শান্তিকে একটা সুযোগ দিন

অতীত পাঠের অনেক ধরনের উপায় রয়েছে। তারিখ, দলিল, স্মৃতিচারণ বা বিবরণীর মধ্য দিয়ে যেমন, আবার এমন কিছু মুহূর্ত রয়েছে যাদের সমস্ত ভার, আবেগ ও বাস্তবতা সবচেয়ে সংক্ষেপে ধারণ করে কেবল একটি আলোকচিত্র। সময়ের সীমানা ভেদ করে টিকে থাকা এসব ছবির পেছনে থাকে একাধিক গল্প। এই ধারাবাহিকের প্রতিটি পর্বে আমরা তুলে ধরব এমনই কোনো বিশ্ববিখ্যাত আলোকচিত্রের অন্তরঙ্গ ইতিহাস।

গ্রাফিকস: প্রথম আলো

জন লেনন ও ইয়োকো ওনোর যুগলবন্দী সাংস্কৃতিক ইতিহাসে অন্যতম আলোচিত, ভুল–বোঝাবুঝিপূর্ণ এবং শেষ পর্যন্ত গভীরভাবে প্রভাবশালী এক ঘটনা। বহুদিন ধরে ইয়োকো ওনোকে কেবল ‘যে নারী বিটলস ভেঙে দিয়েছিল’ বলে চিহ্নিত করা হয়েছে। অথচ বাস্তবে তিনি লেননের রূপান্তরের অনুঘটক ছিলেন। অনুঘটক এই কারণে যে এক অস্থির পপ-আইডল থেকে একজন কনসেপচুয়াল শিল্পী ও বৈশ্বিক শান্তি আন্দোলনের কণ্ঠস্বর হয়ে ওঠার পথে পুরোটা সময় ইয়োকো ছিলেন লেননের সঙ্গী। তাঁদের পারস্পরিক সম্পর্ক নিছক একটি প্রেমকাহিনি নয়। এটি ছিল এক দীর্ঘস্থায়ী পারফরম্যান্স আর্ট, যেখানে ব্যক্তিজীবন, আভাঁ গার্দ শিল্প ও রাজনৈতিক বিপ্লব পরস্পরের সীমা ভেঙে একাকার হয়ে গিয়েছিল।

জন লেনন, নিউ ইয়র্ক, ১৯৭০। আলোকচিত্র: অ্যানি লিবোভিটজ
ছবি: সংগৃহীত

১৯৬৬ সালে লন্ডনের ইন্ডিকা গ্যালারিতে জন লেনন যখন একটি সাদা মই বেয়ে ওপরে উঠেছিলেন, তখন তাঁর প্রত্যাশা ছিল সে সময়ের প্রচলিত ‘অ্যান্টি-আর্ট’ শিল্পকর্ম, যা মূলত ধ্বংসাত্মক ও নৈরাশ্যবাদী। কিন্তু ম্যাগনিফাইং গ্লাস দিয়ে ছাদের ক্যানভাসের দিকে তাকিয়ে তিনি দেখলেন একটি মাত্র ইংরেজি শব্দ—ইয়েস। ইয়োকো ওনোর সিলিং পেইন্টিংয়ের এই অভিজ্ঞতা লেননের কাছে হয়ে উঠেছিল সেই ‘ইতিবাচক স্পর্শ’, যা তিনি বিটলম্যানিয়ার দমবন্ধ করা খ্যাতির ভিড়ে খুঁজে ফিরছিলেন।

তখন ইয়োকো ওনো ছিলেন ফ্লাক্সাস আন্দোলনের একজন সম্মানিত শিল্পী। ‘ফ্লাক্সাস আন্দোলন’ ছিল একটি আন্তর্জাতিক শিল্পী নেটওয়ার্ক, যেখানে বিভিন্ন শিল্পমাধ্যমের সংমিশ্রণ ঘটানো হতো এবং সম্পন্ন শিল্পকর্মের চেয়ে শিল্পকর্মের সৃষ্টির প্রক্রিয়াকেই বেশি গুরুত্ব দেওয়া হতো। একই আন্দোলনে লেনন প্রবেশ করেছিলেন সুর ও গণমানুষের আবেদন নিয়ে। ওনো এনেছিলেন ‘কনসেপচুয়াল রিগার’ (কোনো নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে, বিশেষ করে গবেষণা ও শিক্ষার ক্ষেত্রে ধারণা ও তত্ত্বের অত্যন্ত সতর্ক, পুঙ্খানুপুঙ্খ এবং যথাযথ বিকাশ ও প্রয়োগ) ও ‘হ্যাপেনিং’-এর মানসিকতা বা দৃষ্টিভঙ্গি। এখানেই তাঁরা একসঙ্গে নিজেদের অস্তিত্বকে শিল্পের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করতে শুরু করেন।

