‘গেরিলা’ চলচ্চিত্রে জয়া আহসান ও শতাব্দী ওয়াদুদ
ছবি: সংগৃহীত

‘খল’ হলো বিশেষণ। এটি সংস্কৃত ‘খল্+অ’ থেকে উদ্ভূত। বাংলা চলচ্চিত্রের ভিলেন বা খলনায়কের প্রধান কাজই হলো নায়ক-নায়িকা কিংবা তাদের পরিবার ও পরিচিতজনদের ক্ষতি করা। অর্থাৎ খারাপ কিংবা অহিতকর কর্মকাণ্ড করাই খল চরিত্রের প্রধান বৈশিষ্ট্য।

১৯৩১ সালের শেষার্ধে বাংলাদেশে নির্মিত নির্বাক চলচ্চিত্র ‘দ্য লাস্ট কিস’ বা ‘শেষ চুম্বন’-এর মধ্যেও খল চরিত্রের উপস্থিতি ছিল। ‘শেষ চুম্বন’ চলচ্চিত্রের প্রধান তিন খল চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন খাজা আকমল, টোনাবাবু ও খাজা নসরুল্লাহ। এর মধ্যে খাজা নসরুল্লাহ অত্যাচারী জমিদার এবং টোনাবাবু ও খাজা আকমল ডাকাত চরিত্রের রূপায়ণ করেন। এমনকি এ দেশের প্রথম সবাক চলচ্চিত্র আবদুল রাজ্জাক খাঁ পরিচালিত ‘মুখ ও মুখোশ’ (১৯৫৬)-এও খল চরিত্রের প্রবল উপস্থিতি আছে। ‘মুখ ও মুখোশ’–এর প্রধান খল চরিত্র সমসের ডাকাতের রূপায়ণ করেছিলেন ইনাম আহমেদ।

এরই ধারাবাহিকতায় বিএফডিসি থেকে নির্মিত প্রায় সব চলচ্চিত্রেই খলনায়ক তথা খলচরিত্রের উপস্থিতি যেন অনিবার্যভাবেই ঘটে চলেছে। কোনো কোনো চলচ্চিত্রের প্রথমার্ধে নায়ক বা নায়িকাকেও খলচরিত্রের বৈশিষ্ট্য ধারণ করতে দেখা যায়। ষাটের দশক থেকে নব্বইয়ের দশকের অনেক চলচ্চিত্রেই নায়ক কিংবা নায়িকাকে অহংকারী, দাম্ভিক বৈশিষ্ট্যের অধিকারী হিসেবে প্রথমার্ধে চিত্রায়িত করার দৃষ্টান্ত পরিলক্ষিত হয়। উপরন্তু, নায়ক-নায়িকা চরিত্রে ‘খলতা’র বৈশিষ্ট্য অহংকার, দাম্ভিকতার রূপ প্রতিফলিত হলেও একপর্যায়ে তাই প্রেমে পরিণত হয়। ফলে উক্ত চরিত্রসমূহ নায়ক বা নায়িকা হয়ে ওঠে। কিন্তু, খলরূপে রূপায়িত চরিত্ররা কোনো কোনো সময় চলচ্চিত্রের প্রথমার্ধে ভালোমানুষির চেহারা লালন করে। অতঃপর সময়-সুযোগ অনুযায়ী নিজেদের খলতার রূপ উন্মোচন করেÑ এমন চলচ্চিত্র এদেশে নেহায়েত কম নির্মিত হয়নি।

‘ভিলেন’-এর বাংলা প্রতিশব্দ রূপে ‘খল চরিত্র’, ‘দুষ্ট চরিত্র’, ‘মন্দ বা খারাপ চরিত্র’, ‘খলনায়ক’ প্রভৃতি ব্যবহৃত হয়। প্রাচীন লাতিন শব্দ ‘ভিলেনাস (Villanus)’ থেকে এর উৎপত্তি। ‘খলনায়ক’ বা ‘ভিলেন’ ধারণার গভীর অর্থ মানবজীবন পরিক্রমায়ও নিহিত। কারণ, জীবনধারণের প্রক্রিয়ায় মানুষ অনুকূল সংস্পর্শে যেমন আসে, তেমনি প্রতিকূল সংস্পর্শেও আসে। বাস্তব জীবনে একজন মানুষের প্রতিকূল হিসেবে চিহ্নিত মানুষ ‘শত্রু’রূপে পরিচিত। শিল্প তথা চলচ্চিত্রের বাস্তবতায় ‘শত্রু’রূপে গণ্য মানুষের বৈশিষ্ট্য ধারণকারী চরিত্র হলো ‘ভিলেন’ বা ‘খল চরিত্র’।

