অলংকরণ: আরাফাত করিম

মাকে নিয়ে দাঁতের ডাক্তার দেখাতে এসেছে নাবিলা। ডাক্তার সময় দিয়েছেন সন্ধ্যা সাতটা। কিন্তু পৌঁছে দেখল, সাতটার জন্য বসে আছে আরও কিছু রোগী। মেজাজটা তার খারাপ হলো। কিছুই তার ইচ্ছা মেনে চলছে না। মায়ের সঙ্গে কদিন থেকে একটা স্নায়ুযুদ্ধ চলছে, মা চাইছেন বড় চাচার পছন্দের এক ছেলেকে সে বিয়ে করুক।

ছেলেকে না দেখেই সে আপত্তি জানিয়েছে। নাবিলার বাবা মারা যাওয়ার পর, কবরের মাটি বসে যাওয়ার আগেই, এই চাচা তাদের মুগদার বাড়িটা হাতিয়ে নিলেন, মা আর তাকে নিতান্ত দয়া দেখিয়ে সেই দখলে নেওয়া বাড়িতেই আশ্রয় দিলেন। নাবিলা যদি তার অবাধ্য হয়, তাহলে সেই আশ্রয়ণ প্রকল্পের ইতি। চাচাটা উগ্র, চাচিটাও কম যান না।

কাল বিকেল থেকে দাঁতের ব্যথায় মায়ের কথা বন্ধ। ডাক্তারের অপেক্ষায় তাঁর পাশে বসে বসে নাবিলার মনটা একসময় খারাপ হলো। এতটা অসহায় তাঁকে সে কখনো দেখেনি। সে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল।

দীর্ঘশ্বাসের শব্দটা মা শুনলেন। তিনি একে সাময়িক যুদ্ধবিরতি হিসেবে দেখলেন এবং ব্যাগ থেকে একটা খাম বের করে তার হাতে দিয়ে ইঙ্গিতে বললেন, খুলে দেখো। নাবিলা দেখল। একটা ছবি। তেল চপচপে আঁচড়ানো চুল, চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা, কেবলাকান্ত একটা লোক, বোকার মতো হাসছে। চাচার সেই পাত্র! এই লোক নাকি পরমাণুবিজ্ঞানী! আমেরিকায় পড়ছে। বিয়েটা সেরে ফেলতে এসেছে। নাবিলার কান্না পেল। এ লোককে কারও হাতে গছিয়ে দেওয়া সুপারঘটক পাখি ভাইয়ের পক্ষেও তো অসম্ভব। ছবিটা মাকে দিয়ে সে বলল, ফেরার পথে রিকশা থামিয়ে আমাকে একটু কমলাপুর নামিয়ে দিয়ো। একটা ভদ্র গোছের ট্রেন বেছে নিচে ঝাঁপ দেব।

নাবিলার পাশে বসা একটা চুপচাপ ছেলে, মনে হয় কলেজপড়ুয়া, তাকে আস্তে বলল, মন খারাপ করতে নেই, আপু। এই গানটা বরং শোনেন।

নাবিলা দেখল, ছেলেটা কানে তার লাগিয়ে মোবাইল ফোন থেকে গান শুনছে। তার খুলে সে নাবিলার দিকে এগিয়ে দিল। নাবিলা অবাক হতেও ভুলে গেল। এটাও তাহলে ঘটছে! প্রথমে ভেবেছিল ছেলেটাকে দুটো কথা শোনাবে। কিন্তু ওর হাসি দেখে মায়া হলো। কানে তার লাগাতে লাগাতে সে মায়ের দিকে তাকাল। মা কষ্টে চোখ বুজেছেন। দু–এক ফোঁটা জল ঝরছে চোখ থেকে।

‘সাম ডেজ আর ডায়মন্ড, সাম ডেজ আর স্টোন’ এক গায়ক গাইছেন। কী অসাধারণ, সতেজ গলা! কিছুদিন হীরার, কিছু পাথরের। তাই তো! ছেলেটাকে বলতে ইচ্ছা হলো, তার প্রতিদিনই তো পাথরের। তারপরও পুরো গানটা সে শুনল। গান শেষ হলে ছেলেটার দিকে তাকিয়ে বলল, ধন্যবাদ।

আমার সিরিয়াল আপনাদের আগে। বাট আই উইল ওয়েট, সে বলল।

একটু হেসে জিজ্ঞেস করল নাবিলা, গায়কের নাম কী?

জন ডেনভার, সে জানাল এবং বলল, আমার কাছে অবশ্য অল ডেজ আর ডায়মন্ড। এটা বিশ্বাস করতে হয়, আপু।

নাবিলার কষ্ট হলো। এই ছেলেও তাহলে তাকে করুণা করছে!

