সুকান্তের বাসযোগ্য বিশ্বের ছাড়পত্র ও আমাদের বন্দিত্ব

সুকান্ত ভট্টাচার্য

বাসযোগ্য এক ভবিষ্যৎ পৃথিবীর স্বপ্ন দেখেছিলেন সুকান্ত, যেখানে সদ্য ভূমিষ্ঠ শিশু নতুন বিশ্বের কাছে তীব্র চিৎকারে জানিয়েছিল তার অধিকারের দাবি। হাতে একখানা ছাড়পত্র। খর্বকায় অসহায় দেহ, তবু দৃঢ়প্রতিজ্ঞ মুষ্টিবদ্ধ উদ্ধত তার হাত। কেউ তাকে পাত্তা দেয় না। হাসে ভেংচি কেটে। করে তিরস্কার। কিন্তু কবি ঠিকই বুঝেছিলেন সে অধিকারের ভাষা। তাই তো জীর্ণ, মৃত, ধ্বংস্তূপের পৃথিবীর কশাঘাত থেকে এসব শিশুর জন্য এক নতুন পৃথিবী রেখে যাওয়ার অঙ্গীকার করেছিলেন তিনি; নিজের জীবন বিসর্জন দিয়ে হলেও। সুকান্ত ভট্টাচার্যের ‘ছাড়পত্র’ কবিতার কথা বলছি। শুধু ‘ছাড়পত্র’ নয়, তাঁর বিভিন্ন কবিতায় উঠে এসেছে বাসযোগ্য বিশ্বের স্বপ্ন। যেখানে পৃথিবী হবে মানুষের। সব অন্যায় আর শোষণ হবে পরাজিত। গড়ে উঠবে এক শ্রেণিবৈষম্যহীন সমাজ। ক্ষুধার তাড়নায় কাউকে রুটির তুলনা করতে হবে না পূর্ণিমার চাঁদের সঙ্গে।

‘আগামী’ কবিতায় যেন সেই বাসযোগ্য পৃথিবী আর অধিকারের সূত্রটিও বাতলে দিয়েছেন তিনি। সচেতন করছেন নিজের অধিকার ও দায়িত্ব সম্পর্কে। একটা অঙ্কুরিত বীজের রূপকে, যে ভীরু মাটি ঠেলে চোখ মেলে আকাশের আহ্বানে এক বুক স্বপ্ন নিয়ে। তার ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পাতা একসময় শাখা-প্রশাখা গজিয়ে ডানা মেলে সবার সামনে। তারপর ফুল ফোটায় প্রতিবেশী গাছগুলোর মুখে।

কিন্তু বর্তমানে আমরা যেন সেই অধিকারের ছাড়পত্র ছিঁড়ে ফেলেছি। হয়ে পড়েছি বন্দী। চোখের সামনে দিয়ে লুট হয়ে যাচ্ছে আমাদের সবকিছু। আমরা শুধু নির্বিকার দেখছি, শুনছি। পুঁজিপতিরা ফাঁদ পেতে বসে আছেন। আর আমরা বুঁদ হয়ে আছি সেই ফাঁদে। হয়তো ভুলে গেছি অধিকারের কথা। কর্তব্যের কথা। হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ করা হচ্ছে আমাদের মস্তিষ্ককে চিন্তাশূন্য রাখতে। এ পরিস্থিতিকে তুলনা করতে পারি ‘মহীনের ঘোড়াগুলি’ ব্যান্ডের সেই গানটির মতো—‘পৃথিবীটা নাকি ছোট হতে হতে স্যাটেলাইট আর কেব্‌লের হাতে ড্রয়িংরুমে রাখা বোকাবাক্সতে বন্দী’। হ্যাঁ, বোকাবাক্সের কবলেই আজ বন্দী হয়ে পড়েছে পৃথিবী। সবকিছু এত বেশি হাতের মুঠোয় চলে এসেছে যে চিন্তা করার আগেই মানুষ ঘাড় গুঁজে শুধু দেখেই যাচ্ছে সবকিছু। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের অ্যালগরিদমের অসহায়ত্বকে চমৎকারিত্ব ভেবে তাতে তামরা মজে আছি অন্য কোনো ভাবনা ছাড়াই—এটাই এখনকার বাস্তবতা। আর এই মাথা নিচু করে, ঘাড় গুঁজে হাতের মুঠোয় বন্দী থাকার ফলে সুকান্তের মতো মাথা উঁচু করে আকাশপানে তাকিয়ে এক টুকরো রুটিকে পূর্ণিমার চাঁদের সঙ্গে তুলনা করার মতো কল্পনাশক্তি জন্মাচ্ছে কি কারও?

