সুলতানার স্বপ্ন, সাহসিকাদের জীবন এবং এক অমীমাংসিত লেডিল্যান্ড

সম্প্রতি ইউনেসকো রোকেয়া সাখাওয়া হোসেনের উপন্যাস সুলতানা’স ড্রিমকে ‘বিশ্বস্মৃতি’ বা ‘ওয়ার্ল্ড মেমোরি’র তালিকায় স্থান দিয়েছে। শতবর্ষ আগে লেখা বইটি এখনো প্রাসঙ্গিক

সুলতানা’স ড্রিম অবলম্বনে মার্কিন চিত্রশিল্পী চিত্রা গণেশ ২০১৮ সালে লিনোকাটে ২৭টি অলংকরণ করেন। ডারহাম প্রেস থেকে প্রকাশিত সেই সংকলনের ছবিগুলোর মধ্য থেকে কয়েকটি

রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন বা বেগম রোকেয়া নিজের নাম লিখতেন মিসেস আর এস হোসেন। মতিচূর–এর প্রথম খণ্ডের প্রথম পৃষ্ঠায় তেমনটাই দেখি। আমি সহশিক্ষা বিদ্যালয়ে পড়েছি আর ছেলেমেয়েরা ছোটবেলায় এক শ্রেণিকক্ষে থাকলেও একটু বড় হতেই আলাদা হয়েছি। যদিও স্কুলে নারী সহপাঠীদের কাউকে কাউকে পড়ার চাপে অতিষ্ঠ হয়ে রোকেয়াকেই এই বলে ভর্ৎসনা করতে দেখেছি যে কী কুক্ষণে এই নারী মুসলমান মেয়েদের মধ্যে পড়ালেখা চালু করেছিলেন! এসবের মধ্যে থেকেও আবার এ প্রশ্নও উঠতে দেখেছি, রোকেয়া বিপ্লবী না সমাজ সংস্কারক? সাহিত্যিক না ধর্মদ্রোহী? আর বড় হতে হতে শুনেছি সুলতানা’স ড্রিমকে ‘ফেমিনিস্ট ইউটোপিয়া’ বলা যাবে কি না। অবশ্য এই বিতর্কও পুরোনো হতে চলেছে। তবে যা এই এক শ বছরের বেশি সময়েও পুরোনো হয়নি, তা হলো অবরোধবাসিনীদের প্রান্তিকতা।

রোকেয়া বলেছিলেন, ‘আমরা বহুকাল হইতে অবরোধে থাকিয়া থাকিয়া অভ্যস্ত হইয়া গিয়াছি; সুতরাং অবরোধের বিরুদ্ধে বলিবার আমাদের—বিশেষত আমার কিছুই নাই। মেছোনীকে যদি জিজ্ঞাসা করা যায় যে “পচা মাছের দুর্গন্ধ ভালো না মন্দ?” সে কী উত্তর দিবে?’ (অবরোধবাসিনী, ১৯৩১)।

নব্বইয়ের বেশি বছর পার করেও আমরা এই উপমহাদেশের নারীরা যে এখনো রোকেয়ার অবরোধবাসিনীর গল্পগুলো থেকে অনেক দূরে যাইনি, তার প্রমাণ পত্রিকার পাতায় আর নাটক-সিনেমা কিংবা হালের কনটেন্ট রিল ও টিকটকে ভূরি ভূরি উপস্থিত থাকে। রোকেয়ার তীক্ষ্ণ রসবোধের কিঞ্চিৎ থাকলেও আমরা হয়তো বুঝতাম, তিনি যেমন সমাজ–সংস্কারক, তেমন বিপ্লবীও। তিনি যেমন সাহিত্যিক, তেমনি সংস্কারের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ এক যোদ্ধাও। তবে রোকেয়ার সুলতানা’স ড্রিম, তথা সুলতানার স্বপ্নের দুনিয়াকে কি আসলেই নারীবাদী বলা চলে কি না, আজকের আন্দাজে তা একটু খোঁজ করে দেখা যেতে পারে।

