বীরাঙ্গনা বিষয়ে সাহিত্য রচনার পটভূমি
সে ছিল ক্যাটালিস্ট
আজ থেকে প্রায় ২২ বছর আগে ২০০৩ সালের ১৬ ডিসেম্বর তারিখে মহান বিজয় দিবস উপলক্ষে প্রকাশিত প্রথম আলোর বিশেষ আয়োজনে কথাসাহিত্যিক শাহীন আখতারের এই লেখাটি প্রথম ছাপা হয়েছিল। আমাদের বহু মূল্যবান লেখা শুধু মুদ্রণের পাতায় রয়ে গেছে; তেমনি একটি এই ‘সে ছিল ক্যাটালিস্ট’। তবে দীর্ঘদিন কেবল ছাপার পাতায় সীমাবদ্ধ থাকা এই লেখা বিজয়ের মাসে অনলাইনে উঠে এল নতুন পাঠকদের সামনে।
বিজয় দিবস ও মুক্তিযুদ্ধকে কেন্দ্র করে অনলাইনপূর্ব যুগে যত লেখা, সাক্ষাৎকার, স্মৃতিচারণ ও কবিতা ছাপা হয়েছিল, বিজয়ের পুরো মাসজুড়ে সেসব ধুলোঝরা পৃষ্ঠা আমরা প্রথমবারের মতো অনলাইনে তুলে আনছি।
মুক্তিযুদ্ধের আলোচনায় ‘প্রজন্ম’ বেশ চালু শব্দ। এ ক্ষেত্রে আমার বয়সীরা কোন প্রজন্মের, তা বলা মুশকিল। যেমন ১৯৭১ সালের আগে জন্মে আক্ষরিক অর্থে প্রজন্ম ’৭১ থেকে আমরা বাদ পড়ে গেছি। আবার মুক্তিযোদ্ধা ও বীরাঙ্গনাদের চেয়ে আমাদের বয়সটা কম। সেদিক থেকে খ্যাতিমান এই দুটি প্রজন্মের মাঝখানে আমাদের বলা যায় মিসিং লিংক—হারিয়ে যাওয়া যোগসূত্র। তাই হয়তো মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস থেকেও আমরা অদৃশ্য। এমনকি যুদ্ধের ৯ মাস তেমনভাবে দৃশ্যমান ছিলাম না। আমরা পাকিস্তানি সৈন্যদের প্রাথমিক টার্গেট ছিলাম না বলে (যদিও গণহত্যা চলাকালে আমাদের বয়সী ছেলেমেয়েরা নিহত হয়েছেন) সে সময় আমাদের আত্মীয়রা এ বয়সের সন্তানদের নিয়ে বাড়তি কোনো প্রকার দুশ্চিন্তায় ভোগেননি। তাঁদের শুধু চিন্তা ছিল, স্কুল বন্ধ থাকায় আমরা বখে যাচ্ছি। কোনো দিন দেশ স্বাধীন হলে (৯ মাসের জায়গায় কমসে কম ৯ বছর তো তাঁরা ভেবেই ছিলেন) আমাদের ভবিষ্যৎ থাকবে না। ছেলে হোক মেয়ে হোক—মধ্যবিত্ত, নিম্নমধ্যবিত্ত বাঙালি পরিবারে মূর্খ সন্তানের কানাকড়ির দাম নেই। তাই কী করবেন বুঝতে না পেরে, আম্মা একদিন কাপড় আর রঙিন সুতো নিয়ে আমাকে ফুলতোলা শেখাতে বসলেন। শুরুতেই বিপত্তি। ‘মিলিটারি আইতাছে, মিলিটারি আইতাছে’—দিনদুপুরে দৌড়াদৌড়ি। আমরা মুরগির ছানার মতো দিগ্বিদিক পালাতে শুরু করলাম। দুই দিন পর বাড়ি ফিরে ঘরের থালাবাসনের হদিস পাওয়া না গেলেও রঙিন সুতো আর কাঠের গোল ফ্রেমটা ঠিকই জায়গামতো পড়ে ছিল। আম্মা জিনিসগুলো আর ছুঁতে দিলেন না। ছোঁয়ামাত্র আবার যদি মিলিটারি চলে আসে, সেই ভয়েই হয়তো। এদিকে আমার ১৪–১৫ বছরের চাচাতো বোন আর বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্স্ট