বিজয় দিবসে একটাই প্রশ্ন: দেশে কি গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবে?

আজ থেকে ঠিক ১৭ বছর আগে ২০০৮ সালের ১৬ ডিসেম্বর তারিখে মহান বিজয় দিবস উপলক্ষে প্রকাশিত প্রথম আলোর বিশেষ আয়োজনে তৎকালীন সমাজ-রাজনীতিক বাস্তবতার নিরিখে মুহাম্মদ হাবিবুর রহমানের মন্তব্য প্রতিবেদনটি প্রথম ছাপা হয়েছিল। আমাদের বহু মূল্যবান লেখা শুধু মুদ্রণের পাতায় রয়ে গেছে; তেমনি একটি এই ‘বিজয় দিবসে একটাই প্রশ্ন: দেশে কি গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবে?’। তবে দীর্ঘদিন কেবল ছাপার পাতায় সীমাবদ্ধ থাকা এই লেখা বিজয়ের মাসে অনলাইনে উঠে এল নতুন পাঠকদের সামনে।

বিজয় দিবস ও মুক্তিযুদ্ধকে কেন্দ্র করে অনলাইনপূর্ব যুগে যত লেখা, সাক্ষাৎকার, স্মৃতিচারণ ও কবিতা ছাপা হয়েছিল, বিজয়ের পুরো মাসজুড়ে সেসব ধুলোঝরা পৃষ্ঠা আমরা প্রথমবারের মতো অনলাইনে তুলে আনছি।

গ্রাফিকস: প্রথম আলো

পৃথিবীতে যত তন্ত্রমন্ত্র আছে, তার মধ্যে গণতন্ত্র এখন সবচেয়ে পাঙ্ক্তেয় শব্দ। তবে স্বৈরতন্ত্রীদের হাতে গণতন্ত্রের নানা রকম ধোলাইপাখলাই হয়েছে। নানাবিধ বিশেষণে গণতন্ত্র বিশেষিত হয়েছে। আমরা বনিয়াদি গণতন্ত্র দেখেছিলাম গত শতাব্দীর ষাটের দশকে। আজকে গণতন্ত্রের কথা না বললে কোনো দেশের কোনো শাসকের পক্ষে জগৎসভায় কল্কে পাওয়া বড় মুশকিল।

চীনের কমিউনিস্ট পার্টির সপ্তদশ কংগ্রেসে সংবাদ প্রতিষ্ঠান সিনহুয়া খবর দিয়েছিল পার্টি চেয়ারম্যান ষাটবার গণতন্ত্রের নাম নেন।

আমাদের বাংলাদেশে আমরা সবাই গণতন্ত্র চাই। গণতন্ত্রের নামাবলি বুকে লিখে কেমন করে নূর হোসেন গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গেলেন, আমাদের কোনো সাংবাদিক বন্ধু নিবিড় গবেষণা করে আমাদের সামনে সেই হৃদয়বিদারক ঘটনাটির সব কথা উদ্ঘাটন করলেন না। সে কোন ব্যক্তি এবং কার হুকুম পেয়ে কে গুলি করেছিল? আমাদের দেশে দোষ স্বীকার করার ঐতিহ্য নেই। আল্লাহর কাছে তওবা করা অনেক বেশি সহজ, হয়তো অধিকতর স্বস্তিদায়ক।

আজ নতুন পৃথিবী উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকা বলতে গেলে এমন একটি গণতন্ত্রের গোলার্ধ, যেখানে আপাতদৃষ্টে মনে হয় গণতন্ত্র বেশ ভালোই মাটিতে শিকড় প্রবেশ করিয়েছে। আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্যে গণতন্ত্র এখনো সংগ্রামরত।