এ দেশের প্রথম সবাক চলচ্চিত্র আবদুল রাজ্জাক খাঁ পরিচালিত ‘মুখ ও মুখোশ’ ছবিতে খল চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন ইনাম আহমেদ
ছবি: সংগৃহীত

শিল্প তথা চলচ্চিত্রে ভিলেন চরিত্রের অবস্থান বহুধা বৈচিত্র্যে প্রবাহিত। ‘খল’ বা ‘খলতা’ কোনো একটি চরিত্রের আপেক্ষিক বৈশিষ্ট্যমাত্র। চরিত্রে এই বৈশিষ্ট্যের প্রয়োগসম্পর্কিত যেমন সীমা নির্ধারিত নয়, তেমনি এর অপরিহার্যতাও নেই। চলচ্চিত্রেও যে ‘খল’ বা ‘খলতা’র বৈশিষ্ট্যসমেত চরিত্রের সংযোজন অপরিহার্য তা নয়, বরং একটি চলচ্চিত্রের কাহিনির প্রয়োজনেই ‘খল’ হিসেবে কখনো চরিত্র, কখনো কোনো একটি ঘটনা বা পারিপার্শ্বিকতাকে গ্রহণ করা হয়। আবার চলচ্চিত্রের শ্রেণি বা বিষয়ের আলোকে খলতার নানা রূপ প্রতিফলিত হয়। চলচ্চিত্রে খল চরিত্রের দৃশ্যমান বৈশিষ্ট্যসমূহ হলো:

ক. নায়ক-নায়িকার পরিবার ও পরিচিত ব্যক্তিদের ক্ষতি সাধন করা। যেমন আবদুল্লাহ আল-মামুন পরিচালিত ‘সারেং বৌ’ (১৯৭৮) চলচ্চিত্রের লন্দু মোড়লের (আরিফুল হক) কার্যক্রম স্মরণযোগ্য। এই চলচ্চিত্রে লক্ষ করা যায়, নবীতনকে (কবরী) পাওয়ার জন্য লন্দু মোড়ল পোস্ট মাস্টারের সঙ্গে যোগসাজশ করে তার স্বামী কদম সারেংয়ের পাঠানো চিঠি ও টাকা আত্মসাৎ করে। অধিকন্তু নবীতনকে পাওয়ার জন্য লন্দু মোড়ল সব ধরনের খলতার আশ্রয় গ্রহণ করেও বারবার পরাজিত হয়। কিংবা জহির রায়হান পরিচালিত ‘জীবন থেকে নেয়া’ (১৯৭০) চলচ্চিত্রের রওশন জামিলের কার্যক্রমকেও খল চরিত্রের কর্ম হিসেবে বিবেচনা করা যায়।

খ. নায়কের সঙ্গে লড়াই বা অন্য কোনো ধরনের প্রতিযোগিতায় মুখোমুখি হয়ে দুই-তিনবার জয়ী হয় ভিলেন। কখনো বা সব সময়ই নায়কের বিরুদ্ধে পরাজিত হয়। তবে চূড়ান্ত প্রতিযোগিতায় শোচনীয় পরাজয়ই খল চরিত্রের প্রাপ্য। এ ক্ষেত্রে আমজাদ হোসেন পরিচালিত ‘নয়ন মনি’ (১৯৭৬) চলচ্চিত্রে মোড়লের (এ টি এম শামসুজ্জামান) কর্মকাণ্ড উল্লেখ করা যায়। চলচ্চিত্রে দেখা যায়, মনিকে (ববিতা) বিয়ে করার জন্য নয়নের (ফারুক) প্রতিদ্বন্দ্বীরূপে আবির্ভূত হয় মোড়ল। কিন্তু চলচ্চিত্রের শেষার্ধে মায়ের হত্যার প্রতিশোধ নিতে নয়ন গ্রামবাসীকে নিয়ে মোড়লকে প্রতিহত করে এবং পরাজিত হয় মোড়ল।

