তিন রাষ্ট্রপর্বে রবীন্দ্রনাথ

ব্রিটিশ ভারতের পূর্ববঙ্গে, বিশেষত বাঙালি মুসলমানদের মধ্যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে দেখার নন্দিত ও সমালোচিত দুই ধারা ছিল। সমালোচনাই ছিল প্রধান। পাকিস্তানি শাসনামলে রবীন্দ্রনাথ হয়ে উঠলেন বাঙালির আন্দোলনের অন্যতম প্রেরণা। স্বাধীন বাংলাদেশে রবীন্দ্রবিবেচনা বইল বিচিত্র স্রোতে। রবীন্দ্রজয়ন্তীতে এ লেখায় থাকল তিন কালপর্বে রবীন্দ্র-অবলোকনের রূপরেখা 

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (২৫ বৈশাখ ১২৬৮—২২ শ্রাবণ ১৩৪৮ বঙ্গাব্দ)ছবি: সংগৃহীত

‘বাবু রবীন্দ্রনাথ এ দেশের একজন উদীয়মান কবি। বোধ হয়, তাঁহার জ্যোতির নূতন আভা অচিরেই সমস্ত বঙ্গে ছাঁইয়া পড়িবে। তাঁহার সমগ্র কবিতাতেই একটুকু অপূর্ব্ব ও অনন্যসাধারণ নূতনত্ব আছে।’—সেকালের পূর্ববঙ্গ থেকে উচ্চারিত হয়েছিল এ কথা। কালীপ্রসন্ন ঘোষের বান্ধব (বাংলা ১২৮৮) পত্রিকায় প্রকাশিত কথাগুলো ভবিষ্যতের ইতিহাসে সত্য বলে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। সমগ্র বঙ্গে গৃহীত হয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ; যদিও একই সঙ্গে চলেছিল প্রত্যাখ্যান আর সমালোচনাও। তাঁর সাহিত্য–প্রতিভাকে তুচ্ছ না করে আত্মপরিচয়ের দৃষ্টিকোণ থেকে কেউ কেউ প্রশ্ন তুলেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ ও রবীন্দ্র-সাহিত্য অধ্যয়নের ধরন ছিল নন্দনতাত্ত্বিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ইত্যাদি বিচিত্র।

প্রশ্ন হলো, পূর্ববঙ্গে—আজ যা বাংলাদেশ—রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে গ্রহণের বৈশিষ্ট্য কী ছিল? এই প্রশ্নের একটিমাত্র জবাব নেই। কেননা সাহিত্যের ব্যক্তিক পাঠ যতটা শনাক্তযোগ্য, সামষ্টিক পাঠ তত সহজে শনাক্তযোগ্য নয়। আমরা দেখতে পাই, রবীন্দ্র-মুগ্ধতার অন্য পিঠে বিরোধও ছিল। রবীন্দ্র সাহিত্যের ভোক্তা ও ভক্ত হয়েও অনেকে রবীন্দ্রনাথের রাজনীতি, বিশ্বাস ও কর্মকাণ্ডের সমালোচনা করেছেন।

রবীন্দ্র-সমালোচনার এই বহুস্বরিক বাস্তবতাকে মেনে নিয়েই পূর্ববঙ্গে রবীন্দ্রপাঠের ইতিহাসকে একটি রূপরেখার ভেতর দিয়ে হাজির করা সম্ভব। পূর্ববঙ্গ ও বাংলাদেশে রবীন্দ্রনাথের পাঠ, পরিগ্রহণ ও সমালোচনার তিনটি পর্বকে আমরা সহজেই শনাক্ত করতে পারি—ব্রিটিশ, পাকিস্তান ও বাংলাদেশ পর্বে রবীন্দ্রনাথ।

ব্রিটিশ কালপর্ব

ব্রিটিশ-পর্বে ব্যক্তি রবীন্দ্রনাথ পূর্ববঙ্গের সঙ্গে গভীরভাবে সংলগ্ন। গান, কবিতা ও গল্পের পটভূমি তৈরি করে দিচ্ছে পূর্ববঙ্গ। এ অঞ্চলের জল ও জমি, আলো ও ছায়ার খেলা রাঙিয়ে তুলেছে ‘কলকাত্তাই’ কবির মন।