মানুষ নিপীড়নের পরিবর্তে স্বাধীনতা চায়। এ কথাটা আপ্তবাক্যের মতো শোনায়। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া স্বাধীনতার কথা বলে, কিন্তু স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দান করে না। গণতন্ত্রের আদর্শটা বেশ দীর্ঘজীবীই বলতে হবে, কিন্তু এর স্বাস্থ্য ও সাফল্য প্রায়ই অনিশ্চিত। আমরা নিজেদের অক্ষমতা ঢেকে রাখার জন্য প্রায়ই বলি দেশে গণতন্ত্রকে সুযোগ দেওয়া হয়নি। গণতন্ত্রের নিজস্ব কোনো অবয়ব বা প্রাণ নেই। গণতন্ত্র স্বয়ংক্রিয় নয়। এর ভেতরে একটা তারল্য রয়েছে, যে পাত্রে অবস্থান করে সে তার আকার পায়। হুজ্জতে বাঙালের দেশে গণতন্ত্র যে কী ভঙ্গুর হতে পারে, তার নিদর্শন আমাদের চোখের সামনে ভাসছে। ব্যাংকে আগুন জ্বালিয়ে, রিকশাওয়ালাকে জীবন্ত দগ্ধ করে, যত্রতত্র বোমা ফাটিয়ে, পটকাবাজি করে এবং বাসে বারুদ ছড়িয়ে দিয়ে আগুন জ্বালিয়ে দলীয় নন্দিভৃঙ্গিরা গণতন্ত্র উদ্ধার করতে পারেনি, অত্যন্ত স্বল্পকালের জন্য ক্ষমতায় আরোহণ করে দ্রুত তাদের পদস্খলন ঘটেছে মাত্র।

গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া স্বাধীনতার কথা বলে, কিন্তু স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দান করে না। গণতন্ত্রের আদর্শটা বেশ দীর্ঘজীবীই বলতে হবে, কিন্তু এর স্বাস্থ্য ও সাফল্য প্রায়ই অনিশ্চিত। গণতন্ত্রের নিজস্ব কোনো অবয়ব বা প্রাণ নেই। গণতন্ত্র স্বয়ংক্রিয় নয়। এর ভেতরে একটা তারল্য রয়েছে, যে পাত্রে অবস্থান করে সে তার আকার পায়।

ঐতিহাসিকেরা ঊনবিংশ শতাব্দীতে যে গণতন্ত্রের তরঙ্গের দেখা পান, তার মধ্যে মোট তিনটি প্রধান উত্থান-পতন ঘটেছে। ঊনবিংশ শতাব্দীর গোড়া থেকে বিংশ শতাব্দীর বিশ শতক পর্যন্ত আমরা প্রায় ২৯টি গণতন্ত্রের দেখা পাই। ১৯২২ সালের দিকেই সেই গণতন্ত্রের তরঙ্গে ভাটা দেখা দেয়। গণতন্ত্রের সোপানে আরোহণ করেই ফ্যাসিজম ও নাৎসিজমের জন্ম। ১৯৪২ সালে বিশ্বে গণতন্ত্রের সংখ্যা ১২-তে নেমে আসে।

দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে মিত্রশক্তির জয়ের মধ্য দিয়ে গণতন্ত্রের দ্বিতীয় জোয়ার দেখা যায়। ১৯৬২ সালের মধ্যে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের সংখ্যা বৃদ্ধি পায় ৩৬-এ। আবার ভাটায় সত্তরের দশকে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের সংখ্যা নেমে আসে ৩০-এ। ১৯৭৪ সালের দিকে স্মরণকালের তৃতীয় জোয়ারে আরও ৩০টি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের অভ্যুদয় ঘটে। এই জোয়ার আবার ভাটায় নামতে পারে। মধ্য একবিংশ শতাব্দীতে কয়টি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র বেঁচে থাকবে, তার ওপর সাহস করে কে বাজি ধরবে? অর্থনৈতিক সংকটে গণতন্ত্র হারিয়ে যেতে পারে। গণতন্ত্র আত্মহত্যাও করতে পারে। সংকটকাল থেকে যেসব দেশ সংশোধনের চেষ্টা না করে বিভাময় নেতার পেছনে ঘোরে, সেখানে গণতন্ত্র তো মৃত্যুপথযাত্রী।

