খুব চলে আসতে ইচ্ছা করছে তোমার কাছে, বাবা

আজ বাবা দিবস। এদিনে সদ্য প্রয়াত সম্পাদক ও লেখক আবুল হাসনাতের মেয়ে লিখেছেন তাঁর বাবাকে নিয়ে।

যুক্তরাষ্ট্রে বাবা আবুল হাসনাতের সঙ্গে দিঠি হাসনাতছবি: লেখকের সৌজন্যে

আমাদের সময়ে কখনো আলাদা করে বাবা বা মা দিবস পালন করার প্রচলন ছিল না। আমার কাছে বাবা বা মা দিবস প্রতিদিনের, প্রতি মুহূর্তের। পালন করলে হয়তো আজকের কথাগুলো বাবাকে বলতে পারতাম। বছরের এই সময়টা, অর্থাৎ মে–জুন মাস এলেই আমি আর শ্রেয়সী প্রস্তুতি নিতে থাকতাম, বইমেলা কবে হবে আর বাবা কবে আসবেন। এমনটাই হয়েছে পরপর চার বছর। আমরা হইহই করে একটা মাস কাটিয়েছি। গত বছর অতিমারির কারণে আসতে পারেননি বলে জুন মাসে খুব মন খারাপ করে বাবা আমাকে বলেছেন, ‘আমার কি আর আসা হবে? আমি কি আর তোমাদের দেখতে পাব?’ আমি তখন বাবাকে শুধু বলে গেছি, ‘বাবা, তোমাকে শুধু সুস্থ থাকতে হবে। সময়টা পার হলেই সামনের বছর তুমি আসবে। আমরা অনেক মজা করব।’

আমি গত বছর মার্চ মাসে কোভিড নিয়ে সারা রাত জেগে থেকেছি এই চিন্তা করে যে আম্মু আর বাবা ঠিক আছেন কি না। আর তাঁদের বলে গেছি, ‘তোমাদের ভালো থাকতে হবে, সুস্থভাবে বেঁচে থাকতে হবে। সামনের বছর তুমি আসতে পারবে।’ আমি কি জানতাম সত্যি সত্যি বাবার আর আসা হবে না? ২০১৭, ২০১৮, ২০১৯ সালের বাবা দিবসগুলোয় বাবা নিউইয়র্কেই ছিলেন। ঘটা করে কিছু করা হয়ে ওঠেনি। আমরা একসঙ্গে সময় কাটিয়েছি শুধু। প্রতিদিন আমি বাবা আর আম্মুর সঙ্গে কথা বলি। মাঝেমধ্যে কথা বলতে গেলে মন খারাপ করতেন বাবা। আমার জন্য, শ্রেয়সীর জন্য। এখন সেসব কথা মনে পড়লে মনে হয়, কেন এত দূরে চলে এলাম! বাবার সংবেদনশীল মনটার কথা আমি ছোটবেলায় বুঝতে পারতাম না।

আবুল হাসনাত
ছবি: সংগৃহীত

আমি যখন স্কুলে পড়ি, ক্লাস ফাইভ কি সিক্সে, তখন আমরা থাকতাম পুরান ঢাকার দাদাবাড়িতে। ওই বাড়িতে বাবারও বেড়ে ওঠা। আমরা থাকতাম চারতলায়। দোতলায় দাদা, দাদু আর ছোট কাকা কাশেম কাকা এবং তৃতীয় তলায় বাবু কাকা আর দুলু কাকা। সে সময় বাবা আর আম্মু ‘সংবাদ’ এবং নানান সামাজিক সংগঠনের সঙ্গে ভীষণ ব্যস্ত। বাসায় ফিরে এলেই বাবা বলতেন, ‘আমি বাসায় এলে তুমি কোথাও যাবে না। এমনকি নিচে দাদুর ঘরেও যাবে না। আমার কাছে থাকবে।’ তখন বাবাকে চঞ্চল আমি বলতাম, ‘তুমি এমন কর কেন? একটু কাকার ঘরে যাই, একটু দাদুর ঘরে যাই।’ বাবা আদর করে হেসে বলতেন, ‘তুমি কোথাও যাবে না। আমার কাছে বসে থাকো।’ আমি তো কোথাও যাইনি বাবা, তুমি কোথায় চলে গেলে? আমি এখন তোমাকে বলছি বাবা, আমি তোমার কাছেই বসে থাকতে চাই।

গত বছর অতিমারির কারণে আসতে পারেননি বলে জুন মাসে খুব মন খারাপ করে বাবা আমাকে বলেছেন, ‘আমার কি আর আসা হবে? আমি কি আর তোমাদের দেখতে পাব?’ আমি তখন বাবাকে শুধু বলে গেছি, ‘বাবা, তোমাকে শুধু সুস্থ থাকতে হবে। সময়টা পার হলেই সামনের বছর তুমি আসবে। আমরা অনেক মজা করব।’ আমি গত বছর মার্চ মাসে কোভিড নিয়ে সারা রাত জেগে থেকেছি এই চিন্তা করে যে আম্মু আর বাবা ঠিক আছেন কি না। আর তাঁদের বলে গেছি, ‘তোমাদের ভালো থাকতে হবে, সুস্থভাবে বেঁচে থাকতে হবে। সামনের বছর তুমি আসতে পারবে।’ আমি কি জানতাম সত্যি সত্যি বাবার আর আসা হবে না?

প্রত্যেক সন্তানের কাছে তার মা বা বাবা শ্রেষ্ঠ মা–বাবা হয়। কিন্তু আমার কাছে তার চেয়ে বেশি। কারণ, খুব কম মা–বাবাই পারেন সন্তানের সঙ্গে মানসিক যোগাযোগ স্থাপন করতে। আমি খুব ভাগ্যবান যে আমার বাবার সঙ্গে সেই মানসিক সম্পর্কটা তৈরি হয়েছে শৈশবেই। বাবার কাছে শিল্প–সাহিত্য–সংস্কৃতি শুধু একটা বিষয় নয়; একটা জীবনবোধ, যা মনন তৈরি করে। বাবা সেই জীবনটাই যাপন করেছেন আর আমাদের করতে শিখিয়েছেন। তাঁর রুচিবোধ আমাকে বিস্মিত করে। একজন মানুষ চাইলে কত কিছু শিখতে পারে, মানুষের ভেতর থেকে কতটা ভালো জিনিস গ্রহণ করতে পারে!

নিজেকে প্রতিনিয়ত কতটা ঋদ্ধ করতে পারে, আমি তা দেখে বিস্মিত হই। তা সে সম্পাদনাই হোক বা মৌলিক লেখালেখিই হোক, প্রতিটি মুহূর্তে নিজেকে ঋদ্ধ করতে চেয়েছেন বাবা। আমাকে তাঁর সব আড্ডায় নিয়ে যেতেন ছোটবেলা থেকেই। মা–বাবার জগতের সঙ্গে আমার জগত কখন একাকার হয়ে গেছে, বুঝতেই পারিনি। বাবার বই পড়া, গান শোনা প্রতিটি কাজের সঙ্গে আমি আর আম্মু যুক্ত থাকতাম। আমাদের তিনজনের একটা অনিন্দ্যসুন্দর জগৎ আছে। আর সেই জগতে শ্রেয়সী সম্পৃক্ত হয়েছে। তাই বাবার ধ্যানজ্ঞান ছিল কীভাবে শ্রেয়সী ভালো থাকবে। আমি যখন এই শোক সামলাচ্ছি আট মাস ধরে, শ্রেয়সী আমাকে সান্ত্বনা দেয়, ‘মা, তুমি যেমন তোমার বাবাকে হারিয়েছ, আমার জন্য নানা তো শুধু নানা নন। নানা আমার কাছে আমার ফাদার ফিগার, আমি তাঁকেই হারিয়ে ফেলেছি।’ আমি ভাবি, বাবা তো আমাদের পরিবারের সবার ফাদার ফিগার। আমি এমন কর্তব্যপরায়ণ মানুষ খুব কম দেখেছি। বাবা আমার আর আমার মায়ের সব দুঃখ–কষ্ট, সুযোগ–সুবিধার প্রতি সব সময় লক্ষ রেখেছেন। নিজের মা–বাবা, ভাইবোনসহ, আমার নানা–নানুর প্রতি এবং আমার খালা–মামাদের প্রতিও সব দায়িত্ব পালন করে গেছেন। অনেকে তা মনেও রাখেনি পরবর্তী সময়ে। কাজের প্রতি তাঁর নিষ্ঠা ও সততার প্রকাশ মেলে তাঁর প্রতিটি কাজে।

আমি যখন জীবনের নানা সময় বিক্ষিপ্ত থেকেছি, গত তেরো বছর একটা ভয়ংকর সময় পার করেছি, বাবা শুধু বলেছেন ‘স্থির হও, ধাতস্থ হও। আর এই যন্ত্রণা থেকে বের হয়ে এসো।’ বাবা আমার কাছে একই সঙ্গে বাবা, বন্ধু এবং গুরুও বটে। বাবা সব সময় তাঁর জ্ঞান, রুচি, শিক্ষা, মনন, নৈতিকতা সবটুকু আমার ভেতর সঞ্চারিত করতে চেয়েছেন। আমি কতটুকু নিতে পেরেছি, তা জানি না। শুধু জানি, সেই পথে চলার জন্য প্রস্তুত হয়েছি।

দিঠি হাসনাত, আবুল হাসনাত ও শ্রেয়সী।
ছবি: লেখকের সৌজন্যে

প্রত্যেক মানুষের জীবনে নিজেকে নিয়ে, নিজের সত্তা নিয়ে একটা দ্বন্দ্ব যায়। বাবার তো এই পেশা, এই পরিচয়। তাহলে আমি কী করতে চাই? আমার কী ভালো লাগে? আমি কী হব? আমারও তেমন একটা সময় গেছে, যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে সদ্য ভর্তি হয়েছি। ভীষণ অস্থির থেকেছি। আমি যখন উদ্ভিদবিজ্ঞানে পড়াশোনা করছি, বাবার ইচ্ছা, আমি যেন একাডেমিক লাইনে থাকি, গবেষণা করি, গান করি। আর তখন আমি অস্থির হয়ে নিজেকে খুঁজে ফিরছি। অনেক কিছু করে এত বছর পর আমার উপলব্ধি, বাবা আমার জন্য যা চেয়েছিলেন, সেটাই আমার পথ। পড়াশোনা আর গান করলেই আমি শান্তি পাই। বাবাকে ২০১৯ সালে নিউইয়র্কে বসে তা বললাম। বললাম, ‘বাবা, তুমি ঠিক ছিলে। আমিই ভুল করেছি। তখন তুমি যা বলেছ, আমি তার উল্টো পথে হেঁটেছি। তুমি ঠিক, আমাকে ক্ষমা করো।’ বাবা শুধু বলেছেন, এখন বুঝলেই হলো।

এখন আমি যখন তাঁর নিজেকে গড়ে তোলা, তাঁর সংগ্রাম, তাঁর পরিবারের প্রতি দায়িত্ব, সবটুকু নিয়ে চিত্রটা দেখার চেষ্টা করি, তখন দেখি, একজন মানুষ কত নিষ্ঠার সঙ্গে সব দায়িত্ব পালন করে গেছেন। আর তাঁর এই সামগ্রিক সংগ্রামে তাঁর পাশে থেকেছেন আমার মা। পারস্পরিক শ্রদ্ধা, ভালোবাসা আর বন্ধুত্বের এমন সম্পর্ক এখনকার প্রজন্মে বিরল। জুন মাস এলেই গুগল ফটো অথবা আল্পস মনে করিয়ে দেবে আমাকে আর শ্রেয়সীকে যে নানা আসবেন! কিন্তু আমি খুঁজে ফিরব তোমাকে গানে, তোমার প্রিয় গান গেয়ে অথবা শ্রেয়সীকে নিয়ে মোমাতে গিয়ে! খুব চলে আসতে ইচ্ছা করছে তোমার কাছে, বাবা।


অন্যআলো ডটকমে লেখা পাঠানোর ঠিকানা: info@onnoalo.com