জামাই নিয়ে বাঙালির দুটি কৌতুক
বাঙালির রসিকতা খুবই তীব্র। প্রয়াত লোকসংস্কৃতিবিদ শামসুজ্জামান খান বাংলাদেশের মানুষের কৌতুকনকশা সংগ্রহ করেছেন জীবনভর। বাঙালির লোকজীবনের সেসব তীব্র রসবোধ মূর্ত হয়েছে এই বইয়ে।
‘শ্যাম, তোমার মনের কথা জানি বিলক্ষণ’
নতুন জামাই শ্যামচাঁদ শ্বশুরবাড়ি যাচ্ছে। শ্যামের মা বেয়াইবাড়ির জন্য পিঠা তৈরি করে দিয়েছিল। সেই পিঠা নিয়ে জামাই শ্বশুরবাড়ি চলেছে। পথে যেতে যেতে মনে হলো, একটা পিঠা খেয়ে দেখলে কেমন হয়? এ কথা মনে আসার পর আর তর সইল না। পিঠার পুলিন্দা খুলে একটা পিঠা মুখে দিয়েই জামাই বাবাজির মনে হলো, পিঠা তো কম রলোদি নয়, যেন অমৃত। ভাবে: আর একটা খাই। ভেতরে ঘন ক্ষীরের পুর দেওয়া এ পিঠার স্বাদই আলাদা! শেষ পর্যন্ত সাধ আর মেটে না শ্যামচাঁদের। পিঠা খাওয়ার লোভও যায় বেড়ে। এমনি করে সব পিঠা শেষ।
জামাই ভাবে, শ্বশুরবাড়ির লোকেরা তো আর জানে না যে আমি পিঠার ভেট নিয়ে শ্বশুরবাড়ি যাচ্ছি। তাই ধরা পড়ার আশঙ্কা নেই। ধরা পড়ে যাওয়ার আতঙ্ক থেকে সে তাই পুরোপুরিই হালকা বোধ করে।
কিন্তু ঘন ক্ষীরের অতগুলো পিঠা খাওয়ায় কয়েক মাইল যেতেই সে প্রকৃতির ডাক অনুভব করতে থাকে এবং ধীরে ধীরে তা বিপজ্জনক পর্যায়ে পৌঁছায়। শেষমেশ রাস্তার ধারে একটু ঝোপের মতো জায়গা দেখে সে বিপদ–মুক্ত হয়। মুশকিল আসান হলেও কাছেপিঠের ধু ধু প্রান্তরে জলের কোনো নাম-নিশানা দেখা না যাওয়ায় সে পড়ে মহাফাঁপরে। কিন্তু কোনো পথই পায় না। তাই মাটির ঢেলা ও গাছের পাতা ব্যবহার করে ধুতিখানা ভালো করে পরে আবার যাত্রা শুরু করে।
এমন অবস্থায় শেষ পর্যন্ত আমাদের শ্যামচাঁদ শ্বশুরবাড়ি পৌঁছায়। এবার জামাই দ্রুত বাড়ির ভেতরে গিয়ে পরিষ্কার হতে চায়। কিন্তু শালা-শালিরা তাকে ধরেপাকড়ে বাহির বাড়িতে তার সম্মানে আয়োজিত কৃষ্ণলীলার আসরে নিয়ে বসায়।
অস্বস্তি লাগলেও উঠে গিয়ে আর সাফসুতরো হয়ে আসা সম্ভব হয় না। কারণ, শালা-শালিরা বলে, জামাইবাবু, বাড়িতে কেউ নেই। ওই দিকে তাকিয়ে দেখেন, মেয়েদের আসন আলো করে বসে আছেন আপনার বউরানি ও শাশুড়িমাতা। তো, বাধ্য হয়ে জামাইবাবু গান শোনে। গানের একপর্যায়ে রাই আর দোহাররা ধুয়া ধরে: ‘শ্যাম, তোমার মনের কথা জানি বিলক্ষণ।’
