ভয়ের সংস্কৃতি ও ‘বিদ্রোহী রবীন্দ্রনাথ’

ব্রিটিশ শাসনামলে রবীন্দ্রনাথের কোনো বই নিষিদ্ধ হয়নি। তবে নিষিদ্ধ হয়েছিল তাঁর ওপর লেখা একটি সমালোচনাগ্রন্থ।

ভারত উপমহাদেশে ব্রিটিশ শাসন প্রায় ২০০ বছরের। কিন্তু ইতিহাসবিদেরা দুটি পর্যায়ে এই ঔপনিবেশিক শাসনব্যবস্থাকে ভাগ করেছেন। প্রথম পর্যায় ছিল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বাণিজ্য বিস্তার আর দ্বিতীয় পর্যায় ভারতে সরাসরি ব্রিটিশ সরকারের শাসন। এই ব্রিটিশ বণিকশাসিত ভারতে কত বই নিষিদ্ধ হয়েছিল? ব্রিটিশরাজের পরাজয়ের ৭৫ বছর পর এখন ইতিহাসের দিকে তাকালে অবাক হতে হয়। ভারতবর্ষের অপরাপর ভাষার বইয়ের কথা বাদই দিলাম, শুদ্ধ বাংলা ভাষায় লিখিত বই নিষিদ্ধ হয়েছিল দুই শতাধিক। অসংখ্য লেখকের বই নিষিদ্ধ করার বড় কারণ বইয়ের অন্তর্গত উপাদান। নানা সাহিত্যিক উপাদান থাকলেও মূলত বইগুলোর মূল চেতনাগত দিক হলো সাহিত্যের মাধ্যমে ইংরেজ দুঃশাসন, লুণ্ঠন আর নির্যাতনের বিরোধিতা; স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা; স্বরাজ প্রতিষ্ঠা ও অপশাসনের বিরুদ্ধে জাতীয় নবজাগরণ সৃষ্টি।

বই নিষিদ্ধ করার জন্য ইংরেজ শাসকেরা নানা সময়ে নানা আইন জারি করেছে। সেই সময়ের সবচেয়ে আলোচিত আইন ছিল ‘Act No. XIX of 1876 [16th December, 1876] An Act for the Better Control of public dramatic Performance’। তবে আলোচিত এই আইনের আওতায় শুদ্ধ জনপরিসর নয়, ছিল বাড়ির চৌহদ্দি থেকে কামরা নাগাদ। প্রবন্ধ, গল্প, উপন্যাস, কবিতার বইয়ের ক্ষেত্রে নানা সময়ে নানা আইন ও আদেশ জারি করলেও নাটকের ক্ষেত্রে আইন কেন আলোচিত ছিল? তার মূল কারণ, নাটক জনপরিসরের জিনিস। কেননা নাটক মুখোমুখি ও সরাসরি জনপরিসরকে প্রভাবিত করে সহজ উপায়ে। ফলে সমাজে জনবিদ্রোহ খুব দ্রুত ঘটে। সাধারণত আইনের ধর্ম ‘ন্যায় প্রতিষ্ঠা করা’, কিন্তু ব্রিটিশরাজের এসব আইনের উদ্দেশ্য ছিল শাসনভার নিরঙ্কুশ ও সাহিত্য থেকে সৃষ্ট জনবিদ্রোহ দমন করা। তার সার্বিক ফলাফল হলো জনসমাজে ভয়ের সংস্কৃতি কায়েম করা।

