লেট ইট গো (Let it go) ২০১৩ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ডিজনির ফ্রোজেন (Frozen) সিনেমার একটি গান। যৌথভাবে গানটি রচনা ও সুরারোপ করেছেন মার্কিন শিল্পী-দম্পতি কার্স্টেন-অ্যান্ড-রবার্ট লোপেজ। কণ্ঠে তুলেছেন ইদিনা মেনজেল। আর গানের সঙ্গে ঠোঁট নাড়িয়েছেন এই সিনেমার গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র কুইন এলসা। অ্যানিমেশন মুভির এ চরিত্রটির কণ্ঠও দিয়েছেন ইদিনা। গানটি ২০১৪ সালের ‘বেস্ট অরিজিনাল সং’ ক্যাটাগরিতে অস্কার জিতেছিল। ২০১৫ সালে জেতে মার্কিন সংগীতজগতের সবচেয়ে বড় পুরস্কার গ্র্যামি অ্যাওয়ার্ড।
সিনেমার প্রয়োজনে গান আসে। ঘটনাপরম্পরার ওপর নির্ভর করেই তৈরি করা হয় গানের কথা, সুর বা গায়কির ধরন। সাধারণত সিনেমার প্রয়োজন মেটায় গান। কিন্তু এ ক্ষেত্রে উল্টোটি, অর্থাৎ গানের প্রয়োজন মিটিয়েছে সিনেমা!
২.
কিন্তু পুরস্কার বা আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তা নয়, গানটির গুরুত্ব অন্য জায়গায়। চরিত্র বা ঘটনাকে ফুটিয়ে তোলার জন্য বা নেহাত বাণিজ্যিক কারণে সিনেমায় গান ব্যবহারের রীতি আছে। ডিজনির মুভিগুলোতে এটা আরও বেশি। সিনেমার প্রয়োজনে গান আসে। ঘটনাপরম্পরার ওপর নির্ভর করেই তৈরি করা হয় গানের কথা, সুর বা গায়কির ধরন। সাধারণত সিনেমার প্রয়োজন মেটায় গান। কিন্তু এ ক্ষেত্রে উল্টোটি, অর্থাৎ গানের প্রয়োজন মিটিয়েছে সিনেমা! গানের প্রয়োজনে পরিবর্তন করা হয়েছে সিনেমার ঘটনা, এমনকি চরিত্র! সাধারণত এ রকমটি দেখা যায় না। অথচ ঠিক তা–ই ঘটেছে এ সিনেমায়।
৩.
এক অদ্ভুত ক্ষমতা নিয়ে জন্মগ্রহণ করে নর্ডিক রাজকুমারী এলসা। হাতের ইশারায় বরফ বানিয়ে ফেলতে পারে। শুধু বানানোই নয়, ইচ্ছেমতো বরফের ব্যবহারও করতে পারে। একটা সুন্দর বাড়ি যেমন বানাতে পারে, তৎক্ষণাৎ সে বাড়ি ভেঙে ফেলার ক্ষমতাও রাখে। আস্ত একটা নদীকে শুধু ছুঁয়ে দিয়ে বরফের আস্তরণে ঢেকে দিতে পারে। বানিয়ে দিতে পারে সুশোভিত স্ফটিক উদ্যান।
দুর্লভ এই ক্ষমতা যেমন সুন্দর, তেমনি বিপজ্জনক। কীভাবে সেটা ব্যবহার করা হচ্ছে, তার ওপরেই যেহেতু সব নির্ভর করে। একটা কুঠার দিয়ে যেমন চাইলে আপনি কাঠ কেটে ঘর বানাতে পারেন, আবার বানানো ঘরও তছনছ করে দিতে পারেন। নির্ভর করে ক্ষমতাধরের সদিচ্ছার ওপর।
একে তো ক্ষমতা মানেই এক দুধারী তলোয়ার; উপরন্তু যেকোনো দৈবিক ক্ষমতাকেই ভয়ের চোখে দেখে মানুষ। অনেক সময় ডাইনি উপাধিও দেওয়া হয় এমন বিশেষ ক্ষমতাধরদের। এলসার ছেলেবেলাতেই ঘটে যায় এক মর্মান্তিক ঘটনা। এলসার বানানো বরফের বাগানে খেলতে গিয়েই আহত হয় ছোট বোন আনা। চিকিৎসায় সেরে ওঠে যদিও, কিন্তু ভয় ঢুকে যায় তাদের পিতা-মাতার মনে।
তারা এলসার বিশেষ ক্ষমতা গোপন রাখার সিদ্ধান্ত নেয়। হাতে সব সময় দস্তানা পরিয়ে রাখা হয়। সীমিত করা হয় তার ঘরের বাইরে যাওয়া। ফলে এক বিষণ্ন, স্টোয়িক ধরনের মানুষ হিসেবে বড় হতে থাকে এলসা। প্রকৃতিপ্রদত্ত যে অপূর্ব ক্ষমতা নিয়ে জন্ম, সেটাকেই রাখতে হয় লুকিয়ে। ক্ষমতা দিয়ে বড় কিছু করা তো দূরের ব্যাপার, সাধারণ সৃজনশীল কাজেও তা ব্যবহারের সুযোগ পায় না। ফলে অবদমিত এক চরিত্র হিসেবে বেড়ে ওঠে এলসা।