ইয়ারের ছাত্র বড় ভাইকে সন্ধ্যার আগেই খাইয়ে–দাইয়ে কোথায় যেন পাঠিয়ে দেওয়া হয়। আমরা জানতে গিয়ে ধমক খাই। মনমরা হয়ে হারিকেনের আলোয় লুডু খেলতে বসি। খেলতে গেলে পক্ষে-বিপক্ষে ঝগড়া হবেই। তখন আরেক পশলা ধমক-ধামক, কানমলা, কিল-চড়। আর্মি যে আমাদের বয়সী ছেলেমেয়েদেরও মারতে কসুর করে না—এ নিয়ে এন্তার ভয়ভীতি প্রদর্শন।
‘খালার এই পুঁচকে মেয়েটা জানি কেমন, বড়দের ব্যাপারে সব সময় নাক গলায়।’ তারপর তাঁরা দুজন মিলে শলাপরামর্শ করে আমাকে যুদ্ধের মাঠের লঙ্গরখানার ঝি হতে বলে। কারণ, এ পোস্টের জন্য কোনো প্রকার ট্রেনিং লাগে না। আমি রেগেমেগে তাঁদের গোপন পরিকল্পনা ফাঁস করে দেওয়ার হুমকি দিই।
কেন জানি (আজ আর মনে নেই) সে সময় আমাকে নানাবাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল। জায়গাটা প্রত্যন্ত গ্রাম। রাস্তাঘাটের বালাই নেই। তাই বর্ষাকালের আগে মিলিটারি এলাকায় ঢুকতে পারবে না। সেখানে সবাই গেরিলা যোদ্ধা। বিশেষত হাইস্কুল আর কলেজের ছাত্রী আমার খালাতো বোনেরা। তাঁরা ২৫ মার্চের আগে ঢাকায় কাঠের ডামি রাইফেল দিয়ে ট্রেনিং নিয়েছে। সেই গর্বে মাটিতে পা পড়ে না। সারা দিন কানে রেডিও ঝুলিয়ে রাখে। আর বলে, উত্তরবঙ্গটা পশ্চিম পাকিস্তানি আর্মি কবজা করতে পারবে না। উত্তর আর দক্ষিণ-পূর্ব পাকিস্তান (তখন বাংলাদেশকে এ নামেই ডাকা হতো) দুই ভাগে ভাগ হয়ে যাবে। উত্তর ভিয়েতনাম আর দক্ষিণ ভিয়েতনাম যেমন। আমরা উত্তর থেকে এসে দক্ষিণে যুদ্ধ করব। ‘আমিও করব’—আমি তাঁদের গোপন পরিকল্পনা শুনে বায়না ধরি। তাঁরা তা তা করে তেড়ে আসেন। একজন বলেন, ‘ওই ছেড়ি, তোর ট্রেনিং আছে যে তুই যুদ্ধ করবি? মামাবাড়ির আবদার—আমি যুদ্ধ করব!’ আরেকজন বেজায় উদ্বিগ্ন আমার স্বভাব-চরিত্র নিয়ে, ‘খালার এই পুঁচকে মেয়েটা জানি কেমন, বড়দের ব্যাপারে সব সময় নাক গলায়।’ তারপর তাঁরা দুজন মিলে শলাপরামর্শ করে আমাকে যুদ্ধের মাঠের লঙ্গরখানার ঝি হতে বলে। কারণ, এ পোস্টের জন্য কোনো প্রকার ট্রেনিং লাগে না। আমি রেগেমেগে তাঁদের গোপন পরিকল্পনা ফাঁস করে দেওয়ার হুমকি দিই। তারপর তাঁদের পাল্টা হুমকিটা এত মারাত্মক ছিল যে এর জন্য ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত আমাকে ভয়ে ভয়ে থাকতে হয়েছিল। তাঁদের বক্তব্য ছিল, মুক্তিযোদ্ধার গোপন তথ্য ফাঁস করে যে সে রাজাকার। তাঁরা মুক্তিযোদ্ধা হওয়া মাত্র প্রথম চান্সে আমাকে গুলি করে মেরে ফেলবেন।
