বিশ্লেষণ
সাহিত্যপাতা কেন পড়ি?
১৯৯৮ সালের ৪ নভেম্বর প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল প্রথম আলো। আর এর দুদিন বাদে বেরিয়েছিল সাহিত্যপাতার প্রথম সংখ্যা। সে হিসেবে এই দৈনিকের সাহিত্যপাতারও রজতজয়ন্তী আসন্ন। এই ২৫ বছরে দেশের সাহিত্যাঙ্গনে কী ধরনের ভূমিকা রাখল পাতাটি, তা–ই বিশ্লেষণ করেছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক।
হ্যাঁ, আমি সাহিত্যপাতা পড়ি; হোক তা বিখ্যাত, কুখ্যাত কিংবা অখ্যাত কোনো পত্রিকার পাতা। পড়ি বা পড়ার চেষ্টা করি। কারণ, পড়াপড়ির এ ব্যাপারটা আমার অভ্যাসের অংশ। অন্য অনেকের মতো নাক-মুখ কুঁচকে আমি বলতে পারি না, ‘সাহিত্যপাতা পড়ি না, সাহিত্যপাতায় পড়ার কিছু নেই।’
বরং আমি উল্টোটাই পেয়েছি। আমাদের কৈশোর-তারুণ্যের কথা মনে পড়ে। ছোট্টমতো একটা শহর। একটাই পত্রিকার দোকান। প্রতিদিনের পত্রিকা পেতাম বিকেল অথবা সন্ধ্যা নাগাদ। কাগজ ও কালির গন্ধমাখা পত্রিকা খুলে প্রথমেই চোখ বুলিয়ে নিতাম সৃষ্টিশীল লেখালেখিবিষয়ক কিছু আছে কি না। সাধারণত বৃহস্পতি অথবা শুক্রবারে বেরোত সাহিত্যের সাময়িকী। ব্রডশিটে চার পৃষ্ঠাব্যাপী ছড়ানো থাকত লেখা ও ছবি।
নব্বই দশকের শুরুর দিকে—আমরা তখন কেবল পড়তে ও লিখতে শিখছি। স্বৈরশাসনের অবসানের পর নতুন নতুন পত্রিকার ঝকঝকে উপস্থিতি আমরা দেখতে পাচ্ছিলাম। খুব দ্রুত পাঠকের মন জয় করে নিয়েছিল জনকণ্ঠ, আজকের কাগজ, ভোরের কাগজ। এসব পত্রিকার ফিচার পাতাগুলো ছিল আকর্ষণীয়। নতুন প্রযুক্তি ও চিন্তার ছাপ পড়েছিল পত্রিকার পাতায়।
রংচঙে পত্রিকাগুলো তাই ক্রমেই প্রিয় হয়ে উঠছিল। পুরোনো পত্রিকাগুলোর মধ্যে সংবাদ–এর সাহিত্য সাময়িকী ছিল গম্ভীর ও ধ্রুপদি মেজাজের। আমোস টুটুওলা, পাবলো পিকাসো, সালভেদর দালি, এডভার্ড মুঙ্খ প্রমুখ লেখক-শিল্পীকে চিনেছিলাম ওই পাতার সূত্রে। তরুণ কবি-লেখকদের জন্য জনকণ্ঠ আলাদা পৃষ্ঠা বরাদ্দ করেছিল। ভোরের কাগজ–এর সাহিত্যপাতায় পেয়েছিলাম ফটোগ্রাফির সাক্ষাৎ। আজকের কাগজ ছাপত ভিনদেশি কবি, লেখক ও চলচ্চিত্রবিষয়ক লেখা। মুক্তকণ্ঠ–এর ‘খেলা জানালা’য় হাজির হয়েছিলেন ঢাকা-কলকাতার নবীন-প্রবীণ লেখকেরা।
১৯৯৮ সালের নভেম্বরে বের হলো নতুন পত্রিকা—প্রথম আলো। মনে পড়ে, সে সময় ‘প্রথম আলো’ নামটির মধ্যেই একটা চমক ছিল। পত্রিকাটি বেশ জোরেশোরে মাঠে নেমেছিল। শহর, পাড়া, মহল্লায় লেখক ও সাংবাদিকদের সঙ্গে বৈঠক–আলোচনা করেছিল। প্রথম আলোর পক্ষ থেকে আমাদের শহরেও একজন গিয়েছিলেন। তখন জেনেছিলাম, নতুন একটি পত্রিকা বের হচ্ছে। পত্রিকায় লিখব, কাজ করব, সাংবাদিকতা করব—এ রকম ভাবনা কাজ করত তখন। আর তাই নতুন পত্রিকার কথা শুনলেই আমার মধ্যে দারুণ উত্তেজনা কাজ করত। গভীর মনোযোগের সঙ্গে খেয়াল করতাম, তারা কীভাবে পাতা সাজাচ্ছে, কোন ধরনের ফিচার পাতা রাখছে, সাহিত্যের জন্য বরাদ্দ কতখানি পৃষ্ঠা!
