আনিসুল হকের মঙ্গলবারের লেখা
লেখকদের নিয়ে যত ঘটনা-৯: শামসুর রাহমানের কাছে যাই
কবি ও কথাসাহিত্যিক আনিসুল হক ঢাকা শহরে এসেছিলেন আশির দশকে রংপুর থেকে, পণ করেছিলেন লেখক হবেন। প্রখ্যাত লেখকদের অনেক মজার ঘটনার তিনি সাক্ষী। এই নিয়মিত কলামে তিনি বিখ্যাত মানুষদের জীবনের মজার ঘটনাগুলোর স্মৃতিচারণা করবেন। অন্য আলো ডটকমে এটি প্রতি মঙ্গলবার প্রকাশিত হচ্ছে।
শামসুর রাহমানের কবিতার বই প্রথম হাতে পাই যখন, তখন ক্লাস এইট/নাইনে পড়ি। দুটো বই পেয়েছিলাম, ‘দুঃসময়ে মুখোমুখি’ আর ‘বন্দিশিবির থেকে’। ‘দুঃসময়ে মুখোমুখি’ বইয়ের নাম কবিতাটা খুবই প্রিয় হয়ে উঠল। পড়তে পড়তে প্রায় মুখস্থ করে ফেললাম।
‘বাচ্চু তুমি, বাচ্চু তুই, চলে যাও, চলে যা, সেখানে
ছেচল্লিশ মাহুৎটুলীর খোলা ছাদে। আমি ব্যস্ত, বড় ব্যস্ত
এখন তোমার সঙ্গে, তোর সঙ্গে বাক্যালাপ করার মতন
একটুও সময় নেই। কেন তুই মিছেমিছি এখানে দাঁড়িয়ে
কষ্ট পাবি বল?’
বাচ্চু শামসুর রাহমানের ডাকনাম। নিজের শৈশবের সঙ্গে কথা বলছেন প্রৌঢ় কবি। চমৎকার কবিতা।
‘বন্দিশিবির থেকে’ বইয়ের শুরুতে একটা চমৎকার ভূমিকা ছিল। অযত্নে বেড়ে ওঠা সবুজ ঘাসের বুকে উঠোনে বসে আছে একটা আয়েশি বিড়াল। তার পাশে পাড়াতলী গ্রামে শামসুর রাহমান এক বৈঠকে লিখে ফেললেন যমজ কবিতা, ‘তোমাকে পাওয়ার জন্যে, হে স্বাধীনতা’ আর ‘স্বাধীনতা তুমি’। ‘রাস্তার ধারে একজন গুলিবিদ্ধ মানুষ নিজের রক্ত দিয়ে লিখেছেন স্লোগান, তাঁর দেশের সপক্ষে, দেশবাসীর সপক্ষে। এই ছবি উজ্জ্বল উদ্ধার হয়ে ফিরে এল আমার কাছে, ফিরে এল বারবার।...একাত্তরের এপ্রিল মাসের গোড়ার দিকে আমাদের গ্রামে এক দুপুরে লিখে ফেললাম “স্বাধীনতা তুমি” ও “তোমাকে পাওয়ার জন্য, হে স্বাধীনতা” কবিতা দুটি।’
আমাকে কবি হতে হবে, এই পণ করে এসেছি ঢাকায়। শামসুর রাহমানকে বলা হয় বাংলা ভাষার প্রধান কবি। কাজেই শামসুর রাহমানের কাছে যেতে হবে, তাঁর সঙ্গে পরিচিত হতে হবে, এই বাসনা তো ছিলই। কবে প্রথম তাঁকে কাছ থেকে দেখেছিলাম, কবে প্রথম তাঁর সঙ্গে গল্প করেছিলাম, এটা আর মনে নেই। শুধু মনে আছে, একদিন আমি গল্প করছিলাম দু–একজনের সামনে, বলছিলাম, ‘দেখেন, আমি নিজে থেকে কখনো কোনো বড় কবি বা লেখকের কাছে যাইনি। তাঁরা আমার লেখা পড়ে আমার সম্পর্কে আগ্রহ দেখিয়েছেন, জানতে চেয়েছেন, আনিসুল হক ছেলেটা কে, তারপর আমি তাঁর সঙ্গে দেখা করেছি। শামসুর রাহমানের সঙ্গেও তাই।’ আমার সামনে ছিলেন আমার এক বড় ভাই। সম্ভবত বুয়েটের বড় ভাই। যাঁর প্রজ্ঞা ও পর্যবেক্ষণকে আমি শ্রদ্ধা করি। তিনি আমার এই বেয়াদব-মার্কা কথা শুনে বললেন, ‘আনিস, তুমি এটা খুব খারাপ একটা কথা বললে। আমি তোমার সিনিয়র হিসেবে একটা উপদেশ কি দিতে পারি?
