‘দেওরা’ গানের ফিউশন কেন ইতিবাচক

কোক স্টুডিও বাংলা লোকবাংলার একটি সারিগান ‘দেওরা’কে ফিউশন করে নতুনভাবে উপস্থাপন করেছে। গানটি প্রবল জনপ্রিয়ও হয়েছে। তবে এই গানকে কেন্দ্র করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে চলছে জোর আলোচনা–সমালোচনা। ফিউশন করার ফলে গান তার নিজস্বতা হারাচ্ছে, লোকগানের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে শহুরে সাংস্কৃতিক অধিপত্য—এসব বলছেন অনেকে। আর অন্য পক্ষের বক্তব্য হলো, গানটি আবার নতুনভাবে উপস্থাপিত হওয়ার ফলে নতুন প্রজন্মের কাছে এটি সহজেই পৌঁছেছে। তর্ক–বিতর্কের মধ্য দিয়ে আমাদের জনসংস্কৃতির পরিসরে নতুন উত্তাপ সৃষ্টি করেছে ‘দেওরা’।

‘দেওরা’ গান পরিবেশন করছেন ইসলাম উদ্দিন পালাকার
ছবি: সংগৃহীত

দুনিয়ার সবকিছুর স্থান–কাল–পাত্র বদলাবে আর কেবল লোকসংস্কৃতি অনড় থাকবে, এটা কখনো বাস্তবে  হতে পারে না। এই মানসিকতা থেকে ‘মধ্যবিত্ত’দের বের হতে হবে আগে। সংস্কৃতির বৈশিষ্ট্যই রূপান্তরকামিতা, যা সময়ই নির্ধারণ করে দেয়। লোকসংস্কৃতি বা  লোকগান নিয়ে ভিন্ন মাত্রার পরিবেশনা করা যাবে না, এমন কট্টর অবস্থান থেকে এসব বিষয় বিবেচনা করা উচিত নয়।

করলে একই ফাঁদ অনেক ক্ষেত্রেই তৈরি হবে। লোকসংস্কৃতি ও লোকশিল্পীরা কিন্তু ‘মধ্যবিত্ত’দের মতো কট্টর নন। কোক স্টুডিও প্রদর্শিত ‘দেওরা’ গানে স্থানীয় পালাকারের যে উজ্জ্বল নজড়কাড়া উপস্থিতি, তা গানটাকে অবশ্যই অন্য মাত্রা দিয়েছে। এমনকি শহরের কলাকুশলীরাও খারাপ কিছু করেননি। অথচ কিছু মানুষের রুচিগত অনভ্যস্ততায় একটা ‘গেল গেল রব’ বয়ে চলেছে, যা উৎসাহব্যঞ্জক তো নয়ই, বরং অদরকারিও।

কেবল আধিপত্যের জায়গা থেকে শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতিকে বিচার করতে গেলে অধিকাংশ বিষয়কেই বাতিল করে দিতে হয়! কিন্তু তা কি বাস্তবে সম্ভব বা দরকারি? কোক স্টুডিও নিজে তো ‘ফোক গান’ করছে—এমন দাবি তারা করেনি, বরং তারা ফিউশন করছে।

লোকগান নিয়ে ফিউশন করা যাবে না, এমন কট্টর অবস্থান লোকসংস্কৃতিও সমর্থন করে না। এমনকি রবীন্দ্রনাথের গানের ওপর থেকেও তো আগের কট্টরতা উঠে গেছে। ফলে বিষয়টাকে কেবল আধিপত্যশীলতা দিয়ে বিচার করলে সুবিচার হবে না। লোকগান যদি টিকে থাকার হয়, সে লোকমানসের জীবনাচারে যুক্ত থেকে এমনিতেই টিকে থাকবে। শহুরে ফিউশনে ব্যবহার করায় এর ‘কনটেক্সট’ হারালেও লোকশিল্পীরা এই নতুন প্লাটফর্মে তাঁদের বোল্ড পরিবেশনা আর পরীক্ষা–নিরীক্ষায় অংশগ্রহণ  করার সুযোগ পাচ্ছেন, আরও পাবেন—এদিক থেকে ইতিবাচক।

বাণিজ্য করলেও সেখানে শিল্প নিয়ে নানা ধরনের পরীক্ষা–নিরীক্ষা বা ‘এক্সপেরিমেন্ট’ করা হচ্ছে। বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে হোক আর ঐতিহ্যপ্রীতি থেকেই হোক, কোক স্টুডিও বাংলা অনেক সময়ই লোকগান নিয়ে তাদের পরীক্ষা–নিরীক্ষা জারি রাখছে। এটা ইতিবাচক এই অর্থে যে শহুরে শিল্পীর সঙ্গে গ্রামীণ বা স্থানীয় শিল্পীর মেলবন্ধন ঘটার চমৎকার একটা পাটাতন সেখানে তৈরি হয়েছে—এটাই বা মন্দ কী, বিশেষত এই পশ্চিমা আধিপত্যের রমরমা বাজারের যুগে!

