এই তপ্ত দুপুরে কাচের ভেতর দিয়ে দেখতে পাই ঝলসানো শহর। মনে পড়ে, শেষই তো হয়ে যাচ্ছে এপ্রিল। মনে পড়ে, এই এপ্রিলকে গোরা এক কবি তো চিত্রিত করেছিলেন নিষ্ঠুরতম মাস হিসেবে। সেই থেকে এপ্রিল নিষ্ঠুরতম মাস—কথাটি মানুষের মুখে মুখে ফেরে।
ঠিক ১০০ বছর আগে ইংল্যান্ড থেকে প্রকাশিত হয় এমন এক কবিতা, যা প্রকাশমাত্রই আধুনিক কবিতার দিকদর্শী হয়ে ওঠে। ‘দ্য ওয়েস্টল্যান্ড’ নামে খ্যাত ও বহুচর্চিত সেই কবিতায়ই টি এস এলিয়ট লেখেন:
‘এপ্রিল নিষ্ঠুরতম মাস
মরা মাটি থেকে জন্ম দিচ্ছে লাইলাক, মেশাচ্ছে
স্মৃতির সঙ্গে আকাঙ্ক্ষাকে,
বসন্তের বৃষ্টিতে শুষ্ক শেকড়ে
তুলছে আলোড়ন...’
কিন্তু কেন এপ্রিলকে নিষ্ঠুরতম মাস বলেছিলেন কবি?
প্রশ্নটির উত্তর খুঁজতে গেলে ভিক্টোরীয় এবং তার পরবর্তী কবিদের কবিতায় চোখ ফেরাতে হবে। পশ্চিমের কবিতায় দীর্ঘকাল ধরে কবিরা বসন্তকে যেভাবে আবাহন করছিলেন, তাঁদের সেই সীমাহীন বসন্তবন্দনার প্রতি একধরনের বিদ্রুপই বলা চলে এই পঙ্ক্তিকে।
আবার অনেকে বলেন, জেফরি চসারের ‘দ্য ক্যান্টারবেরি টেলস’–এ উর্বরা, জীবনদায়ী প্রকৃতির যে চিত্র তুলে ধরা হয়েছে, এখানে তাঁকেই ভাঙতে চেয়েছেন এলিয়ট। কিন্তু কেন?
কারণ, এই কবিতা এমন এক সময়ে লেখা, যার আগে পৃথিবীতে কখনো এত প্রাণক্ষয় ঘটেনি। বলে রাখা ভালো, এলিয়ট এ কবিতা লিখেছিলেন ১৯২২ সালে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ–পরবর্তী সেই পৃথিবীতে মৃত্যু অনেক সময় জীবনের চেয়ে কাম্য, বিশ্বাস কাচের চেয়ে ভঙ্গুর আর বিষাদই তখন অস্তিত্বের শিকড়ে গাঁথা। প্রকৃতি আর ঢাকতে পারছে না যুদ্ধের ক্ষত, স্বজন হারানোর বেদনা এবং মানবিকতায় বিশ্বাস হারানোর শূন্যতা। বসন্ত তাই নিষ্ঠুর আর শীত উষ্ণ। কারণ, বিস্মৃতিকামী তুষার ঢেকে দিয়েছিল মাটি আর তার ওপরের সবকিছু।
তাই যে স্তবকে এলিয়ট লিখেছেন, ‘এপ্রিল ইজ দ্য ক্রুয়েলেস্ট মান্থ’ বা এপ্রিল নিষ্ঠুরতম মাস, তারপরের স্তবকেই তিনি রায় দিয়েছেন,
‘মানবসন্তান,
তুমি বলতে বা অনুমান করতে পারো না,
কারণ তুমি কেবল চেনো
ভাঙা চিত্রের স্তূপ।’
যুদ্ধ–পরবর্তী দিনের এই কবিতা যেমন ধ্বংস চেনায়, তেমনি জন্মের আদি নিষ্ঠুরতাকেও শনাক্ত করে। আর কবিতাটির ছত্রে ছত্রে পাওয়া যায়: বর্তমান চেতনা অতীত সংস্কারকে গিলে খাচ্ছে। সামষ্টিক বেদনার কাছে ম্লান হয়ে যাচ্ছে শুভবোধ। ভাঙা চিত্রকল্প ইতস্তত পড়ে রয়েছে এখানে–সেখানে, যেন আমাদের বিক্ষিপ্ত অস্তিত্বের টুকরো—কিছু আছে, কিছু আর কখনো মিলবে না।
বিচ্ছিন্নতার সঙ্গে এলিয়টের পরিচয় অবশ্য পুরোনো। ব্রিটেন থেকে আমেরিকায় পাড়ি জমানো এই কবির পরিবার ছিল বনেদি, অভিজাত। ‘বোস্টন ব্রাহ্মণ’ পরিবারগুলোর একটি ছিল তাঁদের পরিবার। আর এলিয়টের শৈশব কেটেছে একা, নিভৃতে। শারীরিক অসুস্থতা তাঁকে খেলাধুলায় মত্ত হওয়ার সুযোগ দেয়নি। পড়তে শিখেই তাই তিনি বইয়ের সান্নিধ্য নিয়েছেন।
চলুন, এলিয়টের জীবনের জমিনের আরও গভীরে তাকানো যাক। জীবনের ১৬ বছর এই কবি কাটান মিসৌরি ও মিসিসিপি নদীর সঙ্গে। পড়শোনার সুবাদে পাড়ি জমান হার্ভার্ডে। সেখানে পরিচয় হয় এমিলি হেলের সঙ্গে, প্রেমেও পড়েন তাঁর। হেলকে লেখা এলিয়টের ১ হাজার ১৩১টি চিঠি রাখা আছে প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগারে।
তবে অক্সফোর্ডে গিয়ে এলিয়টের সঙ্গে দেখা হয় আরও এক নারীর—ভিভিয়েন হেই উডের। তাঁকে তিনি বিয়ে করেন ১৯১৫ সালে। নানা কারণে সেই বিয়ে সুখের হয়নি।
বার্ট্রান্ড রাসেলের সঙ্গে ভিভিয়েনের সম্পর্ক, এলিয়টের নানা শারীরিক সমস্যা, মানসিক বৈকল্য ক্রমেই কবির সঙ্গে তাঁর দূরত্ব বাড়িয়েছে। তা ছাড়া এলিয়ট নিজে সুরাপানে আসক্ত ছিলেন। তাঁদের বন্ধুদের ভাষ্য, দুজনের একসঙ্গে সময় কাটানো ক্রমেই অসম্ভব হয়ে পড়ছিল। সম্পর্কের এই তিক্ততাও কি এলিয়টকে আরও জীবনবিমুখ করেছিল অথবা জীবনের সেসব দিক দেখতে শিখিয়েছিল, যা আমরা সযত্ন এড়িয়ে যাই?
বসন্ত আর গ্রীষ্মের প্রাণচাঞ্চল্য আমাদের মুগ্ধ করে। তাই তারই জয়গান আমরা গেয়ে যাই। কিন্তু রৌদ্রের খরতাপ তো পোড়ায়ও। অপ্রাপ্তি, যাতনা আর মৃত্যুর বিরানভূমিতে নিত্য বসবাস আমাদের। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ–পরবর্তী প্রেক্ষাপটে সেই বাস্তবতার দিকে আমাদের মুখ ফেরাতে বাধ্য করেন এলিয়ট। প্রচণ্ড রোদে আমাদের চোখ জ্বালা করে। আর আমরা বুঝতে পারি, কেন এপ্রিল নিষ্ঠুরতম মাস।