পূর্ব পাকিস্তান মহিলা পরিষদ
ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলার অকথিত ইতিহাস
আজ থেকে প্রায় ২৬ বছর আগে ১৯৯৯ সালের ১৬ ডিসেম্বর তারিখে মহান বিজয় দিবস উপলক্ষে প্রকাশিত প্রথম আলোর বিশেষ আয়োজনে পূর্ব পাকিস্তান মহিলা পরিষদ নিয়ে মালেকা বেগমের এই লেখাটি প্রথম ছাপা হয়েছিল। আমাদের বহু মূল্যবান লেখা শুধু মুদ্রণের পাতায় রয়ে গেছে; তেমনি একটি এই ‘ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলার অকথিত ইতিহাস’। তবে দীর্ঘদিন কেবল ছাপার পাতায় সীমাবদ্ধ থাকা এই লেখা বিজয়ের মাসে অনলাইনে উঠে এল নতুন পাঠকদের সামনে।
বিজয় দিবস ও মুক্তিযুদ্ধকে কেন্দ্র করে অনলাইনপূর্ব যুগে যত লেখা, সাক্ষাৎকার, স্মৃতিচারণ ও কবিতা ছাপা হয়েছিল, বিজয়ের পুরো মাসজুড়ে সেসব ধুলোঝরা পৃষ্ঠা আমরা প্রথমবারের মতো অনলাইনে তুলে আনছি।
১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বিকেলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণ শোনার জন্য অনেকের মতো উদ্গ্রীব, ব্যাকুলতা নিয়ে অপেক্ষা করছিলাম রেসকোর্সের ময়দানে। আগের দিন ৬ মার্চ পূর্ব পাকিস্তান মহিলা পরিষদের সভা বায়তুল মোকাররম প্রাঙ্গণে করেছিলাম আমরা, সভানেত্রী কবি সুফিয়া কামালের নেতৃত্বে। সংহতি জানিয়েছিলাম গণ–আন্দোলনের প্রতি। সেই সংহতি জানাতে শত শত মহিলা পাড়া-মহল্লা থেকে মিছিলে যোগ দিয়ে এসেছিলেন ৭ মার্চের সভায়। বঙ্গবন্ধুর ভাষণের মধ্যে কয়েকটি বিশেষ কথা তীব্র ও গৌরবের আবেগ ছড়িয়ে দিয়েছিল মহিলাদের মধ্যে। তিনি বলেছিলেন, ‘আমি আগেই বলে দিয়েছি। কোনো গোলটেবিল বৈঠক হবে না...যারা আমার মা-বোনের কোল শূন্য করেছে, তাদের সাথে বসব আমি গোলটেবিল বৈঠকে?...যদি একটি গুলি চলে, তাহলে বাংলার ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো—যার যা আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে।...এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’
ওই যে আমরা শুনলাম মা-বোনের কোল শূন্য করার অপরাধে পাকিস্তান সরকারকে দায়ী করে বঙ্গবন্ধু গোলটেবিলে বসবেন না বলেছেন, ওই যে আমরা শুনলাম ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলার ডাক দিয়েছেন বঙ্গবন্ধু, ওই যে আমরা শুনলাম স্বাধীনতার সংগ্রাম শুরু হয়ে গেছে—তখন মহিলা সমাজের মাতৃহৃদয় আবেগে–ব্যাকুলতায় কিছু করার জন্য অস্থির হয়ে ওঠে।
সবাই শপথে শপথে সাহসী হয়ে বাড়ি ফিরে ছেলেমেয়ে, স্বামী, শ্বশুর-শাশুড়ি, মা-বাবা, ভাইবোনদের সঙ্গে কত রকম আলোচনা–পরিকল্পনা করলেন। সেসব জানা গেল প্রতিদিনের কুচকাওয়াজে, শরীরচর্চার প্রশিক্ষণে যুদ্ধ প্রস্তুতির জন্য হাতে লাঠি, মাথায় ক্যাপ, পায়ে কেডস, মুখে দৃঢ়তা নিয়ে মনোবল তৈরির সমাবেশগুলোতে যখন মহিলারা একত্র হয়ে পরস্পর আলোচনা করতেন তখন।