এখানে এটি বলা জরুরি যে কোক স্টুডিও বাংলা কোনোভাবেই লোকসংস্কৃতি করছে না, সেটা সম্ভবও নয়। তারা সেই দাবিও করেনি। তারা যেটা করছে, লোকসংস্কৃতির উপাদান-উপকরণ নিয়ে ফিউশন তৈরি করে বাজারে বিক্রি করছে।

শহরের মানুষজনের কাছে ‘ফোক’ নামটার সঙ্গে একটা স্মৃতিকাতরতা, মোহময়তা, ঐতিহ্য, শেকড় ইত্যাদি অনুভূতিকাতরতা আছে বলে এসব গান এখন কদর পাচ্ছে। যেকোনোভাবেই হোক, নগর বা নাগরিক বাতাবরণের মধ্যে বেড়ে ওঠা প্রজন্ম এমন সব দেশীয় জিনিসের একটা স্বাদ এখন পাচ্ছেন ভিন্ন তরিকায়। সেদিক থেকে ব্যাপারটা ইতিবাচকই বটে।

‘দেওরা’ গানের একটি দৃশ্য
কোক স্টুডিও বাংলার সৌজন্যে

কিন্তু তা লোকসংস্কৃতি নয়। ফোকলোর বা লোকসংস্কৃতির বিদ্যায়তনিক পঠনপাঠনে একটা টার্ম বা পরিভাষা আছে—‘ফোকলোরিজম’ বা ‘ফোকলোরিসমাস’। এর প্রণেতা জার্মান তাত্ত্বিক হ্যান্স মোজার। ‘ফোকলোরিজম’ বা ‘ফোকলোরিসমাস’ হলো এমন একটি বিষয়, যেখানে লোকসংস্কৃতির কোনো উপাদান বা উপকরণকে তার প্রকৃত ‘কনটেক্সট’ বা পরিবেশ–পরিস্থিতি থেকে সরিয়ে ভিন্ন ‘কনটেক্সট’–এ পরিবেশন করা হয়, জনপ্রিয় করে তোলা হয়; আর তা বিশেষভাবে বাণিজ্যের উদ্দেশ্যেই করা হয়ে থাকে।

অধুনা আলোচিত ‘দেওরা’সহ কোক স্টুডিও বাংলার লোকগানকেন্দ্রিক অন্য পরিবেশনাগুলোকে ‘ফোকলোরিসমাস’ বা ‘ফোকলোরিজম’-এর উৎকৃষ্ট নমুনা হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। এমনকি এটা নগরকেন্দ্রিক লোকসংস্কৃতিও হতে পারে না। কারণ, নগরের মানুষের মধ্যেও ঐতিহ্যনির্ভর কিছু জীবনসংস্কৃতির চর্চা অবশ্যই চলে, যেগুলো নগরের মানুষের জীবনের সঙ্গে স্বতঃস্ফূর্তভাবে যুক্ত। কিন্তু কোক স্টুডিও একটা বানানো জিনিস। একটা তৈরি করা প্লাটফর্ম। বাণিজ্যমুখী হলেও এর শিল্প-পরিবেশনা অধিকাংশই উপভোগ্য।

তবে এদের পরিবেশনায় লোকসংস্কৃতির ফর্মগুলোকে যদি যথাযথ মর্যাদা দেওয়া না হয়, স্বীকার করা না হয়, লোকশিল্পীকে নৈতিক জায়গা থেকে, অর্থনৈতিক দিক থেকে যদি বঞ্চিত করা হয়, তাহলে কোক স্টুডিওর বানানো এই ‘ফোকলোরিসমাস’–এর পরিবেশনা নিয়ে অবশ্যই  সমালোচনার একটা জায়গা থাকে, আছে। কিন্তু এটাকে লোকসংস্কৃতি—তা শহরের হোক আর গ্রামেরই হোক—কোনোভাবেই বলা যায় না!

‘দেওরা’ গানের একটি দৃশ্য
কোক স্টুডিও বাংলার সৌজন্যে

লোকগান নিয়ে ফিউশন করা যাবে না, এমন কট্টর অবস্থান লোকসংস্কৃতিও সমর্থন করে না। এমনকি রবীন্দ্রনাথের গানের ওপর থেকেও তো আগের কট্টরতা উঠে গেছে। ফলে বিষয়টাকে কেবল আধিপত্যশীলতা দিয়ে বিচার করলে সুবিচার হবে না। লোকগান যদি টিকে থাকার হয়, সে লোকমানসের জীবনাচারে যুক্ত থেকে এমনিতেই টিকে থাকবে। শহুরে ফিউশনে ব্যবহার করায় এর ‘কনটেক্সট’ হারালেও লোকশিল্পীরা এই নতুন প্লাটফর্মে তাঁদের বোল্ড পরিবেশনা আর পরীক্ষা-নিরীক্ষায় অংশগ্রহণ  করার সুযোগ পাচ্ছেন, আরও পাবেন-এদিক থেকে ইতিবাচক।