ব্রিটিশ রাজদণ্ড ভয়ের সংস্কৃতি কায়েম করলেও স্বাধীনতাপ্রত্যাশী জনগণ, লেখক ও শিল্পীরা দমে যাননি। লড়াই, লেখনী, প্রকাশনা ও নাটক পরিবেশনা বন্ধ করেননি। ব্রিটিশ আমলে সবচেয়ে বেশি নিষিদ্ধ হয়েছিল কাজী নজরুল ইসলামের বই ও সম্পাদিত পত্রিকা। ফলে নজরুল আমাদের জনসাহিত্য পরিসরে ‘বিদ্রোহী’ বলে বিবেচিত হন। প্রশ্ন হলো, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ক্ষেত্রে এ সাহিত্যিক উপাধি ঠিক কি না? এই প্রশ্ন দুজনের মধ্যে প্রতিতুলনা সৃষ্টি কিংবা নজরুলের ‘বিদ্রোহী’ উপাধিতে রবীন্দ্রনাথের ভাগ বসানোও নয়। বরং আমাদের বিষয়-ঐতিহাসিক সাহিত্যের ভিন্ন এক অনালোচিত ও কম জানা প্রসঙ্গ সামনে আনা।

এ ক্ষেত্রে প্রশ্ন আসে, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কি বিদ্রোহী? হয়তো অনেকেই বলবেন, না। কিন্তু ঔপনিবেশিক সাহিত্যের ইতিহাস ভিন্ন সাক্ষ্য দেয়। ব্রিটিশ আমলে রবীন্দ্রনাথের কোনো বই নিষিদ্ধ হয়নি ঠিক, কিন্তু বাজেয়াপ্ত হয়েছিল তাঁর সাহিত্য নিয়ে রচিত এক সমালোচনাগ্রন্থ বিদ্রোহী রবীন্দ্রনাথ। লেখক ভারতীয় সাহিত্যিক ও বুদ্ধিজীবী বিজয়লাল চট্টোপাধ্যায়। এই বইয়ের দুটি দিক নিয়ে আমরা আলাপ করব।

প্রথম দিক হলো কখন ও কোন আইনে বিদ্রোহী রবীন্দ্রনাথ বাজেয়াপ্ত হয়েছিল? বইটি বাজেয়াপ্ত হয়েছিল ১৯৩২ সালের ১৫ এপ্রিল। এটি বাজেয়াপ্ত করতে ব্রিটিশ রাজদণ্ড জরুরি ক্ষমতাবলে প্রকাশ করেছিল বিশেষ গেজেট। বাংলায় বললে, ১৯৩১-এর ভারতীয় প্রেস (জরুরি ক্ষমতা) অর্ডিন্যান্স ২৩ অনুসারে বইটি বাজেয়াপ্ত হয়। তবে এই বই প্রকাশিত হয় বাজেয়াপ্ত হওয়ার আগের বছর—১৯৩১ সালে। এটির প্রকাশক ছিলেন রমণীমোহন গোস্বামী। আর প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান কলকাতার হরিঘোষ স্ট্রিটের নবসাহিত্য ভবন।

বিদ্রোহী রবীন্দ্রনাথ রবি সাহিত্য সমালোচনার আদি পর্বের কাজ। ব্রিটিশ সরকার শাসন, দমন ও ভয়ের সংস্কৃতি কায়েমের জন্য নানা আইন করলেও জনবিদ্রোহকে তারা মারাত্মক ভয় পেত। এ কথা সত্য, ঔপনিবেশিক শাসনের সংস্কৃতিতে দুই ভয় পরস্পর বিপরীতমুখী—ভয় কেবল জনগণই পায়, তা নয়; পায় অত্যাচারী শাসকেরাও। না হলে এত বই কেনই–বা নিষিদ্ধ হবে!

দ্বিতীয় দিক হলো কী আছে বিদ্রোহী রবীন্দ্রনাথ-এ? বইয়ের প্রথম বাক্য, ‘রবীন্দ্রনাথ বিদ্রোহী কবি।’ কেন? বিজয়লালের যুক্তি, ‘বাঁশির স্বরে সাপের জড়তা ঘোচে, রবীন্দ্রনাথের গানে জাগিয়া উঠিয়াছে আমাদের তরবারি যাহা সকল বাঁধন ক্ষয় করিয়া আমাদের অন্তর্নিহিত ভূমাকে প্রকাশ করে। কিন্তু শুধু বিদ্রোহী বলিলেই তাঁহার সম্বন্ধে সকল কথা বলা ফুরাইয়া যায় না। বিদ্রোহী ভাঙিতে চায়। কবি রবীন্দ্রনাথও ভাঙিতে চাহিয়াছেন—যাহা মিথ্যা, যাহা জীর্ণ, যাহা অসুন্দর তাহাকে সবলে ভাঙিতে চাহিয়াছেন।’ পুরো বইয়ে কেন রবীন্দ্রনাথ বিদ্রোহী, তার এন্তার যুক্তি আছে। এ কথা ঠিক, যেকোনো বিদ্রোহের কারণ জরাজীর্ণ চিন্তা ভাঙা, অত্যাচার-অনাচার-অবিচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো, স্বাধীনতা ও স্বদেশি আত্মনিয়ন্ত্রণের পথে নবজাগরণ সৃষ্টি করা। লেখক বিজয়লাল রবীন্দ্ররচনা থেকে খুঁটে খুঁটে এ বইয়ে সেই উপাদানের তুলনামূলক বিশ্লেষণ করেছেন। আর বইটির উল্লেখযোগ্য দিক হলো পশ্চিমা বিপ্লবী সাহিত্যের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যের নানা মিল-অমিলের বিষয়গুলোর সন্নিবেশ।

লেখক বলেছেন, ‘কবির মধ্যে কোমল ও কঠিন দুইটি দিকই বর্তমান থাকিলেও আমরা তাঁহার কঠিন দিকটাই বাছিয়া লইয়াছি এবং তাঁহাকে বিদ্রোহীরূপে চিত্রায়িত করেছি।’ রবীন্দ্ররচনার বিষয়াবলির দিক থেকে তিনি গান, কবিতা, স্বদেশ চিন্তার গদ্য ও রাশিয়ার চিঠির আশ্রয় নিয়েছেন। বিশেষত স্বদেশ, স্বদেশ ও সংকল্প, জাতীয় সংগীত, পূরবী, বলাকা, কথা ও কাহিনী, মানসী, সমাজ, রাজাপ্রজা, অচলায়তননৈবেদ্য রচনা বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন, অত্যাচারী নিষ্ঠুর শাসকের অবয়ব ও কাণ্ডকারখানা। দেখিয়েছেন ভারতের স্বাধীনতা আর জাতীয় মুক্তির দিশা এবং ব্রিটিশের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ কেন অনিবার্য। পাশ্চাত্যের কথিত শাসন-সভ্যতার বিপরীত অন্ধকার দিকটিও।

প্রশ্ন উঠতে পারে, রবীন্দ্রসাহিত্যে বিদ্রোহের উপাদান থাকলে কেন ব্রিটিশরাজ বইগুলো নিষিদ্ধ করেনি। সে প্রসঙ্গ অন্যত্র আলোচনার বিষয়। তবে অন্য উদাহরণ টানা যাক। ভারতীয় লেখক-গবেষক বিষ্ণু বসু ও অশোককুমার মিত্র বলেছেন, ‘বিস্ময়কর ব্যাপার, বাজেয়াপ্ত বাংলা বইয়ের তালিকায় রবীন্দ্রনাথের কোনো রচনা নেই। অথচ অনুবাদে রবীন্দ্ররচনা বিদেশে নিষিদ্ধ হয়েছিল। হিটলারের আমলে জার্মানিতে এবং লিথুয়ানিয়ায় সমগ্র রবীন্দ্র-রচনাবলি নিষিদ্ধ হয়েছিল।’ এখানে স্মর্তব্য, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রাশিয়ার চিঠির ইংরেজি অনুবাদও নিষিদ্ধ হয়েছিল।

আদতে রাজদণ্ডের ভয় ছিল সাহিত্যে বিদ্রোহের সূত্রগুলো নিয়ে। তাই বিদ্রোহী রবীন্দ্রনাথ বাজেয়াপ্ত করেছিল ব্রিটিশ শাসক। আর অনালোচিত এ বই তুলনামূলক সমালোচনা সাহিত্যের এক আকর গ্রন্থ।