কখনো এই ধরনের অহংকারী কথা বলবে না! কেন তুমি তোমার সিনিয়র লেখকদের কাছে নিজে যেচে যাবে না? কেন একজন বড় মানুষ বা বড় লেখকের কাছে স্ব উদ্যোগে গিয়ে দেখা করবে না, পরিচিত হবে না? আমি নিজে থেকে যাই না, তাঁরা আমাকে ডেকে নেন, এর চেয়ে উদ্ধত কথা এবং ভুল অ্যাপ্রোচ আর কিছু্ই হতে পারে না।’ আমি এই বড় ভাইয়ের কথা মনে রেখেছি, আমৃত্যু মনে রাখব। যেকোনো গুণী মানুষের কাছে, শুধু গুণী মানুষই–বা বলি কেন, যেকোনো মানুষের কাছে স্বেচ্ছায় যেতে, যেচে গিয়ে পরিচিত হতে আমার আর বাধে না। বাস্তব পরিস্থিতিতে সংকোচ বোধ করার কথা হচ্ছে না, কিন্তু আমি যাব না, তিনিই আসবেন বা ডাকবেন, এই মনোভাব আমার একদমই নেই। আমি নিজে যেচে মানুষের কাছে যাই। কথা বলি। আমার চেষ্টা থাকে, বেয়াদবি না করার। নিজেকে উদ্ধত, দুর্বিনীত হিসেবে প্রতিপন্ন করার চেষ্টা না করার। ‘রাগী তরুণের’ তকমা আমি গায়ে লাগাতে চাইনি।
বুয়েটে ফার্স্ট ইয়ারে ভর্তি হয়ে শহীদ স্মৃতি হলে থাকি। রুম নম্বর ১২০৫। আমার বিপরীত দিকে থাকে আমার বন্ধু মুনসুর। তার কাছে আসেন মোজাম্মেল বাবু। জাতীয় ছাত্রলীগে ওদের ভেড়াতে চান। তিনি মুনসুরকে দিয়েছেন তাঁর আর জাহাঙ্গীর সাত্তার টিংকু (ঢাকা মেডিকেলের জাতীয় ছাত্রলীগ নেতা) সম্পাদিত ‘স্পর্শ’। আর দিয়েছেন নিজের লেখা কবিতার বই ‘কিশোরীর ঠোঁটে সূর্যাস্ত’। আমি বলি, আরে, এই রকম একটা কবি-সম্পাদক আমার কাছে না এসে মুনসুরের কাছে আসে কেন? আমার সঙ্গে বাবু ভাইয়ের দেখা হওয়ামাত্র আমি কঠিন জার্গন দিয়ে রাজনৈতিক কথা বলতে শুরু করলাম।
আমি বললাম, আচ্ছা বাবু ভাই, ছাত্রলীগ যে পোস্টারে লিখছে জয় সমাজতন্ত্র, এটা কি তারা ঠিক লিখছে? আওয়ামী লীগ কি আসলে একটা ওয়েলফেয়ার স্টেট বা কল্যাণরাষ্ট্র চায় না? তাদের আদর্শ কি সুইডেন সুইজারল্যান্ড নরওয়ের মতো দেশগুলো নয়?