বহুদিন ইয়োকো ওনোকে কেবল ‘যে নারী বিটলস ভেঙে দিয়েছিল’ বলে চিহ্নিত করা হয়েছে। বাস্তবে তিনি লেননের রূপান্তরের অনুঘটক ছিলেন। অনুঘটক এই কারণে যে এক অস্থির পপ-আইডল থেকে একজন কনসেপচুয়াল শিল্পী ও বৈশ্বিক শান্তি আন্দোলনের কণ্ঠস্বর হয়ে ওঠার পথে পুরোটা সময় ইয়োকো ছিলেন লেননের সঙ্গী।

বিশ শতকে লেনন ও ইয়োকোর সবচেয়ে স্থায়ী অবদান ছিল ‘বেড-ইন ফর পিস’। এটি ছিল যুদ্ধের বিরুদ্ধে একটি ভিন্নধর্মী অহিংস প্রতিবাদ। ১৯৬৯ সালে তাঁদের মধুচন্দ্রিমায়—প্রথমে আমস্টারডাম, পরে মন্ট্রিয়লে—এই বেড-ইন অনুষ্ঠিত হয়। এটি ছিল উচ্চতর মানবিক উদ্দেশ্যে গণমাধ্যম ব্যবহারের এক অসাধারণ কৌশল। হোটেল কক্ষে বিশ্বজুড়ে সংবাদমাধ্যমকে আমন্ত্রণ জানিয়ে তাঁরা দুজন পাপারাজ্জিদের কৌতূহলকে কাজে লাগান ভিয়েতনাম যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে অহিংসার বার্তা ছড়িয়ে দিতে।

এ ক্ষেত্রে জন লেননের উক্তি, ‘আমরা বিশ্বকে বলছি, শুধু বিছানায় বসে থাকো, চুল বড় হতে দাও। যদি তুমি শান্তি চাও, তবে বিছানাতেই থাকো।’

আমস্টারডাম হিলটন হোটেলে তাদের বেড-ইন আন্দোলনের প্রথম দিনে জন লেনন এবং ইয়োকো ওনো, ২৫ মার্চ ১৯৬৯
ছবি: সংগৃহীত

এ সময়েই জন্ম নেয় ‘গিভ পিস আ চান্স’ গানটি। একটি হোটেলকক্ষে সাংবাদিক ও তারকাদের কণ্ঠে ধারণ করা এক শান্তির সংগীত, যা হয়ে ওঠে আন্দোলনের স্লোগান। এখান থেকেই ‘সেলিব্রিটি অ্যাকটিভিস্ট’-এর ধারণা জনপ্রিয়তা পায়। প্রমাণিত হয় যে খ্যাতি কেবল বাণিজ্যিক পণ্য নয়, বরং রাজনৈতিক প্রতিবাদেরও এক শক্তিশালী হাতিয়ার। গানের শুরুর পঙ্‌ক্তিগুলো এ রকম—

‘সবাই কথা বলছে—

ব্যাগ-ইজম, শ্যাগ-ইজম, ড্র্যাগ-ইজম, ম্যাড-ইজম,
র‌্যাগ-ইজম, ট্যাগ-ইজম, এই-বাদ, সেই-বাদ, তত্ত্ব আর তত্ত্ব।

আমাদের শুধু একটাই কথা—

শান্তিকে একটা সুযোগ দিন,
(আমরা শুধু এটুকুই বলছি)

আমাদের শুধু একটাই কথা—
শান্তিকে একটা সুযোগ দিন।’