এক রোগীর ফোন বাজল। কথা বলতে বলতে সে উঠে দাঁড়াল। তারপর বেরিয়ে গেল। আরেক রোগী গেল তার পেছন পেছন। নিশ্চয় কোনো ইমার্জেন্সি। ছেলেটি বলল, আপনার আগে আর একজন। উনিও চলে যাবেন।

গেলেনও। তাঁকে বাথরুমে যেতে হবে। তাঁর ইয়ে চেপেছে।

ডাক্তারের কাছে মাকে পৌঁছে দিয়ে নাবিলা দাঁড়িয়ে থাকল। ডাক্তার বলল, বাইরে গিয়ে বসুন। একটু সময় লাগবে।

বাইরে বেরিয়ে নাবিলা দেখল, ছেলেটা নেই, তার চেয়ারে বসে আছে এক ভদ্রলোক। হাসিখুশি মুখ, সুদর্শন, মাথাভর্তি অবাধ্য চুল, চোখে সোনালি ফ্রেমের চশমা। দেখেই ভরসা জাগে, পাশে বসা যায়। নাবিলার ছেড়ে যাওয়া চেয়ারটাতে এখনো কেউ বসেনি।

ভদ্রলোক তার দিকে হেসে তাকাল। একটা খাম এগিয়ে দিল। এবারও অবাক হওয়ার সময় নাবিলা পেল না। খামটা খুলতে হলো।

সেই পরমাণুবিজ্ঞানী! অসম্ভব বিরক্তি নিয়ে খামটা সে ভদ্রলোককে ফিরিয়ে দিল। তারপর তার চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, কেন এই লোকের জন্য ঘটকালি করতে এসেছেন? কে আপনি?

ভদ্রলোক হাসল। হীরার দ্যুতি ছড়ানো হাসি। আমার ঘটকালি তো আমাকেই করতে হবে, তা–ই না?

মানে আপনিই ফটোর সেই লোক? গলায় অবিশ্বাস ঢেলে বলল নাবিলা।

জি, সেই পরমাণুবিজ্ঞানী। তবে ছবিটা আমার আরেক জীবনের। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে বলল, কাল আপনার অফিস একটু আগেই ছুটি হবে। অফিস শেষে রাস্তায় নেমে পাঁচ মিনিট অপেক্ষা করবেন। প্লিজ।

দুই.

অফিস ঠিকই লাঞ্চের আগে ছুটি হলো। বসের মেয়ের বিয়ে। লোকটা কী করে আগেভাগেই জানল ব্যাপারটা, নাবিলা ভেবে পেল না।

মগবাজারের ব্যস্ত রাস্তায় পা রেখে সে দেখল, দিনটা বিষণ্ন, যেন ছাই মেখে একটা হাতির রং ধরেছে। একসময় টের পেল, তার পাশে কেউ দাঁড়িয়েছে। চলুন, লোকটা বলল। আমার নাম ইমরান।

কোথায়?

কোথায় আবার, লাঞ্চে, সে বলল এবং মানুষের স্রোত কেটে এগিয়ে গেল।

দিনটা কী সুন্দর, তা–ই না? লোকটা বলল।

নাবিলা দেখল, তাই তো! দুপুরটা ঝকঝক করছে। লোকটা কি জাদু জানে?

তিন.

তিনদিন পর নাবিলা বলল, মা, হ্যাঁ জয়যুক্ত হলো।

মা হাসলেন। তার সেই পুরোনো হীরার দ্যুতির হাসি। ডাক্তার যেন তার দাঁতের যৌবন ফিরিয়ে দিয়েছেন।

রাতে নাবিলা একটা স্বপ্ন দেখল। গিটার হাতে এক গায়ক গাইছে, প্রতিটা দিনই তো হীরা। তার লম্বা চুল যেন রেশমে তৈরি। সোনালি ফ্রেমের চশমা থেকে আলো বেরোচ্ছে। গান শেষ হলে নাবিলার দিকে তাকিয়ে গায়ক হাসল। বলল, গিটারটা রেখে গেলাম।

নাবিলার ঘুম ভেঙে গেল। জানালা দিয়ে ভোরের অস্পষ্ট আলো ঢুকছে ঘরে। সে দেখল, ঘরের কোনে একটা গিটার, যেন ভোরের সবগুলো আলো মেখে হাসছে।

অবাক হওয়ার একটা পরীক্ষা চলছে যেন তার! পাশের বিছানায় মা ঘুমিয়ে। তাঁকে জাগিয়ে সে জিজ্ঞেস করল, এটা কোত্থেকে এল, মা? এই গিটারটা?