এই এক কথাতেই কাজ হলো। বাবু ভাই ঠিক করলেন, মিটুনকে জাতীয় ছাত্রলীগে নিতে হবে। তিনি আমার রুমে এসে আমার বিছানায় শুয়ে পড়লেন। প্রথমে বললেন, তুই একটা কাগজ বের কর। কাগজের নামই হবে কাগজ। আমি, খাজা সাহান, শাহিন হাসান এটা বের করতে শুরু করলাম। বাবু ভাই শাকুর মজিদকেও এর সঙ্গে ভেড়ানোর চেষ্টা করলেন। ব্যস, ওই কাগজ করতে করতে বাবু ভাই আমাকে জাতীয় ছাত্রলীগে ভিড়িয়ে ফেললেন। তত দিনে শহীদ স্মৃতি হলে আমাদের বন্ধুদের একটা বিরাট গ্রুপ তৈরি হয়ে গেছে। তাজুল, মিঠু, হেলাল, মতিউর...২০–২২ জন একসঙ্গে চলি, একসঙ্গে খাই। এরা কেউ কোনো দিন রাজনীতি করেনি। এদের সবাইকে বললাম, জাতীয় ছাত্রলীগে শহীদ স্মৃতি হল কমিটিতে জয়েন করতে হবে। ওরা বলল, তুমি বলছ, করব।
কিন্তু কেউ স্টেজে উঠতে পারব না। বাবু ভাইকে বললাম, এরা তো মঞ্চে উঠবে না। বাবু ভাই বললেন, কোনো অসুবিধা নেই, আমরা তানভীর মোকাম্মেলের ‘হুলিয়া’ ছবি দেখাব। মোরশেদুল ইসলামের ‘আগামী’ দেখাব। আর শেষে স্লাইডে কমিটির নাম দেখাব। এইভাবে আমাদের সম্মেলন হলো। আমার বন্ধুরা আমার মুখের দিকে তাকিয়ে জাতীয় ছাত্রলীগে যোগ দিল।
আমি বাবু ভাই, টিংকু ভাই, কবি মিনার মনসুর ভাই, কবি মুহাম্মদ সামাদ ভাই, কবি তারিক সুজাত, আবৃত্তিকার শিমুল মুস্তাফা—এদের সঙ্গে জড়িয়ে পড়লাম—কবিতা এবং রাজনীতি মিলেমিশে যেতে লাগল। স্থপতি আলমগীর কবির ‘দেশবন্ধু’ নামে একটা ‘ব্রডশিট’ সাপ্তাহিক কাগজ বের করতেন। কবি মিনার মনসুর ছিলেন তাঁর দায়িত্বে। ‘যায়যায়দিন’ নিষিদ্ধ হয়ে গেলে মোজাম্মেল বাবু ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক হিসেবে ম্যাগাজিন আকারে বের করতে শুরু করলেন ‘দেশবন্ধু’। ১৯৮৭ সালের নভেম্বর থেকে ১৯৮৮ সালের জানুয়ারি ১০টা সংখ্যা ‘দেশবন্ধু’ বেরিয়েছিল। প্রচ্ছদে থাকত শিশির ভট্টাচার্য্যের কার্টুন। মোজাম্মেল বাবু ভাইয়ের সঙ্গে শিশির ভট্টাচার্য্যের কাঁঠালবাগানের বাড়ি যাওয়া হলো সেই উপলক্ষেই। ‘দেশবন্ধু’র অফিস ছিল স্টেডিয়ামের দোতলায়। সেখানে আসত তারিক সুজাত, কাফি বিল্লাহ, লুৎফুল হোসেন (বাবু), সামিয়া জামান। ইউসুফ হাসান ভাই ছিলেন প্রধান শিল্পী। লিখতেন বিভুরঞ্জন সরকার, নিতাই দাশদা। ওই পত্রিকার জন্য কলাম লিখতেন শামসুর রাহমান। হুমায়ুন আজাদ। প্রথম সংখ্যার প্রচ্ছদ কাহিনি ছিল ডেডলাইন ১০ নভেম্বর। এই সেই ১০ নভেম্বর, নূর হোসেন যেদিন শহীদ হলেন।
শামসুর রাহমানের কবিতা, ‘বুক তার বাংলাদেশের হৃদয়’ সম্ভবত ‘দেশবন্ধু’ পত্রিকাতেই প্রথম ছাপা হয়েছিল। অথবা আরেকটা কবিতা, যেটা শামসুর রাহমান নূর হোসেনকে নিয়ে লিখেছিলেন।