‘গিভ পিস আ চান্স’ গানটি একটি হোটেলকক্ষে সাংবাদিক ও তারকাদের কণ্ঠে ধারণ করা এক শান্তির সংগীত, যা হয়ে ওঠে আন্দোলনের স্লোগান। এখান থেকেই ‘সেলিব্রিটি অ্যাকটিভিস্ট’-এর ধারণা জনপ্রিয়তা পায়। প্রমাণিত হয় যে খ্যাতি কেবল বাণিজ্যিক পণ্য নয়, বরং রাজনৈতিক প্রতিবাদেরও এক শক্তিশালী হাতিয়ার।

একসঙ্গে জন ও ইয়োকো প্রমাণ করেছিলেন, শিল্প মানেই দেয়ালে ঝোলানো ছবি বা তাকের ওপর রাখা রেকর্ড নয়। শিল্প হতে পারে টাইমস স্কয়ারের এক বিশাল বিলবোর্ড, যেখানে লেখা—‘যুদ্ধ শেষ! যদি আপনি চান’, অথবা শান্তির দাবিতে বিছানায় কাটানো একটি সম্পূর্ণ সপ্তাহ।

লেননের সংগীতে ইয়োকো ওনোর প্রভাব ছিল গভীর ও সুদূরপ্রসারী। তিনি লেননকে ঠেলে দিয়েছিলেন তাঁর প্রথম একক শ্রেষ্ঠকর্ম ‘প্লাস্টিক ওনো ব্যান্ড’ (১৯৭০)-এর নগ্ন, সংযত ও কাঁচা সুরের দিকে। অপর দিকে লেননের বৈশ্বিক জনপ্রিয়তা ইয়োকো ওনোর আভাঁ গার্দ ভাবনাগুলোকে পৌঁছে দিয়েছিল বিশ্বমঞ্চে।

জন ও ইয়োকোর গল্প মূলত এক সাহসী আত্মনিবেদনের গল্প। নিজেদের জীবনকে বিশ্বের সামনে উন্মুক্ত করে দিয়ে তাঁরা মানবতাকে আহ্বান জানিয়েছিলেন ভিন্ন একটি বাস্তবতা কল্পনা করতে। রেখে গেছেন এমন এক নকশা, যেখানে শিল্প ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা ও রাজনৈতিক চেতনার মাঝে সেতুবন্ধন রচনা করে। তাঁদের সম্পর্ক হয়ে উঠেছিল একটি জীবন্ত ইশতেহার। টানা এক দশকব্যাপী পারফরম্যান্স আর্ট, যেখানে আভাঁ গার্দ ধারণাবাদ ও পপ সংগীতের বৈশ্বিক প্রভাব একসূত্রে মিলিত হয়েছিল।

‘যুদ্ধ শেষ! যদি আপনি চান’, টাইম স্কয়ার

জন লেনন ও অ্যানি লিবোভিটজের সৃজনশীল সম্পর্ক ইতিহাসে এক বিরল দৃষ্টান্ত, যেখানে একজন আলোকচিত্রীর শিল্পীসত্তার বিকাশ এবং এক সুপারস্টারের আত্মরূপান্তর নিখুঁত সমলয়ে সংঘটিত হয়েছে। এক দশকের বেশি সময় ধরে তাঁদের পথ একাধিক গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণে মিলিত হয়েছে। লিবোভিটজের যাত্রার শুরুটা হয়েছিল ২১ বছর বয়সী এক ছাত্রী হিসেবে, আর শেষ হয়েছিল জন লেননের জীবনের শেষ মুহূর্তগুলোর প্রধান নথিকার হিসেবে।

তাঁদের এই যাত্রা কেবল কিছু ফটোশুটের সমষ্টি ছিল না; এটি ছিল এক দৃশ্যমান সংলাপ—যার মাধ্যমে রক সংগীতের রূপান্তর ধরা পড়ে। ১৯৭০ সালে অ্যানি লিবোভিটজ ছিলেন সান ফ্রান্সিসকো আর্ট ইনস্টিটিউটের ছাত্রী, যখন তিনি সদ্য প্রতিষ্ঠিত ‘রোলিং স্টোন’ ম্যাগাজিনের জন্য প্রথম একটি বড় দায়িত্ব পান। আর তা হলো জন লেননের ছবি তোলার সুযোগ। তখন বিটলস ব্যান্ড সদ্য ভেঙে গেছে। আর লেনন নিজেকে ভেঙে নতুন করে গড়ে তুলছিলেন ‘প্রাইমাল স্ক্রিম’ থেরাপির যন্ত্রণাময় প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে।

