আগুন নেভানোর জন্য কেন হেলিকপ্টার দিয়ে পানি এনে ছিটাতে হলো
ঢাকা শহরে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটলেই আমাদের মনে পড়ে, এই নগরে যেসব পুকুর ছিল, সেগুলো গেল কোথায়!
আজ একটা ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড ঘটে গেল বঙ্গবাজারে। হাজার হাজার দোকান সব পুড়ে ছাই। ঠিক রাস্তার উল্টো দিকেই ফায়ার সার্ভিসের প্রধান ঘাঁটি। সেখানে আগুন নিয়ন্ত্রণের সব আধুনিক ব্যবস্থা মজুত করা। কিন্তু তাতেও শেষ রক্ষা হলো কই। আশপাশে শহীদুল্লাহ হলের পুকুর ছাড়া আর পানির উৎস নেই। ফলে দ্রুত আগুন নেভানোর জন্য হেলিকপ্টার দিয়ে হাতিরঝিল থেকে পানি এনে ছিটাতে হয়েছে।
কেন এমন হলো, ঢাকা শহরে কেন কোনো পুকুর নেই এখন?—এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে তাকাতে হবে ইতিহাসের পাতায়। আর তখনই আপনি দেখবেন, আরে, এ শহরে পুকুর তো ছিলই! এখন শাহবাগের যেখানে আজিজ সুপার মার্কেট, একসময় সেখানে ছিল বিরাট পুকুর। সেই পুকুর ভরাট করে গড়ে তোলা হলো সুরম্য ভবন।
সেই ব্রিটিশ আমলের ঢাকা ছিল নদী আর খাল দিয়ে ঘেরা। আর এর মাঝখানে ছিল অসংখ্য পুকুর। একটি চমকপ্রদ তথ্য দিই, ব্রিটিশ শাসনামলেও ঢাকা শহরে পুকুর, খাল কিংবা কোনো জলাশয় ভরাট করা নিষিদ্ধ ছিল। আর দুই–দুটো বিশ্বযুদ্ধের সময় এই নিষেধাজ্ঞায় ছিল দারুণ কড়াকড়ি। কারণ, আগুন নেভাতে হাতের কাছে থাকা এসব জলাশয়ের বিকল্প ছিল না।
ব্রিটিশ রাজত্বের অবসানের পরও ঢাকা শহরে অনেক পুকুর ছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রোকেয়া হলেই ছিল বিশাল এক পুকুর। এই পুকুরে ফুটে থাকত শয়ে শয়ে পদ্মফুল। সাঁতার কাটতে গিয়ে মারা গিয়েছিলেন বেশ কয়েকজন। আত্মহত্যাও করেছিলেন একজন। (সূত্র: ‘নারী প্রগতিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও রোকেয়া হল’, লেখক: সেলিনা চৌধুরী) তারপরই এটি ভরাট করে বাগান করা হয়। সেই পুকুরেই ছাত্রীরা নৌকাভ্রমণ করতেন—এমন দৃশ্যের ছবিও দেখা যায় ইতিহাস বইয়ে। সেখানেও এখন গড়ে উঠেছে সুরম্য দালান।
শাহবাগের আজিজ মার্কেট যেখানে অবস্থিত, সেখানে যে বিরাট এক পুকুর ছিল, তা তো আগেই বলা হয়েছে। শুধু তা–ই নয়, খোদ শাহবাগেই এমন পুকুর পাশাপাশি ছিল তিনটা। একটা ভরাট করে পাশাপাশি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হল ও মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান হল করা হয়েছে। আরেকটা ভরাট করে কাঁটাবন মোড়ে বিদ্যুতের যে পাওয়ার স্টেশন রয়েছে, সেটি নির্মাণ করা হয়েছে। এসব খুব বেশি দিন আগের কথা নয়। বছর চল্লিশেক আগের ঢাকার চিত্র।
