রবীন্দ্রনাথের প্রতিবাদ, রবীন্দ্রনাথের প্রতিক্রিয়া

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, ‘মুহূর্ত তুলিয়া শির একত্র দাঁড়াও দেখি সবে, যার ভয়ে তুমি ভীত সে অন্যায় ভীরু তোমা চেয়ে, যখনি জাগিবে তুমি তখনি সে পলাইবে ধেয়ে...।’ আসছে ২২ শ্রাবণ এই কবির প্রয়াণবার্ষিকী। দীর্ঘ জীবনে বহু আন্দোলন-সংগ্রামের মুখোমুখি হয়েছেন তিনি। অগ্রাহ্য করতে পারেননি জনমানুষের দাবি, এমনকি নিজের প্রাণের দাবিও। বক্তৃতা, প্রবন্ধ, কবিতা আর গানের মধ্য দিয়ে পাওয়া যায় প্রতিবাদ, প্রতিরোধ ও প্রতিক্রিয়ার অন্য এক রবীন্দ্রনাথকে

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (২৫ বৈশাখ ১২৬৮—২২ শ্রাবণ ১৩৪৮ বঙ্গাব্দ)
ছবি: সংগৃহীত

ব্রিটিশ শাসনের অবসানের পর গত হয়েছে ৭৭ বছর। মাঝখানে পাকিস্তান পর্ব পার হয়ে আজকের বাংলাদেশ। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ঔপনিবেশিক ভারতে বসে দেখেছেন স্বাধীনতার আন্দোলন, শুনেছেন মানুষের দাবি। সেসবের প্রতিক্রিয়ায় তিনি কথা বলেছেন, লিখেছেন। এর মধ্য দিয়ে রাজনীতিসচেতন একজন কবির খোঁজ পাওয়া যায়। তবে বিস্মিত হতে হয় এই ভেবে যে ব্রিটিশ পর্বের একেকটি ঘটনা স্বাধীন বাংলাদেশের বিভিন্ন সময়ের ঘটনার চেয়ে খুব বেশি আলাদা নয়।

রবীন্দ্রনাথের জীবদ্দশায় সবচেয়ে বড় হত্যাকাণ্ড ঘটে জালিয়ানওয়ালাবাগে, ১৯১৯ সালের এপ্রিলে। ব্রিটিশ সরকারের তদন্ত রিপোর্ট অনুযায়ী, নিহতের সংখ্যা ছিল ৩৭৯। কিন্তু পরে বিভিন্ন তদন্তে এই সংখ্যা হাজার ছাড়িয়ে যায়। ঘটনার পরপরই কারফিউ জারি হয়েছিল। এর অন্তত এক মাস পর সবকিছু স্পষ্ট হতে থাকে। তবু কেউ কোনো প্রতিবাদ করার সাহস পায়নি। নিরস্ত্র মানুষের ওপর গুলিবর্ষণের ঘটনা জানতে পেরে রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতন থেকে কলকাতায় আসেন। লাটসাহেবকে কড়া চিঠি লিখে ‘নাইটহুড’ উপাধি ত্যাগ করেন।

এর আগে ১০ এপ্রিল পাঞ্জাবে ও লাহোরে জারি করা হয় সামরিক আইন। সেই খবরে তিক্ত হয়ে রবীন্দ্রনাথ খোলাচিঠি লেখেন গান্ধীজির উদ্দেশে। সেটি ১৬ এপ্রিল প্রকাশিত হয় কলকাতার একটি ইংরেজি দৈনিকে। চিঠিটির বাংলা করলে এ রকম হয়, ‘প্রিয় মহাত্মাজি, শক্তি যেকোনো রূপেই নিজেকে প্রকাশ করুক না কেন, তার মধ্যে কোনো বিচার নেই, যুক্তি নেই। চোখে ঠুলি পরানো ঘোড়া যেমন অন্ধভাবে গাড়ি টেনে নিয়ে যায়, শক্তির গতিও সেই রকম।’ ক্ষমতার শক্তিপ্রদর্শনকে রবীন্দ্রনাথ বরদাশত করতে পারতেন না।