বাংলাদেশের অধিকাংশ বাণিজ্যিক ধারার চলচ্চিত্রে কাহিনির প্রয়োজনে খল চরিত্রের সংযোগ ঘটে। এমনকি খল চরিত্রই কাহিনিকে বিভিন্ন গতি-পরিক্রমায় চালনা করতে বিশেষ ভূমিকা পালন করে। বিশেষত, নায়ক-নায়িকা কিংবা মানুষের সামনে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি এবং বিভিন্ন রকম হিংসাত্মক ও বীভৎস কর্ম পরিচালনার মাধ্যমে কাহিনিকে চলচ্চৈত্রিক উত্তেজনায় ধাবিত করে খল চরিত্ররা।

তবে কখনো কখনো এর ব্যতিক্রমও ঘটে। যেমন ‘পঞ্চাশের আকাল’কে আশ্রয় করে আবু ইসহাক লিখিত উপন্যাস ‘সূর্য দীঘল বাড়ি’র (১৯৭৯; পরিচালক: শেখ নিয়ামত আলী ও মসিহউদ্দিন শাকের) চলচ্চিত্ররূপে প্রথাগত নায়ক-নায়িকা ধারণার বিকাশ না ঘটলেও খল চরিত্রের পরাজয় চিত্রিত নয়। বরং খল চরিত্র হিসেবে গদু প্রধানের (জহিরুল হক) মনোবাঞ্ছা পূরণ না হলেও তারই চক্রান্তে ঘরবাড়ি হারিয়ে পুনরায় শহরমুখী হয় জয়গুন (ডলি আনোয়ার)। গদু প্রধান বহাল তবিয়তেই থেকে যায়। বলা যায়, সাহিত্যভিত্তিক চলচ্চিত্রগুলো প্রথাগত ধারার চলচ্চিত্র থেকে স্বকীয় বৈশিষ্ট্যে সমুজ্জ্বল। ফলে এসব চলচ্চিত্রে ইতিহাসের নির্মম ঘটনা, প্রতারণা কিংবা পারিপার্শ্বিক অবস্থায়ই খলরূপে আবির্ভূত হয়। একইভাবে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাসের চলচ্চিত্ররূপ ‘পদ্মা নদীর মাঝিতে’ও (১৯৯৩; পরিচালক: গৌতম ঘোষ) আপাত খলতার জয়ই আছে। আবার ইতিহাস–আশ্রিত খান আতাউর রহমান পরিচালিত ‘নবাব সিরাজউদৌল্লা’ (১৯৬৭) চলচ্চিত্রেও খল চরিত্রগুলোর জয়ের বার্তাই প্রতিফলিত হয়। কেননা, ইতিহাসে আছে ইংরেজদের বিরুদ্ধে পলাশীর প্রান্তরের যুদ্ধে পরাজিত হয়েছিলেন বাংলার শেষ নবাব সিরাজউদৌল্লা। চলচ্চিত্রও ইতিহাসের এই বাস্তবতাকেই বিশ্বাসযোগ্যভাবে তুলে ধরে।

গ. কোনো কোনো চলচ্চিত্রে নায়ক-নায়িকা যখন অন্যান্য চরিত্রের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠে, তখন খল চরিত্র নায়ক-নায়িকার ক্ষতিসাধনে লিপ্ত হয়। ‘নয়ন মনি’ চলচ্চিত্রের মোড়ল (এ টি এম শামসুজ্জামান) ও ‘আত্ম-অহংকার’ (১৯৯৫; পরিচালক: রায়হান মুজিব) চলচ্চিত্রে সম্পদ আলীর (হুমায়ুন ফরীদি) কার্যক্রম এর উদাহরণ।