হবু মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে এতখানি বিড়ম্বনা সহ্য করার পরও কালে কালে আমি যে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের লোক হয়ে উঠি, তা হয়তো পারিবারিক ও পারিপার্শ্বিক সূত্রে। শুরুতেই বলেছি, আমার সর্বজ্যেষ্ঠ ভ্রাতা ১৯৭১ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষের ছাত্র ছিলেন। অসহযোগের সময় বইপত্র গুছিয়ে হল ছেড়ে তিনি বাড়ি চলে আসেন। কবিতা পড়া নিঃসঙ্গ মানুষ। যুদ্ধের সময় বেচারার অবস্থা কাহিল। জাতি তাঁর কাছে বীরত্ব চায়, রক্ত চায়; কিন্তু তিনি ঘরের কোনায় ঘাপটি মেরে পড়ে থাকেন। কিছুতেই যুদ্ধে যাবেন না। তাঁকে নিয়ে সবার ভয়। আব্বা পারলে ধরেবেঁধে তাঁকে আগরতলায় ২ নম্বর সেক্টর কমান্ডার মেজর খালেদ মোশাররফের হাতে তুলে দিয়ে আসেন। বেচারা নড়াচড়াও করেন না। কিন্তু ‘আর্মি আইতাছে’ শুনলে সবার আগে ভয়ে পালান। আমার লেখা প্রথম গল্পে আমি তাঁকে পঙ্গু বানিয়ে দিয়েছিলাম। তিনি ক্র্যাচ ধরে হাঁটেন। আর সময়–সুযোগমতো আম্মার তহবিল তছরুপ করেন, অর্থাৎ চোর। তাঁর সিগারেট খাওয়ার পয়সা নেই। দ্বিতীয় অগ্রজ ১৯৭১ সালে হাইস্কুলের ছাত্র ছিলেন। যুদ্ধে যাওয়ার জন্য তড়পাতেন সারাক্ষণ। গল্পটায় আমি তাঁকে মুক্তিযুদ্ধে পাঠিয়ে দিয়ে সম্মুখসমরে শহীদ করে দিলাম। কারণ, তত দিনে ১৯৭১-এর রাজনীতির পাঠ আমাকে লাইনে এনে ফেলেছে। (’৭৮ বা ’৭৯-তে কুমিল্লার ‘আমোদ’ পত্রিকায় গল্পটা ছাপা হয়েছিল।) যুদ্ধের কে নায়ক, কে খলনায়ক—সন্দেহাতীতভাবে তখনই ঠিক হয়ে গিয়েছিল। আর পক্ষ-বিপক্ষও নির্ধারিত হলো একই হিসাবে। এভাবে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস আমার কাছে নিজের অজান্তেই দ্বিখণ্ডিত হয়ে গেল। তদুপরি তা আবর্তিত হতে লাগল বড় ভাইদের, প্রকারান্তরে পুরুষদের ঘিরে। নারী সার্বিকভাবেই সেই দৃশ্যপটে অনুপস্থিত। তাঁদের দেখা যায় না। তাঁদের কণ্ঠ শোনা যায় না। এই ‘না’য়ের ভেতর যাঁরা আছেন, তাঁরা নির্যাতিত ‘মা-বোন’। অঙ্কের হিসাবে দুই লাখ—দুইয়ের পর কতগুলো শূন্য। সব মিলিয়ে সংখ্যাই শুধু। চেহারাহীন, অশরীরী মানবী। তাঁদের টিভি নাটক বা সিনেমায় হয়তো দেখানো হলো, কয়েকজন ইউনিফরম পরা, সশস্ত্র আর মোচঅলা লোকের বলাৎকারের ভঙ্গিসহযোগে। পরের দৃশ্যে ‘মা-বোনের’ ব্লাউজের হাতা ছেঁড়া, মাটিতে আঁচল লুটাচ্ছে, এলোমেলো লম্বা চুল, চোখে-মুখে পাগল–পাগল ভাব। তারপর ইজ্জত নিয়ে টানাটানি সমাজের, স্বাধীন বাংলাদেশের। এসব অভিনীত ক্যামেরাদৃশ্য বাদ দিলে রক্তমাংসের বীরাঙ্গনা দেখার সৌভাগ্য আমার হয় যুদ্ধের সিকি শতাব্দী পর। এবং সেই সুবর্ণ সুযোগ আসামাত্র কিছু না ভেবেই সাদা দিলে আমি তাঁর মুখোমুখি বসে গেলাম।