প্রথম যখন সুলতানা’স ড্রিম পড়ি, তখন আমি স্কুলের সপ্তম বা অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থী। একই সঙ্গে পড়া হয়েছিল বিদ্যালয়ে পাঠ্য ‘রসনা বিলাস’, আর আরও পরে অবরোধবাসিনীমতিচূর। নাটকও দেখেছিলাম মনে হয়। এরপর কিছুদিন রোকেয়া আমার থেকে দূরে ছিলেন। হঠাৎ ২০১২ সালে একদিন তিনি আবার বেশ বিপুলভাবে হাজির হলেন। তখন আমি যে শহরে থাকতাম, যে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তাম, তার বিদ্যায়তনিক পরিধি বিপুল এবং খ্যাতি বিশ্বজোড়া হলেও আমার মতো দরিদ্র ছাত্রীর সামর্থ্যের মধ্যে বই কিনতে ঢুঁ দিতে হতো শুক্রবারের ফারমার্স মার্কেটের পুরোনো বইয়ের খোলা স্টলে। সেদিন জোগাড় করলাম বার্নার্ড শর কমপ্লিট প্লেস আর ক্ল্যাসিক সায়েন্স ফিকশন স্টোরিজ। কন্যার জন্য কেনা দ্বিতীয় বইটা খুলে দেখি, তার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে সুলতানা’স ড্রিম!

রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন
প্রতিকৃতি: কাইয়ুম চৌধুরী

২০১১ সালে যুক্তরাজ্যের মাইলস কেলি পাবলিশিং কোম্পানি অনেক দিন টিকবে এমন কাগজে চীন থেকে প্রিন্ট করিয়েছে এই ঢাউস বইখানা। এইচ জি ওয়েলস, জুল ভার্ন, মার্ক টোয়েন, এডগার অ্যালান পো আর হ্যান্স ক্রিশ্চিয়ান অ্যান্ডারসনের সঙ্গে আমাদের রোকেয়া সাখাওয়াতও আছেন এখানে। ফলে চলতি বছরের ১২ মে এই গল্পকে জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতিবিষয়ক সংস্থা ইউনেসকো ‘বিশ্বস্মৃতি’ বা ‘ওয়ার্ল্ড মেমোরি’র তালিকায় স্থান দেওয়ারও বহু আগে থেকেই এটি আন্তর্জাতিকতা পেয়ে আসছে।

মধ্য ভারতের ডোং সম্প্রদায়ের দুর্গা বাইয়ের অলংকরণসহ প্রকাশিত সুলতানা’স ড্রিম খুলে পড়তে পড়তে মনে পড়ে গেল, এমন এক ইউটোপিয়ার মূল উদ্দেশ্য নিয়ে বিতর্কের কথা, মনে পড়ছিল এক শ বছরে নারীর অবরুদ্ধ অন্তর, অবরুদ্ধ কর্মস্থল, সম্পত্তির অধিকার ও অবরুদ্ধ অর্থনৈতিক মুক্তির প্রশ্নটিও।