হ্যাঁ, শেষমেশ সাহিত্যের পাতার দিকেই ঝোঁকটা চলে যেত। সে সময় ছোটকাগজ ও বড়কাগজের দ্বন্দ্ব নিয়ে বেশ শোরগোল হতো। কারও কারও পণ ছিল, বড়কাগজের পাতায় তাঁরা কোনো দিনই লিখবেন না। কারণ, ছোটকাগজ হলো প্রতিষ্ঠানবিরোধী। অন্যদিকে বড়কাগজ নিজেই প্রতিষ্ঠান। আমরাও এই তর্কের সমুদ্দুরে ডুব দিয়েছিলাম। কিন্তু বড়কাগজের সাহিত্যপাতাকে কখনো ছেড়ে যাইনি। আর তাই প্রথম আলো যখন বের হলো, তখন উৎসাহ নিয়ে অপেক্ষা করছিলাম আর ভাবছিলাম, এরা কোন ধরনের সাহিত্যিক ও সাংস্কৃতিক তৎপরতাকে উৎসাহিত করে!
স্মৃতি যদি প্রতারণা না করে, তাহলে মনে পড়ে, প্রথম আলোর প্রথম সাহিত্যপাতা ‘শুক্রবারের সাময়িকী’তে হাসান আজিজুল হক ও হুমায়ূন আহমেদের গল্প ছাপা হয়েছিল। আর কার কার লেখা বেরিয়েছিল, মনে নেই। আমি একটি প্রতিক্রিয়াও লিখে পাঠিয়েছিলাম, যদিও সেটি ছাপা হয়নি। যেমন ছাপা হয়নি জনকণ্ঠতে পাঠানো কবিতাগুলো।
শুরু থেকেই প্রথম আলোর সাহিত্যপাতা আমার ভালো লাগত। কারা সম্পাদনা করতেন, কীভাবে সম্পাদিত হতো—এসব বিষয়ে আমার কোনো জানাশোনা ছিল না। শুধু জানতাম, ফিচার পাতাগুলো সম্পাদনার দায়িত্বে থাকেন আলাদা আলাদা ব্যক্তি।
প্রথম আলোর সঙ্গে সম্পর্কিত কারও কারও নাম শুনতাম। ব্যক্তিগত চেনাজানা কারও সঙ্গেই ছিল না। প্রথম আলো বিভিন্ন কবি-লেখকের সাক্ষাৎকার ছেপেছে। এখন অবশ্য সাক্ষাৎকার ছাপার চলটাই প্রায় উঠে গেছে। কিন্তু নব্বইয়ের দশকে সাক্ষাৎকার দখল করে ছিল সাহিত্যপাতার প্রথম পৃষ্ঠা। তর্কবিতর্ক প্রায় লেগেই থাকত।
প্রথম আলো বেশ কিছু আড্ডার আয়োজন করেছিল তখন। তরুণ লেখকেরা যুক্ত হয়েছিলেন সেসব আড্ডায়। ধারাবাহিকভাবে ছাপা হয়েছিল সৈয়দ শামসুল হকের অনুবাদ কবিতা বিম্বিত কবিতাগুলো। অনেক অনেক গুরুত্বপূর্ণ কবির বাংলা অনুবাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ ঘটেছিল আমাদের। প্রথম আলো সাহিত্যপাতার আরেকটি চমক ছিল নির্বাচিত বইয়ের আলোচনা প্রকাশ। বইমেলায় প্রকাশিত সৃষ্টিশীল ও মননশীল ২০টি বইয়ের সমালোচনা প্রকাশিত হতো, যা নিয়ে পত্রিকার বাইরে বয়ে যেত অন্তহীন তর্ক। প্রথম আলোর নির্বাচন সব সময় যে ভালো লাগত, তা নয়। অনেক নির্বাচিত বই হয়তো পড়ে ভালো লাগেনি। তারপরও কাজটির প্রশংসা করব। কারণ, এতে নতুন কবি–লেখকদের চিনতে পেরেছি। এ কালে বিখ্যাত অনেক লেখককে আমি চিনেছি প্রথম আলোর সাহিত্যপাতা পড়ে; তাঁরা তখন অতিশয় তরুণ। যেমন এখন চিনতে পারছি অনেক নবীন লেখককে। সম্ভবত বছর দুয়েক আগে একজন লেখকের গল্প পড়লাম—চট্টগ্রাম ও পর্তুগিজ প্রেক্ষাপটকে আশ্রয় করে লেখা। খুব ভালো লাগল।
