ছাটবৃষ্টি আশ্চর্য সুন্দর!

গ্রাফিকস: প্রথম আলো

মধ্য আষাঢ়ের এক ঝলমলে দুপুরে লেক রোড ধরে হাঁটছিলাম। চনমনে রোদ। সংসদ ভবনের আশপাশে মানুষজন ঘুরছিল নির্বিঘ্নে। হঠাৎই আকাশ কালো হয়ে এল। কম ট্রাফিকের রাস্তায় ভরদুপুরে আচমকা সন্ধ্যার আবছায়া। আকস্মিক সন্ধ্যা নামটা অদ্ভুতুড়ে বটে। কিছুক্ষণ পর একপশলা স্নিগ্ধ বৃষ্টি। পথপাশে ঝাঁকড়া দোলানো কৃষ্ণচূড়ার নিচে দাঁড়ালাম। উদ্যান ও জাতীয় সংসদ ঘুরতে আসা অনেকেই গাছের নিচে দাঁড়িয়ে আছে। ঝিরঝিরে বৃষ্টি নামল লেক রোডে ধূসর রূপে। জল ও হাওয়ার লুটোপুটি চলল মিনিট দশেক। তারপর তুষারপাতের মতো ঠান্ডা আবহ। মনে পড়ল হৃদপুরের কথা। আমার শৈশব ও কৈশোর কেটেছে উত্তরে। ডুয়ার্সের পথে হেঁটে। রোদ চনচনে আষাঢ়ের দুপুরে এ রকম উথালপাতাল শীতল হাওয়া মানে বৃষ্টি নামবে। তবে মুষলধারে নয়, ঝিরঝির করে। আমাদের অঞ্চলে একে বলে ছিটা কিংবা ছাটবৃষ্টি। এদিকে কৃষ্ণচূড়ার চিরুনি পাতা আটকে দিচ্ছিল ছাটের জলকণা। ক্ষণিক অপেক্ষা করে জিয়া মাজারের ব্রিজ ধরে উদ্যানের পথে হাঁটছি।

আকাশ থেকে বৃষ্টি ঝরছে, কিন্তু ঠিক ভিজছি না। কী অদ্ভুতুড়ে ব্যাপার! বাতাসের তোড়ে বৃষ্টি ছুঁয়ে যাচ্ছে চোখ, মুখ, গাল। শরীরজুড়ে অদ্ভুত শিহরণ। এক অন্য রকমের রোমাঞ্চ।

দেখলাম, উদ্যানে ঘুরতে আসা অভিজ্ঞ প্রকৃতিপ্রেমীরা কেউ বেঞ্চে বসে, কেউবা হেঁটে হাওয়া ও বৃষ্টির এই অদ্ভুত খেলা উপভোগ করছে। আর নবাগতরা কিংকর্তব্যবিমূঢ়। তারা ঠিক বুঝছে না, এই বৃষ্টিতে কী করতে হবে। বাড়ির পথে হাঁটা দেবে, নাকি উদ্যানের উদ্ভুত সবুজ দেখবে।

আরও পড়ুন

চোখ পড়ল লঙ্কান নাগেশ্বরে। শোভাবর্ধক ফুল গাছ। গাছের চিকন পাতা ও ফুল উভয়ই বেশ সুন্দর। বসন্তকালে বেশি ফুটলেও বর্ষায়ও দেখা মেলে এই দুধসাদা ফুলের। ছাটে ভিজে অদ্ভুত সুগন্ধ ছড়াচ্ছে। তবে বৃষ্টিভেজা নাগেশ্বরের কালচে সবুজ পাতা আপনাকে আদ্ভুত মায়ায় জড়াবে। কিছুতেই ছেড়ে যেতে মন চাইবে না। অযত্নে লালিত উদ্যানের পুষ্ট লন ঘাস ভিজছে তারিয়ে তারিয়ে। আর বয়সী লন বৃষ্টিতে ভিজে ছড়াচ্ছে হলুদ আভা।

ছাটবৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে কখন যে বিজয় সরণি মেট্রোস্টেশনে পৌঁছেছি, টেরও পাইনি। মেট্রো কার্ড পাঞ্চ মেশিন ছুঁয়ে ভেতরে প্রবেশ। স্টেশনটি বেশ ফাঁকা। সুনসান প্ল্যাটফর্মে অল্প কয়েকজন যাত্রী ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করছেন। ক্রিসেন্ট লেক, জিয়া উদ্যান, জাতীয় সংসদ—পাশ ঘেঁষে বিজয় সরণি মেট্রোস্টেশন। পুরো এলাকার ল্যান্ডস্কেপের সঙ্গে দারুণভাবে মার্চ করেছে। ঝোড়ো হওয়ার মতো ঢাকা মেট্রো বিজয় সরণিতে দাঁড়াল। মেট্রোতে সিট পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। এ যাত্রায় জুটে গেল। মেট্রোর জানালার পাশে বসে বিজয় সরণি থেকে ফার্মগেট—এমন নান্দনিক ভিউ পাওয়া যায়, অস্ফুটে উচ্চারিত হয় ‘ঢাকা সুন্দর’। রাস্তাজুড়ে রাজসিক দেবদারুর আধিপত্য। ছাটে ভিজে দেবদারুর হলদে কচি পাতা অপরূপ সেজেছে।

ছাটবৃষ্টি নস্টালজিক করছে। কানে কানে বলছে পুরোনো কথা। হুমায়ূন আহমেদের বইয়ে রাখা পুরোনো চিঠির মতো। মেট্রো জানালার কাচে ধূসর ছাট ধাক্কা খায় না, শুধু ছুঁয়ে যায়, স্পর্শ রেখে সরে দাঁড়ায়। ছাট ঘন বর্ষার অগ্রদূত। এরপর শহরে নামবে স্বপ্নজড়ানো ইলশেগুঁড়ি। ছাটের চেয়ে একটু ঘন বৃষ্টি ইলশেগুঁড়ি। খুব বেশি ব্যস্ত নয়, কিছুটা রয়েসয়ে নামে।

ছাটবৃষ্টি ধুলা ধুয়ে দেয়, কখনো স্মৃতি। শহুরে দেয়ালের ফাটলে জমে থাকা পুরোনো স্মৃতি উঁকি দিচ্ছে। হৃদপুরে কাটানো শৈশব ও কৈশোরের ছবি জ্বলজ্বল করছে। আমাদের কাঠের দোতলার টিনে বৃষ্টির টুপটাপ মিহি শব্দ…

বৃষ্টির এত রূপ, এত ভঙ্গি, যেন প্রতিটিই আলাদা গল্প। কখনো সে ফিরে আসে, কখনো হারিয়ে যায়। আর এই শহর? সে কেবল চুপচাপ ভিজে থাকে, না বলা কথার মতো।

মিনিট দশেক পরেই মেট্রো কারওয়ান বাজার চলে এসেছে। পকেটে মোবাইল চেনা টোনে ভাইব্রেট হচ্ছে। হোয়াটসঅ্যাপে ছোট ভাই মেসেজ পাঠিয়েছে, ‘বড় ভাই, হৃদপুরের ছাটবৃষ্টি ঢাকায় নেমেছে। আশ্চর্য সুন্দর!’ তারপর কয়েক ছত্র…

মেট্রোর জানালায়

ছাটবৃষ্টি

তোমার চোখের মতো

নীরব

অথচ জ্বলজ্বলে…