সেই বীরাঙ্গনার যুদ্ধের অভিজ্ঞতাটা বিচিত্র। আমার বিগত দেখা বা শোনার সঙ্গে কোনো মিলই নেই। আমি মুক্তিযুদ্ধের ২৫ বছর পর তাঁর কথা শুনে সেদিন প্রথম যুদ্ধের ভয় পেলাম। অথচ তাঁর কথায় ধর্ষিত হওয়ার বর্ণনার পাশে ভালোবাসার দীর্ঘ একটি উপাখ্যান ছিল: পুরুষটি ইউনিফরম পরা, তকমাধারী পাকিস্তানি আর্মি অফিসার। নিঃসন্দেহে খুনি-ধর্ষকদের একজন। তবে প্রেমিকার বর্ণনায় যথার্থই একজন প্রেমিক সে—সংবেদনশীল, মুখচোরা, পরোপকারী। খানিকটা কবি স্বভাবের। ধর্ষণ-নির্যাতনের তুলনায় মহিলার প্রেমের অংশটা ছোট পরিসরের হলেও আমার মনে হলো তা অবিশ্বাস্য, ভয়ংকর। মৃত মানুষের ঠোঁটে লিপস্টিক মাখা থাকার মতো।
সেই বীরাঙ্গনার যুদ্ধের অভিজ্ঞতাটা বিচিত্র। আমার বিগত দেখা বা শোনার সঙ্গে কোনো মিলই নেই। তিনি নির্যাতিত, গ্যাংরেপেরও শিকার, পাশাপাশি তাঁর প্রেমের সম্পর্ক ছিল একজন পাকিস্তানি সৈন্যের সঙ্গে—মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এমন নারীর স্থান কোথায়?
তিনি নির্যাতিত, গ্যাংরেপেরও শিকার, পাশাপাশি তাঁর প্রেমের সম্পর্ক ছিল একজন পাকিস্তানি সৈন্যের সঙ্গে—মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এমন নারীর স্থান কোথায়? বিশেষত যে ইতিহাস তালগাছ-ডালপালাহীন, একহারা? অথচ ১৯৭১ সালের যুদ্ধটা প্রকৃতই ছিল জনযুদ্ধ, বাংলাদেশের প্রতিটি সশস্ত্র ও নিরস্ত্র মানুষের প্রাণান্তকর বাঁচার লড়াই। সাড়ে সাত কোটি মানুষের এখনো দোহাই পাড়া হয় বটে, ইতিহাসের রাজকীয় প্রাসাদে তাদের প্রবেশ নিষেধ। সেটি পর্যায়ক্রমে বেসামরিক আর সামরিক কর্তাদের দখলে চলে যায়। মহান খেতাবগুলোও বরাতগুণে জোটে তাদেরই ভাগে। এ ছাড়া আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এমন একরৈখিক আর অন্যায্য যে প্রাণের দায়ে যে রাজাকার হয়েছিল, আর যে স্বেচ্ছায় স্ব–উদ্যোগে বদর বাহিনীর সদস্য নীলনকশা প্রণয়নকারী খুনি—উভয়ের অপরাধ মাপা হয় একই বাটখারা দিয়ে। কে যুদ্ধে গেল আর কে গেল না—পক্ষ-বিপক্ষ তালিকাভুক্ত করার এটিও একটি প্রচলিত পদ্ধতি। তার কারণ হয়তো এই—যে জাতি যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের কাঠগড়ায় তুলতে ব্যর্থ হয়েছে, সে মুখে মুখে লঘুপাপে গুরুদণ্ড দিয়ে এভাবে নিজের অক্ষমতা ধামাচাপা দিতে চেষ্টা করে।