এই কাগজে কাজ করতে গিয়েই সম্ভবত শামসুর রাহমানের বাসাতে যাতায়াত শুরু করলাম। হয়তো বাবু ভাই নিয়ে গিয়েছিলেন। তারিক সুজাতের সঙ্গে শামসুর রাহমানের আগে থেকেই খাতির ছিল। ’৮৭ সালেই শুরু হয়ে গেল জাতীয় কবিতা উৎসব। আমি জাতীয় কবিতা উৎসবের বুলেটিনের পুরো লেখা নিজেই লিখেছিলাম। হুমায়ুন আজাদ আমার লেখা এডিট করলেন। একটা বানান ভুল কি না যাচাই করতে অভিধান দেখলেন। নিরন্ন। তিনি দেখলেন, মূর্ধন্য হবে কি হবে না। আমি হুমায়ুন আজাদ স্যারের বাসায় কবিতা পরিষদের বুলেটিনের কাজে প্রায়ই যেতাম।
কবিতা উৎসব এক ভীষণ ব্যাপার। টিএসসির দোতলায় অফিস। গমগম করছে। বড় বড় কবিরা আসছেন। শামসুর রাহমান আসছেন। তাঁকে মাইক্রোবাসে বাসায় পৌঁছে দিতে হবে। কে যাবে? এই সুযোগ কি ছাড়া যায়? আমি সেই মাইক্রোবাসে উঠে পড়লাম।
ঠিক করলাম, বুয়েটে কবিতাপাঠের আসর করব। শামসুর রাহমান, নির্মলেন্দু গুণ, মহাদেব সাহা থেকে শুরু করে হেলাল হাফিজ—সবাইকে আনব। বুয়েটের ক্যাফেটেরিয়ার দোতলায় সুন্দর একটা হল ছিল। সেখানে আয়োজন করলাম সেই কবিতাপাঠের আসর। নাম ‘প্রিয় ফুল খেলবার দিন নয় অদ্য’। আয়োজক জাতীয় কবিতা পরিষদ বুয়েট শাখা। শামসুর রাহমান এসেছিলেন। বড় বড় কবিরা এসেছিলেন।
শামসুর রাহমান ছিলেন অত্যন্ত নম্র, ভদ্র, মিতভাষী। কোনো কথা যখন শুনতেন, হাঁ করে শুনতেন, আর এমনভাব করতেন, এত সুন্দর কথা তিনি এর আগে শোনেননি। ভাব করতেন, তিনি কিছুই জানেন না, এইমাত্র বক্তার কথা শুনে তিনি জানছেন। এমন বিনয়ী মানুষ আমি আর কখনো দেখিনি।কিন্তু কবিতা বিষয়ে তাঁর অহংকার ছিল। ঈর্ষাও ছিল। তিনি বলতেন, খবরদার, কখনো বলবেন না, আমার কবিতা কিছু হয় না। বললে লোকে বলবে, ও নিজেই বলে, ওর কবিতা হয় না। তার মানে হয়ই না। বিনয় করবেন না।
এরপর আস্তে আস্তে শামসুর রাহমানের সঙ্গে আমার একধরনের খাতিরই হয়ে গেল। বাসায় যেতাম। তাঁর পুত্রবধূ টিয়া রাহমান আমাকে বিশেষ রকমের স্নেহ করতেন। এর কারণ, তত দিনে আমার লেখা প্রকাশ হতে শুরু করেছে, আমিও একটুখানি পরিচিতি অর্জন করে ফেলেছি। শামসুর রাহমান হয়তো সেই খোঁজ রাখতেন না, টিয়া রাখতেন। একবার সন্দেশ নিয়ে গিয়েছিলাম, টিয়া বললেন, বাবার তো ডায়াবেটিস। ক্লিনটন বি সিলির ‘আ পোয়েট অ্যাপার্ট’ বেরোলে শামসুর রাহমানের জন্য কিনে নিয়ে গিয়েছিলাম শ্যামলীর বাড়িতে।
শামসুর রাহমানের একটি ‘মোনাজাতের খসড়া’ বেরিয়েছিল ‘ইত্তেফাক’–এ। সঙ্গে সঙ্গে মহা হইচই পড়ে গিয়েছিল।
‘হে রাব্বুল আলামীন,
