লেডি ল্যাজারাস

ভূমিকা ও ভাষান্তর: কল্যাণী রমা

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

ভূমিকা

‘লেডি ল্যাজারাস’ সিলভিয়া প্লাথের সবচেয়ে বিখ্যাত কবিতাগুলোর অন্যতম। কবিতাটি ১৯৬২ সালের ২৩ থেকে ২৯ অক্টোবরে লেখা হয়। কবিতায় উল্লেখিত মেয়েটির সঙ্গে কবির যেন অনেক মিল আছে। কবিতার শিরোনাম এসেছে নিউ টেস্টামেন্টের চরিত্র ‘ল্যাজারাস’ থেকে। ল্যাজারাস মারা যায়, তারপর যিশু তাকে আবার জীবনে ফিরিয়ে আনেন। কবিতায় যে মেয়ের কথা বলা হচ্ছে, সে বারবার আত্মহত্যার চেষ্টা করছে। প্রতি দশ বছরে একবার এই চেষ্টা। কিন্তু বারবারই সে ফিরে আসছে।

মেয়েটির মানসিক কষ্ট ‘কনসেনট্রেশন ক্যাম্পের’ কষ্টের মতোই ভয়ংকর। এ রকম কথা প্রচলিত আছে যে নাৎসিরা ‘হলোকাস্ট ভিক্টিম’দের শরীরের অংশ দিয়ে দৈনন্দিন ব্যবহারের জিনিস বানাত। সেই ভয়াবহতা যেন মেয়েটির জীবনেও। একই রকম কষ্ট হচ্ছে ওরও। ওর শরীরের চামড়া দিয়েও বুঝি নাৎসি বাতির ঢাকনা বানানো হচ্ছে, পা থেকে কাগজ চাপা দেওয়ার পাথর...

সাধারণ মানুষ ঠিক বুঝতে পারে না মেয়েটির অবর্ণনীয় কষ্টের কথা। মেয়েটি মৃত্যু থেকে ফিরে এলে তারা বাদাম চিবুতে চিবুতে যেন সার্কাস দেখতে আসে। ওরা প্রত্যেকেই চায় মেয়েটির একটু কাপড়ের টুকরা, চুল, রক্ত।

জার্মান চিকিৎসককে সম্বোধন করে তাকে ‘শত্রু’ বলে চিহ্নিত করছে লেডি ল্যাজারাস। আবারও নাৎসিদের উদাহরণ উঠে এসেছে। জার্মান চিকিৎসকেরা অনেক নৃশংস পরীক্ষা করেছে ইহুদিদের নিয়ে। অন্য অর্থেও চিকিৎসকেরা তার শত্রু। বারবার আত্মহত্যার চেষ্টার পর ফিরিয়ে এনেছে তাকে মৃত্যু থেকে।

নাৎসিরা গ্যাস চেম্বারে, ক্রিমেটোরিয়ামে জীবন্ত মেরে ফেলেছে ইহুদিদের। লেডি ল্যাজারাসের মনে হচ্ছে, তাকেও বুঝি ইহুদিদের সঙ্গে জ্যান্ত পুড়িয়ে মারা হচ্ছে।

কবিতার শিরোনাম এসেছে নিউ টেস্টামেন্টের চরিত্র ‘ল্যাজারাস’ থেকে। ল্যাজারাস মারা যায়, তারপর যিশু তাকে আবার জীবনে ফিরিয়ে আনেন। কবিতায় যে মেয়ের কথা বলা হচ্ছে, সে বারবার আত্মহত্যার চেষ্টা করছে। প্রতি দশ বছরে একবার এই চেষ্টা। কিন্তু বারবারই সে ফিরে আসছে।

আগুনে পুড়ে শেষ হয়ে যাওয়ার পর শুধু পড়ে আছে ছাই। কোনো মাংস বা হাড় আর নেই। পড়ে আছে বিয়ের আংটি, দাঁতের সোনার ফিলিং। নাৎসিরা মানুষদের শরীরের যা অবশিষ্ট পড়ে থাকত, যে ছাই; তা দিয়ে সাবান বানাত। লেডি ল্যাজারাসের শরীর থেকেও বুঝি তেমন সাবান বানানো হবে।

কবিতার শেষ অংশে এসে ধীরে ধীরে লেডি ল্যাজারাসের স্বর পালটে যেতে থাকে। কবিতার শুরুতে অনুভূতিহীন মানুষেরা মজা দেখার জন্য তাকে দেখতে আসত। অসহায় ছিল লেডি ল্যাজারাস। কিন্তু শেষে এসে দেখা যায় যেন মৃত্যুর ভেতর থেকে লেডি ল্যাজারাসের পুনরুত্থান হচ্ছে। তবে লাজ্যারাসের মত, যিশুর দ্বারা নয়, লেডি ল্যাজারাস নিজের শক্তিতেই আগুনের ভেতর থেকে জীবন্ত হয়ে উঠছে।

লেডি ল্যাজারাস • সিলভিয়া প্লাথ

সিলভিয়া প্লাথ (২৭ অক্টোবর ১৯৩২—১১ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৩)। স্কেচ: মাসুক হেলাল