অদ্ভুত ক্ষমতা নিয়ে জন্মগ্রহণ করে নর্ডিক রাজকুমারী এলসা। হাতের ইশারায় বরফ বানিয়ে ফেলতে পারে। শুধু বানানোই নয়, ইচ্ছেমতো বরফের ব্যবহারও করতে পারে। একটা সুন্দর বাড়ি যেমন বানাতে পারে, তৎক্ষণাৎ সে বাড়ি ভেঙে ফেলতেও সক্ষম।
নিজ ক্ষমতাকে ‘ইভিল পাওয়ার’ ভাবার মতো অবদমন, ভয় ও হীনম্মন্যতা মানুষকে ভেতর থেকে ভেঙে ফেলতে পারে। কেউ হয়ে পড়ে মানসিক ভারসাম্যহীন, কেউ আবার সুইসাইডও করে বসে। ক্ষমতা ব্যবহারের অক্ষমতাজনিত ক্রোধ থেকে এর অপব্যবহারও শুরু করে দেয় অনেকে। ইউরোপে আধুনিক স্লটার হাউস চালুর পর সদ্য বেকার অনেক কসাইকে বিকারগ্রস্ত হয়ে যেতে দেখেছি আমরা। তাদের কেউ কেউ তো তো গরু–ছাগল কাটতে না পারার আক্রোশ থেকে মানুষ কাটাকাটিই শুরু করেছিল।
তেমনটিই ঘটতে যাচ্ছিল এলসার ক্ষেত্রেও। ক্রমঅবদমনের চাপে ধীরে ধীরে একজন নেতিবাদী চরিত্রের মানুষ হয়ে ওঠার উপক্রম হয়। সিনেমার প্রথম স্ক্রিপ্ট সেভাবেই করা হয়েছিল। ছোট বোন আনা প্রটাগনিস্ট, এলসা ভিলেন—এ রকমই ছিল প্রাথমিক চিত্রনাট্য।
৪.
কিন্তু সব গড়বড় করে দেয় এই গান। কীভাবে? আবারও একটু প্লটে ফিরে যাই আমরা। বড় হয়ে গেছে আনা ও এলসা। ইতিমধ্যে তাদের মা–বাবার অকালমৃত্যু হয়েছে সমুদ্রডুবিতে। একাকিত্ব ও হীনম্মন্যতার কারণে বোনের সঙ্গেও কিছুটা দূরত্ব তৈরি হয়েছে এলসার।
এরই মধ্যে চলে আসে এলসার রাজত্ব গ্রহণের পালা। রাজ্যাভিষেক উপলক্ষে এত দিনের বদ্ধ রাজবাড়ি প্রথমবারের মতো উন্মুক্ত করে দেওয়া হয় জনগণের জন্য। উৎসবে মুখরিত চারদিক। ঘরে ঘরে আনন্দ। কিন্তু বিধি বাম। সেদিনই ঘটে এক অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা।
সদ্য প্রেমে পড়া ছোট বোনকে শাসাতে গিয়ে ক্রোধে সংবরণ হারানোর ফলে অনিচ্ছাকৃতভাবে এলসার ক্ষমতা জনসমক্ষে প্রকাশিত হয়ে পড়ে। প্রথমবারের মতো রাজ্যবাসী জানতে পারে এলসার এই দৈব ক্ষমতার কথা। প্রচণ্ড ভয় পেয়ে যায় তারা। ভীতসন্ত্রস্ত জনগণের তোপে পড়ে আত্মনির্বাসনে যেতে হয় এলসাকে। দূরের এক বরফ আচ্ছাদিত দুর্গম পাহাড়ে।
ঠিক এ রকম পরিস্থিতিতে, ভয়ংকর এক ভিলেন চরিত্রের রূপদানের অনুষঙ্গ হিসেবে পরিচালক গানটি তৈরির নির্দেশনা দেন সেই সংগীতশিল্পী–দম্পতিকে। সিনেমার ক্লাইমেক্স ঘনীভূত করার পাশাপাশি যে গানে ফুটে উঠবে অশুভ দানব এলসার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যও। বিষয়গুলো মাথায় রেখেই গানটার কথা ভাবছিলেন। কিন্তু গানটি করার সময় তাদের ফোকাস অন্যদিকে সরে যায়। ডেইলি এক্সপ্রেসে দেওয়া সাক্ষাৎকারে পটভূমি ব্যাখ্যা করেছেন এ দম্পতি।
প্রকৃত ক্ষমতা লুকিয়ে রাখতে বাধ্য হওয়ার গ্লানি এবং শেষ পর্যন্ত তা না পারার ব্যর্থতা নিয়ে নির্বাসিত একজন মানুষের মনোজগৎ কেমন হতে পারে, সেটিই হয়ে উঠল গানের মূল বিষয়বস্তু।
