হেলাল হাফিজের কবিতা যে কারণে সবার কবিতা হয়ে উঠেছে

‘এখন যৌবন যার মিছিলে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়/ এখন যৌবন যার যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়’—এই কালজয়ী পঙ্‌ক্তি লিখেছিলেন যিনি, আজ ৭ অক্টোবর সেই কবি হেলাল হাফিজের ৭৬তম জন্মদিন। তাঁর অনেক কবিতাই মানুষের মুখে মুখে, কিছু কবিতার পঙ্‌ক্তি দেয়াললিখন হিসেবেও ব্যবহৃত হয়েছে। হেলাল হাফিজের কবিতা কেন এমন করে গ্রহণ করলেন সাধারণ মানুষ?

হেলাল হাফিজ। ছবি: জিয়া ইসলাম

কবিতা লিখে মানুষের কাছে পৌঁছানো সহজ নয়। কিন্তু কবিরা এসব নিয়ে ভাবেন না, তোয়াক্কা করেন না। আপন মনে তাঁরা শব্দের মালা গেঁথে যান। চিরাচরিত এ পর্যালোচনা আপেক্ষিকভাবে সত্য হলেও কবি হেলাল হাফিজ ব্যতিক্রম। ১৯৮৬ সালে প্রকাশিত তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘যে জ্বলে আগুন জলে’ দিয়েই মানুষের হৃদয়ে আসন করে নিয়েছেন তিনি।

কেবল কবিতার পাঠকের নিরিখে নয়, যে ব্যক্তি অতটাও সাহিত্যের খোঁজখবর করেন না, এমন অনেকের হৃদয়েও দোলা দিয়েছে হেলাল হাফিজের পঙ্‌ক্তি। প্রথম কাব্যগ্রন্থের মাধ্যমে এ অসম্ভব কীভাবে সম্ভব হলো? আর কেনই–বা ‘যে জ্বলে আগুন জ্বলে’র কবিতা সবার হয়ে উঠল?

উত্তর খোঁজার আগে ‘যে জ্বলে আগুন জ্বলে’ কাব্যগ্রন্থের কবিতাগুলো যে সময়ে লেখা হয়েছে, ওই সময়ের প্রেক্ষাপট ও কবির যাপিত জীবনের ঘটনাপ্রবাহ দৃষ্টি দেওয়া যেতে পারে। ‘যে জ্বলে আগুন জ্বলে’ কাব্যগ্রন্থভুক্ত প্রতিটি কবিতার শেষে উল্লেখিত তারিখ অনুযায়ী কবিতাগুলো লেখা হয়েছে ১৯৬৯ থেকে ১৯৮৫ সালের মধ্যে।

কবিরা হয়তো এমনই। কবিতার বিশালতার মতো বিশাল হৃদয় দিয়ে তুমুলভাবে ভালোবেসেও জোর করে থেকে যাওয়ার দাবিটা শেষ পর্যন্ত করে উঠতে পারেন না। তাই কি কবি বলেছেন—‘…ভালোবাসা মিলনে মলিন হয়, বিরহে উজ্জ্বল’। নাকি কবির মতো এই ভাবনা তাঁদেরও, যাঁরা প্রিয় মানুষকে কাছে পেয়েছেন এবং তাঁদেরও, কবি না হয়েও যাঁরা প্রিয় মানুষকে হারিয়েছেন। পঙ্‌ক্তিটি মানুষের হৃদয়ে হৃদয়ে স্থান করে নেওয়ার নেপথ্যের এই কি কারণ?
হেলাল হাফিজের কবিতার চরণ দিয়ে হয়েছে দেয়াললিখনও
ছবি: কবির হোসেন

আর এ সময়ে বাংলাদেশের ইতিহাসের বেশ কয়েকটি উল্লেখযোগ্য ঘটনাও ঘটেছে। বলাবাহুল্য, ঘটনাগুলো হেলাল হাফিজের মনে বেশ ভালোভাবেই রেখাপাত করেছে। উদাহরণ হিসেবে গ্রন্থভুক্ত ‘নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়’র কথা বলা যাক।

১৯৬৯ সাল, গণ-অভ্যুত্থান চলছে। কবি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। একদিন রিকশা চেপে যাচ্ছেন। হঠাৎ সামনে মিছিল চলে আসায় রিকশাচালক ব্রেক কষে থামলেন। মিছিলকারীদের থামাতে পুলিশ ধাওয়া দিতে শুরু করলে উল্টো দিক থেকে মিছিলকারীরাও ইটপাটকেল ছুড়তে শুরু করল। পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে রিকশাচালক বললেন, ‘মার, মার শালাদের। প্রেমের জন্য কোনো কোনো সময় মার্ডারও করা যায়।’ কথাটা কানে পৌঁছাতে কবির মনে ভাবনার উদয় হয়। ‘আসলেই তো তা–ই! দেশপ্রেমের জন্যও তো মার্ডার করা যেতে পারে।’