আমি তা আবার করেছি। প্রতি
দশ বছরেই একবার
আমি তো তা করি—
একধরনের চলমান বিস্ময়, আমার ত্বক
এক নাৎসি বাতির ঢাকনার মতোই উজ্জ্বল,
আমার ডান পা
একটি কাগজ চাপা দেওয়ার পাথর,
মুখ এক বৈশিষ্ট্যহীন, সূক্ষ্ম
ইহুদি লিনেন।
রুমালটা সরিয়ে নাও
ও আমার শত্রু।
আমি ভয় দেখাই?—
নাক, চোখের কোটর, আমার দুপাটি দাঁত দিয়ে?
নিশ্বাসের টক স্বাদ
এক দিনেই বিলুপ্ত হয়ে যাবে।
অবিলম্বে, অবিলম্বেই কবরে
ক্ষয়ে যাওয়া মাংস
আমার ভীষণ আপন হয়ে যাবে
আর আমি এক হাস্যোজ্জল নারী।
মাত্র ত্রিশ বছর বয়স আমার।
এবং বিড়ালেরই মতো আমার আরও নয়টা মরণ বাকি।
এবারেরটা তৃতীয়বার।
কী বিশ্রী এভাবে
প্রতি দশককে ধ্বংস করা।
কত সহস্র সহস্র আঁশ।
বাদাম চিবুতে চিবুতে জনতা
হাত–পার বাঁধন থেকে ওরা আমার
শরীরকে খুলে ফেলা দেখতে ভেতরে ঢুকে পড়ে—
ক্রমে ক্রমে এক বিকট অঙ্গাবরণ উন্মোচন।
ভদ্রমহোদয় ও মহিলাগণ,
এগুলো আমার হাত
আমারই হাঁটু।
হয়তো বা আমি কেবল চামড়া আর হাড়,
তবু একই অভিন্ন সেই নারী আমি।
প্রথম যখন এটা ঘটেছিল, আমার বয়স ছিল দশ।
সেটা এক দুর্ঘটনা ছিল।
দ্বিতীয়বার চেয়েছিলাম
একে চিরস্থায়ী করতে এবং আর কখনো ফিরে না আসতে।
আমি বন্ধ হয়ে গিয়েছিলাম সে
এক সাগরের ঝিনুকের মতো।
তাদের ডাকতে হয়েছিল বারবার
আর এঁটে থাকা মুক্তার মতো আমার শরীর থেকে সব কীট ঠুকরিয়ে তুলে নিতে হয়েছিল।
আত্মহত্যা
এক শিল্প, অন্য সবকিছুর মতো।
আমি তা অসাধারণ দক্ষতায় নিপুণভাবে করে থাকি।
আমি তা এমনভাবে করি যেন নরক বলেই মনে হয়।
আমি তা এমনভাবে করি যেন সত্য বলে মনে হয়।
তোমরা বলতে পারো, এ আমার সহজাত একটি অভ্যাস।
এক আবদ্ধ ছোট ঘরে এমনটা করা ভীষণ সোজা।
এমন করা এবং সেখানে থাকা সত্যিই ভীষণ সোজা।
কিন্তু এই নাটকীয়
ফিরে আসা উন্মুক্ত দিনের আলোয়
একই জায়গায় একই মুখের মুখোমুখি, সেই একই বর্বর
আনন্দ উল্লাস—
‘কী আশ্চর্য ঘটনা, অলৌকিক একেবারে।’
আমি এক প্রচণ্ড ধাক্কা খাই।
মূল্য ঠিক করা আছে
উৎসুক হয়ে আমার ক্ষতচিহ্নের দিকে তাকানোর জন্য, মূল্য ঠিক করা আছে
আমার হৃৎপিণ্ডের শব্দ শুনবার জন্য—
তা সত্যিই স্পন্দিত হয়।
এবং মূল্য ঠিক করা আছে, এক বিরাট অঙ্কের মূল্য
একটি শব্দ বা একটু স্পর্শের জন্য
অথবা সামান্য রক্ত
কিংবা আমার টুকরো চুল বা কাপড়ের জন্য।
বুঝলে? বুঝলে, হে ডাক্তার?
বুঝলে, হে শত্রু?
আমি তোমারই মহৎ সৃষ্টি,
আমি তোমারই মূল্যবান,
খাঁটি সোনা
যা এক সুতীক্ষ্ণ চিৎকারে গলে যায়।
আমি ঘুরে ঘুরে পাক খাই আর পুড়ে যাই।
মনে কোরো না, তোমার মহান উদ্বেগকে আমি ছোট করে দেখি।
ছাই, ছাই—
খোঁচা দাও আর নাড়া দাও।
মাংস, হাড়, ওখানে কিছুই নেই—
শুধু একটুকরো সাবান,
বিয়ের আংটি,
দাঁতের সোনার ফিলিং।
হে ঈশ্বর, হে লুসিফার
সাবধান
সাবধান।
ছাইয়ের ভেতর থেকে
আমি উঠে আসি আগুনে চুল নিয়ে
আর মানুষকে খাই বাতাসের মতো।

আরও পড়ুন