যেভাবে লেখা হলো ‘এখন যৌবন যার মিছিলে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়’

কালজয়ী এই কবিতা মানুষের মুখে মুখে ফেরে। কীভাবে লেখা হয়েছিল এ কবিতা, কেমন করে সেটি ছড়িয়ে গেল? এসব প্রশ্নের উত্তর জানতে ‘নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়’ নামে বিখ্যাত এই কবিতার রচয়িতা হেলাল হাফিজের মুখোমুখি হয়েছিলেন আরেক কবি—হাসান হাফিজ

মডেল: নীল ও আফসানা
ছবি: কবির হোসেন

দীর্ঘ ৫৩ বছরের বেশি সময় ধরে একটি কবিতা এ দেশের মানুষের মুখে মুখে ফিরছে। কবিতাটির প্রথম দুই পঙ্​ক্তি, ‘এখন যৌবন যার মিছিলে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়/ এখন যৌবন যার যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়’ প্রেরণা জুগিয়েছিল উনসত্তরের গণ–অভ্যুত্থান, মুক্তিযুদ্ধ, স্বৈরাচারবিরোধীসহ প্রগতিশীল সব আন্দোলনে। বলছি কবি হেলাল হাফিজের লেখা ‘নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়’ শিরোনামের কবিতাটির কথা।

কীভাবে লেখা হয়েছিল বিখ্যাত এই কবিতাখানি?

প্রশ্ন করতেই হেলাল হাফিজ ফিরে গেলেন উনসত্তরের সেই উত্তাল দিনগুলোতে, ‘উনসত্তরের গণ–অভ্যুত্থান যে কতটা সর্বগ্রাসী ও সর্বপ্লাবী ছিল, সেটা যাঁরা না দেখেছেন, তাঁদের বোঝানো দুষ্কর। তো গণ–অভ্যুত্থান চলাকালে একদিন সন্ধ্যায় আমি পুরান ঢাকা থেকে ইকবাল হলে (এখন সার্জেন্ট জহুরুল হক হল) ফিরছিলাম। তখন আমি বাংলা অনার্স সেকেন্ড ইয়ারে পড়ি। গুলিস্তানের ফুলবাড়িয়ায় আমার রিকশাটি থামল। সেখানে তখন সমানে মিছিল চলছে। ইপিআর (এখন বিজিবি) ও পুলিশ মিছিলকারীদের পেটাচ্ছে, ধাওয়া দিচ্ছে। মিছিল থেকেও ছোড়া হচ্ছে ইটপাটকেল। এর মধ্যে বয়স্ক এক রিকশাচালক বয়স্ক বলে উঠলেন, “মার, মার শালাদের। প্রেমের জন্য কোনো কোনো সময় মার্ডারও করা যায়।” রিকশাওয়ালারা মাঝেমধ্যে টুকটাক ইংরেজি শব্দও বলে। কথাটা আমার মগজে ও মনে গেঁথে গেল। আসলেই তো তাই! দেশপ্রেমের জন্যও তো মার্ডার করা যেতে পারে। ওই ঘটনা থেকেই কবিতাটির জন্ম।’

পুরোনো দিনের স্মৃতি খুঁড়ে কবিতার জন্মকথা শোনাচ্ছিলেন কবি। তাঁকে জিজ্ঞাসা করলাম, তারপর কী হলো? কবিতাটি মানুষের হয়ে উঠল কীভাবে? 