১১ জানুয়ারি ২০০৭ বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি তত্ত্বাবধায়ক সরকারে তাঁর প্রধান উপদেষ্টা পদে ইস্তফা দেন। রাত ১১টায় জাতির উদ্দেশে রাষ্ট্রপতি এক ভাষণে বলেন, ‘আমি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের স্বার্থে পদত্যাগ করছি। আমাদের প্রায় প্রতিটি সিদ্ধান্ত ও পদক্ষেপ রাজনৈতিক দলসমূহ কর্তৃক সমাদৃত হয়নি।...৯০ দিন সময়সীমার মধ্যে একটি নির্ভুল ভোটার তালিকা প্রণয়ন করে অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও সকলের নিকট গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্ভব নয়।’

২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি দেশে জারি হয় জরুরি অবস্থা। গঠিত হয় সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার। ফখরুদ্দীন আহমদের নেতৃত্বাধীন এই সরকার এক–এগারো নামে পরিচিতি পায়। ছবিতে বঙ্গভবন এলাকায় সেনা টহল
ছবি: প্রথম আলো

২১ জানুয়ারি নবগঠিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা জাতির উদ্দেশে তাঁর প্রথম ভাষণে বলেন, ‘নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন, সুষ্ঠু ভোটার তালিকা ও ভোটার আইডি কার্ড, দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি রোধে পদক্ষেপ এবং স্বল্পতম সময়ে নির্বাচন ও ক্ষমতা হস্তান্তর করা হবে।’

দেশে নতুন করে আইডিসহ ভোটার তালিকা তৈরি হয়েছে। আগের ভোটার তালিকায় প্রচুর ভুয়া ভোটার অন্তর্ভুক্ত ছিল। ছবিওয়ালা ভোটার তালিকার বিরুদ্ধে ভুয়া ভোটার তালিকাভুক্তির কোনো অভিযোগ নেই।

দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে মিত্রশক্তির জয়ের মধ্য দিয়ে গণতন্ত্রের দ্বিতীয় জোয়ার দেখা যায়। ১৯৬২ সালের মধ্যে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের সংখ্যা বৃদ্ধি পায় ৩৬-এ। আবার ভাটায় সত্তরের দশকে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের সংখ্যা নেমে আসে ৩০-এ। ১৯৭৪ সালের দিকে স্মরণকালের তৃতীয় জোয়ারে আরও ৩০টি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের অভ্যুদয় ঘটে। এই জোয়ার আবার ভাটায় নামতে পারে।

রাজনৈতিক দলগুলো নিবন্ধনের ব্যাপারে ও অঙ্গদল সঙ্গে রাখার ব্যাপারে নানা গড়িমসি করেছে। সাংবিধানিক প্রয়োজনে কোনো কোনো দল গঠনতন্ত্র সংশোধন করেছে। এই সব ঘটেছে বড় অনিচ্ছায়, শুধু নির্বাচনে অংশ নেওয়ার জন্য। জনপ্রতিনিধিত্ব আইনের প্রতি তেমন অঙ্গীকার লক্ষ করা যায় না। আমাদের দেশের নির্বাচন কমিশনের কর্মকাণ্ড তেমন বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন করেনি। এবার নির্বাচন কমিশন যেসব গুরুদায়িত্ব নিজ কাঁধে তুলে নিয়েছে, তা পালন করার মতো দক্ষ ও নিরপেক্ষ কর্মকর্তার চাহিদা মেটাতে হবে, যাতে নির্বাচন আইনের লঙ্ঘন দ্রুত এবং দৃষ্টান্তস্বরূপ কঠোরতার সঙ্গে প্রতিরোধ করা যায়।

