রাবেয়া খালাম্মার সঙ্গে সুখস্মৃতি

রাবেয়া খাতুন (২৭ ডিসেম্বর ১৯৩৫—৩ জানুয়ারি ২০২১)
প্রতিকৃতি: মাসুক হেলাল

কথাসাহিত্যিক রাবেয়া খাতুনের জন্মদিনের অনুষ্ঠানে আমার উপস্থিতি এবং তাঁকে গান শোনানো ছিল আমার জন্য অনিবার্য। এখন তাঁর জন্মদিন উপলক্ষে লিখতে বসে ভাবছি, কোথা থেকে শুরু করব। সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে ১৯৭৩-৭৪ সালে যখন তাঁকে প্রথম দেখি, আমি তখন কলেজে পড়ি। রাবেয়া খাতুন সে সময় প্রতিষ্ঠিত লেখক। প্রথম বাংলা একাডেমি পুরস্কার পাওয়া ঔপন্যাসিক।

লেখিকা সংঘের সদস্য হিসেবে তাঁকে প্রথম দেখি। লেখিকা সংঘ তখন খুবই সক্রিয়। তখনকার কালে বেগম পত্রিকায় যেসব নারীর লেখা পড়তাম, সবাই–ই ছিলেন লেখিকা সংঘের সদস্য। রাজিয়া মাহবুব, শামস রশীদ, রিজিয়া রহমান, রাবেয়া খাতুনের লেখার সঙ্গে স্কুলজীবনে বেগম পত্রিকার মাধ্যমেই পরিচয়। চাক্ষুষ দেখলাম ’৭৩/৭৪ সালে কলকাতা থেকে আসা সাহিত্যিক দলের জন্য আয়োজিত সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে। সে দলে বিনয় সরকার নামের সাহিত্যিকের সঙ্গে আমাদের পারিবারিক সম্পর্ক ছিল। তাঁর সঙ্গেই সে সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে গিয়েছিলাম। রাবেয়া খাতুনের তখন বয়স কম। সুন্দরী, ছিমছাম নিজের একক স্বতন্ত্র ব্যক্তিত্ব প্রথমেই নজরে আসে। কথা কম বলেন। সবার মধ্যেও তাঁকে আলাদা করা যেত তাঁর এই ব্যক্তিত্বের জন্যই। তাঁকে অবশ্য প্রথম দর্শনেই অহংকারী মনে হয়েছিল আমার। যে কারণে খুব একটা ঘনিষ্ঠতা বা পরিচয়ের সুযোগ হয়নি। ওই দেখাটুকুই স্মৃতি হয়ে আছে।

১৯৯৬ সালে আমার গুরু কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায় বাংলাদেশ সরকারের আমন্ত্রণে এসে আমার বাড়িতে ছিলেন। সেই সূত্রে অনেক জ্ঞানী–গুণী মানুষের পদধূলি পড়েছিল আমার বাড়িতে। বাদল আপা (সাঈদা খানম) ছিলেন আহাদ ভাইয়ের (আবদুল আহাদ) ছোট বোন। সেই সূত্রে মোহরদির খুব ঘনিষ্ঠ। আবার লেখিকা সংঘের সক্রিয় কর্মী।

রাবেয়া খাতুনেরও খুব ঘনিষ্ঠ। বাদল আপা আয়োজন করেছিলেন লেখিকা সংঘের পক্ষ থেকে মোহরদিকে সংবর্ধনা দেওয়ার। মোহরদির শারীরিক অসুস্থতার জন্য তিনি যাবেন না। তাই লেখিকারা আমার বাসায়ই সংবর্ধনার আয়োজন করবেন। সেই উপলক্ষে রাবেয়া খালাম্মা আমার বাড়িতে এসেছিলেন। সেই অনুষ্ঠানে অনেকেই নিজের লেখা কবিতা পড়লেন, বক্তৃতা দিলেন। কিন্তু খালাম্মা কিছুই করলেন না। হাসিমুখে চুপচাপ বসে রইলেন। মোহরদির পাশে বসে নিচু গলায় নরম সুরে গল্প করলেন। ছবি তুললেন। মোহরদিকে নরম গলায় বললেন, তিনি তাঁর গানের ভক্ত। আগ বাড়িয়ে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করা তাঁর ব্যক্তিত্বে ছিল না। কিন্তু তাঁর গভীর ব্যক্তিত্বের একটা অন্য রকম আকর্ষণ ছিল। এত লেখকের মধ্যেও তিনি আলাদাভাবে মোহরদির দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন। তারপর বহুদিন আর যোগাযোগ নেই।