গল্পের সিস্টার সারা সুলতানাকে বলেন, নিরীহ নারীদের জেনানায় আটকে রেখে পুরুষদের ছেড়ে রাখাটা কত বড় অন্যায়, যেমন রোকেয়া তাঁর ভগিনীদের কেবল জড়োয়া গয়না ও অন্তপুরবাসিনী হয়ে না থেকে শিক্ষার মুক্ত প্রাঙ্গণে তাঁদের বের করে আনতে চান। এটা তো বড় নারীবাদী কথাই। সুলতানাকে সিস্টার সারা যে লেডিল্যান্ডের বর্ণনা দেন অথবা সুলতানা স্বচক্ষে (স্বপ্নে) যা যা দেখে, তার সবটাই আমাদের নারীদের যে পেতে ইচ্ছা করে না, তা নয়! সব কাজ দু-তিন ঘণ্টায় শেষ করে ফেলার মতো প্রযুক্তি যাঁরা আবিষ্কার করেছেন, তাঁরাই আবার রাষ্ট্র পরিচালনা ও করতে পারছেন। এমন সুচারু সে পরিচালনা যে যুদ্ধ নামের ভয়াবহ বিপদ তাঁরা বন্ধ করেছেন; বৃষ্টি ও সৌরশক্তি কাজে লাগিয়ে জয়ী হয়েছেন; এমন সমাজ গড়েছেন, যেখানে চুরি নেই, নেই অপরাধ।

আর এক ফাঁকে এখানে তৈরি হয়েছে মর্দান—যেখানে পুরুষেরা আবদ্ধ থাকেন অন্তপুরে। দেখেন ঘর–সন্তান, সামলান রান্নাঘর। নারীরা সেখানে সব কাজ করেন প্রাকৃতিক উপহারের সদ্ব্যবহার করে। তাঁদের নিয়ম না মানার শাস্তিও অদ্ভুত—বের করে দেওয়া হয় লেডিল্যান্ড থেকে! এমন একটা সমাজে যেখানে শিক্ষার শক্তিই বড়, প্রকৃতিকে সঙ্গে নিয়ে চলা যায় এবং যুদ্ধ বন্ধ করা যায় রক্তপাতহীন পথে। এই সমাজই তো মানুষের কাম্য হওয়ার কথা। 

এখন কথা হলো, যে সমাজে সবাই সমান, সেটিই হওয়া উচিত নারীবাদী ইউটোপিয়া, পুরুষকে আটকে রেখে তাঁর অধিকার খর্ব করে কেমন নারীবাদ?—এ প্রশ্ন করা যেতে পারে, নারীবাদীদের। এ প্রশ্ন করাই প্রয়োজন। তবে এটাও মনে রাখতে হবে, সুলতানা’স ড্রিম প্রকাশিত হয়েছিল আজ থেকে প্রায় ১১৯ বছর আগে ১৯০৫ সালে, ইংরেজি ভাষায়। কার জন্য এটি লিখেছিলেন রোকেয়া? পুরুষকে হেয় করাই কি উদ্দেশ্য ছিল? তাঁদের আটকে রেখে কি নারীমুক্তি হতে পারে? উঠতে পারে এসব প্রশ্নও। জিজ্ঞাসা করা যেতে পারে লেখকের ভাষার অর্বাচীনতা আর অতি সরলীকরণের প্রভাব নিয়ে। তবে এর আগে যা ভাবা জরুরি তা হলো, এই যে মর্দানে আটকে থাকতে থাকতে লেডিল্যান্ডের পুরুষদের আটকে থাকায় অভ্যস্ত হয়ে যাওয়ার ব্যাপার, এটা আমাদের বলে দেয়, রোকেয়া আসলে নারীর সামনে একটা উল্টো চিত্র হাজির করে তাঁদের জাগিয়ে তুলতে চেয়েছিলেন। অভ্যস্ত অন্তরাল থেকে তিনি তাঁদের বের হতে বলছেন আর স্বপ্ন দেখাচ্ছেন নারীর অন্তর্লীন শক্তির প্রতি আস্থা রাখতে। পুরুষকে দাবিয়ে রাখা দেখানো কোনো প্রতিশোধস্পৃহায় নয়; বরং উল্টো নারীকে এ জীবন প্রত্যাখ্যান করার শক্তি জোগানোর চেষ্টামাত্র। তো নারী এই শক্তি অর্জন করতে পারে কেবল একটি পথে—শিক্ষা ও নিজের পায়ে দাঁড়ানোর মাধ্যমে। এ পথে রোকেয়া বরাবরই উজ্জীবিত করতে চেয়েছেন নারীদের।