পরিসংখ্যান বলছে, এই ১৯৯০ সালেও ঢাকায় পুকুর ছিল দুই হাজারের মতো। সঠিকভাবে বলতে গেলে সংখ্যাটা ১৯০০ সালের আশেপাশে। অপরিকল্পিত নগরায়ণ, দখলদারি ও আবাসন চাহিদার কারণে এ পর্যন্ত গত ৩৩ বছরে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে ঢাকার ১ হাজার ৯০০ সরকারি-বেসরকারি পুকুর ও জলাধার। এসব পুকুরের মোট জমির পরিমাণ ছিল ৭০ হাজার হেক্টর। এসব পুকুর একসময় ছিল পানি ধরে রাখার অন্যতম মাধ্যম। ফলে জলাবদ্ধতা নিরসনে এগুলোর ভূমিকা ছিল গুরুত্বপূর্ণ। মৎস্য বিভাগের পরিসংখ্যানমতে, ১৯৯০ সালের দিকে ঢাকায় হাজার দুয়েক পুকুর থাকলেও বেসরকারি হিসাবমতে, এ বছর পর্যন্ত তা এসে ঠেকেছে টেনেটুনে ১০০–তে। যদিও ঢাকায় পুকুরের প্রকৃত সংখ্যা কত, সে হিসাব নেই দুই সিটি করপোরেশনের কারও কাছেই।
বড় বড় দালান এই শহরের বুক দখল করে চলেছে প্রতিদিনই। নগরের প্রয়োজনে হয়তো দালান দরকারি জিনিস। হয়তো দালান না থাকলে সেটাকে ঠিক শহর বলেই মনে হয় না। কিন্তু এসব পুকুরকে রেখেই কি নগরকে সাজানো যেত না? আমাদের এমন উপলব্ধি হয়, সর্বগ্রাসী আগুন যখন জিব দেখায়, তখনই। সে সময়ই মনে হয়, কেন কোনো পুকুর নেই ঢাকায়?
এখন শাহবাগের যেখানে আজিজ সুপার মার্কেট, একসময় সেখানে ছিল বিরাট পুকুর। সেই পুকুর ভরাট করে গড়ে তোলা হলো সুরম্য ভবন। ব্রিটিশ আমলের ঢাকা ছিল নদী আর খাল দিয়ে ঘেরা। এর মাঝখানে ছিল অসংখ্য পুকুর। একটি চমকপ্রদ তথ্য দিই, ব্রিটিশ শাসনামলেও ঢাকা শহরে পুকুর, খাল কিংবা কোনো জলাশয় ভরাট করা নিষিদ্ধ ছিল। আর দুই–দুটো বিশ্বযুদ্ধের সময় এই নিষেধাজ্ঞায় ছিল দারুণ কড়াকড়ি। কারণ, আগুন নেভাতে হাতের কাছে থাকা এসব জলাশয়ের বিকল্প ছিল না।
আসলেই তো, কেন পুকুর নেই? আজকের ঢাকা শহরের প্রতিটি উঁচু, আধুনিক স্থাপনার পাশে একটা টলটলে স্বচ্ছ জলের পুকুর কল্পনা করুন তো। সেই পুকুরে কলমি কিংবা শাপলা ফুল ভেসে ভেসে হাসছে। এটা এ সময় খুব কষ্টকল্পনা হলেও এমনটা ঘটা অসম্ভব ছিল না। কেবলই দখলদারত্ব আর লোভ এই শহরকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিচ্ছে। বলা বাহুল্য, পুকুর তো ছিল, আমরা রাখিনি, রাখতে পারিনি। আমাদের ক্ষুধার কাছে হার মেনে নিয়েছে পরিবেশ ও প্রকৃতি।
বেশ কয়েক বছর আগের একটা সমীক্ষা আছে ইনস্টিটিউট অব ওয়াটার মডেলিংয়ের (আইডব্লিউএম)। সেই প্রতিবেদনে বলা আছে, মাত্র সাড়ে তিন দশকে ঢাকা শহর থেকে হারিয়ে গেছে ১০ হাজার হেক্টরের বেশি জলাভূমি, যা ২৪ হাজার ৭১১ একর। এই পরিমাণ জায়গা কত বড়, তা বোঝাতে একটা উদাহরণ দেওয়া যায়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা মাত্র ২৫৪ একরের। দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো, এত বিশাল পরিমাণ জলাশয় মানুষের পেটে চালান হয়ে গেছে।