বঙ্গবন্ধু নারীসমাজকে, মাতৃহৃদয়কে সর্বোচ্চ সম্মান দিয়েছিলেন বলে মহিলারা উদ্দীপ্ত হয়েছিলেন। বাংলার মায়ের কোল শূন্য করার প্রতিবাদে বঙ্গবন্ধু গোলটেবিল বৈঠকের প্রস্তাব বাতিল করে দিয়েছেন—প্রত্যেক মায়ের মনে কথাটি মহৎ এক তাৎপর্য নিয়ে দাগ কেটেছিল। ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলার আহ্বানও নারীসমাজকে আপ্লুত করেছিল। প্রতিটি ঘর থেকে শুরু করতে হবে স্বাধীনতাসংগ্রামের প্রতিরোধ আন্দোলন, ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তুলতে হবে—নারীসমাজ এই আহ্বানকে আক্ষরিক অর্থেই গুরুত্ব দিয়েছিল।
বঙ্গবন্ধু নারীসমাজকে, মাতৃহৃদয়কে সর্বোচ্চ সম্মান দিয়েছিলেন বলে মহিলারা উদ্দীপ্ত হয়েছিলেন। বাংলার মায়ের কোল শূন্য করার প্রতিবাদে বঙ্গবন্ধু গোলটেবিল বৈঠকের প্রস্তাব বাতিল করে দিয়েছেন—প্রত্যেক মায়ের মনে কথাটি মহৎ এক তাৎপর্য নিয়ে দাগ কেটেছিল।
’৬৯-এর গণ–আন্দোলনের সময় থেকে কবি সুফিয়া কামালের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা মহিলা সংগ্রাম পরিষদের বিলুপ্তি ’৭০-এ ঘটে গেলেও সংগ্রামী মহিলারা মুক্তিযুদ্ধের সূচনালগ্নে নিজ নিজ রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক দলের সঙ্গে যোগ দিয়ে ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ার কাজে ঝাঁপিয়ে পড়েন। তত দিনে পূর্ব পাকিস্তান মহিলা পরিষদ গড়ে উঠেছে। বেগম জোহরা তাজউদ্দীন, সাজেদা চৌধুরী, নূরজাহান মুরশিদ, মতিয়া চৌধুরী, ড. নীলিমা ইব্রাহিম প্রমুখ বহু নেতা উনসত্তরের গণ–আন্দোলনে রাজবন্দী মুক্তি সংগ্রামের সময় বাংলাদেশের নারীসমাজের আন্দোলনকে গণ–আন্দোলনে সমর্থন জানিয়েছেন। মিছিল থেকে সে সময়ের ছাত্রীরাও দৃপ্ত শপথে সংগ্রামে নিবেদিত হয়েছিল। ওরা নিজ নিজ বাড়িতে, পরিবারে মা–বোন–ভাবিদের সমর্থন তৈরি করতে পেরেছিল। সেসব কাহিনি আজও অকথিত রয়ে গেছে।
আমরা যখন ঢাকায় কুচকাওয়াজ করতে একত্র হতাম কোনো দিন সেগুনবাগিচায়, কোনো দিন ধানমন্ডির গার্লস কলেজের মাঠে, কখনো বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় অথবা পলাশী, জিগাতলা, রায়েরবাজার, কলাবাগান, গোপীবাগ-সূত্রাপুর-গেন্ডারিয়ায় তখন বিভিন্ন পাড়া থেকে আসা মহিলারা সোৎসাহে বলতেন, ছেলেমেয়েরাও গিয়েছে ছাত্রছাত্রীদের প্রশিক্ষণে, স্বামী গিয়েছেন রাজনৈতিক সাংস্কৃতিক সমাবেশে। মহিলারা বলতেন, তাঁদের বাড়িগুলো হয়ে উঠেছে একেকটি দুর্গ। বাড়ির সব মানুষ একই রকম ভাবনায় সংগ্রামী নানা কাজের তৎপরতায় একাত্ম হয়ে উঠতেন। মায়ের আছে কুচকাওয়াজের তাড়া, মেয়ের আছে অস্ত্র চালনা ট্রেনিংয়ের তৎপরতা। বাবা আর ছেলেও বেরিয়ে পড়েছেন কোনো না কোনো অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দিতে। কোনো অনুযোগ ছিল না সময়মতো রান্না হলো না, খাওয়ার সময় গৃহিণী বা মা বসে রইলেন না বলে। হাতে হাত লাগিয়ে সংসারের সব কাজ করার জন্য সবাই ছিলেন তৎপর।