ইতিমধ্যে চ্যানেল আইয়ের কারণে সাগর ভাইয়ের (ফরিদুর রেজা সাগর) সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বেড়েছে। ২০০০ সালে একদিন সাগর ভাই জানালেন, ‘কানাডায় টরন্টো ইউনিভার্সিটিতে বাংলা বিভাগ খোলা হবে। সে উপলক্ষে আপনি আর আম্মা আমন্ত্রিত। আপনারা দুজনে একসঙ্গে যাবেন।’ সাগর ভাই যাওয়ার সব ব্যবস্থা করে দিলেন ব্রিটিশ এয়ারওয়েজে। যেদিন যাত্রা, সেদিন এয়ারপোর্টে গিয়ে দেখি, সাগর ভাই, কনাসহ সপরিবার মাকে তুলতে এসেছেন। চেকইনের পর ঢাকা–লন্ডন বোর্ডিং পাস আমার হাতে দিয়ে তিনি আমাকে বললেন, লন্ডন-টরন্টো আপনাদের দুজনের বোর্ডিং পাস আম্মার ব্যাগে দিয়েছি।’

খালাম্মার সঙ্গে সেই আমার প্রথম দূর যাত্রা। দুজন পাশপাশি বসেছি। খালাম্মা তাঁর স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে টুকটাক কথা বলছেন। ব্যাগ থেকে একটা ছোট ডায়েরি বের করে টুকটাক নানা তথ্য টুকে রাখছেন। পরেও দেখেছি, এটি তাঁর একটি অভ্যাস। যখন নতুন কিছু দেখেছেন, শুনেছেন, লেখার কাজে লাগবে মনে হলেই সেটি ডায়েরিতে লিখে রাখতেন। আমি পাশে বসে খালাম্মাকে দেখছি। দুই হাতভরা চুড়ি, পরিপাটি করে চুল খোপা বাঁধা, তাতে আবার প্রজাপতি বা ফুলজাতীয় ক্লিপ দিয়ে সাজানো। হাতের নখে সুন্দর করে নেইলপলিশ দেওয়া। নিজের সৌন্দর্যের প্রতি অত্যন্ত যত্নশীল।

সব সময়ই খালাম্মা খুব পরিপাটি থাকতে ভালোবাসতেন। সাজগোজ, পোশাক, অলংকার—সব বিষয়ে। পরে যখন আলাপ ঘনিষ্ঠতর হয়েছে, দেখেছি অসম্ভব শৌখিন মানুষ তিনি। অনেক জীবনসংগ্রামের পথ পার হয়েও জীবনের রং তাঁর কাছে কখনোই ফিকে হয়ে যায়নি।

লন্ডন পৌঁছানোর পর বেশ কয়েক ঘণ্টার যাত্রাবিরতিতে এয়ারপোর্ট থেকে বেরিয়ে আমার ছোট বোনের সঙ্গে দেখা করার কথা। ছোট বোন সময়মতো এয়ারপোর্টে আসবে এবং আমাকে কিছুক্ষণের জন্য নিয়ে যাবে। খালাম্মা এয়ারপোর্টেই অপেক্ষা করবেন। সেই অনুযায়ী লন্ডন পৌঁছানোর পর আমি ইমিগ্রেশন শেষে বাইরে বেরিয়ে গেছি। খালাম্মাকে বলে গেলাম, নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই আমি ঢুকে পড়ব। এরপর যখন আবার এয়ারপোর্টে ঢুকব, তখন মনে পড়ল সর্বনাশ, আমার কাছে লন্ডন–টরন্টো ফ্লাইটের বোর্ডিং পাসটি নেই! সেটা তো রয়ে গেছে খালাম্মার ব্যাগে। এখন কী করি!

প্রচণ্ড দুশ্চিন্তা নিয়ে এয়ারপোর্ট কাউন্টারে গিয়ে অবস্থা জানালাম। ওরা জিজ্ঞাসা করল, এত বড় এয়ারপোর্টে যার কাছে তোমার বোর্ডিং পাস, সেই নারীকে আমরা চিনব কী করে?