লেননের আলোকচিত্র ধারণে অ্যানি লিবোভিটজ দারুণ সফল হয়েছিলেন। বিটলস-পরবর্তী সময়ের মনস্তাত্ত্বিক চাকচিক্য ও সাইকেডেলিক পালিশ ছেড়ে লিবোভিটজ লেননকে ধারণ করেছিলেন তাঁর নিউইয়র্ক অফিসে—নগ্ন বাস্তবতায়, সামান্য এলোমেলো এবং গভীরভাবে মানবিক এক সত্তা হিসেবে। ছবিগুলো প্রকাশ হয়েছিল বিখ্যাত ‘লেনন রিমেমবারস’ সাক্ষাৎকারে, যেখানে লেনন ঘোষণা করেছিলেন—‘স্বপ্ন শেষ হয়ে গেছে।’

অ্যানির ধারণ করা আলোকচিত্র সেই বক্তব্যের দৃশ্যমান প্রমাণ হাজির করতে পেরেছিল। অ্যানি এমন একজন মানুষকে দেখিয়েছিলেন, যিনি আর ‘মপ-টপ’ নন, বরং নিজের মিথের ভারে নুয়ে পড়া এক ভঙ্গুর মানবসত্তা। অ্যানির ভাষ্যমতে, ‘আমি একজন ভক্ত ছিলাম, কিন্তু একই সঙ্গে আমি একজন আলোকচিত্রীও ছিলাম। আমি শুধু একজন তারকার ছবি তুলতে চাইনি; আমি দেখতে চেয়েছিলাম—চোখের আড়ালে কী আছে।’

অন্যান্য আলোকচিত্রী যেখানে জনসাধারণের ‘শুধু জন’-এর আকাঙ্ক্ষা পূরণ করতে ইয়োকোকে ফ্রেমের বাইরে রাখতেন, সেখানে অ্যানি বুঝেছিলেন যে ওনোই ছিলেন লেননের শিল্পীসত্তার কেন্দ্রবিন্দু। এই উপলব্ধিই গড়ে তোলে এক গভীর বিশ্বাস, যা পরবর্তী সময়ে তাঁদের সবচেয়ে ঐতিহাসিক সাক্ষাতে অপরিহার্য হয়ে ওঠে।

১৯৭৩ সালে অ্যানি যখন রোলিং স্টোনের প্রধান আলোকচিত্রী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হন, তখনো তিনি জন লেনন ও ইয়োকো ওনোর জীবনকে আলোকচিত্রের মাধ্যমে নথিভুক্ত করতে থাকেন। বিশেষত তাঁদের তথাকথিত ‘লস্ট উইকেন্ড’ এবং পরবর্তী জনজীবন থেকে সরে আসার সময়কালেও।

এ পর্যায়ে তাঁর আলোকচিত্রের ভঙ্গি বদলে যায়। প্রাথমিক ‘দেয়ালের মাছি’, ‘ফ্লাই অন দ্য ওয়াল’ ধাঁচের নীরব পর্যবেক্ষণধর্মী রিপোর্টার থেকে তিনি ধীরে ধীরে অগ্রসর হন আরও ধারণাভিত্তিক ও পরিকল্পিত বিন্যাসের দিকে। তিনি উপলব্ধি করতে শুরু করেন লেননকে ধারণ করতে হলে তাঁর সঙ্গে ইয়োকো ওনোর সম্পর্ককেও ধারণ করতে হবে।