‘আহমদ ছফা আর হুমায়ূন কবির—এই দুজন আমাকে তৎকালীন দৈনিক পাকিস্তান-এর সাহিত্য সম্পাদক কবি আহসান হাবীবের কাছে নিয়ে গেলেন। কবিতাটা হাবীব ভাইয়ের হাতে দিয়ে তাঁরা বললেন, “হাবীব ভাই, এ আমাদের এক তরুণ কবি।

বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে পড়ে।”’ হেলাল হাফিজের চোখে এখন সমস্যা আছে, তবে স্মৃতি যে খুবই তরতাজা, বোঝা গেল তাঁর কথা থেকেই, ‘আহসান হাবীব কবিতাটা পড়লেন। আমার দিকে তাকালেন। অবাক চোখে দেখছেন আমাকে। আমার তখন কীই-বা বয়স। একবার পড়া শেষে হাবীব ভাই আরও এক-দুবার পড়লেন। পরে ছফা ভাইকে বললেন, “এই কবিতা আমি দৈনিক পাকিস্তান-এ ছাপতে পারব না। দৈনিক পাকিস্তান সরকারি কাগজ। আর এটা রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে লেখা। সশস্ত্র সংগ্রামের আহ্বান জানানো হয়েছে এই কবিতার মাধ্যমে। এটা ছাপলে আমার চাকরি তো যাবেই, কাগজটাও বন্ধ হয়ে যাবে, আরও কত–কী যে হবে! তাই আমি কবিতাটা ছাপতে পারলাম না। তবে হেলালের আর কবিতা না লিখলেও চলবে।”’

এর পরের ঘটনা আরও চমকপ্রদ। আহসান হাবীব যখন কবিতাটি ছাপতে পারলেন না, তখন এক রাতে আহমদ ছফা ও হুমায়ূন কবির—এই দুই মিলে কবিতাটির প্রথম দুই লাইন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দেয়ালে দেয়ালে চিকা মেরে দিলেন। তখন বিশ্ববিদ্যালয়ে এত ভবন ছিল না। মূলত কলা অনুষদ ও কার্জন হল। মাত্র দুই রাতেই গোটা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের দেয়ালে দেয়ালে স্লোগান হিসেবে এই পঙ্​ক্তি ছেঁয়ে গেল, ‘এখন যৌবন যার মিছিলে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়/ এখন যৌবন যার যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়।’

চিকা মারা কী, তা নিয়ে মজার কথা বললেন ‘নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়’-এর কবি, ‘এখনকার প্রজন্ম অবশ্য চিকা মারা কী, সেটার মর্ম বুঝতে পারবে না। গভীর রাতে ভীতিকর পরিবেশে দেয়াললিখনরত তরুণদের জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, “তোমরা কী করছ?” উত্তরে ওরা বলেছিল, “চিকা (ছুঁচো) মারছি।” সেই থেকে দেয়াললিখনের কাজকে বলা হতো চিকা মারা।’

মুক্তিযুদ্ধের সময় এই কবিতা রণাঙ্গনের মানুষের মুখে মুখে ফিরেছে। স্বাধীনতার পরে, বিশেষত যাঁরা বাম রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন—হক, তোয়াহা ও সিরাজ সিকদারের দল—তাঁরা কবিতাটিকে ব্যাপকভাবে ব্যবহার করতে শুরু করলেন। ‘কবিতাটি বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাকে রাতারাতি তারকাখ্যাতি এনে দিয়েছিল। এরপর এই একটি কবিতাই আমার জীবনধারা আমূল বদলে দিল।’

হেলাল হাফিজের জীবনে কবিতাটি কী বদল ঘটিয়েছিল, তা–ও খোলাসা করলেন তিনি, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাস্তা-করিডর দিয়ে চললেই ছেলেমেয়েরা আঙুল দিয়ে আমাকে দেখিয়ে বলত, “ওই যে কবি হেলাল হাফিজ যায়, দ্যাখ! দ্যাখ!” অনেক সময় আমার নাম না নিয়ে এটাও বলত যে এখন যৌবন যার যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়। মোটকথা, যেখানেই যাই, একটু অতিরিক্ত পাত্তা পাই। রোজ দুপুরে আমাকে কে খাওয়াবে, তা নিয়ে প্রতিযোগিতা হয়। আমাকে কোনো বিল দিতে হয় না।’