পরবর্তী সময়ে এ ঘটনার সূত্রেই কবি রচনা করেন—
‘এখন যৌবন যার মিছিলে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়
এখন যৌবন যার যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়
মিছিলের সব হাত
কণ্ঠ
পা এক নয়’
(নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়)

লড়াইয়ে, সংগ্রামে, প্রেমে-বিরহে, দ্রোহে যাপিত জীবনের পরতে পরতে হেলাল হাফিজ স্পর্শ দিয়ে যান। ‘নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়’র মতো ‘অগ্ন্যুৎসব’ কবিতাও শরীরের রন্ধ্রে রন্ধ্রে আগুন জ্বেলে দেয়। এ কবিতায় কবি বলেছেন, ‘ছিল তা এক অগ্ন্যুৎসব, সেদিন আমি/ সবটুকু বুক রেখেছিলাম স্বয়ংক্রিয় আগ্নেয়াস্ত্রে? জীবন বাজি ধরেছিলাম প্রেমের নামে/ রক্ত ঋণে স্বদেশ হলো,/ তোমার দিকে চোখ ছিল না/ জন্মভূমি সেদিন তোমার সতীন ছিলো।’ কেবল মুক্তিযুদ্ধ কিংবা গণ-অভ্যুত্থানের মতো প্রেক্ষাপটে নয়, যেকোনো অন্যায়ে-শোষণে-অবিচারে হেলাল হাফিজের এ উচ্চারণ সবার হয়ে ওঠে।

আরও পড়ুন

গণ-অভ্যুত্থান, মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতাসহ ওই সময়ের ঘনঘটা আমাদের প্রত্যেকেরই কমবেশি জানা। তাই আর এসব কথার বিস্তার না করে এবার হেলাল হাফিজের ব্যক্তিজীবনে দৃষ্টি দেওয়া যাক। মাত্র তিন বছর বয়সে মাকে হারান কবি। জীবনের অবলম্বন বলতে ছিলেন কেবল বাবা।

তিনিও ১৯৭৩ সালে না–ফেরার দেশে পাড়ি দিলে পুরোপুরি একা হয়ে যান তিনি। সংসারে থাকতে অবলম্বন লাগে, অবলম্বন মানে মানুষ—একান্তই আপন মানুষ। কিন্তু কেউ নেই। তাই জগৎসংসারকে তাঁর কাছে তুচ্ছ মনে হয়। কথায় আছে, খারাপ সময়ে পরপর খারাপ ঘটনা ঘটে। কবির ক্ষেত্রেও এটা ঘটেছে। পিতার মৃত্যুর মাসখানেক পর তাঁর যে প্রেমিকা হেলেন, তিনিও কবির সঙ্গে বিচ্ছেদ ঘটান।

একদিন তাঁকে ডেকে বলেন, ‘আমি বিয়ে করতে যাচ্ছি। বাবা-মা আমার বিয়ে ঠিক করেছে।’ প্রত্যুত্তরে কী বলেছিলেন হেলাল হাফিজ? তাঁর লেখা থেকে উদ্ধৃত করছি, ‘ছোটবেলা থেকে আমি খুব সহনশীল ছিলাম। প্রচণ্ড সহ্যশক্তি আমার। কথাটা শুনে ভেতরের ঝড় বুঝতে দিলাম না হেলেনকে। ওখান থেকে উঠে রিকশা নিয়ে …চলে এলাম।’

জীবনে পরপর ঘটে যাওয়া দুটি ঘটনা কবি কাউকে বুঝতে না দিলেও ঘটনাদ্বয় ভেতরে-ভেতরে তাঁকে এলোমেলো করে দেয়। পিতার চলে যাওয়ায় কিছুই করার ছিল না তাঁর। কিন্তু হেলেন? যাঁকে ভালোবেসে সম্রাজ্ঞী করেছিলেন, তাঁকে কেন যেতে দিলেন, আটকাতে কি পারতেন না?