সে সময়ে একদিন তারা ‘প্রসপেক্ট’ পার্কের আপাত নির্জনতায় হাঁটতে হাঁটতে কথা বলছিলেন এলসা চরিত্র নিয়ে। কেমন মানুষ তিনি? স্ক্রিপ্ট অনুসারে একজন ভিলেন। কিন্তু সেটাই কি শেষ কথা? প্রকৃতিপ্রদত্ত ক্ষমতা তাকে লুকিয়ে রাখতে হলো। ব্যবহার দূরে থাক, বিষয়টা জানাজানি হলেও বিপদ—এমন পরিস্থিতি ফেস করতে হলো আজীবন। তবু শেষ রক্ষা হলো না। প্রকাশিত হওয়ার পর সমাজে চিত্রিত হলো ডাইনি হিসেবে, হতে হলো নির্বাসিত। প্রকৃত ক্ষমতা লুকিয়ে রাখতে বাধ্য হওয়ার গ্লানি এবং শেষ পর্যন্ত তা না পারার ব্যর্থতা নিয়ে নির্বাসিত একজন মানুষের মনোজগৎ কেমন হতে পারে, সেটিই হয়ে উঠল গানের মূল বিষয়বস্তু।
ডাইনি বা নির্বাসিত রাজকন্যা নয়, শিল্পীদ্বয় তাঁদের গানে ফুটিয়ে তুললেন নিজের ক্ষমতা নিয়ে সন্ত্রস্ত একজন নিঃসঙ্গ মানুষকে। যে কিনা মাত্রই পুনরাবিষ্কার করেছে নিজেকে, সম্পূর্ণরূপে অবগত হয়ে উঠেছে নিজের ক্ষমতা সম্পর্কে। এখানে এলসা নির্বাসিত, নিঃসঙ্গ। তাই সম্পূর্ণ স্বাধীন। তার আর দায় নেই নিজের ক্ষমতা বা নিজেকে লুকিয়ে রাখার। চাইলে মেলে ধরতে পারে প্রকাশিত হওয়ার সব আকাঙ্ক্ষাকে। আর কোনো ভয় নেই।
৫.
দুটি বিষয় এখানে আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। প্রথমত, একজন স্বাধীন মানুষ আসলে একজন নিঃসঙ্গ মানুষ। বা একজন নিঃসঙ্গ মানুষই আসলে স্বাধীন মানুষ। দ্বিতীয়ত, একজন স্বাধীন মানুষের পক্ষেই সম্ভব নিজেকে পুরোপুরি আবিষ্কার করা, নিজের ক্ষমতার পূর্ণাঙ্গ ব্যবহার করা। এই নির্বাসিত, একাকী, স্বাধীন জীবনেই এলসা নিজেকে পুরোপুরি চিনতে পারে, উপলব্ধি করতে পারে তার বিশাল ক্ষমতাকে। সেই সঙ্গে এ–ও উপলব্ধি করে, স্বাধীন মানুষের জীবন আসলে কঠিন জীবন। অসামাজিকতা, নিঃসঙ্গতা ও একাকিত্বের জীবন।
আমরা বুঝতে পারি মানুষ যদিও স্বাধীনতার কথা বলে, কিন্তু আসলে পরাধীন থাকতেই বেশি ভালোবাসে। মানুষ আশ্রয় খোঁজে। সুবিধার জন্য দাস্যসুখ মেনে নেয় হাস্যমুখে। শুধু সুবিধা বা আশ্রয়ের হিসাবই নয়, এটি একধরনের মানবিক দুর্বলতাও। সবচেয়ে শক্তিশালী মানুষটিও কখনো কখনো নিজেকে সঁপে দিতে চায় কোনো কোমল মমতার হাতে। প্রিয়জনের মন জোগানোর জন্য বিসর্জন দেয় সাধের কোনো নিজস্বতাকে।
গানটি শুনেই চিত্রনাট্য নিয়ে নতুন করে ভাবতে শুরু করেন পরিচালক জেনিফার লি। এমন একটা সাহসী, তেজোদীপ্ত ও আত্ম আবিষ্কৃত চরিত্রকে ‘ভিলেন’ হিসেবে আর ভাবতে পারছিলেন না। সবকিছুর খোলনলচে পাল্টে ফেলার সিদ্ধান্ত নেন।
এ পরাধীনবৃত্তি নিষ্কণ্টক রাখার জন্য আত্মসত্তাকেও অনেক সময় বিসর্জন দিতে হয়। গোপন রাখতে হয় অনেক সত্য, লুকিয়ে রাখতে হয় বিশেষ প্রতিভা। কখনো স্বেচ্ছায়, কখনো বাধ্য হয়ে। একজন স্বাধীন মানুষই কেবল পারে তার নিজের ক্ষমতার পুরোপুরি ব্যবহার করতে। কারণ, তার ক্ষমতার নিয়ন্ত্রণ তখন তার হাতে থাকে।
তাই নির্বাসিত স্বাধীন জীবনেই নিজেকে পুরোপুরিভাবে আবিষ্কার করতে সমর্থ হয় এলসা।
৬.