আরও পড়ুন

প্রধান সব রাজনৈতিক দল নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করলে তার গ্রহণযোগ্যতা থাকবে না। তা জেনেই নির্বাচনে অংশগ্রহণের দর–কষাকষিতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কাছে নানা দাবি করা হচ্ছে। দুর্নীতিবিরোধী অভিযান শ্লথ গতিতে প্রায় রুদ্ধ। বিলখেলাপি, ঋণখেলাপি এবং জরুরি আইনে সাজাপ্রাপ্তদের নির্বাচনে সুযোগ দেওয়ার জন্য যথেষ্ট চাপ দেওয়া হচ্ছে।

২০০৭ সালের মে মাসে প্রকাশিত এক তথ্যে শান্তিময়তার ক্ষেত্রে ১২১টি দেশের মধ্যে প্রথম দেশ ছিল নরওয়ে। বাংলাদেশের চেয়ে অশান্তিময় দেশও পৃথিবীতে রয়েছে। তাদের সংখ্যা প্রায় ৩৫। দক্ষিণ এশিয়ায় আমাদের স্থান ৮৬, ভুটানের নিচে। আমাদের দেশে ব্যাঙের ছাতার মতো প্রায় চার কুড়ি রাজনৈতিক দল আছে, যাদের সাইনবোর্ড ও দলীয় নেতার পোর্টফোলিও ব্যাগ ছাড়া প্রায় কোনো অস্তিত্ব নেই।

আরও পড়ুন

নবম সংসদ নির্বাচনের জন্য নির্বাচন কমিশনের কাছে ১০৭টি রাজনৈতিক দল নিবন্ধনের জন্য আবেদন করে। ৩৯টি দল নিবন্ধিত হয়েছে। এর ভেতরে ইসলাম ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল রয়েছে সাত-আটটি এবং বামপন্থী দল রয়েছে অনুরূপ সংখ্যার। প্রধান দুটি দল আওয়ামী লীগ ও বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট পার্টি। যে ৩৯টি দল নিবন্ধিত হয়েছে, তার মধ্যে মাত্র ১৪টি দল ১৯৭৩ সালের প্রথম সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে। ১৯৭৪ সালে বাকশাল গঠন করে সব রাজনৈতিক দলকে বিলোপ করা হয়। ১৯৭৯ সালে দ্বিতীয় সংসদ নির্বাচনে ২৯টি দল অংশগ্রহণ করে। ১৯৮৬ সালে তৃতীয় সংসদ নির্বাচনে ২৮টি দল প্রতিযোগিতা করে। ষষ্ঠ সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ, জামায়াতে ইসলামী এবং বামপন্থী দল নির্বাচন বর্জন করলেও ৪৩টি দল অংশ নেয়। ১১ দিনের পর সেই সংসদ ভেঙে দেওয়ার আগে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের জন্য সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী পাস করা হয়।

নামসর্বস্ব যেসব রাজনৈতিক দল বেশি ভোট পায় না, তারা তাদের পোলিং এজেন্টদের অন্যান্য প্রধান দলের কাছে ভাড়া খাটতে দেয় বলে অভিযোগ রয়েছে।

আমাদের নির্দিষ্ট তারিখ–তফসিলের ব্যত্যয় ঘটে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের শেষের কয়েক বছরে। এরপর সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, ভারত বিভাগ এবং বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রভাবে নির্দিষ্ট তারিখের ধারণায় বড় তারল্য ঘটে। ২০০৭ সালের জানুয়ারিতে যে নির্বাচন হয়নি, তার তফসিল চার-চারবার বদলায়। এবার নির্বাচনের তফসিল বদলেছে তিনবার।

২০০৭ সালের ১২ জানুয়ারি প্রথম আলোর নগর সংস্করণ

চতুর্দশ সংশোধনে জাতীয় সংসদে সংরক্ষিত মহিলা আসনসংখ্যা ৩০ থেকে বাড়িয়ে ৪৫ করা হয়। নতুন বিধান অনুসারে সংরক্ষিত মহিলা আসন সংসদে প্রতিনিধিত্বকারী রাজনৈতিক দলগুলোর আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের ভিত্তিতে বণ্টন করা হবে। এই সংরক্ষিত আসনসংখ্যা আগামী ১০ বছরের জন্য বলবৎ থাকবে। নারীমহলের দাবি ছিল ১০০ আসনে নারী প্রার্থীকে সরাসরি ভোটে নির্বাচনের সুযোগ দিতে হবে।

