চলন–বলন
পুরুষ ধর্ষণ ও পুরুষতন্ত্রের রাজকীয় নীরবতা
বাংলাদেশে পরিচালিত গবেষণাগুলো দেখায় যে পুরুষ যৌন নির্যাতনের অভিজ্ঞতা ভুক্তভোগীদের ওপর ভয়াবহ মানসিক প্রভাব ফেলে এবং প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ গুরুতর বিষণ্নতায় ভোগে। প্রায় এক-পঞ্চমাংশ অন্তত একবার আত্মহত্যার চেষ্টা করেছে। অথচ এ ধরনের অভিজ্ঞতা শেয়ার করার হার মাত্র ১৪ দশমিক ৭৫ শতাংশ এবং আইনগত পদক্ষেপ গ্রহণের হার প্রায় শূন্য।
আজকাল ইনস্টাগ্রাম, ফেসবুকের রিলসে একটা কথা ঘুরে বেড়ায়, ‘ইউ বিকাম হোয়াট ইউ মক!’ কোনো প্রবাদ বা বাক্য তো আমাদের বিশেষ কোনো ঘটনা, স্মৃতি, দুঃসহ অতীত মনে করিয়ে দিতেই পারে। আমার মনে পড়ে ২০১৯ সালের একটি ঘটনা।
২০১৯ সালে গাজীপুরের শ্রীপুরে জামাল উদ্দিনের মর্মান্তিক আত্মহত্যা বাংলাদেশের পুরুষতান্ত্রিক কাঠামো কীভাবে পুরুষদের বিরুদ্ধেও যেতে পারে, তার এক নির্মম উদাহরণ। তার অভিজ্ঞতা কেবল একটি অপরাধ বা ব্যক্তিগত ট্র্যাজেডি নয়, এটি এমন একটি সমাজব্যবস্থারও প্রতিফলন, যেখানে ‘পুরুষ সম্মান’ নামের বিমূর্ত ও অমানবিক একটি ধারণা অগ্রাধিকার পায়।
যে সংস্কৃতিতে মনের অনুভূতির প্রকাশকে পুরুষত্বের বিপরীত গুণ হিসেবে গণ্য করা হয়, সেই সমাজে যৌন সহিংসতার শিকার একজন পুরুষের মানসিক চাপ কতটা অসহনীয় হতে পারে, জামালের মৃত্যু অত্যন্ত দুঃখজনকভাবে সেই বাস্তবতাকে স্পষ্ট করে।
অভিযোগ অনুযায়ী, সিয়াম, সাদেক মিয়া, রনি, পিন্টু, সজল ও শাওনের মতো পরিচিতদের নিয়ে একটি দল জামালকে কৌশলে একটি বনাঞ্চলে নিয়ে যায়। সেখানে তাকে গণধর্ষণ এবং পুরো দৃশ্যটি মুঠোফোনে রেকর্ড করা হয়। এরপর ভিডিও প্রকাশের হুমকি দিয়ে তার কাছে দুই লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করে। সহজে অনুমান করা যায়, শারীরিক নির্যাতনের চেয়েও তাকে গভীরভাবে বিধ্বস্ত করে এই ব্ল্যাকমেলিং; কারণ বাংলাদেশের গভীরভাবে প্রোথিত পুরুষতান্ত্রিক সংস্কৃতিতে যৌন সহিংসতার শিকার হওয়া একজন পুরুষের জন্য সামাজিক লজ্জা, অপমান এবং অসম্মানের চাপ অসীম।
যে সংস্কৃতিতে মনের অনুভূতির প্রকাশকে পুরুষত্বের বিপরীত গুণ হিসেবে গণ্য করা হয়, সেই সমাজে যৌন সহিংসতার শিকার একজন পুরুষের মানসিক চাপ কতটা অসহনীয় হতে পারে, জামালের মৃত্যু অত্যন্ত দুঃখজনকভাবে সেই বাস্তবতাকে স্পষ্ট করে।
বলা বাহুল্য, সেই চাপ, সেই ভয় এবং অপমানের সম্ভাব্য বিস্তার একটি মানুষের মানসিক সংকটকে দ্রুত অসহনীয় পর্যায়ে পৌঁছে দিতে পারে। পরদিন সকালে আত্মহত্যা করার আগে পরিবারের সদস্যদের বিদায় জানানো তার চূড়ান্ত সিদ্ধান্তকে আরও করুণ এবং সমাজের প্রতি এক নীরব অভিযোগে পরিণত করে।
জামালের ঘটনা বাংলাদেশের এক নিষিদ্ধ বাস্তবতাকে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে নিয়ে আসে—‘পুরুষ যৌন নির্যাতন।’
সমাজের গভীরে গেঁথে থাকা ভুল ধারণা, ‘পুরুষদের ধর্ষণ সম্ভব নয়’ একদিকে যেমন পুরুষ ভুক্তভোগীদের অমানবিক অভিজ্ঞতাকে অস্বীকার করে, অন্যদিকে তাদের নীরবতাকে স্থায়ী করে তোলে। এই নীরবতা শুধু লজ্জা বা সামাজিক বিচারভীতির কারণে নয়; এটি এমন একটি সামাজিক কাঠামোর ফল, যেখানে যৌন সহিংসতার শিকার হওয়া মানেই ‘পুরুষত্ব হারানো’র সমার্থক একটি সাংস্কৃতিক ধারণা, যা ভুক্তভোগীর সঙ্গে দ্বিতীয়বার সহিংসতা করে।