যাহোক, আমার সিকি শতাব্দীর তালগাছ মার্কা একহারা গড়নের ধারণাগুলোকে উপড়ে ফেলে সেই নারীর বিচিত্র অভিজ্ঞতাকে তখন জায়গা করে দিতে হচ্ছিল। তা ছিল এক বেদনাদায়ক প্রক্রিয়া। অনেকটা নিজের অঙ্গ কেটে বাদ দিয়ে অন্যের অঙ্গ নিজ দেহে সংস্থাপন করার মতো। সাক্ষাৎকার পর্বগুলোতে আমি তা–ই করছিলাম। এ ছিল একটি প্রকল্পের কাজ। রিপোর্ট লেখার প্রয়োজন তাই অচিরেই দেখা দিল। আমার জন্য তখন চরম সংকটকাল। কার ওপর রিপোর্ট লিখব আমি—তার না আমার? একজন বীরাঙ্গনার, না মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস থেকে বিতাড়িত প্রজন্মের একজনের? যে আবার ১৯৭১ সালের রাজনীতির পাঠ ভুলে তত দিনে ‘চেতনা’ হারাতে শুরু করেছে। বলা বাহুল্য, আমার কাছে তখন দুজনই সমান গুরুত্বের। একজনকে বাদ দিয়ে আরেকজন নয়। ফলে তা যুদ্ধ ও যুদ্ধাপরাধের সীমা ছাড়িয়ে যুদ্ধ–পরবর্তী নির্মিত ইতিহাসের কাঁটাতারের বলয়ে প্রবেশ করল এবং একই সঙ্গে এর একমাত্রিক গড়নকে চ্যালেঞ্জ করে বসল, যা রিপোর্টে সংকুলান হওয়ার নয়। এর কারণ এ নয় যে পরিসরটা বড় হয়ে গেল বলে, বরং বিষয়ের প্রকৃতিগত জটিলতার জন্যই তা সম্ভব হচ্ছিল না। আমার আরও মনে হলো, রিপোর্টে এ বয়ান সরাসরি লিখতে গেলে অনেক কৈফিয়ত দিতে হবে তার পক্ষ নিয়ে আমার দিক থেকে। (প্রকল্পের প্রতিবেদনে তা–ই করতে হয়েছে।) এর তুলনায় সাহিত্যের ধারণক্ষমতা অনেক বেশি। একজন ব্যক্তিমানুষ রাজনৈতিক-সামাজিক নানাবিধ অসংগতি নিয়ে এখানে হাজির থাকতে পারে কোনো প্রকার জবাবদিহি ছাড়াই। এমনকি সে একজন নারী হলেও। তার জন্য এজলাস বসে না, পক্ষ-বিপক্ষের উকিল জেরা করে না, মহামান্য আদালত ঘন ঘন টেবিলে হাতুড়ির বাড়ি মারেন না। এখানে বিবেচনাটা থাকে সাহিত্যের বিচারে তা কতখানি মানসম্পন্ন হলো। উপস্থাপনের ভঙ্গিটাই আসল। এমতাবস্থায় তাঁর কাহিনিনির্ভর আমার পরোক্ষ অভিজ্ঞতাকে সম্বল করে আমি পথ বদল করলাম। একটি উপন্যাসের বীজ সঙ্গে নিয়ে আমার যাত্রা শুরু হলো।
মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের লোক হতে গেলে আপনার তৎসংক্রান্ত জ্ঞান-গম্যি না থাকলেও চলবে। কারণ, ডালপালাহীন একটা তালগাছ তো দাঁড় করানোই আছে। তাতে চড়ে বসার জন্য প্রয়োজন শুধু বিচারবোধহীন আবেগ, অসহিষ্ণু আচরণ, মুক্তিযুদ্ধের ওপর একচেটিয়া দখলদারি মনোভাব, জ্বালাময়ী কথাবার্তা—ভুলবশত যেসব গুণপনাকে আমরা দেশপ্রেম ভেবে থাকি। এ রকম ‘দেশপ্রেমিক’ হয়ে আজকের এই দুর্দিনেও আপনি হয়তো পথে-ঘাটে বুক ফুলিয়ে চলতে পারছেন। বর্তমান