প্রথম আলোর সাহিত্যপাতা সম্প্রতি তিনটি দিকে ঝুঁকেছে। প্রথমত, জনপ্রিয় সংস্কৃতির প্রতি মনোযোগী হয়েছে; নতুন গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ভাষা ও সাহিত্যবিষয়ক বিশ্লেষণ হাজির করেছে বিভিন্ন সংখ্যায়। জনপ্রিয় সাহিত্যের সুলুকসন্ধানে চোখ রেখেছে। ক্রিকেট ও ফুটবলের মতো খেলার সঙ্গে সাহিত্যের সম্পর্কের অনুসন্ধানে উদ্যোগী হয়েছে। দ্বিতীয়ত, লোকায়ত সংস্কৃতির হালহকিকত বুঝে দেখার তৎপরতা চালিয়েছে। নিম্নবর্গের মৌখিক সংস্কৃতির ধারাগুলো নতুনভাবে দেখার চেষ্টা করেছে। তৃতীয়ত, বাংলা ভাষা ও সাহিত্য নিয়ে অন্য ভাষায় প্রকাশিত রচনার সঙ্গেও পরিচিতি ঘটিয়েছে। বাংলাদেশে চর্চিত অন্য ভাষাগুলোর সাহিত্য নিয়ে আলাপ বা আয়োজনও চোখে পড়েছে। তবে বাংলাদেশের বহুভাষিক সাহিত্য পরিস্থিতিকে স্পষ্ট করার ক্ষেত্রে সাহিত্যপাতা আরও সক্রিয় ভূমিকা রাখতে পারে বলে মনে করি।
সাহিত্যপাতাগুলো বিশ্বসাহিত্যের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপনে সক্ষম। সংবাদ–এর ‘সাহিত্য সাময়িকী’ এক কালে এ কাজটি অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে সম্পন্ন করেছে। প্রথম আলোর পাতায় মাঝেমধ্যে হাজির হন ভিনভাষী সাহিত্যিকেরা। যেমন এই কিছু দিন আগে পেলাম সালমান রুশদি–বিষয়ক লেখা। এ ধরনের লেখার পরিমাণ আরও বাড়ানো যেতে পারে।
বাংলাদেশের অধিকাংশ পত্রিকার সাহিত্যপাতা ‘অতীত হয়ে যাওয়া’ সাহিত্য নিয়ে খুব বেশি ঘাঁটাঘাঁটি করে না। ধরা যাক, মধুসূদন কিংবা বঙ্কিমচন্দ্র প্রসঙ্গে কোনো আলোচনা চোখে পড়ে না। ব্যাপারটি কি এ রকম যে তাঁরা অপ্রাসঙ্গিক হয়ে গেছেন? নিশ্চয়ই তা নয়। পাঠক এসব পড়তে চান না? না, তা–ও নয়। নতুন মূল্যায়নের আলো ফেলতে পারলে পাঠক নিশ্চিতভাবেই সেসব লেখা পড়বেন। প্রত্যাশার কথা, প্রথম আলো সাহিত্যপাতা মাঝেমধ্যেই ধ্রুপদি সাহিত্যের সঙ্গে পরিচিতি ঘটিয়ে থাকে। তবু বলব, প্রাচীন সাহিত্যের সঙ্গে সম্পর্কের নতুন কোনো সূত্র তৈরি করতে সক্ষম হয়নি প্রথম আলোর সাহিত্যপাতা। ক্ল্যাসিকস বাদ দিয়ে কি সাহিত্যের ইতিহাস গড়ে ওঠে!
