহিত্যিকদের জীবনাচরণ জানার আগ্রহ শাশ্বত। ব্যক্তিগত স্মৃতিচারণা থেকে অনেক কিছু শেখার আছে, এর মাধ্যমে লেখকদের মনোজাগতিক অনেক বিষয় জানা যায়, কবি-সাহিত্যিকদের দর্শন অনুধাবন করা সহজ হয় আর জীবনবোধ সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। সুতরাং এমন পুস্তক যত বেশি প্রকাশিত হবে, পাঠকদের চিন্তার ক্ষেত্রগুলোও আরও বেশি প্রসারিত হবে।
সাহিত্যাঙ্গনেও যে ল্যাং মারার রাজনীতি থাকতে পারে, সেটা আল মাহমুদকে নিয়ে স্মৃতিগদ্যে জনাব হক স্পষ্ট করেছেন। আনিসুল হকের মতে, আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যার ও লেখক আনিসুল হকের বাংলা একাডেমি পুরস্কার দেরিতে পাওয়ার নেপথ্যে কবি আল মাহমুদের প্রভাব থাকতে পারে। তবে নিশ্চিত করে বলা যাবে না যে কবি আল মাহমুদই তাঁদের বিলম্বে পুরস্কার পাওয়ার পেছনে কলকাঠি নেড়েছেন। অনেক ভালো ভালো লেখকও দেরিতে বাংলা একাডেমি পুরস্কার পেয়েছেন। সুতরাং এভাবে সরাসরি বলাটা কতটা সমীচীন হলো, লেখক নিজেই একটু ভেবে দেখতে পারেন। অনুমান বা নিছক ধারণা নিয়ে এভাবে খোলামেলা বক্তব্য দেওয়া সমীচীন নয় বৈকি। এটা যেহেতু উত্তম পুরুষে লেখা স্মৃতিচারণামূলক বা আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ, সেহেতু আনিসুল হকের কথা সত্য না মিথ্যা বা শুধুই অনুমান, সেটা তো প্রমাণ করা কঠিন। তবে তৃতীয় কোনো ব্যক্তি যদি এ বিষয় নিয়ে লেখেন, তাহলে সত্য উদ্ঘাটিত হতে পারে।
সম্ভবত বাংলা সাহিত্যের সবচেয়ে বেশি সাহসী আলোচিত সমালোচিত নারী লেখক তসলিমা নাসরিনের সঙ্গে আনিসুল হকের স্মৃতিগদ্য বেশ তথ্যবহুল। দেশান্তরিত এই লেখকের নারীবাদী লেখা ব্যাপকভাবে নন্দিত আর নিন্দিত হতে লাগল। তসলিমা নাসরিন সম্পর্কে আনিসুল হক সাংবাদিকতার জীবনে অনেক তথ্য পাঠকদের জানালেন। এই লেখা আনিসুল হক বেশ সতর্ক হয়ে লিখছেন বলে মনে হয়েছে। তসলিমা নাসরিনের নন্দিত-নিন্দিত বইগুলোর বিষয়ে আলোচনায় না গিয়ে তিনি বেশ সচেতনতার পরিচয় দিয়েছেন। বেশ সাদামাটাই লাগছে লেখাটা। উল্লেখ করার মতো তেমন কোনো স্মৃতি এই অধ্যায়ে পাঠকেরা কিন্তু পাননি। পুরো অধ্যায়টিই বিভিন্ন সময়ে তসলিমা নাসরিন সম্পর্কে পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সমাবেশই বলা যায়। নতুন স্মৃতিচারণা খুব একটা চোখে পড়ছে না। তবে তসলিমার অনেক কবিতা থেকে বাছাই করে ‘মায়ের কাছে চিঠি’ নামক কবিতাটি পাঠকদের কাছে তুলে নিয়ে আসায় আনিসুল হকের বিশেষত্বই এখানে ফুটে উঠেছে। এ কবিতার প্রতিটি শব্দচয়ন ও বিষয়বস্তু প্রায় সব শ্রেণির পাঠকদের হৃদয় ছুঁয়ে যায়, একটা আলাদা অনুভূতির সৃষ্টি করে, হৃদয়ে আকুল অনুরণন ও স্মৃতির প্রতিধ্বনি তৈরি করে। মাকে নিয়ে দেশান্তরিত এক লেখকের এমন মর্মান্তিক ও হৃদয়স্পর্শী লেখা কালের পরিক্রমায় নতুন প্রজন্মের কাছে আরও শক্তিমান হবে। ‘কেমন আছো তুমি? কত দিন, কত সহস্রদিন তোমাকে দেখি না মা, কত সহস্র দিন তোমার কণ্ঠ শুনি না, কত সহস্রদিন কোন স্পর্শ নেই তোমার….।’
হুমায়ুন আজাদকে নিয়ে স্মৃতিচারণা গদ্যটি সবচেয়ে বেশি পাঠককে প্রভাবিত করতে পেরেছে বলেই মনে হয়। আজাদ স্যারের ব্যক্তিগত স্মৃতির চেয়ে প্রবচনগুলো বইয়ে স্থান দেওয়ায় লেখক ধন্যবাদ পেতেই পারেন। আজাদের লেখায় দার্শনিক তত্ত্ব তো থাকেই, তার মধ্য থেকে কয়েকটি প্রবচনের কথা এখানে বলা যায়:
১. ‘মানুষ সিংহের প্রশংসা করে, কিন্তু আসলে গাধাকেই পছন্দ করে।’
২. ‘শ্রদ্ধা হচ্ছে শক্তিমান কারও সাহায্যে স্বার্থোদ্ধারের বিনিময়ে পরিশোধিত পারিশ্রমিক।’
৩. ‘অধিকাংশ রূপসীর হাসির শোভা মাংসপেশির কৃতিত্ব, হৃদয়ের কৃতিত্ব নয়।’
‘নারীবিষয়ক প্রবচনগুলোয় ভেতরের পুরুষ স্পষ্ট মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে’ আনিসুল হক এমন যে তত্ত্ব দিলেন, সেটা হুমায়ূন আজাদ বিষয়ে একটি সাধারণিকীকরণ মাত্র। ‘নারী’ বইয়ের প্রতিটি অধ্যায়ের বিশ্লেষণের সাহিত্যমান খুবই উঁচুমানের। ‘নারীবিষয়ক প্রবচনগুলোয় ভেতরের পুরুষ স্পষ্ট মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে’ কথাটা সরাসরি এমনভাবে বলা উচিত নয়। ‘নারী’ বইটির প্রতিটি প্রবচনের শাব্দিক অর্থ ও ভাবার্থ আলাদা—একেকজন একেক দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখছে, প্রবচনগুলোর একেক পাঠকের কাছে একেক রকমের ব্যঞ্জনা নিয়ে আসে। ‘নারী’ বইটিকে বাংলা সাহিত্যের অন্যতম একটি মৌলিক গ্রন্থ বলা যায়। তা ছাড়া এটি স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম নারীবাদী বই, যেখানে প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে এখন পর্যন্ত নারীরা কীভাবে ধর্ম, সমাজ, রাজনীতি, সংস্কৃতির দ্বারা নির্যাতিত হয়েছে সেটার নিগূঢ় বর্ণনা রয়েছে। হুমায়ুন আজাদ নিজেই বইটি সম্পর্কে বলেছেন, ‘নারী বইটি পুরুষবিদ্বেষী নয়, তবে পুরুষতন্ত্রবাদী পুরুষদের সমালোচনায় মুখর গ্রন্থ।’ তা ছাড়া হুমায়ুন আজাদ স্যারের কাছে উপনিবেশ-উত্তর চিন্তা ঠিকঠাক পৌঁছায়নি বলে যে মতামত আনিসুল হক দিয়েছেন, সেটা সব ক্ষেত্রে সত্যি নয় এবং এটি একটি সংকীর্ণ ও একপেশে মন্তব্য। ‘নারী’ বইয়ের বিষয়ে আনিসুল হকের বর্ণিত দুটি মন্তব্যের সপক্ষে এ অধ্যায়ে কোনো যুক্তি দেওয়া হয়নি। হুমায়ুন আজাদ বেঁচে থাকলে হয়তো এর একটি কড়া সমালোচনা নিশ্চিতভাবেই লিখতেন।