প্রতিবাদী রবীন্দ্রসত্তার প্রথম পরিচয় মিলবে তাঁর ১৫ বছর বয়সে। ১৮৭৬ সালে হিন্দুমেলার দশম উৎসবে তিনি নিজের লেখা একটি জ্বালাময় কবিতা পড়েন। তখন ভাইসরয় লর্ড লিটনের আমল। এ ধরনের লেখার ওপর নিষেধাজ্ঞা থাকায় কোনো পত্রিকায় সেটি ছাপা হয়নি। পরে কিছু অদলবদল করে সেটাকে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর ব্যবহার করেছিলেন তাঁর স্বপ্নময়ী নাটকে—মধ্যযুগীয় এক বীরের মুখ দিয়ে কবিতাটি সংলাপ আকারে বলানো হয়েছিল।

রবীন্দ্রনাথের ভাবনার দুটি রূপ খুব স্পষ্ট। এর একটি ভেতরের। যার মূল সুর ঈশ্বরভক্তিতে সমর্পিত। আর একটি বাইরের। যেখানে মানবপ্রেম মুখ্য। রবীন্দ্রজীবনীকার প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় অবশ্য বলেন, ‘মাঝে মাঝে মানবকল্যাণের কথা ভেবে যদিও বিতর্কের মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়েন; উত্তেজনা কেটে গেলেই নিজের কবিজীবনের মধ্যেই ফিরে আসেন। তাঁর জীবনের এই বৈশিষ্ট্য বারে বারেই দেখা গেছে।’

১৮৯২ সালে ভারতীয় ব্যবস্থা পরিষদের নতুন আইন সংশোধিত হয়। ভারতীয় রাজনীতিকদের দাবি ছিল প্রতিনিধি মূলক শাসন চালু করার। কিন্তু তা তো হয়ইনি, বরং পরিষদের কয়েকটি আসনের জন্য সাম্প্রদায়িক বাঁটোয়ারা নীতি ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। এমনকি, সরকারি চাকরিতে দেশীয়দের ঢোকার পথে তৈরি করা হয় অনেক বাধা। এসব কারণে শিক্ষিত তরুণদের মন বিষিয়ে উঠেছিল। এর সূত্র ধরে রবীন্দ্রনাথ ধারাবাহিকভাবে অনেকগুলো প্রবন্ধ লেখেন। সেগুলো ওই সময়ে সাধনা ও ভারতী পত্রিকায় প্রকাশিত হয়।

উনিশ শতকের শেষ দিকে সরকারের জুলুম বাড়তে থাকে। এর জবাবে বিভিন্ন পত্রিকা তীব্র সমালোচনা লিখতে থাকে। এসব ‘দায়িত্বহীন’ লেখা বন্ধ করার জন্য ১৮৯৮ সালে ‘সিডিশন বিল’ পাস হয়। বিল পাসের আগের দিন টাউন হলের জনসভায় রবীন্দ্রনাথ ‘কণ্ঠরোধ’ নামে একটি প্রবন্ধ পড়েন। প্রবন্ধের শুরুতে তিনি বলেন, ‘অদ্য আমি যে ভাষায় প্রবন্ধ পাঠ করিতে উদ্যত হইয়াছি, তাহা যদিও বাঙালির ভাষা, দুর্বলের ভাষা, বিজিত জাতির ভাষা, তথাপি সে ভাষাকে আমাদের কর্তৃপক্ষেরা ভয় করিয়া থাকেন। তাহার একটি কারণ, এ ভাষা তাঁহারা জানেন না এবং যেখানেই অজ্ঞানতার অন্ধকার, সেইখানেই অন্ধ আশঙ্কার প্রেতভূমি।’

১৯০৫ সালে বাংলাভাগের পরিপ্রেক্ষিতে আসে ব্রিটিশ পণ্য বর্জনের ডাক। রবীন্দ্রনাথ তখন লেখেন গান, ‘আমি পরের ঘরে কিনব না আর, মা, তোর ভূষণ বলে গলার ফাঁসি।’ কিছুদিন পর কলকাতার টাউন হলে ‘অবস্থা ও ব্যবস্থা’ নামে একটা প্রবন্ধ পড়েন। সেখানে তিনি বলেন, ‘বয়কট বা বর্জননীতি শুধু ইংরেজের তৈরি কাপড়, লবণ বা মনোহারী সামগ্রীর মধ্যে সীমিত করলে চলবে না। শাসন বিষয়েও বয়কট করে আত্মশাসন প্রতিষ্ঠা করতে হবে।’ একই সময়ে তিনি লেখেন ‘বিধির বাঁধন কাটবে তুমি’ গানটি। এই গানে শোষকের দিকে আঙুল তুলে কবি বলেন:

 ‘চিরদিন টানবে পিছে,

          চিরদিন রাখবে নীচে—

এত বল নাই রে তোমার,

          সবে না সেই টান।

শাসনে যতই ঘেরো,

          আছে বল দুর্বলেরও,

হও-না যতই বড়, আছেন ভগবান।’

একই বছরের অক্টোবর মাসে কার্লাইল সাহেব স্কুল-কলেজের অধ্যক্ষদের উদ্দেশ্য বিজ্ঞপ্তি জারি করেন। বলেন, ‘ছাত্ররা যেন স্বদেশি আন্দোলনে যোগ না দেয়, তারা যেন মিছিলে না যায়।’ কিন্তু ছাত্র-জনতা সেই আদেশ অগ্রাহ্য করে। দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে প্রবল বিক্ষোভ ও অসন্তোষ। তার মধ্যে ডিসেম্বর মাসে প্রিন্স অব ওয়েলস বাংলাদেশ সফরে আসেন। তাঁর চলার জন্য নির্দিষ্ট রাস্তা ছিল। তাই মানুষের ক্ষোভের কথা জানতেও পারেননি।

স্বদেশি আন্দোলন পূর্ব বাংলায়ও ছড়িয়ে পড়ে। ১৯০৬ সালে বাংলা নববর্ষের দিনে বরিশালে সম্মেলন হওয়ার কথা ছিল। সভাপতি ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। কিন্তু পুলিশের লাঠিচার্জে সেই সভা হতে পারেনি। কবি বোলপুরে ফিরে আসেন। পরে স্বদেশি আন্দোলনের নেতাদের মধ্যে কাজের পদ্ধতি নিয়ে মতভেদ ও কলহ দেখা দেয়। রবীন্দ্রনাথ তখন কলকাতায় এসে ‘দেশনায়ক’ নামে এক প্রবন্ধ পড়েন। বলেন, ‘কলহ অক্ষমের উত্তেজনা-প্রকাশ, তাহা অকর্মণ্যের একপ্রকার আত্মবিনোদন।’

কলহ তাতেও কমেনি। ১৯০৭ সালের ডিসেম্বরে কংগ্রেসের নরমপন্থী ও চরমপন্থীদের মধ্যে বিবাদের কারণে সভা পণ্ড হয়ে যায়। দুই পক্ষের মধ্যে জুতা-স্যান্ডেল ছোড়াছুড়ির ঘটনাও ঘটে। এর পরিপ্রেক্ষিতে রবীন্দ্রনাথ বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বসুকে লিখেছিলেন, ‘আমাদিগকে নষ্ট করিবার জন্য আর কারও প্রয়োজন হইবে না।’

১৯০৮ সালে ক্ষুদিরামসহ কয়েকজন বিপ্লবী ধরা পড়েন। কলকাতার মানিকতলার একটি পোড়োবাড়িতে বোমা তৈরির সরঞ্জাম, রিভলবার, টোটা ইত্যাদির খোঁজ পায় পুলিশ। ‘চরমপন্থী’ বিপ্লবীদের কণ্ঠেও থাকত ‘নরমপন্থী’ রবীন্দ্রনাথের কবিতা ও গান—‘জীবন মৃত্যু পায়ের ভৃত্য, চিত্ত ভাবনাহীন’ কিংবা ‘সার্থক জনম আমার জন্মেছি এই দেশে।’ রবীন্দ্রনাথ অবশ্য মনে করতেন, হিংসা দিয়ে বড় উদ্দেশ্য সাধন হয় না। তাই তিনি বলতেন, ‘ভবিষ্যৎ যে রাষ্ট্রের স্বপ্ন আমরা দেখি, তার প্রতিষ্ঠা হবে অহিংসা, সত্য ও শ্রেয়ের ওপর।’ ১৯০৯ সালে লেখা প্রায়শ্চিত্ত নাটকে তিনি বলেন, ‘রাজ্যটা রাজার একলার নয়।’