হে লৌকিক, পারলৌকিক আর অলৌকিকের রাজাধিরাজ,
আমার একটি সামান্য ইচ্ছাপূরণের আশায়
আজ আমি আপনার জ্বলজ্বলে পুণ্য আরশ লক্ষ্য ক'রে
সেজদা দিয়েছি। আশৈশব শুনে আসছি,
এই জগৎ সংসারে, সৌরলোকে, আমাদের অজ্ঞাতলোকে
এমন কিছুই ঘটে না, হে রাহমানুর রাহিম,
যাতে আপনার সায় নেই। কুল মখলুকাতে
হাওয়া বয় না, নদীতে ঢেউ জাগে না, মাটি ফুঁড়ে
উদ্ভাসিত হয় না শস্যরাশি,
বাঁশিতে সুর মঞ্জরিত হয় না,
গান গায় না পাখি,
মায় একটি গাছের পাতাও নড়ে না
আপনার হুকুম ছাড়া।
হে দ্বীন ও দুনিয়ার মালিক, চোখের পলকে,
হে সর্বশক্তিমান, আপনি আমাকে
এমন তৌফিক দিন যাতে আমি
আপাদমস্তক মনেপ্রাণে একজন খাস রাজাকার
হয়ে যেতে পারি রাতারাতি। তাহলেই আমি সাততাড়াতাড়ি
মঞ্জিলে মকসুদে পৌঁছে যাব, এই চর্মচক্ষে
দেখে নেবো হাতিশালে হাতি আর
ঘোড়াশালে ঘোড়া আর আমার হাতে আমলকীর মতো
এসে যাবে সব পেয়েছির দেশের সওগাত।
তবে সে জন্যে দাঁত কেলিয়ে হাসতে হবে, হাত
কচলাতে হবে অষ্টপ্রহর আর জহরতের মতো
পায়ের চকচকে জুতোয় চুমো খেতে হবে নানা ছুতোয় সকাল–সন্ধ্যা
এবং মাঝে মাঝে শিন্নি দিতে হবে পীরের দরগায়।...’
‘যায়যায়দিন’–এ আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী ‘একটি মোনাজাতের খসড়া’র জবাব লিখেছিলেন।
শামসুর রাহমান ‘দৈনিক বাংলা’ ও ‘বিচিত্রা’র প্রধান সম্পাদকের পদ থেকে ইস্তফা দিয়েছিলেন এরশাদ সরকারের অগণতান্ত্রিক কাজকর্মের প্রতিবাদ হিসেবে। সেই পদত্যাগপত্র আমরা ‘দেশবন্ধু’ পত্রিকায় ছেপে দিয়েছিলাম।
‘দেশবন্ধু’ পত্রিকা নিষিদ্ধ হয়ে গেল। শামসুর রাহমান সাপ্তাহিক ‘“দেশবন্ধু” নিষিদ্ধের পর’ নামে একটা কবিতা লিখেছিলেন। আমার একটা কাব্য-উপন্যাস আছে, ‘নক্ষত্রের পানে চেয়ে বেদনার পানে’। কণ্ঠশীলন এটা মঞ্চে এনেছিল। উদ্বোধন করেছিলেন শামসুর রাহমান। ফেরার পথে তাঁর সঙ্গে গাড়িতে ছিলেন জাদুশিল্পী জুয়েল আইচ। শামসুর রাহমান ফিরে গিয়ে একটা কবিতা লিখেছিলেন এই আবৃত্তি-অনুষ্ঠান দেখা এবং জুয়েল আইচের সঙ্গে ফেরার অভিজ্ঞতা নিয়ে।
একবার তাঁর কাছে একটা লেখা এনেছিলাম পাখির ওপরে। একটা ক্যালেন্ডারের প্রথম পৃষ্ঠায় ছাপানোর জন্য। ছোট লেখা। এই জন্য তাঁকে ৫ হাজার টাকা দিতে গেলাম আমি আর হুমায়ূন রেজা। তিনি বললেন, এর আগে রামেন্দু মজুমদার একটা ক্যালেন্ডারের লেখার জন্য ২০ হাজার টাকা দিয়েছেন। শুনে লজ্জা পেলাম। পরে আরও ১০ হাজার টাকা নিয়ে গেলাম তাঁর বাসায়। তিনি বললেন, কিসের টাকা। বললাম, ওই যে ক্যালেন্ডারের লেখা...তিনি বললেন, আমার কিছু মনে নেই তো!
