‘যে লোক খাওয়াদাওয়ার জন্য প্রাণ দিতে রাজি, তাকে তোমরা বহিষ্কারের চিন্তা করছ’

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর
প্রতিকৃতি: প্রথম আলো

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের দূরদৃষ্টি ও বিচক্ষণতা সম্পর্কে সবারই কমবেশি জানা। তীক্ষ্ণ রসবোধ ও উপস্থিত আসর জমানোর ব্যাপারেও তিনি ছিলেন ওস্তাদ লোক। অনেক জটিল–কঠিন বিষয়ও রসিকতার মাধ্যমে সমাধান করে ফেলতেন।

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর যখন বিটন কলেজের সেক্রেটারি, তখন সেই কলেজের অধিকাংশ হর্তাকর্তা ও শিক্ষক ছিলেন বিদেশি। প্রধান শিক্ষিকাও ছিলেন অবাঙালি। 

তুচ্ছ একটা বিষয়কে কেন্দ্র করে এক বাঙালি পণ্ডিতকে কলেজ থেকে চাকরিচ্যুত করার জন্য উঠেপড়ে লাগলেন প্রধান শিক্ষিকা। এর মধ্যে পুরো বিষয়টির তদন্তের ভার পড়ল বিদ্যাসাগরের ওপর। তিনি তদন্ত করে দেখলেন, পণ্ডিতের কোনো দোষ নেই, অহেতুক তাঁকে হয়রানি করা হচ্ছে। 

কমিটির বৈঠকে বিদ্যাসাগর যখন পণ্ডিতকে নির্দোষ প্রমাণ করে তদন্ত প্রতিবেদন দিলেন, অবাঙালি প্রধান শিক্ষিকা তা মানতে নারাজ, তিনি তাঁকে চাকরিচ্যুত করবেনই। এ অবস্থায় বিদ্যাসাগর বৈঠকে সবার উদ্দেশে হেসে হেসে বললেন, আপনারা যদি ভাবেন কিছু বলিদান না করলে দেবী (প্রধান শিক্ষিকা) খুশি হবেন না, তবে তা–ই করুন।

বিদ্যাসাগরের এমন রসিকতায় সবাই চুপসে গেলেন। অবাঙালি শিক্ষিকাও সরে এলেন নিজের সিদ্ধান্ত থেকে।

তবে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর কেবল কথার রসিক ছিলেন না, খুব ভোজনরসিকও ছিলেন। নিজে যেমন খেতে ভালোবাসতেন, অন্যদের রান্না করেও খাওয়াতেন। আর এসব খাওয়াদাওয়ার বিষয় আঞ্জাম দিতে ঘনিষ্ঠজনদের নিয়ে ‘ভোজনসভা’ নামে একটা দলও গঠন করেছিলেন। যাদের কাজই ছিল হল্লা করে খাওয়াদাওয়া করা। 

একবার ঘটল কী, ভোজ্যসভার সব সভ্য মিলে ঘটা করে এক বন্ধুর বাড়িতে খেতে গেলেন। ইচ্ছেমতো খাওয়াদাওয়া শেষে বাড়ি ফেরার পর এক সভ্যের পেটে দেখা দিল পীড়া। বেশ অনেক দিন পর সুস্থ হয়ে ভোজনসভার আড্ডায় এলেন সেই সভ্য। বন্ধুরা তাঁকে নিয়ে ঠাট্টায় মেতে উঠলেন, এ বড় পেটরোগা, তাকে ভোজনসভায় রাখা যাবে না। এমন নাজুক পেটের লোক খাদক হবে কী করে!

তখন বিদ্যাসাগর বললেন, তোমরা বাপু ভারি অন্যায় করছ। যে লোক ভোজনসভার আদর্শ মানে, খাওয়াদাওয়ার জন্য প্রাণ দিতে রাজি, তাকে তোমরা বহিষ্কারের চিন্তা করছ! তা তো হয় না। তার এমন আহার-আদর্শের কথা শুনে হো হো করে হেসে উঠলেন সবাই।

আরেকবার বিদ্যাসাগরের এক বন্ধু দ্বিতীয় বিয়ে করে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে এলেন। বন্ধুকে দেখে তিনি বললেন, ‘তোমার তো দেখছি মরার পরই স্বর্গবাস।’ 

বিদ্যাসাগরের কথার মর্ম বুঝতে না পেরে বন্ধু জিজ্ঞাসা করল, ‘কীভাবে?’ এবার হেসে হেসে বিদ্যাসাগর বললেন, ‘মরার পর আমরা কিছুদিন নরকে শাস্তি ভোগ করে তার পরেই হয়তো স্বর্গে যাব! কিন্তু তুমি তো দ্বিতীয় বিয়ে করে মর্ত্যেই নরকের ব্যবস্থা করে ফেলেছ। মৃত্যুর পর আর নরকভোগ লাগবে না, সোজা স্বর্গবাস!’

সূত্র: অংশুমান চক্রবর্তীর বই বঙ্গ মনীষীদের রঙ্গ রসিকতা 


●গ্রন্থনা: বাশিরুল আমিন