দেশের সুশীল সমাজ নির্বাচনের জন্য নানা সংস্কারের সুপারিশ করে আসছে। নির্বাচন কমিশনের কিছু সংস্কার প্রস্তাব রাজনৈতিক দলগুলো গ্রহণ করে নেয়নি। আমাদের দেশে এ পর্যন্ত নির্বাচন কমিশনকে বড় হেনস্তা করা হয়েছে। তার জন্য নির্বাচন কমিশনও কিছুটা দায়ী। ফুটবল খেলা নিয়ে ইংরেজ দর্শকেরা যে বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি করে, তার চেয়ে আমরা অনেক বেশি অনাচার করে থাকি। মামলা হলেও তার শেষ পর্যন্ত সুরাহা হয়। সপ্তম সংসদে ভোলার একটি নির্বাচন কেন্দ্র প্রতিনিধিহীনভাবেই কাটিয়ে দেয়। নির্বাচন আইন ভঙ্গের জন্য তেমন দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়াও হয়নি। রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচন কমিশনকে যেভাবে চোখ রাঙায় এবং হম্বিতম্বি করে, তার এক সহস্রাংশ করলেও আন্তর্জাতিক ফুটবল বা ক্রিকেট খেলায় কোনো ভদ্রলোক রেফারির কাজ করতেন না। আমাদের দেশের রাজনৈতিক মাস্তানি সুবিদিত। আমরা কোনো কর্তৃপক্ষের শাসন মানতে চাই না। আমরা প্রত্যেকে একেকজন খুদে কর্তৃত্ববাদী। আমাদের রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর বিকৃতকরণের প্রতিভা বিস্ময়কর।

দেশের ইতিহাসে পুরুষের চেয়ে নারী ভোটারের সংখ্যা বেশি হওয়ার ঘটনা এবারই প্রথম। ’৭৩ সালের নির্বাচনের আগে নতুন ভোটার তালিকা এবং বাকি সাতটি নির্বাচনের আগে হালনাগাদ ভোটার তালিকা বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, প্রতিটি ভোটার তালিকায় নারী ভোটারের চেয়ে পুরুষ ভোটারের সংখ্যা বেশি ছিল।

‘নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তথ্যাবলী’ অনুযায়ী দেশে মোট ভোটারের সংখ্যা ৮ কোটি ১০ লাখ ৫৮ হাজার ৬৯৮। এর মধ্যে নারী ভোটার ৪ কোটি ১২ লাখ ৩৬ হাজার ১৪৯ এবং পুরুষ ভোটার ৩ কোটি ৯৮ লাখ ২২ হাজার ৫৪৯ জন। পুরুষ ভোটারের চেয়ে নারী ভোটার ১৪ লাখ ১৩ হাজার ৬০০ জন বেশি। অর্থাৎ ভোটার তালিকায় নারী ভোটারের সংখ্যা পৌনে ২ শতাংশ বেশি।

দেশের ইতিহাসে পুরুষের চেয়ে নারী ভোটারের সংখ্যা বেশি হওয়ার ঘটনা এবারই প্রথম। নারীরা ভোটার হতে নিবন্ধন কেন্দ্রে আসবেন না, সেই ধারণা ভুল প্রমাণ হয়েছে। বাদ পড়া ভোটারদের মধ্যে পুরুষের সংখ্যা বেশি।