প্রকৃতি নাহয় বরণ করল, কীভাবে তাঁকে গ্রহণ করেছে এ অঞ্চলের অধিবাসীরা? দেখতে পাই, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একনিষ্ঠ ভক্তের একটি দল ছিল পূর্ববঙ্গে; গোলাম মোস্তফা, জসীমউদ্​দীন, মুহম্মদ মনসুর উদ্দীন, সৈয়দ মুজতবা আলীর মতো কবি, লেখক ও গদ্যকারকে দেখতে পাওয়া যাবে এ অবস্থানে। একসময় কবি গোলাম মোস্তফার বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল, তিনি মাত্রাতিরিক্ত রবীন্দ্রভক্ত; পাকিস্তান-পর্বে অবশ্য তাঁর রবীন্দ্রভক্তি পরিণত হয়েছিল রবীন্দ্রবিরোধিতায়। অন্যদিকে জসীমউদ্​দীন পারিবারিক ও ব্যক্তিক পর্যায়ে বহুবার ‘ঠাকুরবাড়ির আঙিনায়’ গমনাগমন করেছেন। পরবর্তীকালে তাঁকেও আমরা রবীন্দ্র-সমালোচক হয়ে উঠতে দেখি। রবীন্দ্র-আশীর্বাদ মাথায় নিয়ে গবেষণা ও লেখালেখিতে অগ্রসর হয়েছেন মুহম্মদ মনসুর উদ্দীন। সৈয়দ মুজতবা আলীর রবীন্দ্রভক্তি সর্বজনবিদিত। রবীন্দ্রনাথের প্রতি তাঁদের আগ্রহ ও মুগ্ধতার উৎস ছিল ঠাকুরের সাহিত্য ও ব্যক্তিত্ব। কিন্তু এই পূর্ববঙ্গেই গড়ে উঠেছিল রবিঠাকুরের অন্য পাঠ; সে পাঠ নিবিড়ভাবে সাহিত্যিক নয়, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক—হাল আমলের পরিভাষা ব্যবহার করে বলা যায় ‘সাংস্কৃতিক রাজনীতি’ ঘিরে গড়ে ওঠা পাঠ। 

বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনের সময় প্রবল সমালোচনার মুখোমুখি হন রবীন্দ্রনাথ। কারণ, তাঁর অবস্থানকে চিহ্নিত করা হয়েছিল মুসলমান ও পূর্ববঙ্গের স্বার্থবিরোধী বলে, যার জের টেনে এখনো কেউ কেউ বলেন যে রবীন্দ্রনাথ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করেছিলেন।

মোটা দাগে ১৯৪৭ সালের আগ পর্যন্ত পূর্ববঙ্গের চোখে—এক. রবীন্দ্রনাথ অতুলনীয় প্রতিভাবান কবি ও লেখক হওয়া সত্ত্বেও পূর্ববঙ্গ ও মুসলমানের রাজনৈতিক স্বার্থের বিরোধী; দুই. অখণ্ড বাংলায় হিন্দু-মুসলমান ঐক্য বিস্তারে তিনি অসফল; তিন. রবীন্দ্রনাথের রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষা এবং ভারতীয় কংগ্রেসের রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষা মূলত এক। এই সব কিছুর যোগ-বিয়োগ শেষে ব্রিটিশ–ভারতের শেষ যুগে পাকিস্তানবাদী আন্দোলন প্রত্যক্ষভাবে রবীন্দ্রনাথকে অস্বীকার করতে চেয়েছে। 

আত্মপ্রতিকৃতি, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

পাকিস্তান কালপর্ব

পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর রবীন্দ্রনাথকেই এবার আঁকড়ে ধরল পূর্ববঙ্গের বুদ্ধিবৃত্তিক পরিমণ্ডল। এ বঙ্গের বাঙালির ভেতর তৈরি হলো সম্প্রদায়-নিরপেক্ষ নতুন এক জাতীয় চেতনা, গুণগত দিক থেকে বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনের চেয়ে যা ভিন্ন। এই জাতীয়তাবাদ অখণ্ড বাংলার স্বপ্নকে পুনরুজ্জীবিত করল না, বরং পূর্ববঙ্গকে কেন্দ্র করে গড়ে তুলল নতুন রাষ্ট্রবাসনা। এই জাতীয়তাবাদই ধীরে ধীরে গড়ে তুলেছে পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার পথ।