অন্যান্য অনেক আলোকচিত্রী যেখানে জনসাধারণের ‘শুধু জন’-এর আকাঙ্ক্ষা পূরণ করতে ইয়োকোকে ফ্রেমের বাইরে রাখতেন, সেখানে অ্যানি বুঝেছিলেন যে ওনোই ছিলেন লেননের শিল্পীসত্তা ও আবেগপ্রবণ জীবনের কেন্দ্রবিন্দু। এই উপলব্ধিই গড়ে তোলে এক গভীর বিশ্বাস, যা পরবর্তী সময়ে তাঁদের সবচেয়ে ঐতিহাসিক সাক্ষাতে অপরিহার্য হয়ে ওঠে।

তারিখ ৮ ডিসেম্বর ১৯৮০। তাঁদের ১০ বছরের সৃজনশীল যাত্রার পরিসমাপ্তি ঘটে নিউইয়র্কের ডাকোটা অ্যাপার্টমেন্টে, যেদিন জন লেনন নিহত হন। অ্যানিকে পাঠানো হয়েছিল ১৯৮১ সালের জানুয়ারি সংখ্যার ‘রোলিং স্টোন’ প্রচ্ছদের জন্য লেননের ছবি তুলতে। ম্যাগাজিনের সম্পাদকেরা স্পষ্টভাবে চেয়েছিলেন লেননের একক একটি ছবি। কিন্তু লেনন তা প্রত্যাখ্যান করেন। তাঁর উক্তি ছিল, ‘ওকে ছাড়া আমি প্রচ্ছদে যাব না।’

আলিঙ্গনরত শেষ আলোকচিত্রে জন লেনন ও ইয়োকো ওনো। আলোকচিত্র: অ্যানি লিবোভিটজ, ১৯৮০
ছবি: সংগৃহীত

অ্যানি তখনই তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত নেন। তিনি ‘ডাবল ফ্যান্টাসি’ অ্যালবামের প্রচ্ছদে দম্পতির এক অন্তরঙ্গ চুম্বনের কথা স্মরণ করেন এবং সেই ঘনিষ্ঠতাকে নতুনভাবে ধারণ করতে চান। ফলাফল—এক অবিস্মরণীয় চিত্র: সম্পূর্ণ নগ্ন, ভ্রূণসদৃশ ভঙ্গিতে কুঁকড়ে থাকা লেনন, সম্পূর্ণ পোশাক পরিহিতা ইয়োকো ওনোকে আঁকড়ে ধরে আছেন। এটাই ছিল জন লেননের জীবনের শেষ পেশাগত আলোকচিত্র।

জন লেনন ও অ্যানির আলোকচিত্রযাত্রা প্রমাণ করে, শিল্পী ও বিষয়ের মধ্যে দীর্ঘস্থায়ী সম্পর্ক কতটা শক্তিশালী হতে পারে। ছাত্রজীবন থেকেই লেননকে জানার সুবাদে অ্যানি ‘তারকা-আবরণ’ এড়িয়ে তাঁর শেষ সময়ের গভীর ভঙ্গুরতাকে ধারণ করতে পেরেছিলেন।

তাঁদের কোলাবোরেশন শুধু ইতিহাস নথিবদ্ধ করেনি; বরং জন লেননকে আমরা কীভাবে স্মরণ করি, তা–ও নির্ধারণ করে দিয়েছে। দূরের কোনো রক-দেবতা হিসেবে নয়, বরং একজন মানুষ হিসেবে, যিনি জীবনের শেষ মুহূর্তে চেয়েছিলেন ভালোবাসার মানুষের সবচেয়ে কাছাকাছি থাকতে।

তাঁদের ১০ বছরের সৃজনশীল যাত্রার পরিসমাপ্তি ঘটে নিউইয়র্কের ডাকোটা অ্যাপার্টমেন্টে, যেদিন জন লেনন নিহত হন। অ্যানিকে পাঠানো হয়েছিল ‘রোলিং স্টোন’-এর প্রচ্ছদের জন্য লেননের ছবি তুলতে। সম্পাদকেরা চেয়েছিলেন লেননের একক ছবি। কিন্তু লেনন তা প্রত্যাখ্যান করেন, ‘ওকে ছাড়া আমি প্রচ্ছদে যাব না।’