এই সুযোগটিই নিচ্ছে শোষকশ্রেণি। এখন আমাদের অধিকারের চেতনা একেবারে তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে। হারিয়ে ফেলেছি মনোবল। আমরা শূন্য মাথা নিয়ে হাঁটছি, উটপাখির মতো মাথা ঢুকিয়ে রাখছি বালুর মধ্যে। সুকান্তের ‘একটি মোরগের কাহিনী’ কবিতার মতো ভালো খাবারের আশায়, নিজের সুন্দর জীবনের আশায় মরীচিকার প্রাসাদের খাবার টেবিলে যাওয়ার বাসনা করছি অন্য কারও কথা না ভেবে। শেষ পর্যন্ত হয়তো সেই টেবিলে গিয়ে হাজিরও হচ্ছি, কিন্তু টেবিলের অতিথি হয়ে নয়, বরং টেবিলের খাবার হয়ে।

কবির ‘সিঁড়ি’ কবিতাতেও ফুটে উঠেছে শোষণের চিরায়ত চিত্র: ‘আমরা সিঁড়ি, /তোমরা আমাদের মাড়িয়ে/প্রতিদিন অনেক উঁচুতে উঠে যাও, /তারপর ফিরেও তাকাও না পিছনের দিকে; /তোমাদের পদধূলিধন্য আমাদের বুক/পদাঘাতে ক্ষতবিক্ষত হয়ে যায় প্রতিদিন।’

আমাদের এই বন্দিত্ব আর অসহায়ত্ব থেকে মুক্তির একমাত্র পথ নিজের অধিকার সম্পর্কে সচেতন হওয়া। সেই মুক্তির পথেও আমাদের সামনে ত্রাতা হিসেবে হাজির হন সুকান্ত। তাঁর ‘চারাগাছ’ কবিতা আমাদের শেখায় কীভাবে রসহীন খাদ্যহীন একটি চারাগাছ শোষকের দম্ভের প্রাসাদে শিকড় ছড়িয়ে সেই প্রাসাদে ফাটল ধরায়। যেখানে বিকশিত হয় আত্মশক্তির বারুদ। বিদ্রোহের দূত হিসেবে চারাগাছ হাজির হয় আমাদের সামনে। এই বন্দিত্বের দিনে তাই সুকান্ত আরও প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠেন। তাঁর কবিতা মানুষের মুক্তির আশা জাগায়। আজ তাঁর জন্মদিনে তাঁর স্বপ্নের সঙ্গে একত্ব হয়ে আমরাও মুক্ত বাসযোগ্য পৃথিবীর স্বপ্ন দেখি: আমাদের হৃদ্‌যন্ত্রে ঘা লেগে বেজে উঠেছে কয়েকটি কথা—/পৃথিবী মুক্ত-জনগণ চূড়ান্ত সংগ্রামে জয়ী/ তোমাদের ঘরে আজো অন্ধকার, চোখে স্বপ্ন/কিন্তু জানি একদিন সকাল আসবেই/যেদিন এই খবর পাবে প্রত্যেকের চোখেমুখে/সকালের আলোয়, ঘাসে ঘাসে পাতায় পাতায়।’