রবীন্দ্রনাথ পূর্ববঙ্গে এবার আরাধ্য হয়ে উঠলেন বঙ্গভঙ্গের সময়কার রবীন্দ্রনাথের তুলনায় বেশি। জীবিত রবীন্দ্রনাথের চেয়ে বাঙালির প্রাণে প্রগাঢ় দোলা দিলেন যে রবীন্দ্রনাথ, তিনি প্রয়াত। যে রবীন্দ্রনাথ জাতীয়তাবাদে আস্থা রাখেননি, সেই রবীন্দ্রনাথই ব্যবহৃত হলেন বাঙালি জাতীয়তাবাদীদের মোক্ষম অস্ত্র হিসেবে। পাকিস্তানবাদী বাঙালিরা যখন ইকবালকে হাজির করেছিলেন পাকিস্তানি জাতীয়তাবাদের প্রাণভোমরা হিসেবে, বাঙালিত্ববাদীরা তখন সামনে নিয়ে এসেছিলেন রবীন্দ্রনাথ ও তাঁর সাহিত্যকে। এই বাঙালিদের মধ্যে ছিল নাগরিক মধ্যবিত্ত, মার্ক্সবাদী ও উদারনৈতিক মতাদর্শে আস্থাবান ব্যক্তিরা। 

উল্লেখ্য, ১৯৪৭ সালের দেশভাগের আঘাতে এঁদের অনেকেই পশ্চিমবঙ্গ থেকে বাস্তুচ্যুত হয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথ তাঁদের কাছে নিঃসন্দেহে এক অন্তরতম মনীষা। আর ভৌগোলিক কিংবা স্থানিক পরিচয়ে যাঁরা পূর্ববঙ্গবাসী, পাকিস্তান-পর্বের বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে তাঁরাও রবীন্দ্রনাথকে আন্তরিকভাবে গ্রহণ করেছেন। রবীন্দ্রনাথের ভেতর তাঁরা পেয়েছিলেন নিপীড়িতের ভরসা, উদার মানবতাবোধ, বাঙালিত্ব পরিচয়ের শক্তি ও উদ্দীপনা। পাকিস্তানি জাতীয়তাবাদের মোকাবিলায় ঢাকাকেন্দ্রিক বাঙালি মধ্যবিত্তের সামনে রবীন্দ্রনাথ ছিলেন ঐতিহ্য ও আধুনিকতার অবিকল্প প্রতীক। জাতীয়তাবাদের জন্যও এমন একজন ব্যক্তি দরকার, যার ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে বহু বছরের প্রজ্ঞা ও ইতিহাস। পূর্ববঙ্গে জাতীয়তাবাদের নেতৃত্বে থাকা মধ্যবিত্তরা তাই রবীন্দ্রনাথকে আলিঙ্গন করতে পিছপা হয়নি। রবীন্দ্রজন্মশতবর্ষ পালনে বাধা দেওয়া, গণমাধ্যমে রবীন্দ্রসংগীত নিষিদ্ধ করাকে তারা চিহ্নিত করেছে শাসকগোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক আধিপত্য হিসেবে।

পূর্ববঙ্গের বাঙালিরা দ্বিজেন্দ্রলাল, অতুলপ্রসাদ, নজরুল, জীবনানন্দকেও গ্রহণ করেছিল। অথচ বাঙালি জাতীয়তাবাদী ও বাঙালি জাতীয়তাবাদবিরোধীরা এমনভাবে বক্তব্য হাজির করেন, তাতে মনে হয় রবীন্দ্রনাথই ছিলেন পূর্ববঙ্গে গড়ে ওঠা বাঙালি জাতীয়তাবাদের একমাত্র প্রতীক।