১৯১৩ সালে নোবেলজয়ের পর পৌষ উৎসব চলছিল শান্তিনিকেতনে। তখন বিশ্বভারতীর ছাত্রদের উদ্দেশে কবি বলেন, ‘এ আশ্রম, এখানে কোনো দল নেই।’ ওই সময় থেকে আশ্রমে বিভিন্ন ধর্ম ও মতের মানুষ যোগ দিতে থাকেন। ১৯১৪ সালের বৈশাখে তারুণ্যকে স্বাগত জানিয়ে লেখেন, ‘সবুজের অভিযান’ কবিতা। ওই বছর জুলাই মাসে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়। কবি প্রবলভাবে ব্যথিত হন। তবু তাঁর আশা ছিল যে এই ধ্বংসের মধ্য দিয়ে নতুন কিছুর সৃষ্টি হবে। বলাকা কবিতাগুলোয় তাই তারুণ্যের স্ফুরণ দেখা যায়।

১৯১৬ সালের প্রথম দিকে একটি ব্যতিক্রম ঘটনা ঘটে। প্রেসিডেন্সি কলেজের অধ্যাপক ওটন সাহেব তাঁর ক্লাসে ভারতীয়দের সম্পর্কে কটূক্তি করেন। ছাত্ররা এর প্রতিবাদ করেন। শুধু তা–ই নয়, সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় অধ্যাপককে প্রহারও করেন। এ ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় রবীন্দ্রনাথ ‘ছাত্র-শাসনতন্ত্র’ নামে প্রবন্ধ লেখেন। সেখানে তিনি বলেন, ‘যাদের উচিত ছিল জেলের দারোগা বা ড্রিলসার্জেন্ট বা ভূতের ওঝা হওয়া, তাদের কোনোমতেই উচিত হয় না ছাত্রদিগকে মানুষ করিবার ভার লওয়া।’

পরের বছর ১৯১৭ সালে গণতন্ত্র ও স্বাধীনতাকামী অ্যানি বেসান্তকে ব্রিটিশ সরকার গৃহবন্দী করে রাখে। সেই সঙ্গে ভারতরক্ষা আইন জারি করে ১ হাজার ২০০ বাঙালি যুবককে জেলে আটকায়। এর প্রতিবাদ করে রবীন্দ্রনাথ সংবাদপত্রে বিবৃতি দেন। তিনি কলকাতার টাউন হলে সভা করতে চেয়েছিলেন। তবে সরকারের বাধায় সেটা করতে পারেননি। পরে রামমোহন হলে ও আলফ্রেড রঙ্গমঞ্চে ‘কর্তার ইচ্ছায় কর্ম’ নামে একটি দীর্ঘ প্রবন্ধ পড়েন। সেখানে তিনি বলেন, ‘আমাদের অতীত তার সম্মোহনপাশ দিয়ে আমাদের বর্তমানকে ব্যর্থ এবং ভবিষ্যৎকে দুষ্প্রাপ্য করে রেখেছে।’

১৯২০-২১ সালের বেশ খানিকটা সময় রবীন্দ্রনাথ দেশের বাইরে ছিলেন। তখন প্রবল আকার ধারণ করেছে অসহযোগ আন্দোলন। কবি দেশে ফিরে দেখতে পান, শান্তিনিকেতন এই আন্দোলনের বড় কেন্দ্র হয়ে উঠেছে। যেসব ছাত্র কখনো রাজনীতি করেননি, তাঁরাই আজ অগ্রণী! তিনি ছাত্রদের পক্ষ নিলেন।

এরপর ১৯২৪ সালের ঘটনা। ২৪ অক্টোবর বেঙ্গল অর্ডিন্যান্স পাস হয়। স্বরাজ্য দলের অসংখ্য কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়। রবীন্দ্রনাথ তখন আর্জেন্টিনায়। সেখান থেকে তিনি প্যারোডি করে লেখেন:

 ‘ঘরের খবর পাইনে কিছুই, গুজব শুনি নাকি

কুলিশপাণি পুলিশ সেথায় লাগায় হাঁকাহাঁকি।

শুনছি নাকি বাংলাদেশের গান হাসি সব ঠেলে

কুলুপ দিয়ে করছে আটক আলিপুরের জেলে।’

রবীন্দ্রনাথ তাঁর জীবনের একদিকে দেখেছেন শাসন-শোষণ, অন্যদিকে প্রতিবাদ-প্রতিরোধ। ১৯৩১ সালের সেপ্টেম্বরে কলকাতার গড়ের মাঠে বিশাল জনসভা হয়। সরকারের উগ্র দমননীতির বিপরীতে লাখের বেশি লোক সেখানে জড়ো হন। জেলের ভেতর রক্ষীরা দুজন বন্দীকে হত্যা করেছিলেন, আর ২০ জনকে মেরে আধমরা করেন। এ ছাড়া রিমান্ডে নিয়ে নানা রকম অত্যাচার তো ছিলই। রবীন্দ্রনাথ এর প্রতিবাদ জানিয়ে জনসভায় বলেন, প্রজার অনুকূল বিচার ও আন্তরিক সমর্থনের ওপরই শাসনের স্থায়িত্ব নির্ভর করে।