বাংলাদেশে পরিচালিত গবেষণাগুলো দেখায় যে পুরুষ যৌন নির্যাতনের অভিজ্ঞতা ভুক্তভোগীদের ওপর ভয়াবহ মানসিক প্রভাব ফেলে এবং প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ গুরুতর বিষণ্নতায় ভোগে। আত্মহত্যার প্রবণতাও অত্যন্ত উদ্বেগজনক। প্রায় এক-পঞ্চমাংশ অন্তত একবার আত্মহত্যার চেষ্টা করেছে। অথচ এ ধরনের অভিজ্ঞতা শেয়ার করার হার মাত্র ১৪ দশমিক ৭৫ শতাংশ এবং আইনগত পদক্ষেপ গ্রহণের হার প্রায় শূন্য।
‘পুরুষদের ধর্ষণ সম্ভব নয়’ এমন ধারণা একদিকে যেমন পুরুষ ভুক্তভোগীদের অমানবিক অভিজ্ঞতাকে অস্বীকার করে, অন্যদিকে তাদের নীরবতাকে স্থায়ী করে তোলে। এটি এমন সামাজিক কাঠামোর ফল, যেখানে যৌন সহিংসতার শিকার হওয়া মানেই ‘পুরুষত্ব হারানো’র সমার্থক একটি সাংস্কৃতিক ধারণা।
জামালের মৃত্যুর পর পুলিশ তদন্ত শুরু করে এবং গ্রেপ্তারের চেষ্টা চালানোর কথা জানায়। কিছু আলোচনা ও সংবাদ হলেও বিষয়টি দ্রুত জনসাধারণের দৃষ্টি থেকে সরে যায়। ২০২০ সালের অক্টোবরে ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদণ্ড অনুমোদিত হওয়ার পর যে জাতীয় প্রতিবাদ ও আলোচনার সূত্রপাত ঘটে, তা মূলত নারী ভুক্তভোগীদের কেন্দ্র করেই আবর্তিত হয়। পুরুষ যৌন সহিংসতা, তার সামাজিক কলঙ্ক এবং আইনি কাঠামোর অদৃশ্যতা, এই গুরুত্বপূর্ণ দিকগুলো তখনো অনালোচিত থেকে যায়, এমনকি এখনো তা মোটেই আলোচ্য নয়।
যে পুরুষতান্ত্রিক কাঠামো পুরুষকে ‘অজেয়’ ও ‘অদম্য’ হিসেবে গড়ে তুলতে চেয়েছে, সেই একই কাঠামো শেষ পর্যন্ত পুরুষদের ওপরই সহিংস হয়ে ফিরে এসেছে।
সমাজ যে পুরুষত্বকে দুর্বলতা অস্বীকারকারী একটি শক্তির প্রতীক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছিল, সেই মিথই পুরুষদের বাস্তব দুর্বলতাকে চরম নীরবতা, ভয়, লজ্জা এবং মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়েছে। ফলে সমাজ যাকে একসময় দুর্বলতা হিসেবে বিদ্রূপ করত, সেটি তার নিজেরই নির্মিত ফাঁদে পরিণত হয়েছে।
অপরাধীদের ক্ষেত্রেও একই সত্য প্রতিফলিত হয়। তারা যে আধিপত্য, ক্ষমতা ও ‘পুরুষালি শক্তি’র প্রদর্শনকে নিজেদের পরিচয়ের অংশ হিসেবে দেখেছিল, তা সমাজের দীর্ঘদিনের পুরুষতান্ত্রিক উপহাস ও ক্ষমতার রাজনীতিরই বিকৃত প্রতিফলন। এই ধারণা অন্যদেরকে ছোট করার, নিয়ন্ত্রণ করার ও দমন করার মাধ্যমে পুরুষত্ব প্রমাণের যে আচার সৃষ্টি করেছে, অপরাধীরা সেই আচরণই পুনরাবৃত্তি করেছে। অর্থাৎ তারা সেই রূপেই পরিণত হয়েছে, যেটিকে সমাজ একটি আদর্শ পুরুষত্ব বলে প্রচার করতে চেয়েছে, যদিও তা মূলত অমানবিক, সহিংস এবং ধ্বংসাত্মক।
যে সমাজ পুরুষ ভুক্তভোগীদের অভিজ্ঞতাকে ঠাট্টার বিষয় করেছে, সেই সমাজই আজ ভুক্তভোগীদের নীরবতার বোঝা বহন করছে। সাহায্য পেতে না পারা, কথা বলতে না পারা, ন্যায়বিচারের দ্বারস্থ হতে না পারা, এসবই সেই উপহাসের প্রতিক্রিয়া, যা বছরের পর বছর ধরে পুরুষদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে।
‘ইউ বিকাম হোয়াট ইউ মক’—একটি সমাজ নিজের তৈরি মিথ্যে পৌরুষের সংস্কৃতির শিকার। আমার হাসি পায়, হাসি পায় লজ্জায়!