বাংলাদেশ কালপর্ব

বাংলাদেশ-পর্বে রবীন্দ্রনাথ রাষ্ট্রীয়ভাবে গৃহীত হলেন। রবি ঠাকুরের গান গৃহীত হলো নতুন রাষ্ট্রের জাতীয় সংগীত হিসেবে। কিন্তু লেখক ও বুদ্ধিজীবীদের কেউ কেউ নিয়ে এলেন প্রত্যাখ্যান। আহমদ শরীফ তাঁদের মধ্যে প্রধান। তিনি (আগস্ট ১৯৭৩) বললেন, রবীন্দ্রনাথ ‘নির্বিশেষ বাঙালিকে অনুপ্রাণিত করার মতো শক্তিধর’ ছিলেন না; যদি তা-ই হতেন তাহলে মুসলমানেরা বঙ্গভঙ্গের বিরোধিতা করত না, এমনকি রাষ্ট্রনৈতিকভাবে ‘অখণ্ড যুক্ত বাংলা থাকত অথবা খণ্ড ভারতে যুক্ত বাংলা’ হতো। আহমদ শরীফ সম্ভবত ভুলে গিয়েছিলেন ৪৪ বছর বয়সী রবীন্দ্রনাথ ‘নির্বিশেষ বাঙালি’র কাছে চেনা ও শক্তিধর হয়ে উঠেছিলেন বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনের সময়ই।

পাশাপাশি এটাও মনে রাখা দরকার, নোবেল পাওয়ার আগের ও পরের রবীন্দ্রনাথের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রতিপত্তির মধ্যে বিরাট পার্থক্য বিদ্যমান। শরীফ এড়িয়ে গেলেন এই প্রশ্নটিকেও ‘বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিকাশ, বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রাম এবং সমাজ বিবর্তনে রবীন্দ্রনাথের প্রভাব কী?’ প্রশ্ন জাগে, রবীন্দ্রনাথের দোষ কী? আহমদ শরীফের কথায় মনে হয় মার্ক্সবাদী না হতে পারাটাই রবীন্দ্রনাথের সীমাবদ্ধতা; সমাজতন্ত্র তাঁর কাম্য বলে আহমদ শরীফ মনে করেন, ‘রবীন্দ্রনাথ যদি রাজনৈতিক চেতনার ক্ষেত্রে আমাদের প্রেরণার উৎস হতেন তাহলে আমরা সাধারণ বুর্জোয়া গণতন্ত্র কামনা করতাম।’ তাহলে রবীন্দ্রনাথ কী? আহমদ শরীফের ভাষায়, ‘রবীন্দ্রনাথ ছিলেন বুর্জোয়া মানবতার প্রতীক’ ও ‘উদারতম মানবতাবাদী’। পশ্চিমবঙ্গের মার্ক্সবাদীরাও চল্লিশের দশকে হাজির করেছিলেন এ-জাতীয় বয়ান। 

আহমদ শরীফ কিংবা মার্ক্সবাদীরা যা-ই বলুন না কেন, রাজনীতি ও সংস্কৃতির সামরিকায়ন ও ইসলামীকরণের যুগে, নব্বইয়ের গণ-আন্দোলনে রবীন্দ্রনাথ আবারও হয়ে উঠলেন প্রেরণার উৎসস্থল। কিন্তু বাঙালিত্ব ও বাংলাদেশিত্বের নামে জাতীয় চেতনা ও জাতীয়তাবাদ যত বিভাজিত হতে থাকল, ততই বদলে যেতে থাকল রবীন্দ্রপাঠ ও পরিগ্রহণের ধরন। বিগত ৫০ বছরের বাংলাদেশে রবীন্দ্রনাথ আবারও নির্দয় কাটাছেঁড়ার মুখোমুখি হলেন। এর জন্য যত না দায়ী রবীন্দ্রনাথ অথবা রবীন্দ্রসাহিত্য, তার চেয়ে দায় বেশি জাতীয়তাবাদীদের। কেননা বাঙালি জাতীয়তাবাদীরা রবীন্দ্রনাথকে কুক্ষিগত করে প্রশ্ন ও পর্যালোচনাবিহীন রবীন্দ্র-বন্দনার প্রাবল্যে ভাসিয়ে দিয়েছেন বাঙালি জাতির অপরাপর সাংস্কৃতিক, ঐতিহ্যিক ও সাহিত্যিক উপাদানসমূহকে। এর বিপরীতে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ নামে গড়ে ওঠা মতাদর্শের নিশানবরদাররা রবীন্দ্রনাথকে পুনরায় সন্দেহের বস্তুতে পরিণত করতে পেরেছিলেন। তাঁরা দেখাতে পেরেছিলেন হিন্দুত্ব, ভারত ও রবীন্দ্রনাথ আদতে একই জিনিস।