ওই সমীক্ষায় বলা হয়েছে আরেকটি অশনিসংকেতের কথা। আশঙ্কা করা হয়েছে, জলাশয় ভরাটের এ প্রবণতা অব্যাহত থাকলে ২০৩১ সাল নাগাদ ঢাকায় জলাশয় ও নিম্নভূমির পরিমাণ মোট আয়তনের ১০ শতাংশের নিচে নেমে যাবে। এতে আরও বলা হয়, ১৯৭৮ সালে ঢাকা ও আশপাশের বিভিন্ন এলাকায় জলাভূমির পরিমাণ ছিল ২ হাজার ৯৫২ হেক্টর আর নিম্নভূমি ছিল ১৩ হাজার ৫২৮ হেক্টর। একই সময়ে খাল ও নদী ছিল ২ হাজার ৯০০ হেক্টর। রাজধানীর বৃষ্টির পানি এসব খাল দিয়েই পড়েছে নদীতে। ২০১৪ সালে ঢাকা ও আশপাশে জলাভূমি কমে হয়েছে ১ হাজার ৯৩৫ হেক্টর, নিম্নভূমি ৬ হাজার ১৯৮ হেক্টর এবং নদী-খাল ১ হাজার ২ হেক্টর। অর্থাৎ ৩৫ বছরে জলাশয় কমেছে ৩৪ দশমিক ৪৫ শতাংশ। এ সময়ের ব্যবধানে নিম্নভূমি কমেছে ৫৪ দশমিক ১৮ এবং নদী-খাল ৬৫ দশমিক ৪৫ শতাংশ।
আচ্ছা, ঢাকা শহরে যে এত এত বড় ভবন উঠেছে, তার কতভাগ নির্মাণের পেছনে পরিবেশবান্ধব পরিকল্পনা আছে বলে মনে হয়? আদৌ কি আছে? আমাদের কিছু আইন আছে জলাধার রক্ষায়। কিন্তু সেগুলো আমরা কেউ মানি না। তাই একের পর এক এসব জলাশয় ভরাট হয়ে গড়ে উঠছে আবাসন। এখন প্রতিবছর প্রচুর বৃষ্টিপাত হচ্ছে আর ডুবে যাচ্ছে ঢাকা। ব্রিটিশ আমল, পাকিস্তান আমল বা স্বাধীন বাংলাদেশেও ঢাকা শহরে যে পুকুরের অস্তিত্ব ছিল, সেসব পুকুরের অর্ধেক থাকলেও ঢাকায় এখন এত জলাবদ্ধতা হতো না। নগরবাসীর সুবিধার জন্য এসব পুকুর সংরক্ষণ করা বা টিকিয়ে রাখা দরকার ছিল।
অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা বর্তমানে এ শহরের নৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। কয়েক দিন পরপরই এখানে–সেখানে আগুন লেগে জানমালের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। বছর কয়েক আগের নিমতলী থেকে আজকের বঙ্গবাজারের কথা মনে করুন। সবই তো আগুনে পোড়ার ঘটনা।
নিমতলী, চুড়িহাট্টা আর বঙ্গবাজার খুবই কাছাকাছি এলাকায় অবস্থিত। এসব জায়গায় আগুন যে বারবার তার লকলকে জিব দেখাচ্ছে, তাতেও যদি আমাদের টনক না নড়ে, তাহলে বুঝতে হবে, আগামী প্রজন্মের জন্য খুব খারাপ কিছু অপেক্ষা করছে। আগুন নেভানোর জন্য এখন আধুনিক অনেক বিকল্প ব্যবস্থা এলেও পুকুরগুলো নেই। যার দরুন অগ্নিনির্বাপণের সময় আমরা হাতের কাছে পাচ্ছি না পানির পর্যাপ্ত উৎস।
পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় যে ২৫ শতাংশ জলাশয় থাকা প্রয়োজন, সেটা যেন আমরা এখন আর মনেই করতে চাই না। কিন্তু আমরা যদি এটা ভুলে যাই, তাহলে বিপদ আমাদেরই। তাই এখনো ঢাকা শহরে যেসব পুকুর, খাল টিকে আছে, সেগুলো বাঁচাতে সবাইকে সোচ্চার হতে হবে।