দেয়াললিখন হিসেবে এ কবিতার প্রথম দুই চরণ প্রচারিত হওয়ার পর ‘নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়’ কবিতাটি প্রথম প্রকাশিত হয় একটি ছোট কাগজে। সে কাগজের নাম এখন আর বয়োবৃদ্ধ হেলাল হাফিজের মনে নেই। তিনি বললেন, ‘সেকালে একুশে ফেব্রুয়ারির সময় প্রচুর লিটল ম্যাগাজিন বের হতো। তার কোনো একটিতে।’

কবিতাটি ইংরেজি, হিন্দি, জার্মান, ফরাসিসহ বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়েছে। অনেকেই এটি আবৃত্তি করেছেন। গোটা তিনেক গানও হয়েছে, এসব তথ্য দিতে দিতে কবি বললেন ভিন্ন কথা, ‘গানের সুরগুলো যে আমার মনমতো হয়েছে, তা না। আসলে কবিতাটা তো স্লোগানধর্মী।’

না, এটুকু বলেই থামলেন না বর্তমানে অসুস্থ হেলাল হাফিজ। যেন আরও কিছু বলার দায় আছে—এমনভাবে তাঁর মুখে শোনা গেল, ‘আমি বেসিক্যালি যুদ্ধবিরোধী লোক। কিন্তু আমার হাত দিয়েই বেরোল এই কবিতা। সেকালে বাংলাদেশের রাজনীতির নিয়ন্ত্রণকেন্দ্র ছিল দুটো—একটি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের বাসভবন ধানমন্ডির ৩২ নম্বর রোড এবং দ্বিতীয়টি ইকবাল হল। এই হলে তখন থাকতেন সিরাজুল আলম খান, তোফায়েল আহমেদ, আ স ম আবদুর রব, আবদুল কুদ্দুস মাখনের মতো ডাকসাইটে ছাত্রনেতারা। আমি তাঁদের অমূল্য স্নেহ পেয়েছি। সে-ও এই কবিতার বদৌলতেই বলতে পারো।’ 

জীবনসায়াহ্নে এসে আপনি কি এমন পঙ্​ক্তির কবিতা আর লিখবেন?

এবার হেলাল হাফিজের কথা ছিল, ‘“এখন যৌবন যার...” এই দ্যুতিময় পঙ্​ক্তির যিনি স্রষ্টা, তিনি চিরনবীন। বাস্তবে তাঁর বয়স যতই হোক না কেন। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, যত দিন সমাজে অন্যায়-উৎপীড়ন, অনিয়ম-অনাচার থাকবে, এই পঙ্​ক্তিমালাকে আশ্রয় করে প্রতিবাদী কিছু মানুষ ঘুরে দাঁড়াতে চাইবে।’ 

হেলাল হাফিজ
ছবি: জিয়া ইসলাম

নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়

হেলাল হাফিজ

এখন যৌবন যার মিছিলে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়

এখন যৌবন যার যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়।

মিছিলের সব হাত

পা

কণ্ঠ

এক নয়

সেখানে সংসারী থাকে, সংসার বিবাগী থাকে,

কেউ আসে রাজপথে সাজাতে সংসার

কেউ আসে জ্বালিয়ে বা জ্বালাতে সংসার।

শাশ্বত শান্তির যারা তারাও যুদ্ধে আসে

অবশ্য আসতে হয় মাঝেমধ্যে

অস্তিত্বের প্রগাঢ় আহ্বানে,

কেউ আবার যুদ্ধবাজ হয়ে যায় মোহরের প্রিয় প্রলোভনে।

কোনো কোনো প্রেম আছে প্রেমিককে খুনি হতে হয়।

যদি কেউ ভালোবেসে খুনি হতে চান

তাই হয়ে যান

উৎকৃষ্ট সময় কিন্তু আজ বয়ে যায়

এখন যৌবন যার মিছিলে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়

এখন যৌবন যার যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়।

রচনাকাল: ১ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