ঘুমজড়ানো গলায় মা বললেন, ওই দাঁতের ডাক্তারের চেম্বারে যে বাচ্চা ছেলেটা ছিল সে কাল বিকেলে দিয়ে গেছে। তোর জন্য।

নাবিলা কিছুক্ষণ ভাবল। তার অফিসের সৌরভদা গিটার বাজান। তাঁকে এটি গছিয়ে দিতে হবে।

নাশতা খেতে বসে তার স্বপ্নের গানটার কথা মনে পড়ল। কে গাইছিল গানটা? ডেনভার?

ফোনে গুগল খুলে সে জন ডেনভারকে চাইল। সেই গায়ক এল। স্বপ্নে দেখা ঠিক সেই মানুষটা! নাবিলার হাত থেকে চায়ের কাপটা যেন পড়েই গেল।

গিটার হাতে অফিসের পথে নামতেই তা থেকে হীরার দিনের সুর উঠল। বাসের জন্য দাঁড়িয়ে নাবিলা ভাবল, না, এটা সৌরভদার জন্য নয়, এটা দেওয়া যায় শুধু একজনকেই।

সেই একজন পাশে এসে দাঁড়াল। বলল, আজ আপনার অফিস যাওয়া হবে না। আপনার অনেক ছুটি পাওনা। আজ সারা দিন আমরা ঘুরব। কথা বলব। আর হ্যাঁ, ধন্যবাদ গিটারটার জন্য। নাবিলার হাত থেকে সেটা তুলে নিতে নিতে বলল, এটার জন্যই বসে ছিলাম।

নাবিলার মুখে একটা কথাও জুটল না।

চার.

হীরার একটা দিন কাটল নাবিলার। বেলা ১১টায় বনানীর নর্থ এন্ডে কফি খেতে খেতে ইমরান তাকে বলল, নাবিলাকে সে স্বপ্নে পেয়েছে। স্বপ্নটা দেখিয়েছে ডেনভার। লোকটা তাকে বলেছে, মেয়েটা হীরার দিনের খোঁজে আছে। তুমিও।

বাইরে ঝুপ ঝুপ বৃষ্টি। আষাঢ়ের ঘনঘোর। ইমরান বলল, এমন দিনে তোমাকে আমার গল্পগুলো বলা যায়।

আষাঢ়ে গপ্পো তো? বলতে পারেন, নাবিলা বলল। শুনতে ভালোই লাগে।

আষাঢ়ে গপ্পো আমার হাতেই তৈরি হয়, ইমরান বলল।

তারা আপনি থেকে তুমিতে নামল। বিয়ের দিন ঠিক করল। বিয়ের তিন মাসের মধ্যেই নাবিলার ভিসাটিসা পাওয়া হয়ে যাবে। তারপর ইমরানের পাথর–দিনের অবসান।

নাবিলা জিজ্ঞেস করল, তোমার আবার পাথর–দিন কেন?

সেই গল্পটাই বলব। পাথর–দিনের শুরু আমার ল্যাবে। আমার তিন সহপাঠী একসঙ্গে গবেষণা করছে। আমাকে ধরেছে তাদের একটা কাজ করে দিতে। সেটা করে দিলে তারা আরও জটিল একটা কাজ চাপিয়ে দিল। সেটাও কিছুটা করেছি, কিন্তু পরে ভেবেছি, নিজের কাজ ফেলে ওদেরটা কেন করব। তা ছাড়া ওদের সব কাজ সন্ধ্যায়। সন্ধ্যাগুলো অকারণে হারানো যায় না। তাই কিছুদিন ল্যাবে যাওয়া ছেড়ে দিয়েছি। একদিন তারা জানতে চাইল, কেন আমি ল্যাবে যাই না। বললাম, ল্যাবে ভূত আছে। তারা আমার চালাকিটা বুঝল, কিন্তু কথাটা চাউর করে দিল। আমাকে নিয়ে হাসাহাসি শুরু হলো। তবে তাদের একজন—জেনেট—যার ভূতের ভয় আছে, এক সন্ধ্যায় ল্যাবে ঢুকে একটা চিৎকার দিয়ে চিৎপটাং হয়ে গেল। কেউ একজন ভূত হয়ে তাকে ভয় দেখিয়েছে। অভিযোগের তির এল আমার দিকে। অথচ ওই সন্ধ্যায় আমি ল্যাবেই ছিলাম না। কিন্তু তাতে কি! আমি মানুষটা যে বাদামি। জেনেট আমার বিরুদ্ধে হ্যারাসমেন্টের অভিযোগ আনল। এরপর বিভাগের ল্যাবে কাজ করাই আমার জন্য কঠিন হয়ে পড়ল।

নাবিলা বলল, তাহলে এখনই কেন ফিরে যাবে?