শহরের অত্যাধুনিক প্রযুক্তিগত জনপ্রিয় মিডিয়ার দাপুটে পরিবেশনায় স্থানীয় লোকগান এবং শিল্পীরা অন্যভাবে দুনিয়াজুড়ে পরিচিতি পাচ্ছেন—এটা অবশ্যই ইতিবাচক ব্যাপার। খোদ দীনেশচন্দ্র সেন সেই কোন আমলে ‘মৈমনসিংহ গীতিকা’ নিয়ে সারা বিশ্ব কাঁপিয়েছেন, জনপ্রিয়তা পেয়েছেন। সেখানে এমনকি তিনি কলম চালিয়েছেন, ইচ্ছেমতো কিছু অদলবদলও ঘটিয়েছেন, সেখানেও ফোকলোরিজমের অনুরূপ প্রক্রিয়া মৃদুভাবে ক্রিয়াশীল ছিল! কনটেক্সটের  বদল তো ঘটেই ছিল! কিন্তু তাতে কি মানুষজন তা গ্রহণ করেননি?

সব ছাপিয়ে এ দেশের শহর ও বিভিন্ন অঞ্চলের লোকশিল্পীর মিলিত আয়োজনে কোক স্টুডিও বাংলা যদি সামনের দিনে আরও আরও চমৎকার পরিবেশনায় সবাইকে আনন্দ দিতে পারে, নতুন প্রজন্মের কাছে গানগুলো আবার ফিরিয়ে দিতে পারে, সেটা অনেক ভালো ব্যাপার হবে। আপাতত সে অপেক্ষা আমাদের জারি থাকুক। তারা যদি সত্যি কোনো প্রবঞ্চনা করে, তা নিয়ে সব সময়ই সমালোচনা করার সুযোগ থাকবে।

‘দেওরা’ হলো সারি গান৷ মাঝি–মাল্লার গান। নদীর গান। একে মঞ্চে আনলে তা বদলে যাবেই। বাউলগান তো একটা গোষ্ঠীর জীবনাচরণের সঙ্গে যুক্ত সংগীত। একে কি মঞ্চে পরিবেশন করা হয় না? ফিউশনের মতো অন্য ধরনের বদল না ঘটলেও কিছু বদল তাতে ঘটেই। মঞ্চে যখন কোনো লোকগান পরিবেশিত হয়, তখন যে তার কনটেক্সট বা পরিবেশ বদলায় না, বড় গলায় তা বলার সুযোগ নেই। এখানে কোক স্টুডিওর নিরীক্ষা এবং তারা এতে পশ্চিমা বাদ্যযন্ত্র ব্যবহার করেছে বলে কি হাহাকারটা বেশি শোনা যাচ্ছে? এ মেলবন্ধনের মধ্যে শহরের পরিবেশনাগত সৌন্দর্য আছে। সর্বোপরি অধিকাংশ দর্শকই তো গানটিকে গ্রহণ করছেন। তরুণ শিল্পীরা লোকগান নিয়ে পরীক্ষা–নিরীক্ষা করার সুযোগ পাচ্ছেন, শ্রেণিগত দিকটা স্বীকার করে নিয়েই ‘দেওরা’সহ এ ধরনের গানকে গ্রহণ করতে হবে। বর্জনে বিশেষ কোনো ফায়দা তো নেই। এখন বাজারপ্রধান এই যুগকে কি অস্বীকার করার উপায় আছে আমাদের?

যদি না থাকে, তাহলে ‘দেওরা’ গানের যে কথা—‘হাতে লাগে ব্যথা রে... হাত ছাইড়া দাও সোনার দেওরা রে’—ওই কথার ‘হাত ছেড়ে’ দেওয়ার চেয়ে ‘হাতের ব্যথা’র কথাটা বরং নিজের জবানে ‘দেওরা’ গানে দৃঢ়ভাবে জানান দেওয়াও তো একটা ঘটনা, তা–ই না!

যুগের বদলকে ধরতে পারাও আসলে একটা ঘটনা, যখন কিনা পৃথিবীর নানা পরিবেশ-পরিস্থিতিগত বদলে খোদ লোকসংস্কৃতি ও লোকশিল্পীরা পর্যুদস্ত—একে অস্বীকারের উপায় সত্যি আমাদের আছে কি! নিরঙ্কুশ পণ্যায়নের যুগে প্রায় সব শিল্প–সাহিত্যই তো পণ্য, ‘ফোক’-ই–বা বাদ থাকে কী করে!

আরও পড়ুন