প্রশ্ন তোলা হয়েছে শ্রেণিদৃষ্টিকোণ থেকেও। বাংলাদেশের পাঁচ বছর অতিক্রান্ত হতে না হতেই রবীন্দ্রনাথ ভূষিত হলেন ‘বৃত্তাবদ্ধ রবীন্দ্রনাথ’, ‘দুর্বলতায় রবীন্দ্রনাথ’ নামে। রবীন্দ্রনাথ যা করেননি, তারই ফর্দ লিপিবদ্ধ হতে থাকল নবীন-প্রবীণের হাতে।

মাওলানা ভাসানীর হক-কথা (১৯৭২) পত্রিকায় রবীন্দ্র-সমালোচনা কিন্তু পেশ করল অন্য প্রস্তাব, ‘বাংলাদেশ আজ স্বাধীন। পাক আমলে প্রতিক্রিয়াশীল চক্র রবীন্দ্রনাথের রচনাবলিকে নানা অপবাদে বারবার আক্রমণ করেছে। স্বাধীন দেশে এর অবসান অবশ্যই হওয়া উচিত। রবীন্দ্রনাথের মানবিক আবেদনে সমৃদ্ধ লেখা থেকে বাঙালিকে আর বঞ্চিত রাখা চলবে না।...রবীন্দ্রনাথকে পড়তে হবে, জানতে হবে, স্বাধীন বাংলায় রবীন্দ্র-সাহিত্যের নবমূল্যায়ন করতে হবে অবশ্যই। নির্যাতিত, শোষিত মানুষের দুয়ারে পৌঁছে দিতে হবে তাঁর কবিতার ফসল।’

পুরোনো একটি প্রশ্ন ঘুরেফিরে আবার এল; আহমদ ছফা প্রশ্ন তুললেন, ‘রবীন্দ্রনাথ তাঁর মুসলমান প্রজাদের নিয়ে একটা পূর্ণাঙ্গ গল্প কিংবা উপন্যাস কেন লিখলেন না?’ ছফার জিজ্ঞাসা, মুসলমান প্রজাদেরটা খেয়ে-পরে বড় হওয়া রবীন্দ্রনাথ কি একটি গল্প লিখে হলেও ‘স্বীকৃতি’ দিতে পারতেন না তাঁর প্রজাদের? 

নব্বইয়ের দশকের শুরুতে কেউ কেউ এই বলে তর্ক তুলেছেন যে হিন্দুত্বই রবীন্দ্রনাথের আদি ও অকৃত্রিম পরিচয়। মুসলমান সমাজের ছবি তিনি আঁকতে পারেননি। এ ধরনের ব্যাখ্যাকে সহজেই চালিয়ে দেওয়া গেছে; কারণ তত দিনে সংবিধান মোতাবেক বাংলাদেশে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে মুসলমানের ধর্ম ইসলাম প্রতিষ্ঠিত। তাই এই প্রশ্নও তোলা গেছে, হিন্দু রবীন্দ্রনাথের গান কেন ‘সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানের দেশে’ জাতীয় সংগীত হবে? যেন অন্য কোনো গান জাতীয় সংগীত হতে পারত; অবশ্য সম্ভাব্য কোনো গানের উল্লেখ তাঁরা করেননি। 

আরেকটু এগিয়ে গিয়ে নিম্নবর্গের ভাবুকতায় বিশ্বাসীদের কেউ কেউ লালন ও রবীন্দ্রনাথকে নির্মাণ করেছেন পরস্পরের যুগ্ম-বৈপরীত্য হিসেবে। বাঙালি, বাংলা অঞ্চল ও রবীন্দ্র-অধ্যয়নের দিক থেকে এটি নতুন এক প্রবর্তনা। রবীন্দ্রনাথ যে রকম শিক্ষিত ও নাগরিক মধ্যবিত্তের মধ্যে ভাবপ্রতিমা হিসেবে গড়ে উঠেছিলেন, তারই বিপরীতে এ ধারার ভাবুকেরা জাতি, রাষ্ট্র কিংবা জাতীয়তাবাদের পরিসরে লালনকে হাজির করেন। প্রকৃতপক্ষে এই দৃষ্টিভঙ্গিও শিক্ষিত ও নাগরিক মধ্যবিত্তের আরেক নব্য-ভাবপ্রতিমামাত্র—বাঙালি জাতীয়তাবাদ যেটিকে ‘আইকনিক’ মর্যাদায় উন্নীত করেনি, শহুরে লালনবাদীরা সেটিকে নব্বই দশকি আবিষ্কার হিসেবে হাজির করেছেন। সহি লালনবাদীরা রবীন্দ্রনাথ কিংবা ভাবাদর্শের জঙ্গনামা থেকে ঢের দূরে বাস করেন।