আরেকটি সীমাবদ্ধতার কথা না বললেই নয়, সেটি হলো দার্শনিক ও ক্রিটিক্যাল চিন্তার সমাবেশ এই পাতায় দৃষ্টিগ্রাহ্যভাবে কম। অথচ সারা বিশ্বে তত্ত্বচিন্তার দাপুটে অবস্থান পরিলক্ষিত হয়। নামডাকওয়ালা সাহিত্য সাময়িকীগুলো সেসব চিন্তার সঙ্গে পাঠককে পরিচিত করে থাকে।
দুঃখজনক দিক হলো, প্রথম আলোর সাহিত্যপাতার পৃষ্ঠার সংখ্যা কমে এসেছে। ছোট হয়ে এসেছে কবিতার আকৃতি ও গল্পের পরিসর। বই আলোচনাগুলো ছোট হতে হতে সাধারণ পুস্তক পরিচিতিতে পরিণত হয়েছে। অথচ একটি বইকে যথার্থভাবে বিশ্লেষণের জন্য পরিসর বাড়ানো ছাড়া বিকল্প নেই।
প্রথম আলোর সাহিত্যপাতা নিজস্ব প্রকাশনা সংস্থার বইগুলোর পরিচিতি বা সমালোচনা বিশেষভাবে তুলে ধরে। এই একপেশেপনা থেকে বের হওয়া দরকার। কেননা অন্য অনেক প্রকাশনা থেকে প্রভাবশালী চিন্তার বইও প্রকাশিত হয়, সেগুলোও আলোচনার দাবি রাখে। সাহিত্যিক ইতিহাসের বস্তুনিষ্ঠতার লক্ষ্যেই অন্য সবার জন্য দরকারি স্থান উন্মুক্ত করা জরুরি।
সবচেয়ে বড় কথা, প্রথম আলোর সাহিত্যপাতা বাংলাদেশি সাহিত্যের আত্মপরিচয়ের একটি নিশানা তৈরি করতে চায়। নানা মত ও পথ, চিন্তা ও মতাদর্শের সংঘাত এড়িয়ে এ কাজটি সম্পন্ন করা অত্যন্ত জটিল। তা ছাড়া পত্রিকার ভেতরমহলেও নিশ্চয়ই থেকে যায় নিজস্ব সম্পাদনা-নীতি; সেসবের উত্তাপ এড়িয়ে যাওয়াও কঠিন।
২৫ বছরের প্রেক্ষাপটে প্রথম আলো নিশ্চয়ই বাংলাদেশি সাহিত্যের পরিচয় নির্মাণে আরও দায়িত্বশীল ও নিষ্ঠাবান হয়ে উঠবে। মনে রাখতে হবে, বাংলাদেশেরই বিভিন্ন প্রান্তে বসে আছেন কতশত নিবিষ্ট পাঠক, যাঁরা আতশ কাচ হাতে অপেক্ষা করছেন; তাঁরা কিন্তু ঠিকঠাক মেপে দেখবেন ঐতিহাসিক দায়দায়িত্বের হিসাব। কারণ, তাঁরা কেবল খবর নয়, নিবিড়ভাবে সাহিত্যপাতাও পড়েন। সমকালীন সাহিত্যের সঙ্গে পাঠকের প্রাথমিক সেতুবন্ধের কাজে সাহিত্যপাতার ভূমিকাকে তো আর অস্বীকার করার উপায় নেই।