সরকারের তখ্তের কাছাকাছি যুদ্ধাপরাধীরা অবস্থান নিলেও তারা আপনার গোড়া কাটতেই ব্যস্ত। আগায়-মাথায় বাড়ি মারতে এখনো ছুটে আসছে না। যাহোক, আমি ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’ হারিয়ে একরকম শূন্য থেকে যাত্রা শুরু করলাম। তাঁর প্রেমের অভিজ্ঞতাটা যা আমি বহন করে চলেছি, এটি তেলের মতো জলের সঙ্গে মিশ খায় না। ১৯৭১ সালের হত্যা-ধর্ষণের মাঝখানে আলাদাভাবে ভাসতে থাকে। তাকালে পর চোখ কটকট করে, অস্বস্তি লাগে। সে আমার চোখ দুটি খুলে দিয়েছে সত্য, মীমাংসায় পৌঁছিয়ে দেয়নি। সেই নতুন দৃষ্টি নিয়ে আমি মুক্তিযুদ্ধের বইপত্র, দলিল-দস্তাবেজ, চলচ্চিত্র, খবরের কাগজ, ডায়েরি, স্মৃতিচারণা, কেসস্টাডি, অপ্রকাশিত সাক্ষাৎকারের খসড়া—যা পাওয়া যায়, যা যায় না—সবকিছুর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লাম। সময়-সুযোগমতো নানাজনের সাক্ষাৎকার গ্রহণও পাশাপাশি চলতে লাগল (এখনো চলছে)। তার সঙ্গে চলল ইন্টারনেট, বিদেশি সাহিত্য ও সিনেমার মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের বাইরের যুদ্ধপাঠ। আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধের ট্রাইব্যুনালগুলোর খবরাখবর। এ পর্বে আমি কৃতজ্ঞ আমার কর্মস্থল আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) প্রতি। টোকিও ট্রাইব্যুনাল-২০০০-এর দোরগোড়ায় সংস্থাটি আমাকে পৌঁছে দিয়েছিল। সেখানে প্রশান্ত মহাসাগরীয় দেশগুলোর শখানেক লোলচর্ম বৃদ্ধা, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ধর্ষণের শিকার নারী, ‘কমফোর্ট উইমেন’-এর যুদ্ধাপরাধের বিচারসভায় সমাগম। তাঁরা গত শতাব্দীর নিপীড়িত, নিঃস্ব নারী। ৫৫ বছর আগে শেষ হয়ে যাওয়া এক প্রলয়ংকরী যুদ্ধ সেই যে তাঁদের পথে বসিয়ে দিয়ে গেছে, আজও তাঁরা পথে পথে। আমি কি তাঁদের মাঝখানে তাঁকেই খুঁজে বেড়ালাম? তাঁদের অভিজ্ঞতার সঙ্গে তাঁর অভিজ্ঞতা মেলাতে চেয়েছিলাম? কিংবা তাঁদের জীবনের সঙ্গে তাঁর জীবন? আসলে এত সব খোঁজাখুঁজির মধ্য দিয়ে, একটি উপন্যাস লেখার অজুহাতে আমার প্রথম দেখা যুদ্ধবিধ্বস্ত সেই নারীকে আমি কড়ায়–গন্ডায় বুঝে নিতে চাচ্ছিলাম। অবশেষে তাঁর সঙ্গে আমার বোঝাপড়ার পালা যখন সাঙ্গ হলো, আমি যখন তাঁকে পুরোপুরি বুঝতে সক্ষম হলাম, তত দিনে তাঁকে ছেড়ে আমি অনেক দূরে চলে গেছি। আমার অর্ধসমাপ্ত উপন্যাসটিতে তাঁর ছায়া থাকতে পারে, তিনি নেই।
তাঁদেরই বোধ করি ক্যাটালিস্ট বলে, যাঁরা যথার্থই আমাদের পথে নামান।