বাবা এসেছে, বোলিংটা আজ নিশ্চয়ই ভালো হবে!

বাবা আবদুর রশিদকে নিয়ে লিখেছেন ক্রিকেটার তাসকিন আহমেদ

এক ফ্রেমে তিন প্রজন্ম—বাবা আবদুর রশিদ, তাসকিন আহমেদ ও তাঁর ছেলে তাসফিন আহমেদ

খেলোয়াড়িজীবনে আমার ভালো সময় এসেছে, খারাপ সময়ও এসেছে। দর্শকেরা আমার নাম ধরে চিৎকার করে গ্যালারি কাঁপিয়েছে, আবার সমালোচনাও করেছে। একজন পেশাদার ক্রিকেটারের জীবন এমনই। কিন্তু কিছু মানুষ সব সময়ই আমার পাশে ছিলেন। তাঁরা আমাকে মাঠের পারফরম্যান্স দিয়ে কখনো বিচার করেননি। আমার বাবা সেই দলের একজন।

ক্রিকেটার হতে গেলে পরিবারের সাপোর্ট লাগেই। আর বাবাদের সাপোর্ট যদি না থাকে, তাহলে বড় পর্যায়ের ক্রিকেটার হওয়া খুব কঠিন, বিশেষত শুরুর দিকে। ১০০ জনে একজন হয়তো পাবেন এমন, যাঁরা তেমন কোনো সাপোর্ট ছাড়াই শীর্ষে এসেছেন।

তিনি অনুমতি দিলেন

ক্যারিয়ারের শুরুর দিকের একটা গল্প বলি। আমাকে ক্রিকেটের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয় আমার এক বন্ধু। তখন স্কুলের ফাইনাল পরীক্ষা শেষে ছুটি চলছিল। এ সময় আমাকে সে বলল, ‘চল, খেলবি?’ আমিও রাজি হয়ে গেলাম। এরপর ক্রিকেটের প্রতি ভালোবাসা জন্মে যায়।

পরে স্কুল খোলার সময় হলো। কিন্তু ততদিনে আমার মাথায় ক্রিকেটের পোকা ঢুকেছে। বাবার কাছে গেলাম খেলা চালিয়ে যাওয়ার অনুমতি নিতে।

ভাগ্য ভালো, বাবা অনুমতি দিলেন। শর্ত একটাই, ঠিকঠাক পড়ালেখা চালিয়ে যেতে হবে।

একদিন তিনি আমার খেলা দেখতে মাঠে এলেন। আমি জানতাম না তিনি আসবেন। আমাকে বোলিং করতে দেখে বাবার যে কী খুশি! কোচের সঙ্গে কথা বলার পর আরও আশ্বস্ত হলেন আমার খেলা চালিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে। একটা সময় পরে রাতের খাবার টেবিলেও তাঁর সঙ্গে ক্রিকেট নিয়ে নানা কথাবার্তা হতে থাকে আমার। তিনি আমার বন্ধু হয়ে ওঠেন। বাবা যদি এমন করে পাশে না থাকতেন, তাহলে ভালো ক্রিকেটার হওয়া আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না।

প্রথম ব্যাটটা চুরি হয়ে গেল

বাবাই আমার প্রথম স্পাইক কিনে দিয়েছিলেন, ব্যাট, প্যাড, অন্য সব গিয়ার্সও। এসব নিয়েও একটা গল্প আছে। আমি নতুন ব্যাট নিয়ে ধুপখোলা মাঠে স্কুল ক্রিকেটের ম্যাচ খেলতে গিয়েছিলাম। অপেক্ষায় ছিলাম প্যাড পরে ব্যাটিংয়ে নামার জন্য। এমন সময় পেছন থেকে কে জানি আমার ব্যাটটা চুরি করে নিয়ে যায়। খোলা মাঠ। অনেক দর্শক আসা–যাওয়া করছিল। পরে আমি আরেকজনের ব্যাট নিয়ে ব্যাটিং করছিলাম। আর কাঁদছিলাম। খুব ভয় পেয়েছিলাম, বাবার দেওয়া নতুন ব্যাটটা চুরি হয়ে গেল, এখন তিনি যদি রাগ করেন! ২০০৯ সালের ঘটনা এটা। ব্যাটের দাম ছিল সাত হাজার টাকা। সেটা তখন আমার জন্য অনেক টাকার ব্যাপার। এ ঘটনায় বাবা আমাকে একটু বকা দিয়েছিলেন, ‘কেয়ারলেস, খেয়াল রাখো না’—এসব বলেছিলেন। পরে অবশ্য আবার কিনে দিয়েছেন ব্যাট।

‘বাবা, তুমি মাঠে ছিলে না, কেমন জানি লাগছিল’

আমার খেলা থাকলে বাবা সব সময় মাঠে আসেন। সেটা ছোটবেলা থেকেই। এটা আমার খুব ভালো লাগে। একবার অনূর্ধ্ব-১৫ দলের হয়ে খেলছিলাম সিএবির (ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশন অব বেঙ্গল) বিপক্ষে। খেলা হচ্ছিল সিলেটে। ঢাকার বাইরে সেটাই ছিল আমার প্রথম সফর। ঢাকার বাইরে খেলছি—এটা তখন বিরাট ব্যাপার। কিন্তু প্রথম দিন আমার বোলিং এলোমেলো হচ্ছিল। সেদিন রাতে বাবাকে ফোন দিয়ে বলেছিলাম, ‘বাবা, তুমি মাঠে ছিলে না, কেমন জানি লাগছিল।’ এটা শুনে বাবা ওই রাতেই বাসে রওনা দিয়ে সিলেট চলে আসেন। তাঁকে মাঠে দেখার পর থেকেই আমার মনে হলো, এবার ভালো কিছুই হবে। সেদিন ভালো বল করেছিলাম। তিন উইকেট নিয়েছিলাম।

বাবা আমাকে অনূর্ধ্ব-১৯ পর্যন্ত অনুশীলনে পৌঁছে দিতেন। অনুশীলন শেষে নিতে আসতেন। আমার বয়সভিত্তিক দলের কোচরা বলতেন, ছেলে তো অনূর্ধ্ব-১৯–এ খেলছে। এখন ওকে একাই আসতে দেন। কিন্তু তিনি শুনতেন না।

বাবা এখনো শোনেন না। মিরপুরে বাংলাদেশের খেলা হলেই তিনি গ্যালারিতে চলে আসেন। ছোটবেলার সে রোমাঞ্চটা এখনো কাজ করে। মনে হয়, বাবা এসেছে, বোলিংটা আজ নিশ্চয়ই ভালো হবে!

অনুলিখন: মোহাম্মদ জুবাইর