বইয়ের ওপর খড়্গ ধোপে টেকে না

বই
ছবি: সংগৃহীত

বই ও বইমেলার সঙ্গে জার্মানি নামটা অদ্ভুতভাবে মিশে আছে। পৃথিবীর প্রথম বইটি ছাপা হয়েছিল জার্মানির গুটেনবার্গ প্রিন্টিং প্রেসে। আর পৃথিবীর প্রথম বইমেলা হিসেবে এখনো ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলার নামই স্বীকৃত। এর আগে পৃথিবীতে আর কোনো বইমেলা হয়েছিল কি না, তা গবেষকেরা এখনো জানতে পারেননি। সুতরাং ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলাই পৃথিবীর প্রথম বইমেলা। আসলে এটি ছিল বই বাণিজ্যমেলা।

ফ্রাঙ্কফুর্ট হলো জার্মানির একটি শহর। এই শহরে ১৪৭৮ সালে প্রথম বইমেলা অনুষ্ঠিত হয়েছিল। বহু শতাব্দী ধরে ইউরোপের বাণিজ্য ও ব্যাংকিংয়ের কেন্দ্রে ছিল ফ্রাঙ্কফুর্ট শহর। সুতরাং এই শহরে বই বিক্রিকে কেন্দ্র করে মেলা হওয়া বিচিত্র কিছু নয়। বিভিন্ন গবেষকের লেখা থেকে জানা যায়, ওই বই বাণিজ্য মেলার ভেন্যু ছিল ফ্রাঙ্কফুর্টার মেস।

লেখক পিটার উইয়েলহল তাঁর হিস্ট্রি অব ফ্রাঙ্কফুর্ট বুক ফেয়ার বইয়ে বলেছেন, রাজা অষ্টম হনরি অক্সফোর্ড লাইব্রেরির জন্য বই কিনতে টমাস বোডলিকে পাঠিয়েছিলেন ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলায়।

তবে ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলার প্রথম দিকে ক্যাথলিক ধর্মযাজকেরা বাধা দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন বলে অভিযোগ রয়েছে। সুতরাং এ বছরের অমর একুশে বইমেলায় যে একটি প্রকাশনীকে স্টল দেওয়া হলো না, সেটি নতুন কোনো প্রবণতা নয়। বইমেলা শুরুর ইতিহাসের সঙ্গেই এমন ঘটনা জড়িয়ে আছে। যুগে যুগে ক্ষমতাশীলেরা তাঁদের ক্ষমতার প্রদর্শনী দেখিয়েছেন বই নিষিদ্ধ করার মাধ্যমে। কখনোবা বইমেলায় স্টল বরাদ্দ না দেওয়ার মাধ্যমে। কখনো আবার বই বিক্রি নিষিদ্ধ করার মাধ্যমে।

রানি মেরি তাঁর রাজত্বকালে নিষিদ্ধ বইয়ের তালিকা করেছিলেন। সেই তালিকায় স্থান পেয়েছিল ফ্রাঙ্কফুর্ট মেলার অনেক বই। এ কারণে ফ্রাঙ্কফুর্টের প্রকাশনা ব্যবসা ক্ষতিগ্রস্তও হয়। 

রাজা, রানি, পুরোহিত, ক্যাথলিকদের যুগ শেষ হলেও বইয়ের ওপর নিষেধাজ্ঞা ফুরিয়ে যায়নি। ২০১৬ সালে কুয়েত বইমেলায় বেশ কয়েকটি বইয়ের বিক্রির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিল কুয়েত সরকার। ওই সময়ের কুয়েতের প্রখ্যাত লেখক বোথাইনা আল-এসা বলেছিলেন, তথ্য মন্ত্রণালয় মূলত সাহিত্য হত্যাযজ্ঞ শুরু করেছে। এর পেছনে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ছাড়া আর কিছুই নেই। সরকার যদি মনে করে, নিষেধাজ্ঞা দিয়ে এসব বই বিক্রি করা বন্ধ করবে, তবে তা ভীষণ ভুল ভাবনা। কুয়েত বইমেলায় এসব বই বিক্রি বন্ধ করা গেলেও অন্যান্য জায়গায় গোপনে বিক্রি করা বন্ধ করা যাবে না।

যাহোক, বই বিক্রি বন্ধ করা ও নিষিদ্ধ করা নিয়ে কালে কালে প্রতিবাদও কম হয়নি। এই তো গেল বছরের অক্টোবরে ‘নিষিদ্ধ বই’ প্রতিপাদ্যকে সামনে রেখে লন্ডনস রেয়ার বুক ফেয়ার অনুষ্ঠিত হয়েছে। এটি আয়োজন করেছিল অ্যান্টিকুয়েরিয়ান বুকসেলারস অ্যাসোসিয়েশন। ওই মেলায় জেমস জয়েসের ইউলিসিস প্রকাশের শতবর্ষ উদ্​যাপন করা হয়েছিল। বিক্রি করা হয়েছিল গ্যালিলিও গ্যালিলির ডায়ালগ বইয়ের প্রথম সংস্করণ। এই বই লেখা ও প্রকাশের অপরাধে গ্যালিলিওকে গ্রেপ্তার করেছিল ইতালি সরকার।

তারপরও কি এ বইয়ের ছড়িয়ে পড়া বন্ধ করা গিয়েছিল? না। বরং চোরাপথে ইতালি থেকে নেদারল্যান্ডসে গিয়ে ছাপা হয়েছে বইটি, ছড়িয়ে পড়েছে সারা বিশ্বে।

২০১৫ সালের হংকং বইমেলাও একটি বিশেষ কারণে আলোচিত। ওই বইমেলায় চীনে নিষিদ্ধ অনেক বইয়ের প্রদর্শনী হয়েছিল। বিবিসির সাংবাদিক লিন্ডা কেনেডি বলেছেন, চীনের পাঠকেরাই সেসব বই সীমান্ত পার হয়ে হংকং পর্যন্ত বয়ে এনে বইমেলায় প্রদর্শন করেছিলেন।

সুতরাং বিভিন্ন সময়ে বইয়ের বিক্রির ওপর ক্ষমতাশীলেরা যে খড়্গ নামান, ইতিহাস বলে, তা শেষ পর্যন্ত ধোপে টেকে না।

সূত্র : লাইভ অ্যাবাউট, ফাইন বুকস ম্যগাজিন, ফ্রাঙ্কফুর্টার বাচমেস, ডয়চে ভেলে, গার্ডিয়ান ও বিবিসি