তাঁর বাসায় গেলে তিনি জিজ্ঞাসা করতেন, চা খাবেন। আরও কিছুক্ষণ থাকবার লোভে বলতাম, হ্যাঁ।
গল্প করতাম। তাঁর দোতলার শোবার ঘরে দেখতাম আমার কবিতার বইটা আছে কি না। ‘খোলা চিঠি সুন্দরের কাছে’ পড়ে তিনি দু–একজনের কাছে প্রশংসা করেছিলেন। তাঁর সঙ্গে গল্প করবার সময় বিভিন্ন কবির কবিতা থেকে মুখস্থ বললে তিনি বিস্মিত হয়ে বলতেন, আপনার স্মৃতিশক্তি এত ভালো! সব মুখস্থ রাখতে পারেন। আমি পারি না।
শামসুর রাহমানকে সবাই রাহমান ভাই বলত। আমিও বলতাম। তিনি বলতেন আপনি করে। শুধু বেলাল চৌধুরী তাঁকে ডাকতেন স্যার। আর বোধ হয় কবি মারুফ রায়হানকে রাহমান ভাই তুমি করে বলতেন!
শামসুর রাহমানের চোখে গ্লুকোমা হলো। তখন একটা লেখা লিখলাম সাপ্তাহিক ‘খবরের কাগজ’–এ। চোখের জ্যোতি নিভে যাচ্ছে কবি শামসুর রাহমানের। এই লেখাও পাঠকদের নাড়িয়ে দিল। রাহমান ভাই বললেন, কী লিখেছেন, সবাই তো ফোন করে করে খোঁজ নিচ্ছে। তখন জ ই মামুন আর অনু একটা চিঠি লিখলেন। তাঁরা শামসুর রাহমানকে চোখ দান করতে চান। মামুন তখন ‘খবরের কাগজ’–এর বিপণন বিভাগে কাজ করতেন। লেখা পড়ে মুগ্ধ হয়ে তাঁকে ডেকে আমি বললাম, এত ভালো যিনি লেখেন, তিনি কেন বিপণনে কাজ করবেন। আপনি সাংবাদিকতায় আসুন। জ ই মামুনের সাংবাদিকতায় আসার সেটাই সূত্র।
‘প্রথম আলো’ শুরুর আগেই আমরা সিএ ভবনের ১১তলার মিলনায়তনে লেখক-সুধী সমাবেশ করেছিলাম। শামসুর রাহমান অবশ্যই তাতে ছিলেন উপস্থিত। ‘প্রথম আলো’র প্রথম সংখ্যাতে তাঁর লেখা ছিল।
বেলাল চৌধুরী বলেছিলেন, শামসুর রাহমান আমাদের সুদর্শনতম কবি। আমাদের প্রধান কবি সুদর্শন হবেন, এটাই স্বাভাবিক। শামসুর রাহমান ছিলেন অত্যন্ত নম্র, ভদ্র, মিতভাষী। কোনো কথা যখন শুনতেন, হাঁ করে শুনতেন, আর এমনভাব করতেন, এত সুন্দর কথা তিনি এর আগে শোনেননি। ভাব করতেন, তিনি কিছুই জানেন না, এইমাত্র বক্তার কথা শুনে তিনি জানছেন। এমন বিনয়ী মানুষ আমি আর কখনো দেখিনি।