আরও পড়ুন

স্বাধীনতার পর ১৯৭৩ সালের নির্বাচনের আগে প্রথম ভোটার তালিকা তৈরি হয়। এরপর সাতটি নির্বাচনের আগে তা হালনাগাদ করা হয়। ’৭৩ সালের নির্বাচনের আগে নতুন ভোটার তালিকা এবং বাকি সাতটি নির্বাচনের আগে হালনাগাদ ভোটার তালিকা বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, প্রতিটি ভোটার তালিকায় নারী ভোটারের চেয়ে পুরুষ ভোটারের সংখ্যা বেশি ছিল। ২০০১ সালে অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে তৈরি হালনাগাদ ভোটার তালিকা অনুযায়ী দেশে পুরুষ ভোটার ৩ কোটি ৮৬ লাখ ৮৪ হাজার ৯৭২ এবং নারী ভোটার ৩ কোটি ৬৩ লাখ ১৫ হাজার ৬৮৪ জন।

ভোটার তালিকার কাজ শেষ হওয়ার পরও আবেদনের মাধ্যমে পাঁচ শতাধিক মানুষ ভোটার হয়েছে। তাঁদের বেশির ভাগই পুরুষ। দেশের বাইরে ও ভেতরে পেশাগত কাজে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকায় অনেক পুরুষের পক্ষে ভোটার হওয়া সম্ভব হয়নি। পুরুষ ভোটার কমার এটাও একটা কারণ হতে পারে। আগের ভোটার তালিকায় দেখা গেছে ভুয়া ও দ্বৈত ভোটারদের মধ্যে পুরুষের সংখ্যা অনেক বেশি। এবার সেই সুযোগ না থাকায় পুরুষ ভোটার কমেছে। এটাও একটা কারণ।

প্রধান সব রাজনৈতিক দল নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করলে তার গ্রহণযোগ্যতা থাকবে না। তা জেনেই নির্বাচনে অংশগ্রহণের দর–কষাকষিতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কাছে নানা দাবি করা হচ্ছে। দুর্নীতিবিরোধী অভিযান শ্লথ গতিতে প্রায় রুদ্ধ। জরুরি আইনে সাজাপ্রাপ্তদের নির্বাচনে সুযোগ দেওয়ার জন্য যথেষ্ট চাপ দেওয়া হচ্ছে।
মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান [৩ ডিসেম্বর ১৯২৮—১১ জানুয়ারি ২০১৪]
প্রতিকৃতি: মাসুক হেলাল

রাজনৈতিক দল ও স্বতন্ত্র মিলিয়ে দেশে ২ হাজার ৪৬০ জন মনোনয়নপত্র জমা দেন। ৫৫৭টি মনোনয়নপত্র বাতিল বলে গণ্য হয়। আপিলে নির্বাচন কমিশন ৪৩ জনের প্রার্থিতা বৈধ বলে রায় দেয়। ছয় শতাধিক প্রার্থী তাঁদের প্রার্থিতা প্রত্যাহার করেন। ফলে ১৯৯১ সালের পর সংসদের ২৯৯ আসনে সবচেয়ে কম প্রার্থী সংখ্যা ১৫৭২। শ্রমিকনেতা রহস্যজনকভাবে অগ্নিদগ্ধ হয়ে মারা যাওয়ায় নোয়াখালী-১ আসনে নির্বাচন স্থগিত থাকবে।