একদিন সারা আলী খালাম্মা বললেন, (তাঁদের সেগুনবাগিচা বাসার সামনের খোলা বড় মাঠে নিয়মিত লাঠি হাতে কুচকাওয়াজ হতো), ‘রেজা আলীকে নিয়ে আমি ভয় পেয়েছি এত দিন, পুলিশ জেল-জুলুমের ভয়। এখন রেজা ভয় পায় তার নানিকে নিয়ে, মাকে নিয়ে।’ রেজা ভাইয়ের নানি, এ দেশের প্রথম মহিলা রাজনীতিবিদ জোবেদা খাতুন চৌধুরাণীকে (৭০ বছর বয়সেও) যখন আমাদের সভাগুলোতে, মিছিলে, কুচকাওয়াজে পেতাম ১৯৭০ থেকে ১৯৭১-এর মার্চ মাসের প্রতিরোধে উত্তাল দিনগুলোতে, তখন আমরা সাহসে বলীয়ান হয়ে উঠতাম। তিনি দেশেই ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের সময়। নানাভাবে সাহায্য করেছিলেন মুক্তিযোদ্ধাদের। ১৬ ডিসেম্বর জাতীয় পতাকা হাতে পাড়ার সবাইকে নিয়ে মিছিল করে বেড়েয়েছিলেন। হোসনে আরা ইসলাম (বেবী আপা) বললেন, ‘তোমার ইসলাম ভাইকে (স্থপতি মাযহারুল ইসলাম) নিয়ে সব সময় চিন্তিত থাকতাম কখন না জানি কী হয়, এখন নিজে বেরিয়ে পড়েছি, সভায় মিছিলে যুদ্ধ প্রশিক্ষণে; সবাই বড় উদ্বিগ্ন থাকে আমার যদি কিছু হয়?’ ষাটের দশকজুড়ে তাঁদের পরীবাগের বাড়িটিকে আমরা পেয়েছি সব রকম কাজের কেন্দ্ররূপে। বাড়িটি তখন থেকেই দুর্গ হিসেবে গড়ে উঠেছিল।
কবি সুফিয়া কামাল সে সময় দৃপ্ত স্লোগানে খর দ্রুতপায়ে হাঁটতেন মিছিলের পুরোভাগে। তাঁর সঙ্গে তাল মিলিয়ে হাঁটতে গিয়ে তরুণী আমরা হিমশিম খেতাম। ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলার দায়িত্ব তিনি বুঝিয়ে দিতেন আমাদের সবাইকে। কী ব্যাকুল আনন্দে, কী অধীর উন্মাদনায় সেদিন মায়েরা-মেয়েরা কাজের দায়িত্বগুলো বুঝে নিয়েছিলাম, আজও তা মনে হলে রক্তে বেজে ওঠে দামামা। হুরমুতুন্নেসা ওদুদ (প্রয়াত), নুরুজাহান কাদের, আমেনা আহমেদ, সারা আলী, রেবেকা মহিউদ্দিন, হোসনে আরা ইসলাম, উম্মেহানি খানম, সখিনা বেগম, তাবিন্দা আক্তার, হাস্নাবানু, এডলিন মালাকার, ফওজিয়া মোসলেম, ফরিদা আক্তার, কাজী মমতা হেনা, মাখদুমা নার্গিস, নাজমুন নাহার, মাহফুজা খানম, আয়শা খানম, রোকেয়া কবির, রোকেয়া সুলতানা রাকা, মুনিরা আক্তার, খালেদা মাহবুবসহ বহু নারী ও ছাত্রী সংগঠকদের নিয়ে আমরা মহিলাদের মধ্যে ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলার প্রস্তুতি নেওয়ার জন্য নানাভাবে উদ্দীপ্ত করতাম। সে সময় আমরা একেকটি এলাকা ধরে বাড়ি বাড়ি গিয়ে বুঝিয়েছিলাম স্বাধীনতাসংগ্রামের একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ ‘ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলা’, এই কাজের ৯০ ভাগ দায়িত্ব নারীসমাজকেই গ্রহণ করতে হবে।
কবি সুফিয়া কামাল সে সময় দৃপ্ত স্লোগানে খর দ্রুতপায়ে হাঁটতেন মিছিলের পুরোভাগে। তাঁর সঙ্গে তাল মিলিয়ে হাঁটতে গিয়ে তরুণী আমরা হিমশিম খেতাম। ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলার দায়িত্ব তিনি বুঝিয়ে দিতেন আমাদের সবাইকে।
