যেভাবে গল্পকার হলাম

উর্দু কথাশিল্পী সাদত হাসান মান্টোর গল্পগুলো যেমন সরস, তেমনি তীক্ষ্ণ। কীভাবে গল্পকার হয়েছিলেন তিনি? মান্টো কি কাহানিয়াঁ বইয়ের ভূমিকায় চমৎকার করে সে কথা তিনি লিখেছেন। উর্দু থেকে অনুবাদ জাভেদ হুসেন

সাদত হাসান মান্টো
ছবি: সংগৃহীত

কয়েক বছর আগে আমার জীবনে এক অদ্ভুত দিন এসেছিল। সেদিন আমি কী যে তীব্রভাবে আমার নিঃস্বতা উপলব্ধি করেছিলাম! সেই অনুভব আমায় অস্থির–অধীর করে তুলেছিল। তবু আমি কোনোমতে নিজেকে সামলে নিয়ে নিজের ভেতরে তাকালাম। ভাবলাম, দেখি তো একবার ভেতরে কোনো সয়সম্পত্তি আদৌ বাকি রয়ে গেছে, নাকি একেবারেই ফাঁকা! তাকিয়ে দেখি, সেখানে চলে যাওয়া দিনের এক মিছিল। এর মধ্যে কিছুদিন অনেক উজ্জ্বল। কিছুদিন এত কালো যে চন্দ্রহীন রাতও তার গায়ের কালো রং দেখে ঈর্ষা করবে। কিছু ঘটনা খুব মিষ্টি। আর কিছু ঘটনা এমন তিক্ত যে যদি আজ আমি তাদের লিখি, তাহলে কাগজের মুখ থুতু ফেলতে ফেলতে ক্লান্ত হয়ে গেলেও সেই তিক্ততা যাবে না। একদিকে আমার নিবিষ্টতা বসে ছিল লাজুকভাবে। আরেক জায়গায় আমার স্বভাবের তীব্রতা দাঁড়িয়ে ছিল অস্থির হয়ে। নাহ, কাজের কোনো কিছুই পাওয়া গেল না। মানে এমন কিছুই পেলাম না, যা এই পৃথিবীতে আমার কাজে লাগবে।

খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখেও নিজের ভেতরে কাজের কোনো কিছুই পেলাম না। খুব নিরাশ হলাম। অগত্যা বিমর্ষ হয়ে আমি আমার বুকের দরজা বন্ধ করতে যাচ্ছিলাম, ঠিক এমন সময় খুব দুর্বল একটা কণ্ঠস্বর শুনতে পেলাম। কে যেন বলছে: আমি বোধ হয় তোমার কাজে লাগতে পারি।

আমি জিজ্ঞাসা করলাম: তুমি কে?

উত্তর এল: আমি গল্প।

অবাক হয়ে প্রশ্ন করলাম: গল্প? তুমি কোথায় লুকিয়ে ছিলে?...না, আগে বলো তুমি আমার ভেতরে এলে কী করে?

গল্প খুব নিস্তেজ গলায় বলল: আমি তোমার ভেতরে কী করে এলাম, তা তো জানি না। তবে এটুকু জানি, অনেক দিন ধরে তোমার ভেতরে এক অন্ধকার কোণে আমি কয়েদ হয়ে আছি। মনে হয়, আমার জন্ম হয়েছিল এই আন্ধার কুঠুরিতেই।

গল্পের কথা শুনে খুব মজা লাগল আমার। অন্ধকার কোণ থেকে বের করে আমি তাকে আলোয় নিয়ে এলাম। এবার গল্পের দিকে তাকিয়ে আমি অবাক, বাক্‌রুদ্ধ হয়ে গেলাম! এ কী, এ যে অবিকল আমার মতো দেখতে!

আমি বললাম: অরে! তুমি যে আমার যমজ! বলো, বলো, কী বলতে চাও?

গল্পের ঠোঁটে একটা হালকা হাসির তরঙ্গ খেলে গেল। সে বলল: আমার তো অনেক কিছু বলার আছে। কিন্তু আমার গলার জোর কম। সব কথা অন্য কোনো দিন বলব। তুমি বরং বলো, এত দিন আমাকে তুমি দেখতে পেলে না কেন? আজ তুমি যদি সত্যিই তোমার বুকের দরজা বন্ধ করে চলে যেতে, তাহলে জানো কি হতো?

বেপরোয়া ভঙ্গিতে বলাম: কী হতো?

উত্তর এল: অনেক বড় একটা সম্পত্তি থেকে তুমি বঞ্চিত হতে।

আমি হেসে ব্যঙ্গস্বরে বললাম: সম্পত্তি!

উত্তর এল: তোমার সম্পত্তি আমি। আমাকে গ্রহণ করো। আমাকে তোমার অধিকারে নাও। আমাকে বাইরে নিয়ে এসে দেখাও, সবাইকে দেখাও। তোমার সংবেদনশীল হৃদয়ের স্পন্দন আমাকে কোলে করে বড় করেছে। তোমার আন্তরিকতা আমাকে নিজের দুধ পান করিয়েছে। তোমার চলে যাওয়া দিনগুলো আমাকে দুলিয়েছে দোলনায়। তোমার স্বভাবের অস্থিরতা আমার বিছানা। আমি যদি তোমার ভেতর থেকে বের হয়ে চলে যাই, তবে তুমি হবে সেই ঝিনুক, যার মুক্তো অবহেলায় ধুলোয় গড়ায়। এদিকে এসো। আশ্রয় দাও আমাকে। আমি বাইরে আসতে চাই।

সেই দিন থেকে আমি গল্পকার হয়ে গেলাম।

আমাকে ভালো গল্পকার বানিয়ে দিয়েছে খারাপ দিনগুলো।