এই বইয়ে অরুন্ধতী রায়ের যে সাক্ষাৎকারটি রয়েছে সেটি ‘লেখক–সঙ্গ স্মৃতি আনন্দ’ বইটির সঙ্গে খুব একটা যায় না। কারণ এটি একটি নিছক সাক্ষাৎকারই বটে। সাক্ষাৎকারের পর্ব ছাড়া অরুন্ধতীর সঙ্গে আনিসুল হকের আর কোনো দেখাসাক্ষাৎ হয়েছে কি না, তা সাক্ষাৎকারে উল্লেখ নেই। বর্তমান বিশ্বসাহিত্যে বিশেষ করে উত্তরাধুনিক সাহিত্যে সবচেয়ে শক্তিমান ও পঠিত লেখক হলেন অরুন্ধতী রায়। ‘দ্য গড অব স্মল থিংস’ সারা বিশ্বে খুব সাড়া ফেলেছিল। অতি দারিদ্র্যের মাঝে পিতৃহীনভাবে বেড়ে ওঠা কেরালার এই লেখক বিস্ময়করভাবে বিশ্বসাহিত্যে একের পর এক অভূতপূর্ব লেখাগুলো দিয়ে সমৃদ্ধ করে তুলেছেন। এই সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে আমরা তাঁর সংগ্রামী জীবনের ক্ষুদ্র একটি অধ্যায়ের সন্ধান পাই। তাঁর বাবা বাংলাদেশের বরিশালের অধিবাসী, সেটা এই বই পড়ার আগে অনেক পাঠকই হয়তো জানতেন না। অরুন্ধতীর ক্ষোভের মধ্যে একটি কথা বেশ ভালো ঠেকেছে, ‘ভারতে একটা নারী হয়ে জন্মানোর চেয়ে গরু হয়ে জন্মানো নিরাপদ…।’ বিশ্বব্যাপী লেখক–কবি–সাহিত্যিকেরা যে ক্ষমতাসীনদের রোষানলে পড়েন, তাই তিনি লিখেছেন, ‘আমি যে ভারতে থাকতে পারছি, তার কারণ আমি যা নিয়ে লিখেছি, তা নিয়ে চারপাশে যে সংহতি বিরাজ করে, সেটা।….কাজ আমাদের রক্ষা করে। পাঠকেরা আমাদের রক্ষা করে।’
এ ছাড়া এই বইয়ের কাহিনিগুলো পড়তে গিয়ে গুটি কয়েকটি বাদে বাকি কৌতুকগুলোতে উল্লেখ করার মতো শিক্ষণীয় কিছু আছে বলে মনে হয়নি। ‘লেখক-সঙ্গে’ কবি-সাহিত্যিকদের সঙ্গ কিছুটা পেয়েছি বৈকি, তবে স্মৃতি–আনন্দ খুবই অপ্রতুল ছিল। থাকলেও অধিকাংশ স্মৃতি পাঠকদের মনে ব্যাপকভাবে স্থান করে নিতে সক্ষম হয়নি। আনিসুল হকের সাম্প্রতিক বইগুলোর কাহিনি যেভাবে পাঠকদের হৃদয় স্পর্শ করেছিল, ‘লেখক-সঙ্গ’ বইটি তা করতে কিঞ্চিত ব্যর্থ হয়েছে বলে মনে হয়।
আগেই বলেছি, ‘লেখক-সঙ্গ: স্মৃতি আনন্দ’ বইটি খুবই ব্যতিক্রমী বই। এমন বই বেশি বেশি লেখা হলে পাঠকেরা বেশ করে উপকৃত হবেন। তা ছাড়া শুধু নন্দিত লেখকই–বা কেন, সমাজের অন্যান্য শ্রেণি-পেশার বিশিষ্টজনদের নিয়েও তো এমন স্মৃতি-মন্থন গ্রন্থ লেখা যেতে পারে।