অনেকে পুরোনো সেই বিতর্ক—রবীন্দ্র-নজরুল বাহাসকে জাহির করতে উদ্যোগী হয়েছেন। সাম্প্রদায়িক ইতিহাসের তোরঙ্গ থেকে পুরোনো বোতলটি বের করে তারা পুরোনো সুরা ঢালতে আরম্ভ করেছেন। ১৯৪১ সালে প্রয়াত রবীন্দ্রনাথের পূর্বকালীন ভাবাদর্শ দেশভাগ অথবা বাংলা বিভাগের পেছনে ভূমিকা রেখেছে কি না, সেই প্রশ্নের ময়নাতদন্তেও শামিল হয়েছেন। গবেষণাযোগ্য বিষয় হিসেবে ভালো জিজ্ঞাসাই বটে। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের কোনো বক্তব্য, কোনো উচ্চারণ, কোনো অচেতন-স্থিত ভাষা দেশভাগের দায়কে নির্দেশ করে, তার কোনো নিশানা এই ভাষ্যকারেরা দেন না। আর তাই রবীন্দ্রনাথের এই জোড়া-তালিমার্কা পাঠকে সুবিচার ও সুপাঠ—কোনোটিই বলা চলে না; বড়জোর বলা চলে, মহাসমুদ্রে তরঙ্গ তোলা, কিংবা দেবদারুর নিচে দাঁড়িয়ে ছোট ছোট গাছের দেবদারু হওয়ার বাসনা।

এই লেখায় পূর্ববঙ্গ বা বাংলাদেশজুড়ে রবীন্দ্রপাঠের একটি খণ্ডচিত্রমাত্র হাজির করা হলো। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাহিত্যিক মূল্যায়নের চেয়ে কারও কাছে মুখ্য হয়ে উঠেছে রবীন্দ্রনাথের জমিদারি, হিন্দুত্ব, শ্রেণিপরিচয়, রাজনৈতিক ও সামাজিক অবস্থান। পাঠের এই বহুরৈখিকতা নিঃসন্দেহে রবীন্দ্রনাথকে প্রতিমুহূর্তে জীবন্ত রাখে। তবু প্রশ্ন থেকে যায়, পরিবর্তমান কাল রবীন্দ্রনাথকে কীভাবে গ্রহণ করবে? নবীন বাংলাদেশের এক অকালপ্রয়াত কবি হুমায়ুন কবির ৫০ বছরের বেশি আগে লিখেছিলেন, ‘রবীন্দ্রনাথকে আক্রমণ বা রক্ষা করার এখন আর কিছু নেই’; সেই তারুণ্যেই তিনি চেয়েছিলেন ‘নবকালের পরিপ্রেক্ষিতে রবীন্দ্র-সাহিত্যের ভূমিনিষ্ঠ বিচার।’

হুমায়ুন কবিরের সঙ্গে আমরা শুধু একটি শব্দই যোগ করতে চাই, ‘বস্তুনিষ্ঠ’ বিচার; মতলবি অধ্যয়ন ও বস্তুনিষ্ঠ অধ্যয়নের ফারাক কারোরই অজানা নয়।

সংশোধনী

৩ মে ২০২৪ শুক্রবার ‘অন্য আলো’র ছাপা সংস্করণে ‘ব্রিটিশ ভারত পাকিস্তান বাংলাদেশ: তিন রাষ্ট্রপর্বে রবীন্দ্রনাথ’ শিরোনামে লেখার সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মূল ছবির বদলে ভুলক্রমে পাবলো সেজারের ‘থিঙ্কিং অব হিম’ চলচ্চিত্রে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর চরিত্রে অভিনয় করা এক অভিনেতার ছবি ব্যবহার করা হয়েছে। এই অনিচ্ছাকৃত ভুলের জন্য আমরা আন্তরিকভাবে দুঃখিত। অনলাইন সংস্করণে ছবিটি বদলে দেওয়া হলো।

বি. স.

৩ মে ২০২৪, ১৩:৩০