স্বাধীন, নিঃসঙ্গ, জনহীন এক রাজ্যের রানি হিসেবে সে গেয়ে উঠে—‘লেট ইট গো।’ যা হওয়ার হোক, ভালো মেয়ে হয়ে থাকার অনেক চেষ্টা তো করলাম, আর করব না। আর কিছু লুকাব না। যতই ঝড় উঠুক না কেন, কোনো ভয়, কোনো শীতলতা আমাকে আর দমিয়ে রাখতে পারবে না।
উন্মোচিত হয়ে পড়ার যে ভয় তাকে সব সময় গ্রাস করে রাখত, তা এখন আর নেই। সুতরাং ক্ষমতার পূর্ণ প্রয়োগ ঘটাতে পারে, নিজের সীমাকে পুনরাবিষ্কার করতে পারে। এখন সে এক বাধাহীন মানুষ। নীতিনৈতিকতার কোনো চোখ রাঙানো নেই, তথাকথিত ভালো-মন্দ বিবেচনার জুলুম নেই, নেই কোনো নিয়মের বেড়াজাল। সে চিৎকার করে ওঠে, আমার ক্ষমতা আজ প্রসারিত হোক, ভূমি থেকে দিগন্ত অবধি। যদি কোনো বিপদও আসে, সেটাও মোকাবিলা করব। এলসা যেন এখন এক মুক্ত ঘুড়ি। কিন্তু মৃদু বাতাসে নয়, আন্দোলিত হচ্ছে ঘূর্ণিঝড়ের সঙ্গে।
৭.
গানটি প্রথমবার শুনেই চিত্রনাট্য নিয়ে নতুন করে ভাবতে শুরু করেন পরিচালক জেনিফার লি। এমন একটা সাহসী, তেজোদীপ্ত ও আত্ম আবিষ্কৃত চরিত্রকে ‘ভিলেন’ হিসেবে আর ভাবতে পারছিলেন না। ফিল্মের শুটিং মাঝামাঝি পর্যায়ে তখন। কিন্তু গানের এ মাদকতাময় ক্ষমতায় বিমোহিত হয়ে সবকিছুর খোলনলচে পাল্টে ফেলার সিদ্ধান্ত নেন। এলসাকে প্রটাগনিস্ট বানানোর জন্য স্ক্রিপ্ট পরিবর্তনের নির্দেশ দেন এবং এ ব্যাপারে রাজি করিয়ে ফেলেন প্রযোজক প্রতিষ্ঠান ওয়াল্ট ডিজনিকে।
এরপর পরিবর্তিত স্ক্রিপ্টে এগিয়ে যেতে থাকে সিনেমা। ভিলেন হওয়ার বদলে প্রটাগনিস্ট হয়ে ওঠে রাজকুমারী এলসা। সবার মধুর মিলনে সমাপ্তি ঘটে সিনেমার। সিনেমার সঙ্গে গানটাও সুপার ডুপার হিট হয়। বিলবোর্ড হট হান্ড্রেডে সেরা ৫–এ উঠে আসে। লাভ করে নানা আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি। হয়ে ওঠে সর্বাধিক রেকর্ডকৃত ডিজনি সং, যা গাওয়া হয় পৃথিবীর ২৫টি ভাষায়। ছড়িয়ে পড়ে পুতুল বা খেলনা গাড়ির সঙ্গে জুড়ে যাওয়া মিউজিকে। বিশ্বব্যাপী ছড়ানো পপ কালচারের অন্যতম আইকন হয়ে ওঠে।