অ্যানি লিবোভিটজের ভাষ্যমতে, ‘মজার বিষয় হলো সে বলেছিল, চাইলে সে তার ওপরের পোশাক খুলে ফেলতে পারে। আমি বলেছিলাম, “সবকিছু পরেই থাকো”। তখনো ছবিটা নিয়ে আমার কোনো নির্দিষ্ট পূর্বকল্পনা ছিল না। তারপর জন এসে তার পাশে কুঁকড়ে শুয়ে পড়ল আর সেই মুহূর্তটাই ছিল অসম্ভব শক্তিশালী। তাকে দেখে মনে হচ্ছিল, সে ঠান্ডায় কাঁপছে, আর যেন সে ইয়োকোর শরীর আঁকড়ে ধরে আছে আশ্রয়ের মতো করে। প্রথম পোলারয়েড ছবিটা দেখেই মনে হয়েছিল, এটা অবিশ্বাস্য। দুজনেই ভীষণ উত্তেজিত হয়ে পড়েছিল। জন বলেছিল, “তুমি আমাদের সম্পর্কটা ঠিক যেমন, তেমনই ধরে ফেলেছ। কথা দাও, এটাই প্রচ্ছদে যাবে।” আমি তার চোখের দিকে তাকালাম, আর আমরা দুজন হাত মিলিয়ে প্রতিশ্রুতি করলাম।’

হত্যাকাণ্ডের কয়েক ঘণ্টা আগে হত্যাকারী চ্যাপম্যানকে ‘ডাবল ফ্যান্টাসি’ অ্যালবামের একটি কপিতে অটোগ্রাফ দিচ্ছেন লেনন
ছবি: সংগৃহীত

অ্যানি লিবোভিটজ একজন আমেরিকান পোর্ট্রেট আলোকচিত্রী, যিনি তাঁর তোলা পোর্ট্রেটগুলোর জন্য বিশ্বজুড়ে সুপরিচিত। বিশেষ করে তারকাদের ছবি তোলার ক্ষেত্রে। তাঁর আলোকচিত্রগুলোতে প্রায়ই মডেলদের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ পরিবেশে অন্তরঙ্গ ভঙ্গিমায় দেখা যায়। লাইব্রেরি অব কংগ্রেস তাঁকে ‘লিভিং লিজেন্ড’ ঘোষণা করেছে। এ ছাড়া তিনিই প্রথম নারী আলোকচিত্রী, যাঁর একক প্রদর্শনী ওয়াশিংটনের ন্যাশনাল পোর্ট্রেট গ্যালারিতে অনুষ্ঠিত হয়েছে।

আরও পড়ুন

সেদিন (৮ ডিসেম্বর ১৯৮০ সাল, আলোকচিত্রটি ধারণ করার দিন) বিকেলেই জন লেনন ও তাঁর স্ত্রী ইয়োকো ওনো একটি রেকর্ডিং সেশনের জন্য স্টুডিওতে যাচ্ছিলেন। যাওয়ার পথে ভবনের সামনে থাকা মার্ক ডেভিড চ্যাপম্যান নামের ২৫ বছর বয়সী এক তরুণের অনুরোধে লেনন তাঁর ‘ডাবল ফ্যান্টাসি’ অ্যালবামে অটোগ্রাফ দেন।

রাত প্রায় ১০টা ৫০ মিনিটের দিকে রেকর্ডিং শেষ করে যখন লেনন ও ওনো তাঁদের লিমোজিন থেকে নেমে ভবনের প্রবেশপথের দিকে এগোচ্ছিলেন, তখন চ্যাপম্যান সেখানে ওত পেতে ছিল। লেনন তাঁকে পাশ কাটিয়ে চলে যাওয়ার সময় চ্যাপম্যান তাঁকে লক্ষ্য করে পাঁচটি গুলি ছোড়ে, যার মধ্যে চারটি লেননের পিঠে ও কাঁধে বিদ্ধ হয়। প্রচণ্ড রক্তক্ষরণ শুরু হলে তাঁকে দ্রুত রুজভেল্ট হাসপাতালে নেওয়া হয়, কিন্তু হাসপাতালে পৌঁছানোর আগেই তিনি মৃত্যুবরণ করেন। রাত ১১টা ১৫ মিনিটে চিকিৎসকেরা তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন।