হাঙ্গেরির ঔপন্যাসিক লাসলো ক্রাসনাহোরকাই এবার সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেলেন। তাঁর ফিকশনের বিষয়ে বলা হয়, মানুষের জীবনে কঠোরভাবে রক্ষিত থাকে সেসব গোপনীয়তা সেসব তিনি তুলে ধরেন তাঁর লেখায়। আবার এ–ও বলা হয়, লাসলো ক্রাসনাহোরকাই বিষয় হিসেবে বেছে নেন সেই কালো নদীর মতো বহমান অন্ধকারকে যা ঘটবেই কিন্তু প্রহসনের মতো মানুষের সেটা দেখা ছাড়া উপায় নেই। কিন্তু এই অন্ধকারের ভেতর আলোর ফুল ফোটানোও যেন তাঁরই কাজ।
একটা উদাহরণ দিলে হয়তো বিষয়টা পরিষ্কার হবে। যেমন লাসলোর ফিকশনের এক চরিত্রের বিখ্যাত উক্তি: ‘বেঁচে থাকা সুন্দর নয়। মরে যাওয়াও সুন্দর নয়। এমনকি জীবনও সুন্দর নয়। শুধু মানুষই সুন্দর’। ডাস্টিন ইলিংওয়ার্থ প্যারিস রিভিউতে তাঁর ব্যাপারে লিখেছেন, লাসলো ক্রাসনাহোরকাইর অবসেশন গোপন জিনিসের প্রতি, যেগুলো মানুষের জীবনের অন্ধকারাচ্ছন্ন দিক।
লাসলো ক্রাসনাহোরকাইয়ের চারটি উপন্যাসকে তাঁর প্রধান কাজ বলে বিবেচনা করা হয়। উপন্যাসগুলো হচ্ছে: ‘স্যাটানট্যাঙ্গো’, ‘দ্য মেলানকলি অব রেজিস্ট্যান্স’, ‘ওয়ার অ্যান্ড ওয়ার’ এবং ‘ব্যারন ওনকহেইমস হোমকামিং’। অবশ্য ক্রাসনাহোরকাই নিজে এই চারটি উপন্যাসকে তাঁর জীবনের একটিমাত্র বই বলে মনে করেন।
‘ব্যারন ওনকহেইমস হোমকামিং’ উপন্যাসটি প্রথম ২০১৬ সালে হাঙ্গেরিয়ান ভাষায় প্রকাশিত হয়। পরে ওটিলি মুলজেট এটিকে ইংরেজিতে অনুবাদ করেন। প্রকাশিত হয় ২০১৯ সালে।
লাসলো ক্রাসনাহোরকাইয়ের চারটি উপন্যাসকে তাঁর প্রধান কাজ বলে বিবেচনা করা হয়। উপন্যাসগুলো হচ্ছে: ‘স্যাটানট্যাঙ্গো’, ‘দ্য মেলানকলি অব রেজিস্ট্যান্স’, ‘ওয়ার অ্যান্ড ওয়ার’ এবং ‘ব্যারন ওনকহেইমস হোমকামিং’।
এ উপন্যাসে কৌতুকপূর্ণ আবার হতাশাবাদী কল্পকাহিনি থেকে যেন স্বীকৃতভাবে এক অন্তর্মুখী সংগীত নির্গত হয়। তাঁর উপন্যাসগুলো এক আবেশি প্রবৃত্তি দ্বারা অভিভূত বেকেটিয়ান আবেগের ইঙ্গিত দেয়। ক্রাসনাহোরকাইয়ের উপন্যাসের বাক্য দীর্ঘ। কিন্তু মহাকাব্যিক। অনেক সময় মনোলোগের মতো মনে হয়। রয়েছে আচমকা রাক্ষসী ত্বরণ, তীব্রতার অসাধারণ লাফ ও চেতনার অত্যাশ্চর্য বিচ্যুতি।
যেমন ধরা যাক, মিটেলিউরোপার একটি কর্দমাক্ত শহর। সেই ছোট শহরে চলছে হাসির জোয়ার। এরপর দেখা যায়, অপেক্ষা করছে একজন কলেরিক দেবতার বিস্তৃত অনুভূতি। এখানে এমন কল্পকাহিনি রয়েছে যা ক্ষুদ্র অস্বাভাবিকতায় ভেঙে পড়ে এবং বিশাল বিশ্বতত্ত্বে বিস্ফোরিত হয়।
লাসলো ক্রাসনাহোরকাই সম্প্রতি দ্য প্যারিস রিভিউকে তাঁর ‘আর্ট অব ফিকশন’ সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘আমি হাজারবার বলেছি যে আমি সব সময় কেবল একটি বই লিখতে চেয়েছিলাম। আমি প্রথমটিতে সন্তুষ্ট ছিলাম না। সে কারণেই আমি দ্বিতীয়টি লিখেছিলাম। আমি দ্বিতীয়টিতে সন্তুষ্ট ছিলাম না, তাই আমি তৃতীয়টি লিখেছিলাম ইত্যাদি। এখন ব্যারনের (চরিত্রের নাম) সঙ্গে আমি গল্পটি শেষ করতে পারি। এই উপন্যাস দিয়ে আমি প্রমাণ করতে পারি যে আমি সত্যিই আমার জীবনে কেবল একটি বই লিখেছি।’
ব্যারন আর্জেন্টিনায় জমে থাকা বিশাল জুয়ার ঋণ থেকে পালিয়ে তার দেশ হাঙ্গেরির ছোট একটি শহরে ফিরে আসে। তার ফিরে আসার খবরে গ্রামের বাসিন্দারা একটি স্বাগত কুচকাওয়াজের পরিকল্পনা করে। কারণ কী? কারণ হলো, তার কাছে পাওনাদারেরা যেসব পেত, সেসব পুনরুদ্ধারের জন্য চাপ প্রয়োগ করা। খুব প্রকাশ্যে চলতে থাকে এই অভ্যর্থনা অনুষ্ঠানের কাজ। কিন্তু গোপন বিষয় হচ্ছে ব্যারনকে শাস্তি দেওয়া। এ বিষয়ে আমলা এবং গ্রামের বিশিষ্ট ব্যক্তি এমনকি অপরাধী বাইকার ও প্রতারকেরা পর্যন্ত একজোট হয়ে যায়। ব্যারনকে দেওয়া হবে অভ্যর্থনা, কিন্তু সে লাজুক এবং ভেতরে ভেতরে ভয় পায়। মৃত্যুর মতো ভয়। কারণ, তাকে কেন এসব দেওয়া হবে? সে তো কেউকেটা ধরনের কেউ নয়। সে অতি সাধারণ, সব হারানো মানুষ।
সেই সন্ন্যাসী বা শেওলাবিশেষজ্ঞ প্রথমে মৃত্যুর ভান করেন এবং পরে শহর ছেড়ে পালিয়ে যান। উপন্যাস থেকে সম্পূর্ণ অদৃশ্য হওয়ার আগে তিনি একটি চূড়ান্ত উন্মত্ত মনোলোগে পরিবেশন করেন উন্মাদনার প্রস্থান সংগীত।
সে তার পুরোনো প্রেয়সী মারিকাকে খুঁজতে থাকে। যে তাকে বহু বহু আগে প্রত্যাখ্যান করেছিল।
সেই শহরে একটি পরিত্যক্ত কুঁড়েঘরে এক সন্ন্যাসী থাকেন। তিনি আবার অধ্যাপক হিসেবেও পরিচিত। পরিচিত শেওলাবিশেষজ্ঞ হিসেবে। তাঁকে কেন শেওলাবিশেষজ্ঞ হিসেবে দেখানো হলো, প্রশ্ন জাগতে পারে। উত্তর হচ্ছে, ব্যারনের জীবন তো নদীতে ভেসে যাওয়া শেওলার মতোই। সন্ন্যাসী ব্যারন সম্পর্কে সুচিন্তিত মতামত দেবেন। যদিও সন্ন্যাসী, তবু সুশীল গোত্রের।
এদিকে সবকিছু তো আর পরিকল্পনামাফিক চলে না, তাই দেখা যায়, আত্মরক্ষার জন্য বাইকার গ্যাংয়ের এক সদস্য এক লেফটেন্যান্টকে গুলি করার পর সেই সন্ন্যাসী বা অধ্যাপক বা শেওলাবিশেষজ্ঞ বা সুশীল প্রথমে মৃত্যুর ভান করেন এবং পরে শহর ছেড়ে পালিয়ে যান। উপন্যাস থেকে সম্পূর্ণ অদৃশ্য হওয়ার আগে তিনি একটি চূড়ান্ত উন্মত্ত মনোলোগে পরিবেশন করেন উন্মাদনার প্রস্থান সংগীত।
‘চিন্তাকে ধ্বংস করার প্রচেষ্টা বৃথা’; তিনি বলেন, ‘চিন্তার কোনো ফলাফলে পৌঁছানো থেকে ক্রমাগত নিজেদের বিরত রাখতে আমাদের ধারাবাহিক, ভয়ংকর, ভয়াবহ, কঠোর মনোযোগ আবশ্যক।’
উপন্যাসে শেওলাবিশেষজ্ঞ চরিত্রটি মাত্র কয়েকটি পৃষ্ঠায় অসীমের ধারণা, সংস্কৃতির জন্ম হিসেবে ভয়, নাস্তিকতার কাপুরুষতা ও মানবিক বিভ্রমের ব্যাপকতার ওপর প্রজ্ঞাপূর্ণ মতামত তুলে ধরেন। তিনি বলেন, ‘পৃথিবীটা একটা ঘটনা, পাগলামি, কোটি কোটি ঘটনার পাগলামি ছাড়া আর কিছুই নয়।’ তিনি আরও বলেন, ‘এবং কিছুই স্থির নয়, কিছুই আবদ্ধ নয়, কিছুই ধরা যায় না। সবকিছুই আঁকড়ে ধরতে গেলে তা পিছলে যায়।’
উপন্যাসের এ পর্যায়ে দেখা যায়, ব্যারনের দীর্ঘ প্রতীক্ষিত স্বদেশ প্রত্যাবর্তনে শহরের মানুষেরা যে পরিকল্পনা করেছিল, একসময় বুঝতে পারে যে সেটা করে আদৌ ব্যারনের কাছ থেকে তেমন কিছুই পাওয়া যাবে না। কারণ, ব্যারন সব খুইয়ে এসেছে। সে একটা জুয়ারি। ব্যারনের কাছে মনে হয়, তার পুরোনো শহরেও আর কিছুই নেই আগের মতো। সেই একই রেলস্টেশন, প্রধান রাস্তা, হাসপাতাল, দুর্গ বা চ্যাটো সবই আগের মতো জরাজীর্ণ, ক্লিশে এবং অদ্ভুতভাবে একই জায়গায় যেন দাঁড়িয়ে আছে। ব্যারনের সঙ্গে পুরোনো প্রেমিকা মারিকার দেখা হয়। ব্যারন যেন চিনতেই পারছে না। মারিকাও যেন মারিকা নেই। অন্য কেউ। ব্যারন বিব্রত বোধ করে। মারিকা বলে, ‘কী ভাবছ আমায় দেখে?’
ক্রাসনাহোরকাইয়ের উপন্যাসে বাস্তবতা ও কল্পনার সীমারেখা অনিশ্চিত। ‘ব্যারন ওনকহেইমস হোমকামিং’-এ আমরা দেখি, প্রতিটি চরিত্র যেন পৃথিবীর শেষ নাগরিক যারা নিজেদের অস্তিত্বের বোঝা টেনে নিয়ে চলছে এক অনন্ত ক্লান্তির ভেতর।
ব্যারন নিরুত্তর। অবশেষে একধরনের আধ্যাত্মিক পরীক্ষার সামনে যেন দাঁড়ায়। ব্যারন মনে করে, তার এ সময় কি বেঁচে থাকা উচিত নাকি নিজেকে ধ্বংস করা উচিত? বনের ভেতর দিয়ে এঁকেবেঁকে যাওয়া রেলপথ ধরে সে হাঁটতে থাকে। চাঁদের আলোয় তাকে ঘোরগ্রস্ত মানুষ মনে হয়।
লেখক ক্রাসনাহোরকাই এখানে যেন দস্তয়েভস্কি দ্বারা প্রভাবিত। দেখা যায়, ব্যারন তার শেষ মুহূর্তে ভাগ্যের সঙ্গে বিরোধিতা করে এমন এক কারামাজভের ক্ষিপ্ত মহিমা অর্জন করে। যে কারামাজভকে আমরা দেখি, ফিওদর দস্তয়েভস্কির লেখা বিখ্যাত উপন্যাস ‘দ্য ব্রাদার্স কারামাজভ’–এ।
উপন্যাসের শেষে সেই একই সর্বনাশের শঙ্কা। যেখানে একজন ব্যক্তি যিনি খ্রিষ্টবিরোধী হতে পারেন বা না–ও পারেন, তিনি শহর ও এর জঘন্য বাসিন্দাদের পুড়িয়ে ফেলার জন্য এক নির্মম অগ্নিকাণ্ডের কল্পনা করেন। মোটামুটি এ–ই হচ্ছে উপন্যাসের সারসংক্ষেপ। বোকা মেয়র, দুষ্ট ও আবেগপ্রবণ নেতা, প্রতারক শিল্পী দান্তে, পোপের একটি ক্যামিও—এসব তো রয়েছেই। এ উপন্যাস সমসাময়িক সাহিত্যের অন্যতম সেরা কৃতিত্ব। ইতিমধ্যেই বিভিন্ন দেশে সাহিত্যমোদীদের কাছে প্রশংসিত হয়েছে।
এই উপন্যাসে লাসলো ক্রাসনাহোরকাই মানুষের অস্তিত্বের এক গভীর, অবসন্ন প্রতিধ্বনি লিখে রাখেন। তাঁর লেখার ভেতর দিয়ে ভেসে ওঠে সভ্যতার পতনের কণ্ঠস্বর, যেখানে মানুষ কেবল এক অনন্ত ঘূর্ণির মধ্যে আবর্তিত হয়—আলো আর অন্ধকারের, পাপ আর মুক্তির, বেঁচে থাকা আর ধ্বংসের মাঝখানে।
ক্রাসনাহোরকাইয়ের ভাষা এখানে কেবল গল্প বলার মাধ্যম নয়, বরং নিজেই এক অভিজ্ঞতা—যেন বাক্যগুলো পড়তে পড়তে পাঠকও সেই পচে যাওয়া শহরের কর্দমাক্ত রাস্তায় হাঁটতে থাকে, ব্যারনের মতোই হারানো কিছুর খোঁজে, যার অস্তিত্ব হয়তো কখনোই ছিল না। তাঁর বর্ণনা একদিকে প্রলাপময়, আবার অন্যদিকে এক আধ্যাত্মিক স্থিতি বহন করে—যেন বিশৃঙ্খলার মধ্যে তিনি খুঁজে বেড়াচ্ছেন সৃষ্টির লুকোনো শৃঙ্খলাকে।
বেকেটের পর থেকে যে অস্তিত্ববাদী শূন্যতার উত্তরাধিকার সাহিত্য টেনে এনেছে, ক্রাসনাহোরকাই সেটাকে পুনরায় নতুন আঙ্গিকে প্রাণ দেন—এক হাঙ্গেরীয় নিঃসঙ্গতা ও ইউরোপীয় বিভ্রান্তির মিশেলে।
ক্রাসনাহোরকাইয়ের উপন্যাসে সময় এক রেখায় চলে না; বাস্তবতা ও কল্পনার সীমারেখাও অনিশ্চিত। ‘ব্যারন ওনকহেইমস হোমকামিং’-এ আমরা দেখি, প্রতিটি চরিত্র যেন পৃথিবীর শেষ নাগরিক যারা নিজেদের অস্তিত্বের বোঝা টেনে নিয়ে চলছে এক অনন্ত ক্লান্তির ভেতর। অথচ এই ক্লান্তির মধ্যেই লেখক খুঁজে পান এক ধরনের গূঢ় সৌন্দর্য। তাঁর পৃথিবীতে অর্থহীনতাই হয়ে ওঠে অর্থের উৎস, পতনই হয়ে ওঠে মুক্তির উপায়। যেন বেকেটের পর থেকে যে অস্তিত্ববাদী শূন্যতার উত্তরাধিকার সাহিত্য টেনে এনেছে, ক্রাসনাহোরকাই সেটাকে পুনরায় নতুন আঙ্গিকে প্রাণ দেন—এক হাঙ্গেরীয় নিঃসঙ্গতা ও ইউরোপীয় বিভ্রান্তির মিশেলে।
এই উপন্যাস, এবং প্রকৃতপক্ষে তাঁর সমগ্র রচনাজীবন পাঠককে কোনো সান্ত্বনা দেয় না, বরং এক গভীর আত্মসমীক্ষার দিকে ঠেলে দেয়। ‘ব্যারন ওনকহেইমস হোমকামিং’ শেষ হয় আগুনে, ধ্বংসে, কিন্তু সেই ধ্বংসই যেন নতুন এক শুরু, যেমন করে শেওলার ভেতর থেকেও জন্ম নেয় সবুজের ইঙ্গিত। মানুষের প্রতি তাঁর অগাধ বিশ্বাস এই যে, সব নষ্টের পরেও সৌন্দর্য অবশিষ্ট থাকে। হয়তো সেই কারণেই তিনি বলেছেন, ‘বেঁচে থাকা সুন্দর নয়, জীবনও সুন্দর নয়, শুধু মানুষই সুন্দর।’ লাসলো ক্রাসনাহোরকাইয়ের এই বিশ্বাসই তাঁকে আধুনিক ইউরোপীয় সাহিত্যের অনন্যতম কণ্ঠে পরিণত করেছে।