কিন্তু কবিতা বিষয়ে তাঁর অহংকার ছিল। ঈর্ষাও ছিল। তিনি বলতেন, খবরদার, কখনো বলবেন না, আমার কবিতা কিছু হয় না। বললে লোকে বলবে, ও নিজেই বলে, ওর কবিতা হয় না। তার মানে হয়ই না। বিনয় করবেন না।
বইমেলায় একদিন তিনি এসেছেন। স্বভাবতই আমি তাঁর সঙ্গে হাঁটতে লাগলাম। তাঁর নতুন কবিতার বই কিনে তাঁর কাছে অটোগ্রাফ নিলাম। এই সময় এক তরুণী রবীন্দ্রনাথের বই এনে বলল, একটা অটোগ্রাফ দেবেন।
শামসুর রাহমান বললেন, রবীন্দ্রনাথের বইয়ে আমি কীভাবে অটোগ্রাফ দেব। আমার বই কিনে আনুন। আমি অটোগ্রাফ দেব। অন্য কোনো লেখকের বইয়ে আমি অটোগ্রাফ দিতে পারি না।
তরুণী কাতর কণ্ঠে বলল, এটা তো রবীন্দ্রনাথের।
শামসুর রাহমান বললেন, হ্যাঁ। কিন্তু এটা আমার না।
শামসুর রাহমান অসুস্থ হয়ে পিজি হাসপাতালে ভর্তি হলেন। তাঁকে দেখতে যেতাম। তিনি অচেতন ছিলেন। তারপর তিনি মর্ত্যলোক ছেড়ে চলে গেলেন অমরত্বের দিকে।
তাঁর সম্পর্কে আমি একবার লিখেছিলাম, শামসুর রাহমান আমাদের সবচেয়ে মিস আন্ডারস্টুড পোয়েট। আমরা তাঁকে ভুল বুঝেছি। আমাদের ধারণা, তিনি শুধু সমকালীন রাজনৈতিক বিষয় নিয়ে কবিতা লিখে গেছেন। শামসুর রাহমানের প্রথম কবিতার বই ‘প্রথম গান, দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে’। তাঁর পূর্বলেখ কবিতায় তিনি লিখেছিলেন:
‘মনে হয় আমি যেন সেই লোকশ্রুত ল্যাজারস
তিন দিন ছিলাম কবরে, মৃত-পুনর্জীবনের
মায়াস্পর্শে আবার এসেছি ফিরে পৃথিবীর রোদে।
...
মাঝে মাঝে কৃষ্ণকায় বিকট পাখির লৌহচঞ্চু
মাংস ছিঁড়ে নিতে আসে—আমি তাকে পারি না ফেরাতে।
আর চেয়ে দেখি মৃত্তিকায় করোটিতে জ্যোৎস্না জ্বলে
বিষণ্ন স্মৃতির মতো, দ্বিতীয় মৃত্যুর ধ্বনি ভাসে।’
প্রথমবার মৃত্যুর পর জেগে, ল্যাজারস, এই পৃথিবী, এই সাবেকি পৃথিবীকে দেখছে। করোটিতে জ্যোৎস্না জ্বলছে। দ্বিতীয় মৃত্যুর ধ্বনি ভেসে আসছে। এই ইমেজ একজন কবি তাঁর প্রথম বইয়ের পূর্বলেখে লিখে গেছেন। কতটা শক্তিমান হলে এটা করা সম্ভব!
আমরা তাঁর সেই অসাধারণ কীর্তিগাথা যেন পাঠ করি, এর সৌন্দর্য অনুভব করি।