শুধু ঢাকা শহরেই সীমাবদ্ধ ছিল না আমাদের কর্মকাণ্ড। দেশের অনেক জেলা—নারায়ণগঞ্জ, বরিশাল, ময়মনসিংহ, নরসিংদী, ফরিদপুর, পাবনা, রংপুর, সিলেট, দিনাজপুর, বগুড়া, কুমিল্লা, চট্টগ্রামসহ অনেক জেলাতেই কবি সুফিয়া কামালের নেতৃত্বে গড়ে উঠেছিল পূর্ব পাকিস্তান মহিলা পরিষদের শাখা। মনোরমা বসু বরিশালে নেতৃত্ব দিয়েছেন, সঙ্গে ছিলেন পুষ্প নাগ, রানী ভট্টাচার্য, সুফিয়া ইসলামসহ অনেকেই। উমরতুল ফজল নেতৃত্ব দিয়েছেন চট্টগ্রামে, সেখানে মুশতারী শফি, নূরজাহান খান, হান্নানা বেগম, দিল আফরোজ দিলু, মিসেস এম এস হক, গীতা ঘোষ, জাহানারা বেগম, আরতি দত্ত, সীমা চক্রবর্তী প্রমুখ নারী ও ছাত্রী সংগঠক ছিলেন। পাবনায় রকিবা খাতুন, ঈশ্বরদীতে মিসেস জসীম মণ্ডল, উষা দাশ পুরকায়স্থ সিলেটে, সেখানে খোদেজা কিবরিয়াসহ অনেকে ছিলেন সঙ্গে; কুমিল্লায় সেলিনা বানু, ময়মনসিংহে সোফিয়া করিম, মজিরুন্নেছা, রাজিয়া খাতুন, হালিমা খাতুন, নুরুন্নাহার বেলী, নারায়ণগঞ্জে নেতৃত্ব দেন হেনা দাশ, সঙ্গে ছিলেন নাজমা রহমান, জোবেদা, দীপা, মাহফুজা, হোসনে আরা, রেণু চক্রবর্তী, লক্ষ্মী প্রমুখ। নরসিংদীতে যূথিকা চ্যাটার্জী, গৌরী সাহা, ফৌজিয়া পারভীন ছিল নিবেদিত। প্রবীণ ও নবীন নারী ছাত্রী নেত্রীরা গড়ে তোলেন নারীদের মধ্যে ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলার ব্যাপক তৎপরতা। বহু নবীন ছাত্রী যোগ দিয়েছিলেন সারা দেশের নারীসমাজের এই তৎপরতায়।
কবি সুফিয়া কামালের সঙ্গে সে সময় অনেক জেলায় ঝটিতি সফর করার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল। তিনি সভানেত্রী, আমি ছিলাম সাধারণ সম্পাদিকা। নিজেদের বাড়িঘর ফেলে মার্চ মাসের উত্তাল দিনগুলোতে আমরা ছুটে চলেছি ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলার বার্তা নিয়ে। ২২ মার্চ ’৭১ চট্টগ্রামে ছিল আমাদের সর্বশেষ সফর। ঢাকা শহরের চেয়ে কোনো অংশে কম তৎপরতা ছিল না জেলার নারীসমাজের মধ্যে। সেখানে যেমন দেখেছি মিছিল-মিটিং-প্রতিরোধ আন্দোলনে মেয়েরা সক্রিয়ভাবে কাজ করেছেন, তেমনি দেখেছি তাঁরা সাংস্কৃতিকভাবে সোচ্চার হয়ে কণ্ঠ মেলাচ্ছেন গানে, অভিনয় করছেন পথনাটকে। তাঁদের সঙ্গে শিশু–কিশোরী সন্তানেরাও যোগ দিত। ঢাকা শহরে লেখিকা-কবি-শিল্পী নারীরা, নার্স মেয়েরা নিজ নিজ ব্যানারে সংগঠনের কাজ করেছেন (নাম বাদ পড়েছে অনেকের। তাঁরা নিজ গুণে ক্ষমা করবেন)।
সংগঠনের সঙ্গে যে নারীরা যুক্ত হতে পারেননি নানা কারণে, যেমন বাড়িতে অসুস্থ প্রবীণ বৃদ্ধ আত্মীয় থাকায়, দুগ্ধপোষ্য শিশু থাকায় অথবা সংকোচে, অবরোধের বাধায়, গৃহস্থালি কাজের চাপে; তাঁরাও কিন্তু ঘরে ঘরে সচেতন হতে থাকেন, সতর্ক হয়ে ওঠেন সংগ্রামের হাতছানিতে। ছাত্রছাত্রী সন্তানটিকে কাছে পেয়ে গভীর রাতের অন্ধকারে শুনে নিতেন তাঁরা সমুদ্রের কল কল গর্জন। নিজেদের অন্তরে পাঠিয়ে দিতেন সে ডাক। লাখ লাখ মা তাই মুক্তিযোদ্ধা, গেরিলা যোদ্ধা সন্তানকে দেশের জন্য উৎসর্গ করতে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন।
শুধু ঢাকা শহরেই না। দেশের অনেক জেলা—নারায়ণগঞ্জ, বরিশাল, ময়মনসিংহ, নরসিংদী, ফরিদপুর, পাবনা, রংপুর, সিলেট, দিনাজপুর, বগুড়া, কুমিল্লা, চট্টগ্রামসহ অনেক জেলাতেই কবি সুফিয়া কামালের নেতৃত্বে গড়ে উঠেছিল পূর্ব পাকিস্তান মহিলা পরিষদের শাখা।