এতে জামাই শ্যামচাঁদ ভাবে, সর্বনাশ! আমি যে অশুচি অবস্থায় বেকায়দায় আছি—এটা এরা জানল কেমনে! তাই তাড়াতাড়ি পেলা ছুড়ে দিয়ে গায়েনদের মুখ বন্ধ করতে চায় সে। এবার গায়েনরা ভাবে, নতুন জামাইয়ের বুঝি গান খুব ভালো লেগেছে। তাই খুশি হয়ে এত টাকার পেলা দিয়েছে।
কিছুক্ষণ পরই গানের নিয়মমাফিক গায়েনরা আবার গায়, ‘শ্যাম, তোমার গোপন কথা জানি বিলক্ষণ।’ এবার জামাইবাবু হাতের ঘড়ি খুলে ছুড়ে দেয় দোহারদের দিকে। এরপর গলার সোনার চেইন, পাঞ্জাবির সোনার বোতাম এবং শেষে পাঞ্জাবি পর্যন্ত খুলে দেয়।
দোহাররা এতে তো মহাখুশি। এমন গুণী ও ভক্ত শ্রোতা পেয়ে আবার তারা গেয়ে ওঠে, ‘শ্যাম, তোমার মনের কথা জানি বিলক্ষণ।’ জামাইয়ের তখন দেওয়ার মতো ধুতি আর জুতা ছাড়া কিছুই নেই, কিন্তু এর একটাও দেওয়া যায় না। তাই রাগে-দুঃখে মরিয়া হয়ে সে বলে, ‘আমার আর কিছু নাই। কিছু দিবার পারুম না। কী কইবা কও! এই গোপন কথাই তো কইবা যে আমি হেই কাম কইরা জল খরচ করি নাই!’
দোহাররা এ কথা শুনে আবার নতুন ধুয়া ধরে, ‘জানিলাম, জানিলাম, জানিলাম রে, নতুন জামাইবাবুর গোপন কথা জানিলাম রে!’
রাইতকানা জামাই
এটা আরেক নতুন জামাইয়ের কাহিনি। নতুন জামাই আসবে শ্বশুরবাড়িতে। তাই জামাইবরণের আয়োজন-এন্তেজামের তোড়জোড় চলছে। শাশুড়ি জামাইকে কী কী খাওয়াবেন, তার ফর্দ তৈরি করছেন। শ্বশুর বাহির বাড়িতে নানাজনকে জামাই আসার সংবাদ দিচ্ছেন, কখনো হাসিমুখে পায়চারি করছেন আর ভাবছেন, জামাই এলে বাজার থেকে বড় একটা রুই মাছ আনতে হবে। আর আনতে হবে মুরগি গোটা চারেক। পাশের ঘোষবাড়িতে বলে রেখেছেন ঘিয়ের কথা। দোকান থেকে আনতে হবে পোলাওয়ের চাল আর গরমমসলা।
শালা-শালিরা তাদের মতো করে তৈরি হচ্ছে, কীভাবে দুলাভাইকে নাকাল করা হবে, তার পরিকল্পনা চলছে।
নির্ধারিত দিনে সন্ধ্যার একটু পর জামাই বাবাজি এল। ছেলেপুলেরা ‘জামাই আইছে, জামাই আইছে’ বলে রব তুলে বাড়ি গরম করে ফেলল। আশপাশের বাড়িঘরের বউঝিরা উঁকিঝুঁকি মারতে লাগল। জামাইকে বাহির বাড়ির বাংলোঘরের সামনের রাস্তা থেকে এগিয়ে নিয়ে এল জামাইয়ের এক বড় সম্বন্ধী ও শ্বশুর।
এরপরই জামাইয়ের দখল নিয়ে নিল শালা-শালিরা। তারা বাংলোঘরের কাছ থেকে জামাইকে নিয়ে অন্দরমহলের দিকে যাত্রা করেছে তখন। তো, জামাইকে নিয়ে বাড়ির ভেতরের দিকে পাটকাঠির সরু বেড়ার প্রবেশপথ দিয়ে ঢুকতে গেলে জামাই বেড়ার এক প্রান্তে বেশ জোরে ধাক্কা খেল। তাতে এক বুড়া নানাশ্বশুর ফোড়ন কাটেন, ‘জামাই দেহি শালার রাইতকানা উদুমের (নির্বোধের) লাহান করে।’
জামাই চটপট সামলে নিয়ে বলে, ‘না, আপনেগো বেড়াডা পরীক্ষা কইরা দেখলাম। বানছে (বেঁধেছে) বড় শক্ত কইরা। কাম খুব মজবুত অইছে।’
এদিকে জামাই আসার খবর পেয়ে শাশুড়ি ভেতরবাড়িতে এনে পালের গাইয়ের দুধ পানাচ্ছিলেন (দোহন করা) আর নানিশাশুড়ি ফরসি হুঁকায় তামাক খেতে খেতে ফোকলা দাঁত বের করে নানা মেয়েলি ঠাট্টা-মশকরা করছিলেন। এমন সময় শাশুড়ি দুধের বালতি পাশে রেখে দাঁড়ালেন, যাতে জামাই তাঁকে কদমবুসি করতে পারে। কে একজন জামাইকে বলল, ‘এই তোমার শাশুড়ি, সালাম করো।’ জামাই সালাম করতে গিয়ে শাশুড়িকে ছাড়িয়ে প্রায় গাইয়ের পায়ের কাছে গিয়ে পড়ল। ছেলেমেয়েরা হাততালি দিয়ে উঠতেই জামাই বলল, ‘গাইটা তো বড় সুন্দর, আর দুধও দেয় মেলা। তাই একটু গাইটারে আগে দেখলাম।’ পরে অবশ্য শাশুড়িকে সালাম করল জামাই।
রাতের বেলা জামাই খেতে বসেছে। শাশুড়ি যত্ন-আত্তি করে খাওয়ানোর জন্য জামাইয়ের মুখোমুখি বসে চিতল মাছের পেটিটা, রুই মাছের ভাজা টুকরাটা তার পাতে তুলে দিচ্ছেন। এর মধ্যে শাশুড়ি হঠাৎ খেয়াল করলেন, বাড়ির ছোঁচা হুলো বিড়ালটা জামাইয়ের পাত থেকে মাছের আস্ত টুকরা টেনে নিয়ে মাচার নিচে গিয়ে কুড়মুড় করে খাচ্ছে।
শাশুড়ি জামাইকে বলেন, ‘মিয়ার পুত, একটু চারদিকে খেয়াল রাইখা খাইয়ো। মাছের বড় টুকরাডা তো বিলাইয়ে লইয়া গেছে গা।’
জামাই: দেখছি। কিছু কই নাই, কী জানি, আপনেগো শখের বিলাই। আপনেরা যদি আবার বেজার অন।
শাশুড়ি: বেজার অমু কেন, বাবা। বিলাই খাইব কাঁটাকুটা, অমন সরস মাছের খণ্ড কি বিলাই দিয়া খাওয়ামু?
জামাই: আইচ্ছা আম্মাজান, ইবার বুঝলাম। আহুক আবার ওই বজ্জাত বিলাই, মজাডা টের পাওয়াইয়া দিমুনে।
একটু পরে শাশুড়ি মাছের আরেকটা টুকরা জামাইয়ের পাতে তুলে দিচ্ছিলেন। জামাই এবার খপ করে শাশুড়ির হাত ধরে ফেলে বলে, ‘হারামজাদা বিলাই, বারবার মাছ নিয়া পলাও। ইবার ধরছি। অহন মজা দেহামু।’
এবার শাশুড়ি অতি দুঃখে হেসে দিয়ে বলেন, ‘হারামজাদা বিলাই ধারেকাছেও নাই। আমার হাতখানা ইবার ছাড়ো।’ আর মনে মনে বলেন, ‘এমুন ব্যাক্কলের (বেয়াক্কেল) পুত ব্যাক্কল আর তো দেখি নাই! হাছাই দেহি রাইতকানা জামাই।’