ইমরান বলল, হীরার দিনের মোড়ক খোলার জন্য।

ইমরানরে কথা বোঝা মুশকিল। তার চালচলনেও রহস্য। পরমাণুবিজ্ঞানীরা নিশ্চয় এমনই, নাবিলা ভাবল।

পাঁচ.

বিয়ের সাত দিন পর ইমরান চলে গেল। যেভাবেই হোক, তার কাজ তো শেষ করতে হবে। একা একাই সব সামলাল নাবিলা। একগাদা ফরম পূরণ করল। ভিসার লাইনে দাঁড়াল। ভিসা পেল। আড়াই মাসের মাথায় মাকে এক আকাশ শূন্যতায় ভাসিয়ে আকাশে উড়ল।

বোস্টনে নেমে ইমরানকে জড়িয়ে ধরে তার মনে হলো, শহরের সব শীত যেন সে ঢাকার বসন্তে ঢেকে দিল।

সপ্তাহ দু–একের মধ্যে সে বুঝল, ইমরানের পাথর–দিন শেষ হতে অনেক বাকি। তাকে কেউ বিশ্বাস করে না। জেনেট তার বিরুদ্ধে একটা মামলা ঠোকার কথা ভাবছে। শুধু তার সুপারভাইজার আছেন তার পক্ষে। তিনি বললেন নাবিলাকে, ইমরান তার সঙ্গে যে কাজটা করছে, তাতে একদিন তাঁরা নোবেলটা পেয়ে যেতে পারেন।

এক রাতে ১২টা বাজতেই গিটার বাজিয়ে জন ডেনভারের গান ধরল ইমরান। গান শুনে অবাক নাবিলা, কী সুন্দর গলা, আর কী অদ্ভুত মিল দুজনের গলায়! গান শেষে গভীর আলিঙ্গনে বেঁধে নাবিলাকে সে বলল, হ্যাপি বার্থডে। তারপর তার আঙুলে পরিয়ে দিল হীরার একটা আংটি।

কথা হারানোর আগে নাবিলা বলল, হীরার দিনের তাহলে উন্মোচন হলো?

না, সেটা ঠিক দুদিন পর।

ছয়.

দুদিন পর আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নামল বোস্টনে। ঠিক যেন আষাঢ়ে বৃষ্টি। সন্ধ্যার আগেই ল্যাব থেকে ফিরল ইমরান। জেনেটের মামলা করাটা বেশ এগিয়েছে, সে বলল। নাবিলা তাকে জিজ্ঞেস করল, গিটারটা নিয়ে যে বেরোলে, সেটা কোথায়?

গিটার আছে গিটারের জায়গায়, একটা রহস্যের হাসি দিয়ে ইমরান বলল।

রাত ১০টায় ফোন এল সুপারভাইজারের। এক্ষুনি ল্যাবে এসো, তিনি বললেন।

নাবিলাকে নিয়ে বেরোল ইমরান।

ল্যাবের বাইরে ভিড়। তাদের দেখে সুপারভাইজার এগিয়ে এলেন। বললেন, ভূত দেখে জনি আর অ্যালানরের দাঁতকপাটি লেগেছে। জেনেট গেছে হাসপাতালে। সে সমানে চিৎকার করছে। ল্যাবের অন্তত ১৫ জন ভূতটা দেখেছে। তাদের অবস্থা না-বলার মতো।

ভূত দেখে? নাবিলা জিজ্ঞেস করল।

ভূত আবার যেমন–তেমন নয়। বিরাট লম্বা। ঘাড় পর্যন্ত সোনালি চুল। চোখে সোনার চশমা। হাতে গিটার। গিটারে ঝংকার তুলে সারা ল্যাবে আতঙ্ক ছড়িয়েছে। ভূত যে আছে, তা নিয়ে কেউ এখন প্রশ্ন তুলবে না।

অর্থাৎ ইমরান জয়যুক্ত হলো। কিন্তু ভূত কি তাকেও ছাড়বে? সুপারভাইজার বললেন, তাঁরও ভয় লাগছে।

না, প্রফেসর ব্রড, আমি আপনাকে ছাড়ব না, ইমরান হেসে বলল। তারপর নাবিলার হাত ধরল। চলো, সে বলল, বাড়ি গিয়ে হীরার দিনের মোড়কটা খুলি।

গিটারটা নেবে না? নাবিলা জিজ্ঞেস করল।

না, সেটা যার, সে নিয়ে গেছে। চোখে রহস্য ছড়িয়ে বলল ইমরান।

এ দেশেও তাহলে আষাঢ় আসে, আর মানুষকে তার গল্পে নিয়ে যায়! নাবিলা ভাবল।