আনিসুল হকের মঙ্গলবারের লেখা
লেখকদের নিয়ে যত ঘটনা-১০: হেলাল হাফিজ ভাইয়ের সঙ্গে হাঁটছি
কবি ও কথাসাহিত্যিক আনিসুল হক ঢাকা শহরে এসেছিলেন আশির দশকে রংপুর থেকে, পণ করেছিলেন লেখক হবেন। প্রখ্যাত লেখকদের অনেক মজার ঘটনার তিনি সাক্ষী। এই নিয়মিত কলামে তিনি বিখ্যাত মানুষদের জীবনের মজার ঘটনাগুলোর স্মৃতিচারণা করবেন। অন্য আলো ডটকমে এটি প্রতি মঙ্গলবার প্রকাশিত হচ্ছে।
বুয়েটে ভর্তি হয়েছি। শহীদ স্মৃতি হলে থাকি। পাশাপাশি দুটো ক্যানটিন হলের সামনে, আহসানউল্লাহ হলের ক্যানটিন আর নজরুল-শহীদ স্মৃতি ক্যানটিন। দুই টাকায় পাওয়া যায় বিরিয়ানি, তিন টাকায় খিচুড়ি। চৌবাচ্চায় পানি জমা থাকে, সেখান থেকে তুলে গেলাসে গেলাসে দেওয়া হয়। আমরা সেই পানি পান করি, শরীর খারাপ কোনো দিনও করে না। ক্যানটিনের দেয়ালে হলুদ লাল সবুজ পোস্টার পেপারে হাতে লেখা স্লোগান। এর মধ্যে একটা হলো: এখন যৌবন যার, মিছিলে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়।
১৯৮০-এর দশক। এখন যৌবন যার কবিতাটা লেখা হেলাল হাফিজের, এটা জানি। তাঁর বই বেরিয়েছিল বইমেলায়, দৈনিক ‘ইত্তেফাক’ প্রথম পৃষ্ঠায় সেই খবরটা দিয়েছিল, বইয়ের নাম ‘যে জলে আগুন জ্বলে’। কোনো কবিতার বই প্রকাশের খবর তখনকার ‘ইত্তেফাক’–এর প্রথম পৃষ্ঠায় বেরোতে পারে, তা ছিল অকল্পনীয়।
হেলাল হাফিজের ‘যে জলে আগুন জ্বলে’ বইটা হলের ছেলেদের কাছে থাকত। শ্মশ্রুমণ্ডিত হেলাল হাফিজ ছিলেন আমাদের মতো মফস্বল-আগত তরুণ কবিযশঃপ্রার্থীদের প্রায় স্বপ্নের মানুষ।
আমাকে হেলাল হাফিজের কাছে নিয়ে গেলেন আমার রংপুর কারমাইকেল কলেজের বন্ধু হ্যাপি। হ্যাপির ভালো নাম এজাজ আল মামুন। তিনি পড়েন শেরেবাংলা কৃষি কলেজে, এখন যেটা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়। তিনি নিজে কবিতা লেখেন, আর তাঁর কলেজের শিক্ষার্থী স্বপ্নার সঙ্গে প্রেম করেন। কারমাইকেল কলেজ থেকেই হ্যাপি জাতীয় ছাত্র লীগের একনিষ্ঠ কর্মী। সব মিলিয়ে হ্যাপির সঙ্গে আমার খাতির বেশ গভীর, আড্ডা নিয়মিত। কবি মিনার মনসুরের কাছে নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারেও হ্যাপির উৎসাহ প্রচুর। একদিন হ্যাপি আমাকে বললেন, চলো হেলাল ভাইয়ের কাছে যাই।
হেলাল হাফিজ তখন দৈনিক ‘দেশ’ পত্রিকার সাহিত্য পাতা দেখেন। তাদের অফিস সেগুনবাগিচায়। পরে যেখানে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর হবে, সেই পুরোনো খিলানওয়ালা কড়িবর্গাশোভিত পুরোনো ভবনটায়।
আমার যত দূর মনে পড়ে, স্বপ্না আর আমাকে নিয়ে হ্যাপি চললেন সেগুনবাগিচায়। হেলাল হাফিজ ভাইয়ের জন্য আলাদা একটা রুম বরাদ্দ। তাঁর সামনে গেলাম। তিনি হাসিমুখে আমাদের বরণ করলেন। বললেন, চা খাবে?
আরও খানিকক্ষণ বসবার আশায় আমরা বললাম, খাব। হেলাল ভাই চায়ের অর্ডার দিলেন।
হেলাল ভাই কথা কম বলেন। তবু গল্প করলেন। একটা কথা আমার মনে আছে। তিনি বললেন, কবিতার বিষয় হিসেবে প্রেম চিরন্তন। প্রেমের কবিতার বেঁচে থাকবার সম্ভাবনা রাজনৈতিক কবিতার চেয়ে বেশি।
এরপর একদিন কবিতা পকেটে নিয়ে হাজির হলাম কবি হেলাল হাফিজের কাছে। তত দিনে সম্ভবত আমি বুয়েটে ইলেকশন করে ইউকসুর বার্ষিকী সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছি। নির্বাচনের সময় আমার নাম ছিল—আনিসুল হক মিটুন। সেই ইলেকশন ছিল ভারি মজার। আমার প্যানেল ছিল ছোট। আমাদের সেলিম-রানা পরিষদের বাঁধা ভোট গোটা ৫০-এর বেশি না। প্রতিদ্বন্দ্বী প্যানেলের মিছিলে ৬০০-৭০০ জন বের হয়। আমি তখন বুয়েটের অডিটরিয়ামের ছাদ থেকে বিশাল ব্যানার ঝুলিয়ে দিলাম: ‘কবি নজরুল পরাজিত হলে ক্ষতি কার?—নির্মলেন্দু গুণ।’ ছাত্রীহলে গিয়ে ভোট চাইবার বদলে শোনালাম আল মাহমুদের ‘সোনালি কাবিন’ থেকে দুটো লাইন: ‘পরাজিত নই নারী, পরাজিত হয় না কবিরা, আহত দারুণ বটে, আর্ত আজ শিরা-উপশিরা।’ ছাত্রী হলে ১৫৮টা ভোট ছিল। আমি পেলাম ১৫০টা। ইউকসুর বার্ষিকী সম্পাদক নির্বাচিত হলাম।
যদি খেয়াল করেন, দেখবেন, রংপুর জিলা স্কুলের প্রাক্তন ছাত্ররা আমাকে ডাকে ‘আনিসুল’, বুয়েটের শিক্ষার্থীরা আমাকে ডাকে ‘মিটুন’, আর সাংবাদিক কমিউনিটিতে আমার নাম ‘আনিস’। তো বুয়েটে পড়াকালে আমি ভাবলাম, আমার নামে মিটুন শব্দটা রাখতে হবে। তখন ‘ইত্তেফা’–এ ছড়া ছাপা হলো আনিসুল হক মিটুন নামে। তারপর ভাবলাম, এইভাবে ডাকনাম ব্যবহার ঠিক না। নামটাকে কবিজনোচিত করতে হবে। নিজে নিজে ঠিক করলাম, আমার নাম রাখব ‘আনিস মিটুন’। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ময়মনসিংহ থেকে আমার একটা কবিতা বেরোল আনিস মিটুন নামে। সে জন্য ওই সময়ে কৃষিবিদেরা আমাকে এখনো আনিস মিটুন নামে ডাকেন। যেমন সরকারের সচিব হাসানুজ্জামান কল্লোল।
হেলাল ভাইয়ের ভালোবাসা পেয়েছিলাম লেখকজীবনের শুরুতে। এখনো সেই ভালোবাসার বন্ধন অটুট আছে। তিনি মেসেঞ্জারে বার্তা পাঠান: আনিস, কেমন আছ। মাঝেমধ্যে নিজেই ফোন করেন।
হেলাল ভাই একটা আশ্চর্য জীবন যাপন করছেন। বিয়ে করেননি। হোটেলে হোটেলে থেকে জীবন পার করে দিলেন। প্রেসক্লাবে গিয়ে দিনের বেলা তাস খেলেন। আর কিছু করেন না। সাক্ষাৎকারে যেসব কথা বলেন, তা ছাপানোর সাহস আমার নাই।
তো আমি কবিতা নিয়ে গেলাম হেলাল হাফিজ ভাইয়ের কাছে। কবিতার নিচে কবির নাম: আনিস মিটুন। হেলাল ভাই সেটা দেখে বললেন, আনিস, তোমার এত সুন্দর একটা নাম আছে। আনিসুল হক। তুমি এটা কেন ব্যবহার করবে না?
আমি বললাম, রংপুর শহরে ধাপ এলাকায় ছড়াকার আনিসুল হক থাকেন। আমি তাঁকে আনিস চাচা বলে ডাকি। কবি কায়সুল হকের ছোট ভাই। বিখ্যাত ছড়াকার। তাঁর ছড়ার বইয়ের নাম ‘আতা পাতা হা হা’। তাঁর ছড়া আছে: ‘ইকরি মিকরি চাম চিকরি, টাকার কাছে মাথা বিক্রি, আয় রে ভোঁদড় ফিরে চা, বুদ্ধিজীবী দেখে যা।’
হেলাল হাফিজ ভাই বললেন, তোমার আব্বা-আম্মা নাম রেখেছেন আনিসুল হক। তুমি কেন এটা ছাড়বে? ওই আনিসুল হকের কীর্তি তাঁর কাছে যাবে, তোমার কাজের ফল তোমার কাছে আসবে।
বলে তিনি আমার কবিতা ড্রয়ারে রাখলেন। পরে দেখলাম, ছাপা হয়েছে, কবির নাম আনিসুল হক। নিজের নামটা দেখে আমার নিজেরই এত ভালো লাগল। আমি এর পর থেকে আনিসুল হক নামেই লিখি। আমার নামকরণের জন্য আমি তাই হেলাল হাফিজ ভাইয়ের কাছে ঋণী। এই ঋণ আমি কোনো দিন শোধ করতে পারব না।
হেলাল ভাইয়ের কাছে আমরা কবিতা চাইতাম, ছোটকাগজে ছাপানোর জন্য। তিনি পুরোনো কতগুলো কবিতা দিলেন। তার মধ্যে একটা ছিল:
‘ভালোবেসে নাম দিয়েছি ”তনা”,
মন না দিলে ছোবল দিও তুলে বিষের ফণা।’
ত. না. কে, আশা করি আপনার বুঝছেন।
হেলাল হাফিজ ভাইয়ের সঙ্গে ময়মনসিংহে গেলাম। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে। কবিতা পড়তে। ওখানে গিয়ে দেখি, পশ্চিমবঙ্গ থেকে দুই কবি ঝোলা কাঁধে এসেছেন। ওদের ক্যানটিনে রাতের খাবার খাচ্ছি। ক্যানটিনের সেই বিখ্যাত তিন টাকার খিচুড়ি। এসব খেয়ে খেয়ে আমার পেটে চড়া পড়ে গেছে। কিন্তু দুই পশ্চিম বাংলার কবি খুবই মন দিয়ে তৃপ্তি করে খাচ্ছেন। হেলাল ভাই বললেন, আমাদের অতিথিদের আরও খিচুড়ি দাও। আর আমাদের বললেন, তাড়াহুড়া কোরো না। পশ্চিম বাংলা থেকে এসেছেন। ওরা একটু ভালোমন্দ খেতে পাচ্ছেন। খেতে থাকুন।
হেলাল ভাইয়ের চোখ তখনো জলে টলমল করত। তিনি কালো চশমা পরে থাকতেন। মাঝেমধ্যে চোখে ড্রপ দিতেন।
বইমেলায় হেলাল ভাই আসতেন। আমি আর হ্যাপি তাঁর সঙ্গে হাঁটতাম।
একদিন বললাম, না, আর বিখ্যাত কবির সঙ্গে হাঁটব না।
হেলাল ভাই খুব দুঃখ পেলেন। বললেন, আনিস, তুমি এই কথা বলতে পারলে?
