যাহা বলিব প্যাঁচাইয়া বলিব...

যে কথা জাতের-পদের না, তার নাম সোজা কথা। পদে পদে বিপদ সঙ্গে করে চলা—এ এক আপাদমস্তক আপদ। সোজা বিষয়টাকে কায়দামতো কথার ত্যানায় পেঁচিয়ে স্পিন বোলিংয়ের মতো বলতে পারলেই তা বিএসটিআই অনুমোদিত শতভাগ বিপদমুক্ত সোজা কথা হয়ে ওঠে। তাই ‘যাহা বলিব প্যাঁচাইয়া বলিব...’।

প্রথম থেকেই পলিটিকসে পলিউশন। সেখানে দূষণমুক্ত নির্মল সোজাসাপটা কথা বলে এ পর্যন্ত কত নেতা পাটিসাপটার মতো চ্যাপটা হয়ে রাজনীতির সিভিলিয়ান মাঠ ছেড়ে প্যাভিলিয়নে ফিরে গেছেন, তার কোনো লেখাজোখা নাই। যার কথা যত ত্যাড়াব্যাঁকা–ন্যাতানো, সে তত বড় নেতা।

সংস্কৃতিরও সতীত্ব গেছে বলছি না; তবে দেশি মসুরিতে বিদেশি ‘ভেচ’ যে ঢুকেছে, তা নিশ্চিত। সাহিত্যেও সীতা-সাবিত্রী নেই। রাজনীতির গডফাদারদের মতো সাহিত্যেও ‘ধর্মের বাপ’দের চেইন অব কমান্ড আছে। সোজা কথাগুলো গ্রুপের বিপক্ষে গেলে সেন্সর ক্যানসার হয়ে ধরে। সবখানেই ‘উচিত কথায় বন্ধু বেজার’ অবস্থা।

ফেসবুকে লেখা কোন কথায় সরকারি লোকেরা বেজার হবে; কোন কথায় বিরোধীরা মা-বাপ তুলে শাপ শাপান্ত করবে; কোন কবিতার কোন উপমাকে ইঙ্গিত মারা খোঁচা হিসেবে ধরে নিয়ে অফিসের বস উঠতি ক্যারিয়ারে ফস করে ধস নামিয়ে দেবে; কার সঙ্গে তোলা কোন ছবি পোস্ট করলে বাপের বাড়ি বেড়াতে যাওয়ার লাগেজপত্র গোছাতে বউয়ের ব্যস্ততার সীমা থাকবে না—এই সব দুর্ভাবনার কারণে সোজা কথার সোজা ভাষণ তো দূরের কথা, সোজা ভাষার সোজা সাহিত্যও এখন নেই।

 চুলায় চাপানো পাতিলে ধাওয়া জ্বালে উতলানো দুধের মতো মন উগরে কত অনুভূতি বমির মতো ঠেলে বের হতে চায়। সেটাই কলমের মুখ দিয়ে ছন্দের দমকে দমকে খাতায় উগরে দেওয়ার নাম রোমান্টিক কবিতা। এই কথাকেই ভদ্রলোকি ভাষায় ওয়ার্ডসওয়ার্থ ‘পোয়েট্রি ইজ দ্য স্পন্টেনিয়াস ওভারফ্লো অব পাওয়ারফুল ফিলিংস’ বলে চালিয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু আমরা চালাতে পারছি কই। আমাদের মগজে একজন করে ‘সদা-সতর্ক-সর্বত্র’ ‘আমি’ কাঁচি হাতে ‘সেন্সর বোর্ডের’ এডিটর হয়ে বসে আছে। ফলে ‘স্পন্টেনিয়াস ওভারফ্লো অব পাওয়ারফুল ফিলিংস’ বা গলা ফাটিয়ে বের হওয়া চিৎকারের মতো মন থেকে আপন মনে ফিনকি দিয়ে বের হতে চাওয়া ‘পাওয়ারফুল ফিলিংস’কে বের হতে দেওয়া যাচ্ছে না; কোঁত করে তাকে প্যারাসিটামলের মতো গিলে ফেলতে হচ্ছে। বউয়ের ভয়ে (সম্মানিত নারী পাঠকেরা চাইলে ‘বউয়ের ভয়ে’ কথাটাকে ‘স্বামীর ভয়ে’ ধরে নিয়ে পড়তে পারেন), পুলিশের ভয়ে, বসের ভয়ে, সর্বোপরি মগজের মধ্যে বসা ‘সদা-সতর্ক-সর্বত্র’ ‘আমি’ নামক ভদ্রলোকের ভয়ে দারুণ রোমান্টিসিজমে ভর করে বলা যাচ্ছে না—‘অন্তর হতে আহরি বচন...গীতরসধারা করি সিঞ্চন’।

তারপরও বইপত্র, পত্রিকা, এমনকি ফেসবুকে নিয়ন্ত্রিত আবেগ দিয়ে রোমান্টিক কবিতা লেখার, মানে সীমাকে দিয়ে অসীমকে (বি. দ্র.: এখানে ‘সীমা’ বলতে কোনো মেয়ে এবং ‘অসীম’ বলতে কোনো ছেলের কথা বলা হচ্ছে না) ধরার মতো আনরোমান্টিক গ্রাম্যতা দেখা যাচ্ছে।

এসব চাপাচাপি আর লুকোছাপা দেখে খারাপ লাগে। খারাপ লাগে বুবলীকে সতিন দেখে অপু যখন রণে ভঙ্গ দেয়। মনে ভাবি, সমাজের যে মহল্লায় রবি ঠাকুরের ‘গোরা’ বাস করে, তারই কোনো লেন-বাইলেনে শেক্‌সপিয়ারের ‘ওথেলো’কে ফাঁদে ফেলা ‘ইয়াগো’ ঘাপটি মেরে আছে। আলোর নিচে আলেয়া। দশাননের ভাই বিভীষণ। তাই মাথার মধ্যে বসা ‘সদা-সতর্ক-সর্বত্র’ সেই ‘আমি’ বলে, ‘সাবধান! সাবধান!’ অথচ সাবধানে সাহিত্য হয় না।

তারপরও আমি চোখের ক্ষুধার কথা বলতে চাই। আমি বিরান বাগানে যতীন বাগচীর ‘অন্ধবধুর’ মতো ঝরা বকুল কুড়াতে চাই। সাহিত্যের সওদা কিনতে ‘অতি দূর সমুদ্রের পর হাল ভেঙে’ দিশা হারানো নাবিকের মতো বনলতা সেনের ডাগর চোখে নোঙর ফেলি। শিলং পাহাড়ে লাবণ্যের পিছে অমিত হয়ে ঘুরি আর ভাবি, সাহিত্যের গার্ডেন গড়তে একটা বিত্তশালী চিত্ত দরকার।

সাহিত্য জিনিসটা ভাবের সঙ্গে শব্দের কোর্ট ম্যারেজ। সেখানেও বেহুলার বাসরঘর। সেখানেও মনসার ফণা। সে বিষ ঝাড়ার মতো বেদের মেয়ে জোছনা তো নেই। আর নেই বলেই সোজা সাহিত্য আজ পলতের মতো প্যাঁচানো সাহিত্য হয়ে আছে। সে কারণেই আজকের কবিতা, আজকের সাহিত্য, আজকের ফেসবুকীয় গদ্য-পদ্য—সব দুঃস্বপ্নের জোছনায় মাখা ভাতের ফেনার মতো বাসি হয়ে গেছে। যাক গে, আমার কী!