প্রত্যেকের নিজ অভিজ্ঞতা মিলিয়ে দেখবেন, বাড়িগুলো সে সময় দুর্গই হয়ে উঠেছিল কি না! আমার শাশুড়ি লুৎফুন্নেসাকে দেখেছি, বাড়িতে পাঁচ মেয়ে ও দুই যুবক-কিশোর ছেলেকে নিয়ে যুদ্ধপ্রস্তুতির মোকাবিলা করতে; আমার মা ফহিমা বেগমকে দেখেছি, নীরবে—স্থির প্রতিজ্ঞায় অটল থেকে বাড়িটিকে দুর্গ করে গড়ে তুলতে। পুরো ষাটের দশক এবং পরবর্তী সময়ে তাঁদের বাড়িতে আত্মগোপনকারী কমিউনিস্ট ও ছাত্রনেতাদের অনেকেই তাঁদের সযত্ন আশ্রয়ে থেকেছেন। গোপন সভা হয়েছে প্রচুর। বোনেরা সহায়তা দিয়েছেন অনেক। তাঁদের সমর্থন আমাকে, স্বামীকে, ভাইকে মুক্তিযুদ্ধের জন্য নিবেদিত হতে অনুপ্রাণিত করেছে। ’৭১-এ আমার শাশুড়ি তরুণী পাঁচ মেয়েকে নিয়ে গ্রাম থেকে গ্রামে ঘুরে ফিরেছেন নিরাপত্তার জন্য। সেই অবস্থায়ও মতিয়া চৌধুরী, বজলুর রহমান এবং আয়েশা খানম, মুনিরা আক্তার, রোকেয়া কবীরসহ আমাদের সবাইকে ঝুঁকি নিয়ে রেখেছেন কাপাসিয়ায়। কেউ জানেনি এঁদের পরিচয়। আমরা চলে গেলাম আমাদের পরম শুভানুধ্যায়ী, আশ্রয়দাত্রী শাশুড়িকে ফেলে আগরতলায় মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিতে। তিনি রক্ষা করলেন মেয়েদের, বাড়িঘর। ফিরে এসে আবার পেলাম আশ্রয়। মাকে ফেলে গেলাম ঢাকার ওয়ারীর বাসায়। ভাবি মুন্নুজান ও তাঁর পুরো পরিবার পথ দেখিয়ে ঢাকা থেকে নিয়ে গেল বেরাইদের পথে। মা, বোন, ভাবিরা রয়ে গেলেন ঢাকায়। আমাদের বই, লিফলেট, কাগজপত্র সামলাতে তাঁদের প্রাণান্ত হয়েছিল। সে বাড়িতেই মুক্তিযুদ্ধ শেষে পেলাম আবার মায়ের আশ্রয়।
সাইফুদ্দিন আহমেদ মানিকের আম্মা, আব্বা, বোন, ভাইদের সহায়তায় তাঁদের বাড়িটি হয়ে উঠেছিল আমাদের আশ্রয়স্থল। ফওজিয়া মোসলেমের আম্মা, নাজমুন নাহার, মাখদুমা নার্গিসের আম্মা, সারোয়ার আলীর আম্মা—এ রকম বহু ছাত্র-রাজনৈতিক নেতার বাড়িকে মায়েরা–বোনেরাই বানিয়েছিলেন দুর্গ।
সেসব ভুলি কীভাবে? মায়েরা এভাবেই দুর্গ বানিয়েছিলেন। কৃতজ্ঞ তাঁদের কাছে।
গাঁয়ের পথে রাজাকারেরা যখন ওত পেতে ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের ধরার জন্য, তখন ঘরে ঘরে মায়েরাই বুক পেতে আশ্রয় দিয়েছিলেন মুক্তিযোদ্ধাদের। মুক্তিযুদ্ধ ও গেরিলা যুদ্ধের সাহসিক সশস্ত্র লড়াই এ দেশের ৩০ লাখ শহীদ সন্তান অকুতোভয়ে আত্মোৎসর্গ করেছেন; তাঁদের মায়ের আশীর্বাদে, বোনের অপার স্নেহ-মমতার শক্তিতেই। ঘরে ঘরে মা-বোনেরা রইলেন দুর্গ গড়ার জন্য। ছেলেরা—ভাইয়েরা, বাবারা গেলেন দেশ স্বাধীন করার জন্য সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে। বহু নারীও যুদ্ধ করেছেন। কিন্তু ইতিহাসে তার উল্লেখ নেই ।