যা হোক, ব্রিটিশ এয়ারওয়েজের রিসিপশনের মেয়েটি কাউকে ভেতরে পাঠাল। মেয়েটি ভেতরে গিয়ে কিছুক্ষণের মধ্যে ফিরেও এল। ওকে নাকি ভেতরে ঢুকতেই হয়নি। খালাম্মা সিকিউরিটি গেটের সামনেই দাঁড়িয়ে ছিলেন। যখন তাঁর মনে পড়েছে, তাঁর ব্যাগে আমার বোর্ডিং পাস, তার পর থেকে তিনি আর কোথাও যাননি। সিকিউরিটি গেটের সামনে অপেক্ষা করেছেন। সেই প্রথম যাত্রায়ই খালাম্মার স্নেহ আর দায়িত্ববোধ তাঁর প্রতি আমাকে গভীরভাবে আকৃষ্ট করেছে।

দীর্ঘ যাত্রাপথের শেষে টরন্টোয় পৌঁছে দেখি, এয়ারপোর্টে আমার বন্ধু রুমানাসহ আরও অনেকেই এসেছেন আমাদের নিতে। রুমানার বাড়িতেই আমাদের দুজনের থাকার কথা। মালপত্র সংগ্রহ করতে গিয়ে দেখি আরেক বিপদ। খালাম্মা আর আমার দুজনের কারোরই স্যুটকেস আসেনি। পরদিনই আমাদের অনুষ্ঠান। মন একটু খারাপ হলো। কিন্তু কী আর করা!

রুমানার বাড়িতে এলাম। এর মধ্যে রুমানা নানা রকম খোঁজখবর নিতে শুরু করল আমাদের স্যুটকেসের ব্যাপারে। খবর পাওয়া গেল। স্যুটকেস লন্ডন থেকে বিমানেই ওঠেনি। পরের ফ্লাইটে তারা পাঠিয়ে দেবে। তারপর ব্রিটিশ এয়ারওয়েজের লোকেরাই বাড়িতে পৌঁছে দেবে। কিন্তু আমাদের তো পরের দিনই অনুষ্ঠান। রুমানার বাড়িতে একই ঘরে আমাদের শোবার ব্যবস্থা। সারা রাত আমাদের দুজনেরই চোখে ঘুম নেই। অনুষ্ঠানে কী পরব, কী করে কী হবে—এসব চিন্তায়। স্থানীয় লোকজনরা যদিও আশ্বস্ত করেছেন, তাঁরা কাপড়চোপড়ের ব্যবস্থা করবেন, দুশ্চিন্তা তাতেও কাটছিল না।

খালাম্মা পরিপাটি মানুষ। অন্যের বাড়ির কাপড়চোপড় পরা তাঁর জন্য মোটেও স্বস্তিদায়ক ছিল না। নিজের পছন্দ–অপছন্দের ব্যাপারে তিনি বরাবরই খুব সচেতন। সম্ভবত সেই সাময়িক বিপদ আমাদের ঘনিষ্ঠতর করেছিল।

খালাম্মার সঙ্গে নানা জায়গায় বেড়ানোর অভিজ্ঞতা খুবই আকর্ষণীয়। কিন্তু কানাডার প্রথম সফরের অভিজ্ঞতা আজও মনে সুখস্মৃতি হিসেবে জাগরুক।

করোনার আগের জন্মদিনে গিয়ে খালাম্মাকে শুভেচ্ছা জানিয়ে বললাম, ‘খালাম্মা, এবারে ছেলে কী দিল?’

কিশোরীর মতো লাজুক হাসিতে ধীরে ধীরে স্বভাবসুলভ মৃদুকণ্ঠে বললেন আর দেখালেন হাতে, কানে, গলায় পরা অলংকার। সেই দেখানোর মধ্যে, হাসির মধ্যে এক অনির্বচনীয় অনুভূতি খেলা করছিল। সেবারই  তাঁর শেষ জন্মদিন পালিত হলো। তারপরের জন্মদিনে করোনার থাবায় সব পর্যুদস্ত। গেলাম বাড়িতে, কিন্তু নিচ থেকেই খালাম্মাকে শুভেচ্ছা জানিয়ে চলে আসতে হলো। তখন তো ভাবিনি, কখনো আর দেখা হবে না।