আমি সরি বললাম। তারপর আবার তাঁর সঙ্গে হাঁটতে শুরু করলাম।
হেলাল ভাইয়ের ভালোবাসা পেয়েছিলাম লেখকজীবনের শুরুতে। এখনো সেই ভালোবাসার বন্ধন অটুট আছে। তিনি মেসেঞ্জারে বার্তা পাঠান: আনিস, কেমন আছ। মাঝেমধ্যে নিজেই ফোন করেন।
হেলাল ভাই একটা আশ্চর্য জীবন যাপন করছেন। বিয়ে করেননি। হোটেলে হোটেলে থেকে জীবন পার করে দিলেন। প্রেসক্লাবে গিয়ে দিনের বেলা তাস খেলেন। আর কিছু করেন না। সাক্ষাৎকারে যেসব কথা বলেন, তা ছাপানোর সাহস আমার নাই।
কিন্তু লোকটাকে আমি বড় ভালোবাসি। বুয়েটে একবার একটা বড় কবিতাপাঠের আসর করেছিলাম ১৯৮৯ সালে। শহীদ মিনারে আয়োজন। কবি শামসুর রাহমান এসেছেন, কবি নির্মলেন্দু গুণ এসেছেন। অনেক বড় বড় কবি এসেছেন। আমি পাঠ করলাম ‘খোলা চিঠি সুন্দরের কাছে’। ৫ পৃষ্ঠার দীর্ঘ কবিতা। এক পৃষ্ঠা পড়ে বললাম, আর পড়ব না, অনেক বড়। দর্শকেরা চিৎকার করে উঠলেন, না না, পড়ো পড়ো। পুরোটা পড়তে হলো।
সেই অনুষ্ঠানে এসে হেলাল হাফিজ ভাই বললেন, আমি তো আমার বই আনিনি। আমি বললাম, কোনো অসুবিধা নাই। মাইকে ঘোষণা দিলাম, আমি জানি, আপনাদের কাছে ‘যে জলে আগুন জ্বলে’ আছে। কেউ কি রুম থেকে এনে দেবেন। সত্যি সত্যি একজন বইটা হল থেকে এনে দিলেন।
হেলাল ভাইয়ের সঙ্গে দেখা হয়েছিল ‘সমকাল’ সম্পাদক সারওয়ার ভাইয়ের জন্মদিনের অনুষ্ঠানে। তাঁকে জড়িয়ে ধরলাম। এখনো মনে হয়, আমি সেই ২২ বছরের তরুণ, হেলাল হাফিজ ভাইয়ের হাত ধরে বইমেলায় হাঁটছি। নিজেকে খুব ভাগ্যবান বলে মনে হয়। না চাহিতেই বড় মানুষদের অনেক বেশি ভালোবাসা এই জীবনে পেয়ে আসছি।
হেলাল ভাইয়ের ‘নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়’ কবিতাটা কিন্তু আমি মিছিলে হাঁটার সময় বারবার করে বলি:
‘এখন যৌবন যার মিছিলে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়
এখন যৌবন যার যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়
মিছিলের সব হাত
কণ্ঠ
পা এক নয়।
সেখানে সংসারী থাকে, সংসার বিরাগী থাকে,
কেউ আসে রাজপথে সাজাতে সংসার।
কেউ আসে জ্বালিয়ে বা জ্বালাতে সংসার
শাশ্বত শান্তির যারা তারাও যুদ্ধে আসে
অবশ্য আসতে হয় মাঝেমধ্যে
অস্তিত্বের প্রগাঢ় আহ্বানে,
কেউ আবার যুদ্ধবাজ হয়ে যায় মোহরের প্রিয় প্রলোভনে
কোনো কোনো প্রেম আছে প্রেমিককে খুনি হতে হয়।
যদি কেউ ভালোবেসে খুনি হতে চান
তাই হয়ে যান
উৎকৃষ্ট সময় কিন্তু আজ বয়ে যায়।
এখন যৌবন যার মিছিলে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়।