অনেক বাড়িতেই দেখেছি মেয়েরা বাড়ির বঁটি, দা, কুড়াল, চাকু এসব অস্ত্র মজুত রাখতেন নিজেদের আত্মরক্ষার জন্য। আমার মা-শাশুড়ির মতো প্রায় সব মা–ই মুক্তিযুদ্ধের সময় হাতে রাখতেন ধারালো বড় দা। বলতেন, ‘পাকিস্তানি সেনারা, রাজাকারেরা এলে আগে আমাকে মেরে তবে বাড়িতে ঢুকবে, তাদের মেরে তবে মরব।’ হাতে লাঠি নিয়ে মিছিলে যেতেন মায়েরা-মেয়েরা। এ সবই সশস্ত্র (আগ্নেয়াস্ত্র) যুদ্ধ মোকাবিলার ক্ষেত্রে প্রতীকী প্রস্তুতি ছাড়া কিছুই ছিল না। কিন্তু এই প্রস্তুতির ফলে নারীর যে অকুতোভয় সাহস ও বীরত্বের প্রস্তুতি গড়ে উঠেছিল, তা দিয়েই তো নয়টি মাস এ দেশের নারীরা শত্রুদের মোকাবিলা করেছেন। তা আজও অকথিত রয়ে গেছে।
একেবারে উচ্চারিত হয়নি তা নয়; কিন্তু সেসব ভুলে যাচ্ছি আমরা, চলে যাচ্ছে বিস্মৃতির অন্তরালে। কবি সুফিয়া কামালের ‘একাত্তরের ডায়েরী’র পাতায় পাতায় আছে রক্তাক্ত স্বাক্ষর (মুক্তিযুদ্ধের জাদুঘরে ডায়েরিটি সংরক্ষিত আছে। প্রকাশিত হয়েছে বই আকারে)।
কবি সুফিয়া কামাল নিজে রইলেন তাঁর ধানমন্ডির বাড়িতেই। মেয়েদের পাঠিয়ে দিলেন মুক্তিযুদ্ধে। বাড়িতেই তিনি গড়ে তুলেছিলেন মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তার জন্য নানাবিধ কাজের নানা প্রক্রিয়া। পাড়ার ভেতরে দেয়াল টপকে টপকে (সদরে যেহেতু সশস্ত্র সেনা থাকত) এ বাড়ি ও বাড়ির মধ্য দিয়ে চলত মহিলাদের মধ্যে যোগাযোগ। যাঁরা পাড়া ছেড়ে চলে যেতেন তাঁরা রেশন কার্ড রেখে যেতেন কবি সুফিয়া কামালের কাছে। রেশন কার্ড একত্র করে রেশন তুলে সুফিয়া খালাম্মার বাসায় মজুত করা হতো। রিকশাওয়ালা সেজে অধ্যাপক গিয়াসউদ্দিন আহমেদ (শহীদ) খালাম্মার প্রতিবেশীদের বাড়ি টপকে টপকে এসে নিয়ে যেতেন সেসব খাদ্যসমাগ্রী।
অনেক বাড়িতেই দেখেছি মেয়েরা বাড়ির বঁটি, দা, কুড়াল, চাকু এসব অস্ত্র মজুত রাখতেন নিজেদের আত্মরক্ষার জন্য। আমার মা-শাশুড়ির মতো প্রায় সব মা–ই মুক্তিযুদ্ধের সময় হাতে রাখতেন ধারালো বড় দা।
সুফিয়া কামালের ডায়েরি থেকে আমরা জানতে পারি, তাঁর বাড়িটির উল্টো দিকে (ভেতরের দিকে) ছিল রাশিয়ান কালচারাল সেন্টার। দুই বাড়ির মাঝে পাকা দেয়াল ছিল না তখন। সেই সেন্টারে কাজ করতেন একসময়ের ছাত্রনেতা নুরুল ইসলাম (পরে শ্রমিকনেতা)। তাঁর মাধ্যমে যোগাযোগ হতো কবির সঙ্গে বহির্বিশ্বের নানা খবরাখবরের ব্যক্তির। সাহিত্যিক-সাংবাদিক (শহীদ) শহীদুল্লা কায়সার সে পথেই একদিন এসেছিলেন। খাবার সাজিয়েও কবি তাঁকে খাওয়াতে পারেননি। তাঁকে চলে যেতে বলেছিলেন দেশ ছেড়ে, লুকিয়ে থাকতে বাড়ি ছেড়ে। কিন্তু কী যেন ভাবতেন শহীদুল্লা কায়সার। অবশেষে বাড়ি ছেড়ে যেদিন যাবেন, সেদিনই (স্বাধীনতার মাত্র দুই দিন আগে, ১৪ ডিসেম্বর) আলবদরের হাতে তিনি নিহত হলেন। এ খবর পেয়ে কবি সুফিয়া কামালের অন্তর শতধা হয়ে যায় ।
এপ্রিলের শেষ দিকে ঢাকায় প্রতিরোধের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ভিত্তিগুলো গড়ে উঠছিল, জানা যায় মুনতাসীর মামুনের স্মৃতিকথায়। বোরহান উদ্দিন খান জাহাঙ্গীর, অধ্যাপক গিয়াসউদ্দিন, অধ্যাপক জয়নুল আবেদিনসহ কয়েকজনের সহায়তায় একটি গ্রুপ হয়েছিল। তাঁদের মূল কাজ ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের ও শহীদ পরিবারের সাহায্য করা। বেবী মওদুদ থাকতেন কাছাকাছি বাসায়। তিনি ও মুনতাসীর মামুন সাহায্য করতেন সব রকম কাজে। পরোক্ষে বহু পরিবারের মা-বোনেরা যুক্ত হয়েছিলেন এসব কাজে।