আরও পড়ুন

হয়তো পারতেন অথবা পারতেন না কিংবা কবিরা হয়তো এমনই। কবিতার বিশালতার মতো বিশাল হৃদয় দিয়ে তুমুলভাবে ভালোবেসেও জোর করে থেকে যাওয়ার দাবিটা শেষ পর্যন্ত করে উঠতে পারেন না। তাই কি কবি বলেছেন—‘…ভালোবাসা মিলনে মলিন হয়, বিরহে উজ্জ্বল’। নাকি কবির মতো এই ভাবনা তাঁদেরও, যাঁরা প্রিয় মানুষকে কাছে পেয়েছেন এবং তাঁদেরও, কবি না হয়েও যাঁরা প্রিয় মানুষকে হারিয়েছেন। পঙ্‌ক্তিটি মানুষের হৃদয়ে হৃদয়ে স্থান করে নেওয়ার নেপথ্যের এই কি কারণ?

আবার ‘পৃথক পাহাড়’ শিরোনামের কবিতায় দ্বিধাহীন কণ্ঠে হেলাল হাফিজ যখন বলেন, ‘আমি আর কতটুকু পারি?/ এর বেশি পারেনি মানুষ।’ এ কথা কি কেবল কবির একার নাকি আমরা যারা কবির মতো করে বলতে পারি না, তাদেরও?

‘এখন তুমি কোথায় আছ কেমন আছ, পত্র দিয়ো। …কোন কথাটা অষ্টপ্রহর কেবল বাজে মনের কানে/ কোন স্মৃতিটা উস্কানি দেয় ভাসতে বলে প্রেমের বানে/ পত্র দিয়ো, পত্র দিয়ো।’ ‘প্রস্থান’ শিরোনামের এ কবিতার শেষে গিয়ে যখন কবি বলেন, ‘এক জীবনে কতটা আর নষ্ট হবে,/ এক মানবী কতটা আর কষ্ট দেবে’; তখন কথাগুলো কি সবার হয়ে যায় না? প্রিয় মানুষকে অনুভব করে এ উচ্চারণ কি কবির মতো সব প্রেমিকের নয়! সব প্রেমিকই তো এ কথা বলতে চায়।

হেলাল হাফিজ
ছবি: জিয়া ইসলাম

শুধু প্রেম-ভালোবাসা-বিরহ নয়, জীবনের কঠিন কথাও সহজ ও সুন্দরভাবে বলেছেন হেলাল হাফিজ। বলেছেন, ‘একটা কিছু করুন/ এভাবে আর কদিন চলে দিন ফুরালে হাসবে লোকে/ দুঃসময়ে আপনি কিছু বলুন/ একটা কিছু করুন।’ এ কথাও কি তোমার-আমার-আপনার-আমাদের নয়?

এ ছাড়া ব্যবহারিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলেও উপলব্ধি করা যায়, হেলাল হাফিজের ‘যে জ্বলে আগুন জ্বলে’র বেশির ভাগ কবিতা কোনো না কোনোভাবে সবার হয়ে উঠেছে। এর প্রধান কারণ হলো, কবির সহজভাবে বলে যাওয়া। সহজ কথা সহজ করে বলা কঠিন। তার চেয়ে কঠিন কবিতায় সবার কথা বলতে পারা। কবি ও কবিতার শক্তি এখানেই।

হেলাল হাফিজ
ছবি: জিয়া ইসলাম

একমাত্র কবিতার মাধ্যমেই সবার কথা বলে ফেলা যায়। ‘আগুন পোড়ালে তবু কিছু রাখে/ কিছু থাকে/ হোক তা শ্যামল রং ছাই,/ মানুষে পোড়ালে আর কিছুই রাখে না/ কিচ্ছু থাকে না,/ খাঁ খাঁ বিরান, আমার কিছু নাই।’ ‘মানবানল’ শিরোনামের এ কবিতার মতো ‘যে জ্বলে আগুন জ্বলে’র অধিকাংশ কবিতাতেই হেলাল হাফিজ সবার কথা বলতে পেরেছেন। এ কারণেই তিনি অনন্য। এ কারণেই তাঁর কবিতা সবার কবিতা এবং বহুল পঠিত তিনি।

‘যে জ্বলে আগুন জ্বলে’ কাব্যগ্রন্থই হেলাল হাফিজকে দিয়েছে অসাম্য খ্যাতি। এরপর দীর্ঘদিন আর কোনো বই বের করেননি তিনি। ২০১২ সালে ‘যে জ্বলে আগুন জ্বলে’ কাব্যগ্রন্থের কবিতার সঙ্গে কিছু কবিতা যুক্ত করে প্রকাশ করা হয় তাঁর দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘কবিতা একাত্তর’। সবশেষ ২০১৯ সালে প্রকাশিত হয় তৃতীয় কবিতার বই ‘বেদনাকে বলেছি কেঁদো না’। কবির জন্মদিনে তাঁর সুস্থতা ও দীর্ঘায়ু প্রার্থনা করি।