‘বিশ্বপ্রেমিক’ সিনেমায় মৌসুমী ও হুমায়ুন ফরীদি
ছবি: সংগৃহীত

ঘ. প্রতিটি চলচ্চিত্রের প্রারম্ভ থেকে প্রবল প্রতাপের অধিকারী এবং যেকোনো প্রকার দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করাই খল চরিত্রের সক্রিয় উপস্থিতিকে চিহ্নিত করে। আনোয়ারার (১৯৬৭) ‘গোলাপজান’ (রানী সরকার) ও ‘জীবন থেকে নেয়া’ চলচ্চিত্রের ফাতেমা বেগমের (রওশন জামিল) কার্যক্রম এর আওতাভুক্ত। এ ছাড়া কাজী হায়াৎ পরিচালিত ‘দাঙ্গা’ (১৯৯২) চলচ্চিত্রের আবুল হোসেন এমপি (মিজু আহমেদ), চেয়ারম্যান, কালু গুন্ডা (রাজীব) প্রমুখ চরিত্রের কার্যক্রম অনুরূপ। আবার, ‘শ্রাবণ মেঘের দিন’ (১৯৯৯; পরিচালক: হুমায়ূন আহমেদ)-এর জমিদার ইরতাজউদ্দিনের (গোলাম মুস্তাফা) কার্যক্রমও তদ্রূপ।

ঙ. নারীর প্রতি সহিংস আচরণ, বলপ্রয়োগে নারীকে পাওয়ার চেষ্টা কোনো কোনো খল চরিত্রের বিশেষ প্রবণতা হিসেবে চিহ্নিত। ‘সারেং বৌ’ চলচ্চিত্রের লন্দু মোড়ল, ‘সূর্য দীঘল বাড়ি’র গদু প্রধান (জহিরুল হক), ‘নয়ন মনি’র মোড়ল প্রমুখ চরিত্রের কার্যাবলি স্মরণীয়। সেই সঙ্গে মানুষ হত্যা, চাঁদাবাজি, ছিনতাই, বোমাবাজি প্রভৃতি কর্মও খল চরিত্রের উপস্থিতিকে দৃশ্যমান করে। প্রসঙ্গত, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্রগুলোর খল চরিত্রের ভূমিকাও উল্লেখযোগ্য। বলা বাহুল্য, মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্রে ইতিহাসের আলোকে চলচ্চৈত্রিক এক বাস্তবতা নির্মাণের প্রয়াস থাকে। ফলে এই ধারার চলচ্চিত্রে পাকিস্তানপন্থীদের প্রায় সব কাজই খলতার স্বরূপ হিসেবে প্রকাশিত হয়। এই ধারার চলচ্চিত্রের মধ্যে চাষী নজরুল ইসলামের ‘ওরা ১১ জন’ (১৯৭২), হুমায়ূন আহমেদের ‘আগুনের পরশমণি’ (১৯৯৪), নাসির উদ্দিন ইউসুফের ‘গেরিলা’ (২০১১) উল্লেখযোগ্য।

চ. মাদক ব্যবসা, অস্ত্র চোরাচালান প্রভৃতিও খল চরিত্রের মধ্যে প্রায়ই প্রতিফলিত হতে দেখা যায়।  এমনকি মাদক কিংবা অবৈধ অস্ত্র আটককারীকে হত্যা করতেও দ্বিধা বোধ করে না তারা। উদাহরণস্বরূপ ‘সারেং বৌ’-এর মন্টু (গোলাম মোস্তফা) এবং আবিদ হাসান বাদল পরিচালিত ‘হাবিলদার’ (১৯৯৫) চলচ্চিত্রে স্মাগলার প্রধান (আহমেদ শরীফ) ও তার বাহিনীর কার্যক্রম উল্লেখযোগ্য।

ছ. ধর্মান্ধ শ্রেণির খল চরিত্রের উপস্থিতিও নানাভাবে চলচ্চিত্রে প্রতিফলিত। উদাহরণরূপে তানভীর মোকাম্মেল পরিচালিত ‘লালসালু’ (২০০১) চলচ্চিত্রের মজিদ চরিত্র স্মরণীয়।