আজ শতবর্ষ পেরিয়েও যখন দেখি, বাড়িওয়ালার এক গালিতে অধিকার আদায়ে জড়ো হওয়া নারী শ্রমিকেরা নিমেষে হাওয়া হয়ে যান; চাকরি ও ঘর হারানো বা অপবাদের ভয়ে, এমনভাবে সমাজে টিকে থাকেন (যদিও তাঁরাই আয় করেন সংসারে), তবু যেন অদৃশ্য–অনাহূত, অকর্মণ্য স্বামীর লাথি-গুঁতা খেয়েও পড়ে থাকেন সংসার সামলানোর দায় নিয়ে; তখন মনে হয়, এসব পুরুষকে আটকানোর মর্দান থাকলে মন্দ হতো না। যখন অপহৃত, ধর্ষিত কন্যা-ভগ্নি-জননীর মৃতদেহ পড়ে থাকে, খেতে-জঙ্গলে বা রাস্তায়; আর সে অপরাধের দায় চাপে নৃশংস অপরাধের শিকার নারীর ঘাড়েই, আপনারও কি মনে হয় না যে এই ভয়াবহ অপরাধীদের কোথাও আটকে রাখতে পারলেই হতো রক্ষা? যে সমাজে আজও নারীর অধিকারের কথা বলা ‘অপরাধ’, সম্পত্তির ন্যায্য হিস্যার প্রশ্ন তোলা ‘পাপ’, অথচ সংসার চালানো ও সামলানোর দায়ও তারই ঘাড়ে, তখন আমার তো মাঝেমধ্যেই মনে হয়, একটা লেডিল্যান্ডে ঢুকে পড়তে পারলে বেঁচে যেতাম।

দুর্গা বাইয়ের শীর্ষচিত্রণে সুলতানা’স ড্রিম

পরিবেশ আর প্রকৃতি ধ্বংস করা উন্নয়নের হাত থেকে প্রজ্ঞাপূর্ণ সহাবস্থানের লেডিল্যান্ড নারীবাদী ইউটোপিয়া হয়ে ওঠে আমাদের অনেকের কাছে।

পরিবেশ আর প্রকৃতি ধ্বংস করা উন্নয়নের হাত থেকে প্রজ্ঞাপূর্ণ সহাবস্থানের লেডিল্যান্ড সে কারণেও নারীবাদী ইউটোপিয়া হয়ে ওঠে আমাদের অনেকের কাছে। এক শ বছর আগে সমাজ সংস্কার করতে গিয়েছিলেন বলেই তাঁকে পূতপবিত্র আর নিষ্কলুষ হতে হবে, এমন দিব্যি রোকেয়াকে কেউ দেয়নি। নিজের বুদ্ধি–বিবেচনা খাটিয়ে আপন করণীয় করে গেছেন রোকেয়া। নিজের সম্প্রদায়ের লোকজনের কাছ থেকে আঘাত পেয়েও অটল থেকেছেন কর্তব্যে—স্ত্রী জাতিকে শিক্ষার আলোয় আলোকিত করার লড়াইয়ে দিয়ে গেছেন জীবনটাই।

মৃত্যুর পর তাঁর কবরের মাটি জোগাড় না হওয়ার আশঙ্কায় তাঁকে কলকাতার কাছেই সোদপুরের পানিহাটিতে যে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে অন্তিম শয়ানে রাখা হয়েছে, সে অঙ্গনে দৌড়ে বেড়ানো বা কোনো দিন বিদ্যালয়ে পা না রাখা প্রতিটি শিশুর মনে আমাদের বানিয়ে তোলা বিতর্কের বাইরে একটি করে লেডিল্যান্ড তত দিনই থাকবে, যত দিন পর্যন্ত আমাদের স্ত্রীজাতির দুর্দশা আর প্রান্তিকতা না ঘুচবে।