পরের বছরের প্রথম দিকে মহাত্মা গান্ধী ও নেতাদের অনেককে আটক করা হয়। রবীন্দ্রনাথ ইংল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রীর কাছে তারবার্তা পাঠিয়ে জানতে চান, ‘এরপর ব্রিটিশ প্রতিনিধিরা আর কী করে আমাদের কাছ থেকে সহযোগিতা ও শান্তিপূর্ণ সমাধানের সম্ভাবনা আশা করতে পারেন?’ কাছাকাছি সময়ে তিনি লেখেন ‘প্রশ্ন’ কবিতা:

 ‘আমি যে দেখেছি, গোপন হিংসা কপট রাত্রিছায়ে

হেনেছে নিঃসহায়ে।

আমি যে দেখেছি, প্রতিকারহীন শক্তের অপরাধে

বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কাঁদে।’

১৯৩৫ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি বিশ্বভারতী দেখতে আসেন লাটসাহেব জন অ্যান্ডারসন। তাঁর আসা উপলক্ষে কয়েক দিন আগে থেকেই পুলিশ ও গুপ্তচরে ছেয়ে যায় ক্যাম্পাস। পুলিশ বিভাগের কর্তা এসে বলেন, বিশেষ কারণে কয়েকজন ছাত্রকে আটকে রাখা দরকার। রবীন্দ্রনাথ এতে ক্রুদ্ধ হয়ে বলেন, ‘তাহলে আপনারা তাঁর অভ্যর্থনা করুন, আমি এখান থেকে চললাম।’ শেষে ব্যবস্থা হলো এই যে গভর্নরের আসার দিন ছাত্র-শিক্ষকেরা কেউ আশ্রমে থাকবেন না। কেবল বিভাগের অধ্যক্ষরা থাকলেন পুলিশবেষ্টিত হয়ে।

১৯৩৬ সালে জওহরলাল নেহরু কবিকে পত্র পাঠান। তাতে লেখা ছিল—ভারতের সর্বত্র ব্যক্তিস্বাধীনতা বিপন্ন; মানুষের জন্মগত অধিকার রক্ষার জন্য একটি সংঘ গড়া হয়েছে। সেই সংঘের সভাপতি করা হয়েছিল রবীন্দ্রনাথকে।

জীবনের শেষ দিকে ১৯৩৯ সালে দেশীয় রাজনীতির অবস্থা দেখে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, ‘পৃথিবীতে যে দেশে যে বিভাগেই ক্ষমতা অতি প্রতিভূ হয়ে সঞ্চিত হয়ে ওঠে, সেখানেই ভিতরে ভিতরে নিজের মারণ-বিষ উদ্ভাবিত করে।’ একই বছর আন্তর্জাতিক ঘাত-প্রতিঘাত দেখে মংপুতে বসে বলেছিলেন, ‘ইচ্ছে করে না খবরের কাগজ খুলি, ইচ্ছে করে না রেডিওর খবর শুনি। কিন্তু না শুনেও তো পারিনে। চোখ বুজে তো বেদনার অন্ত করা যায় না।...বাঁচতে ইচ্ছে করে না আর। এ পৃথিবী বাসের অযোগ্য হয়ে উঠেছে।...এ নৃশংসতা আর কত দেখব!’

রবীন্দ্রনাথ কবি; তবে রবীন্দ্রজীবনের সবটা কাব্য নয়। আবার আন্দোলন-রাজনীতির দমকা হাওয়ার বিপরীতে কাব্যের আশ্রয় নিয়েছেন বারবার। মৃত্যুর সপ্তাহখানেক আগে লিখেছিলেন, ‘দুঃখের আঁধার রাত্রি বারে বারে/এসেছে আমার দ্বারে’। একই কবিতায় স্পর্ধা নিয়ে বলেছেন, ‘যতবার ভয়ের মুখোশ তার করেছি বিশ্বাস/ ততবার হয়েছে অনর্থ পরাজয়।’