আরও পড়ুন

১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বরে স্বল্পকালের মধ্যেই বিত্তবান এবং উচ্চবিত্তদের জন্য বিজয় প্রতিষ্ঠিত হয়। দেশগড়া ও ভাঙার সময় অর্থকরী উদ্যোগের জন্য সে এক মাহেন্দ্রক্ষণ। চতুর বাঙালি বৈধ ও অবৈধ উপায়ের সর্ব উদ্যোগ গ্রহণ করে। নিম্নবিত্ত ও গরিবদের জীবনে বিজয় প্রতিষ্ঠা হয়নি। মনে হয় গণতন্ত্র সুদূরপরাহত। ১৯৯১ সালের ডিসেম্বরে দেশে বিশেষ করে রাজনীতিতে যে বিপ্লব ঘটে যায়, তাতে দেশের মানুষ আবার আশায় বুক বাঁধে। তারা দ্রুত বুঝতে পারে রাজনৈতিক দলগুলো কেবলই দলীয় লক্ষ্য সামনে রেখে আত্মচিন্তায় মগ্ন। সপ্তম ও অষ্টম সংসদ ওয়াক আউটের জন্য ধূ–ধূ মরুভূমির মতো দেখায়। শেষে অবস্থার এত দ্রুত অবনতি ঘটে যে ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি দেশে সেনাসমর্থিত এক সরকার ক্ষমতাসীন হয়ে সুস্থ, অবাধ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের প্রতিশ্রুতি দেয়। আগামী ২৯ ডিসেম্বর সেই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। নির্বাচনী প্রচারের স্বার্থে ১৭ ডিসেম্বর জরুরি অবস্থা প্রত্যাহার করা হবে। গত দুই বছরে দেশে যত বাক্য ব্যয় হয়েছে তাদের ডেসিবেল ছিল বেশ উচ্চমাত্রায়।

বাংলাদেশে গণতন্ত্রের কাঠামোটা যে বড়ই ভঙ্গুর। আমাদের দেশের প্রথম আনুগত্য আত্মীয়ের প্রতি। বাংলা ভাষায় আত্মীয়-সম্পর্কের শব্দের সংখ্যা বিস্ময়করভাবে বেশি, প্রায় ২১৫। পরিবারতন্ত্র নিয়ে ইতিমধ্যে নানাজনে সাতকাহন গেয়েছেন। আমি সে পাঁচালি পাড়তে চাই না। আমাদের দ্বিতীয় আনুগত্য পাড়াগত বা অঞ্চলের প্রতি। শত অপকর্মের মহাজন তাঁর নিজের অঞ্চলে ‘হামার ছাওয়াল’ বা ‘হামার মাইয়া’। সেখানে জনগণ তাঁর অনুগত, তিনি সেবিত এবং প্রচুর ভোট পান।

আরও পড়ুন

আর দুর্যোগপ্রবণ দেশে কে তাঁদের পাশে এসে দাঁড়ায়? তাঁরাই তো তাঁদের সহায়সংগতি! এমন ব্যক্তিদের দলে টানার জন্য কে না চেষ্টা করেছেন। একজন রাজনৈতিক দলপ্রধান বলেছিলেন, ‘নির্বাচনে হেরে গেলে কোথায় থাকবে আদর্শ?’ সত্যিই তো, নির্বাচনে হেরে যাওয়া ভাবাই যায় না! যেনতেন প্রকারে নির্বাচনে জিততে হবে। যে আদর্শের ধারকেরা মধ্যবিত্ত-নিম্নবিত্তদের ঘরে বড় অনাদরে বেড়ে উঠেছিল, তারা তো এখন দ্রব্যমূল্য ঠেকাতে মুরব্বিদের ঘরে ঋণের মক্কেল। যাঁরা রাজনীতি করেন, তাঁরা কী জবাব দেবেন, আদর্শের কোনো থাকার জায়গা রয়েছে কি বাংলাদেশে?

এই লেখার শিরোনাম হিসেবে যে প্রশ্ন রাখা হয়েছে, তার সঠিক উত্তর আমার জানা নেই। হৃত গণতন্ত্রের পুনরুদ্ধার এবং তার প্রত্যাবর্তনে দেশে দেশে সাধারণ মানুষ অভূতপূর্ব মেধা ও বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়েছে। বাঙালিরা নিজেদের বুদ্ধি নিয়ে প্রায়ই এক আত্ম–অহংকারে মগ্ন হয়। বিদেশিরা বাঙালিদের এই অজুহাতপ্রিয়তায় বিস্মিত হয়। আশা করি সেই বাঙালি, যে বারবার সুযোগ হারিয়েছে, এবার ২৯ ডিসেম্বর সঠিক পথে অগ্রসর হবে এবং দুহাত বাড়িয়ে পরিবর্তনের এত বড় সুযোগের সদ্ব্যবহার করবে।