কবি সুফিয়া কামাল বলেছেন, ‘বাংলাদেশকে স্বাধীন করার জন্য মা-বোনেরা যুদ্ধ করেছেন। মা, বোন, ভাই, স্বামী একত্র হয়ে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। তারা সংগ্রাম করেছেন। তারা সাহসের সঙ্গে মোকাবিলা করেছেন শত্রুকে। যুদ্ধের পর কেউ তাদের ডাকেনি। এটা তাদের দুঃখ ও ক্ষোভের বিষয়।’ (নারী গ্রন্থ প্রবর্তনার ‘মহিলা মুক্তিযোদ্ধা বই’)
সাহিত্যিক সংগ্রামী সত্যেন সেন স্মৃতিকথায় (‘রক্তাক্ত বাংলা’ গ্রন্থে) বলেছেন, ‘ছোট্ট মেয়ে মিলি অষ্টম শ্রেণীর ছাত্রী।...আমাকে সে বলত এবারকার সংগ্রামে শুধু ছেলেরা নয়, মেয়েরাও এগিয়ে যাবে। বারবার সে বলত...দাদা, ওরা তো আক্রমণ করছে। আমরা কি এখনো প্রতিরোধ করব না? কেমন করে প্রতিরোধ করব? আমাদের হাতে যে অস্ত্র নেই? এ কথার কোনো উত্তর নেই।...স্বাধীনতাসংগ্রামের যুগে পুলিশের শ্যেনদৃষ্টি এড়িয়ে পলাতক অবস্থায় যে পরিবারে ছিলাম সেখানে বৌমার রক্ষণাবেক্ষণ ছাড়া বাঁচতেই পারতাম না। স্বাধীনতার পর নতুন অধ্যায়ে বৌমাদের কথা ভুলেই গিয়েছিলাম, নিমকহারামি আর কাকে বলে?’
সেই সহায়তার কথা রয়ে গেছে আড়ালে, ভাস্বর হয়েছে পুরুষের গেরিলা যুদ্ধ। নারীরা পরোক্ষে কাজ করেছেন গেরিলা যুদ্ধে। গেরিলা যোদ্ধা হিসেবে নারীদের ভূমিকা ইতিহাসে স্বীকৃতি পায়নি। নারীদের সহায়তা ছাড়া গেরিলাদের সাফল্য সম্ভব হতো না।
সাহিত্যিক আবুল ফজল তাঁর ‘দুর্দিনের দিনলিপি’তে বলেছেন, ‘বন্দুকধারী দুর্বৃত্তরা এক মহিলার বালা ছিনিয়ে নিতে চেষ্টা করেও পারেনি মুক্তিযুদ্ধের সময়। বয়স্কা মহিলার কাছে দুর্বৃত্তরা বোধ করি এতখানি সাহস আশা করেনি। মনে হয় প্রতিরোধের নিজস্ব একটা মূল্য রয়েছে, যা সব ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ ব্যর্থ নয়।...আজ শ্রদ্ধাবনতচিত্তে স্মরণ করব যারা আমাদের এ বিজয়ের পথ রচনা করেছেন রক্ত দিয়ে, অশ্রু দিয়ে, পুত্র দিয়ে, স্বামী দিয়ে, পিতা-ভাইকে বলি দিয়ে—সেসব অজ্ঞাতনামাদের। ইতিহাসে তারা উল্লিখিত হবেন না সত্য, কিন্তু কৃতজ্ঞচিত্তে বাঙালি কখনো ভুলবে না এ আত্মোৎসর্গের অমর স্মৃতি। গৌরবের সঙ্গে মিশে আছে অসীম বেদনাও।’
বাসন্তী গুহঠাকুরতা ‘একাত্তরের স্মৃতি’তে বলেছেন, ‘মুক্তিযুদ্ধে মেয়েদের অংশগ্রহণ মানে মেয়েদের সাহস।’
সাহিত্যিক রাবেয়া খাতুন, সেলিনা হোসেন বলেছেন বিভিন্ন লেখায়, মুক্তিযুদ্ধের সময় দেশের নারীসমাজ কীভাবে ঘরে ঘরে দুর্গ গড়েছিলেন। রশীদ হায়দার সম্পাদিত ‘স্মৃতি ’৭১’-এর পাতায় পাতায় শহীদ স্বজনদের কথা বলেছেন নারীরা, যাঁরা দুর্গ গড়েছিলেন, কিন্তু বাঁচাতে পারেননি স্বজনদের। কাদের সিদ্দিকী বলেছেন (স্বাধীনতা ’৭১), ‘প্রত্যক্ষভাবে নারীসমাজ টাঙ্গাইলের মুক্তিযুদ্ধে অস্ত্র ধারণ না করলেও তারা মুক্তিযুদ্ধের অর্ধেক দায় দায়িত্ব বহন করেছেন। তাদের অমূল্য অবদান না থাকলে আমরা এত তাড়াতাড়ি সফল হতে পারতাম না।’