উল্লিখিত বৈশিষ্ট্যের বাইরেও খল চরিত্রের বহুমাত্রিক প্রকাশ এ দেশীয় চলচ্চিত্রে দেখা যায়। তবে ব্যতিক্রমও আছে। বিশেষত কাজী হায়াতের ‘আম্মাজান’ (১৯৯৯) চলচ্চিত্রের প্রধান চরিত্র হয়েও মাতৃলাঞ্ছনা, নারীলাঞ্ছনার প্রতিশোধ নিতে বাদশা (মান্না) মানুষ হত্যা করে। আবার নায়িকা চরিত্র রীনাকে (মৌসুমী) জোরপূর্বক বিয়ে করতে চায়। অথচ রীনা ভালোবাসে মিজানকে (আমিন খান)। তাই বলা যায়, ‘আম্মাজান’-এ বাদশাই খলনায়কের ভূমিকা পালন করে। সেই সঙ্গে চলচ্চিত্রের অন্তে মৃত্যুবরণ করে বাদশা। বলা ভালো, নব্বইয়ের দশকের শেষার্ধ থেকে এ দেশীয় চলচ্চিত্রে সহিংস নায়ক চরিত্রের উত্থান অধিক পরিলক্ষিত হতে শুরু করে। এ ক্ষেত্রে মাতৃ–পিতৃহত্যা কিংবা অন্য কোনো বিষয়ের প্রতিশোধ গ্রহণে নায়ক দৃঢ়প্রতিজ্ঞ থাকলেও তার কার্যক্রম কখনো কখনো প্রতিনায়ক তথা খল চরিত্রকে হার মানায়। তদুপরি খল চরিত্রগুলো থেকে নায়ক-নায়িকা চরিত্রগুলো একসময় সহিংসতাকে পরিহার করতে সক্ষম হয়। কিন্তু মৃত্যু, অনুশোচনা, পরাজয়, জেল কিংবা পুলিশের হাতে গ্রেপ্তারের আগপর্যন্ত খল চরিত্রের খলপনার সমাপ্তি ঘটে না। এখানেই মূলত বর্তমান সময়ের সহিংস নায়ক-নায়িকা চরিত্রের সঙ্গে খল চরিত্রের পার্থক্য। অধুনা মুক্তিপ্রাপ্ত বুলবুল বিশ্বাসের ‘রাজনীতি’ (২০১৭) চলচ্চিত্রেও এরূপ কাহিনির দৃশ্যায়ন পরিদৃষ্ট।

‘পদ্মা নদীর মাঝি’ ছবিতে আসাদ ও উৎপল দত্ত
ছবি: সংগৃহীত

সাধারণত চলচ্চিত্রে কয়েক শ্রেণির খল চরিত্রের উপস্থিতি পাওয়া যায়। তার মধ্যে সামাজিক, ঐতিহাসিক, কল্পকাহিনিভিত্তিক চলচ্চিত্রে বিশ্বাসঘাতক, প্রভুত্ববাদী, প্রতিশোধপরায়ণ, অহংকারী, শঠ, ভণ্ড, প্রতারক, নেতা, গোঁড়াপন্থী, লম্পট, মক্ষীরানি, ক্ষমতাবাদী, উন্মাদ, স্মাগলার, খুনি, লোভী শ্রেণির খল চরিত্রের উপস্থিতিই প্রধানত পর্দায় প্রতিফলিত হয়। অধিকন্তু, ‘ফ্যান্টাসিধর্মী’ বা রূপকথামূলক চলচ্চিত্রে ‘না-মানুষ’ চরিত্র তথা দৈত্য-দানব, রাক্ষস, ডাকিনী, জিন, ভূত, শয়তান প্রভৃতির উপস্থিতিও লক্ষণীয়। আবার স্থান-কাল-পাত্র ভেদে ‘খল চরিত্র’গুলো খল না–ও হতে পারে। বাংলাদেশের কোনো কোনো চলচ্চিত্রে খল চরিত্রের গুণাবলি ধারণ করেও নায়ক চরিত্র ‘খল’ হিসেবে বিবেচ্য হয় না। কারণ ‘খল চরিত্র’ সম্পর্কে যে স্বাভাবিক চিন্তাভাবনা সমাজে ক্রিয়াশীল, তা–ই বিবেচ্য। কেননা, কখনো একজন খুনিও নিজ পরিবারের কাছে খুনি হিসেবে বিচার্য হয়ে ওঠে না। সাহিত্যের ক্ষেত্রেও দেখা যায়, রামায়ণের প্রধান ‘খল চরিত্র’ রাবণ হলেও, মাইকেল মধুসূদন দত্তের ‘মেঘনাদবধ’-এ সেই রাবণই নায়ক হিসেবে আবির্ভূত। অর্থাৎ ‘খল’ ধারণা আপেক্ষিক। ব্যক্তি, সময়কাল, স্থান ভেদে ‘খল চরিত্র’গুলো ‘খল’রূপে বিবেচ্য না–ও হতে পারে। কখনো বা পারিপার্শ্বিক অবস্থায়ই খল হিসেবে চিহ্নিত হয়।

বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে প্রধান খল চরিত্র রূপায়ণে ইনাম আহমেদ, গোলাম মুস্তাফা, রওশন জামিল, ফতেহ্ লোহানী, রানী সরকার, খলিল, আদিল, জসিম, জাম্বু, রাজ, নাসির খান, রাজীব, হুমায়ুন ফরীদি, দারাশিকো, মায়া হাজারিকা, কোবরা, শানু শিবা, নাগমা, কাবিলা, বাবর, মিজু আহমেদ, দুলারী, শবনম পারভীন, জাহানারা ভূঁইয়া, সিরাজ হায়দার, গাংগুয়া, এ টি এম শামসুজ্জামান, মিশা সওদাগর, অমিত হাসান, রিনা খান, ডন, টাইগার রবি, ইরেশ জাকের, সাদেক বাচ্চু, আহমেদ শরীফ, ডিপজল প্রমুখ অভিনেতা-অভিনেত্রী বিশেষ দক্ষতার পরিচয় রাখতে সক্ষম হয়েছেন। এসব অভিনয়শিল্পী বহুমাত্রিক খল চরিত্রের রূপায়ণে বুদ্ধিমত্তার ছাপ রাখতে সক্ষম হন। ফলে খল চরিত্র রূপায়ণের তাঁদের স্বকীয় বৈশিষ্ট্য যেমন নির্ণয় করা যায়, তেমনি তাঁদের অভিনয়শৈলীর স্বরূপ অনুধাবন করাও সম্ভব হয়ে ওঠে। আবার, খল চরিত্রের সঙ্গে একাত্ম হওয়ার কারণেই কোনো কোনো অভিনয়শিল্পীকে দর্শকেরাও ‘ভিলেন’ বলে অভিহিত করেন।

বলা বাহুল্য, বাংলাদেশের অধিকাংশ বাণিজ্যিক ধারার চলচ্চিত্রে কাহিনির প্রয়োজনে ‘খল চরিত্রে’র সংযোগ ঘটে। এমনকি খল চরিত্রই কাহিনিকে বিভিন্ন গতি-পরিক্রমায় চালিত করতে বিশেষ ভূমিকা পালন করে। বিশেষত, নায়ক-নায়িকা কিংবা মানুষের সামনে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি এবং বিভিন্ন রকম হিংসাত্মক ও বীভৎস কর্ম পরিচালনার মাধ্যমে কাহিনিকে চলচ্চৈত্রিক উত্তেজনায় ধাবিত করে খল চরিত্ররা। কিংবা, চলচ্চিত্র কাহিনিতে মানবসৃষ্ট যেকোনো প্রকার ধ্বংসাত্মক কর্ম এবং পরিবেশ সৃষ্টির মূল কান্ডারি হলো খল চরিত্র। খল চরিত্রগুলো চলচ্চিত্রের কাহিনির প্রথমার্ধ থেকেই ভয়ংকর, প্রবল প্রতিপত্তিশালী কিংবা ক্ষমতার আধার হয়ে থাকে। অধিকন্তু, প্রায় সব চলচ্চিত্রের অন্তেই খল চরিত্রের পরাজয় তথা পরাজিত মুখচ্ছবিই সুন্দর ভবিষ্যৎকে আহ্বান করে। অর্থাৎ খল চরিত্রগুলোর চূড়ান্ত পরাজয়ের মধ্য দিয়ে ‘প্রোটাগোনিস্ট’ তথা নায়ক-নায়িকারূপী চরিত্রের জীবন সুন্দরের দিকে ধাবিত হয়। কারণ, প্রতিটি চলচ্চিত্রেই ‘অসুন্দর’, ‘কুৎসিত’, ‘বীভৎস’, ‘শয়তান’, ‘খলতা’র পরাজয়ের মধ্য দিয়ে ভালোকে প্রতিষ্ঠা করার প্রয়াস নিহিত থাকে।