সম্প্রতি প্রদর্শিত তারেক ও ক্যাথরিন মাসুদ নির্মিত ‘মুক্তির কথা’ প্রমাণ্যচিত্রে আমরা দেখেছি গ্রামের মহিলারা, পুরুষরা ঢাল-সড়কি, কাতরা নিয়ে যুদ্ধ করেছিলেন, পাকিস্তানি সেনাদের তাড়িয়ে দিয়েছিলেন গ্রাম থেকে। ছবিতে বলেছেন মইফুল ‘মেলেটারি নগরকান্দার থাইক্যা প্রথম আইসা চান্দের হাট গেছিল। চান্দের হাটেরতো ফিরা আবার আইসা আমাগো গ্রামের ভিতরদা এহেনে খাড়াইয়া গুলি করবার আরম্ভ করল। গুলি হরে আমাগো বাড়ির দিকে। গুলি হরলে দ্যাহে, খাইছে, আমাগো তো সারা গ্রাম থাকবে না আর, আগুন ধরাইয়া দিবেনে। এই তো আমাগো গ্রামের মানুষ বাইরাইলো ঢাল, কাতরা লইয়া। আমিও বাইরাইছিলাম। কত পানি নিয়া বাইরাইয়া বিটাগো খাওয়াছি। তারা তো দাবরাইতে দাবরাইতে হয়রান হইয়া গেছিল। হগলতা লইয়াও বাইরাইছিলাম। লইয়া আউগাইয়া আউগাইয়া দিছি। কত চাড়া, কান্দা, ঢাল, কাতরা, নাডি, ঠ্যাঙ্গা সবতা আউগাইয়া আউগাইয়া দিছি।’ এ রকম সংগ্রামের কথা, ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ার কথা আজও অকথিত রয়ে গেছে।
গেরিলা যুদ্ধের বিবরণ যৎসামান্য হলেও ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ: দলিলপত্র’তে রয়েছে। সেই যুদ্ধের সাফল্যের সঙ্গে এ দেশের গ্রামগঞ্জের ও শহর-বন্দরের নারীদের পরোক্ষ সহায়তা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। কিন্তু সেই সহায়তার কথা রয়ে গেছে আড়ালে, ভাস্বর হয়েছে পুরুষের গেরিলা যুদ্ধ। নারীরা পরোক্ষে কাজ করেছেন গেরিলা যুদ্ধে। গেরিলা যোদ্ধা হিসেবে নারীদের ভূমিকা ইতিহাসে স্বীকৃতি পায়নি। নারীদের সহায়তা ছাড়া গেরিলাদের সাফল্য সম্ভব হতো না।
১৯৭১-এর মার্চ মাসের ৮ তারিখ থেকে ভবনে ভবনে কালো পতাকা তোলার কর্মসূচি সফল করার ক্ষেত্রে মেয়েরা–মায়েরা ভূমিকা রেখেছেন। অবলীলায় তাঁরা এক টুকরা কালো কাপড় সেলাই করে পতাকা বানিয়ে বাড়ির ছাদে ছাদে টানিয়েছিলেন বাঁশের আগায়। ঢাকা শহরের বিভিন্ন পাড়ায়, বিভিন্ন শহরে বাড়িতে বাড়িতে শিশু কাঁখে গৃহবধূরা সোত্সাহে কালো পতাকা উড়িয়েছেন। এরপর ২৩ মার্চ থেকে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা তুলেছিলেন তাঁরা বাড়ির ছাদে ছাদে। এই পতাকার জন্য বাড়িতে সেনা ঢুকেছে, রাজাকারদের সঙ্গে নিয়ে। মেয়েদের বাড়িতে বাড়িতে নির্যাতিত হতে হয়েছে পাকিস্তানি সেনা-রাজাকারদের কাছে। তবু নারীরা হাল ছাড়েননি। মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করেছেন সব সময়।
ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলার কারিগরদের কথা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে আজও অকথিত, বিস্মৃত। আমার দেখা, জানা ও শোনা কিছু কথা বললাম। অনেক রয়ে গেছে অজানা। অন্যেরা যা জানেন, দেখেছেন-শুনেছেন, সেসব বললেই সম্পূর্ণ হবে এই ইতিহাস। সবাইকেই বলতে হবে সেসব কথা। শুরু হোক সেই কাজ।
৭/১২/৯৯